বাঙালির বৈরিভাব -

ছবি -অনুপ রায়

বাঙালির বৈরিভাব

বাঙালির আত্মজনে বিশ্বাস নেই। হেয় করাতেই তার আনন্দ। আর তর্ক, সে অভ্যাসও আমরা ছেড়েছি বহুদিন।

অর্ক দেব

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। কিন্তু বাঙালির আত্মজনে বিশ্বাস নেই। হেয় করাতেই তার আনন্দ। আর তর্ক, সে অভ্যাসও আমরা ছেড়েছি বহুদিন। সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েই কথা বলি আমরা। ফলে বহুদূর আর যাওয়া হয় না। স্বখাতসলিলে ডুবে-মজে থাকি। আজ যখন ডিজিটাল বাস্তুতন্ত্রে দেখছি বাঙালিই বাঙালিকে টেনে নামাচ্ছে, ভাবতে চাইছি, এই অবিশ্বাসের শুরুটা কোথায়?

ধরা যাক, মির্জা মহম্মদ সিরাজদৌল্লার কথা। বাঙালি তাঁকে অর্বাচীন, নির্দয়,লোভী উচ্চাকাঙ্খী  ভেবে এসছে। এই ইতিহাসের ঠিক-ভুল যাচাইয়ে বাঙালি কখনও মন দেয়নি। পাঠ্যবইয়েও বিষয়টা ধোঁয়াশার মতো হয়ে থাকে। অথচ এই বিষয় সম্পর্কে স্পষ্টধারণা জাতিগত অস্মিতার প্রথম বিন্দু হতে পারত। ঠিক যেমন অস্মিতা শিবাজীকে ঘিরে মারাঠা জাতির গড়ে উঠেছে। কিন্তু তথ্যে আমাদের মন নেই। কেউই এগিয়ে এসে জনতার সামনে তথ্য তুলে ধরেন না৷  চেনাজনের মধ্যে কারও এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা পাই না, স্রেফ কিন্তু সিদ্ধান্তের কথা শুনি। যেমন, সিরাজ হঠকারী যুদ্ধোন্মাদ ছিলেন৷ অথচ এক বাঙালি, সুশীল চৌধুরী তাঁর লেখায়(১) তথ্য তুলে দেখিয়েছেন সিরাজ সম্পর্কে এই বক্তব্যগুলির প্রবক্তা যারা তারা সকলেই কোনো না কোনো ভাবে সিরাজকে প্রত্যক্ষ শত্রু মনে করতেন। কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল, সিয়র গ্রন্থটির প্রণেতা গোলাম হোসেন, রিয়াজ উস সালাতিনের লেখক গোলাম হোসেন সালিম বা রিফ্লেকশনস গ্রন্থের লেখক লিউক ক্র‍্যাফটন- প্রত্যেকে সিরাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ শত্রুতায় জড়িত ছিলেন। গোলাম হোসেন খান বা গোলাম হোসেন সালিমরা ছিলেন ইংরেজ-অনুরক্ত। ক্রাফটন সরাসরি পলাশি ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন। তাহলে তাদের লেখা থেকে ছড়ানো জনশ্রুতিকে আমরা মেনে নিলাম কেন? কেন একজন বাঙালির চেয়ে ব্রিটিশকে এগিয়ে রাখা হলো? কেন আমরা সুশীল চৌধুরীদের লেখা সেভাবে পড়লামই না? উত্তর একটাই, বাঙালি নিজেকে, স্বজাতির কাউকে সেভাবে বিশ্বাস করে না। প্রয়োজনে টেনে নামাতে সে পরের সাহায্য নেয়। যেমনটা হয়েছিল সিরাজের ক্ষেত্রে। এরই উত্তরাধিকার, অবিশ্বাসের গ্লানি, অপমানজর্জর জীবন বইতে হয়েছে মণীষীদের। যে-ই একটু উঠেছে, বাঙালি পিছনে টেনে ধরেছে।

‘মাইকেলের যথেচ্ছ-যতির উর্মিলতা’ বিহ্বল করেছিল বুদ্ধদেব বসুকে। কিন্তু জীবদ্দশায় তিনি ন্যূনতম সম্মান পাননি। ঘরে বাইরে একঘরে হয়েছেন। হিন্দুসমাজ দূরে ঠেলে দিয়েছে, খ্রিস্টীয় সমাজের চোখেও ছিলেন বহিরাগত। এমন দানবিক প্রতিভাধর মানুষ যে দারিদ্র‍ যে সহ্য করেছেন, তা অকল্পনীয়। বিদ্যাসাগর-মহাশয় বাদ দিয়ে প্রায় কেউই এগিয়ে আসেনি। ‘আমার দুর্ভাগ্য এই দেশে জন্মেছি! যদি বিদেশে জন্মাতাম, আমার মতো মানুষকে ওরা মাথায় করে রাখত’, মাইকেলের এই মনস্তাপের আড়ালে আছে বাঙালির অসূয়া, চোরামার।

আরও পড়ুন –

এই চোরামার থেকে বিদ্যাসাগর নিজেও নিস্তার পাননি। ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ বইটি সামনে আসতেই অপমানের বন্যা বইতে শুরু করে। সংবাদ প্রভাকরে একের পর এক অশালীন লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। আইন পাশ হতে শুরু হলো  তাকে একঘরে করা। ইন্দ্রমিত্র-র লেখা থেকে জানা যায়। খুনের হুমকিও পেতেন বিদ্যাসাগর। ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বীরসিংহ থেকে লেঠেল শ্রীমন্তকে বিদ্যাসাগরের কাছে  পাঠিয়েছিলেন। বঙ্গসমাজের অসূয়ায় তিতিবিরক্ত বিদ্যাসাগর জীবনের শেষপর্ব কাটিয়েছেন কার্মাটোরে। নিজের গ্রামে যাননি ১৯ বছর। শুধু কর্তব্যে অবিচল থেকেছেন।

১৮৮৬ তে প্রকাশিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের কড়ি ও কোমল। দু’বছরের মধ্যে আসরে নামছেন কালীপ্রসন্ন বিদ্যাবিশারদ। রাহু ছদ্মনামে তিনি কড়ি ও কোমলের প্যারডি লিখলেন। কড়ি ও কোমলকে অশ্লীল দাগিয়ে দিলেন। সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের জন্য রবীন্দ্রনাথকে অপমান করেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। লিখেছেন, ‘যদি স্পষ্ট করিয়া না লিখিতে পারেন সে আপনার অক্ষমতা।’ চিত্রাঙ্গদার জন্য মুণ্ডপাত করে লিখেছেন, ‘একজন যে কোনো ভদ্রসন্তান এরূপ করিলে তাহাকে আমরা একাসনে বসিতে দিতে চাহিতাম না।’ এই দ্বিজেন্দ্রলালের পুত্রের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাক্যালাপ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। এতটুকু অসূয়া দেখাননি কখনও।

১৯১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রথম গাওয়া হয় জনগণমন। পরদিন এই গান সম্পর্কে ইংলিশম্যান লেখে, “The proceedings opened with a song of welcome to the King Emperor, specially composed for the occasion by Babu Rabindranath Tagore…” দেশের একাংশ সেদিন থেকে এ মতের সমর্থক।রবীন্দ্রনাথের কানেও গিয়েছিল সে কথা। ২৯ মার্চ ১৯৩৯ সালে রবীন্দ্রনাথ সুধারাণী দেবীকে দুঃখের সঙ্গে লেখেন, “শাশ্বত মানব-ইতিহাসের যুগযুগধাবিত পথিকদের রথযাত্রায় চিরসারথি বলে আমি চতুর্থ বা পঞ্চম জর্জের স্তব করতে পারি, এরকম অপরিমিত মূঢ়তা আমার সম্বন্ধে যাঁরা সন্দেহ করতে পারেন তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আত্মাবমাননা।”

অবশ্য এর চেয়েও  ভয়াবহ পরিণতি হয়েছে নজরুলের।  সমসাময়িক সাহিত্যিক মোহিতলাল মজুমদার তাঁকে চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। তাঁকে কবিত্বপ্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর দু’টি (২), (৩) লেখায় এসেছে। যথা, নজরুল ইসলাম (১৯৪৪) এবং  রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক (১৯৫২)। তাঁর কাব্যজীবন সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর পর্যবেক্ষণ ছিল:

১. নজরুল চড়া গলার কবি, তাঁর কাব্যে হৈচৈ অত্যন্ত বেশি।… স্বতঃস্ফূর্তা নজরুলের রচনার প্রধান গুণ এবং প্রধান দোষ।

২. কাঁচা, কড়া, উদ্দাম শক্তি, সেই চিন্তাহীন অনর্গলতা।… রুচির স্খলন।

৩. জীবনদর্শনের গভীরতা তাঁর কাব্যকে রূপান্তরিত করে না।

   ৪.  ‘বিদ্রোহী’ কবি, ‘সাম্যবাদী’ কবি কিংবা ‘সর্বহারা’র কবি হিশেবে মহাকাল তাঁকে মনে রাখবে কিনা জানিনে . . .।

৫. নজরুলের কবিতা অসংযত, অসংবৃত, প্রগলভ ; তাতে পরিণতির দিকে প্রবণতা নেই; আগাগোড়াই তিনি প্রতিভাবান বালকের মতো লিখে গেছেন…।

৬. তাঁর কবিতায় যে পরিমাণ উত্তেজনা ছিল সে পরিমাণ পুষ্টি ছিল না…।

বুদ্ধদেবের সিদ্ধান্তই অধিকাংশ বাঙালি মেনে নিয়েছে। নজরুল প্রসঙ্গে নানাসময়ে বিতর্ক দানা বাঁধলে তাঁর পক্ষে কিছু লোককে পাওয়া যায়। কিন্তু বিশ্বভারতীর স্টোরে যেমন রবীন্দ্রনাথের নানা ক্ষুদ্রকায় বই পাওয়া যায়, তেমন ভাঙার গান, সর্বহারা কাব্যগ্রন্থগুলি আলাদা করে চাইলে কোথায় পাব কি? পাব না। কারণ বাঙালি বুদ্ধদেবের পর্যবেক্ষণ থেকে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিয়েছে। বুদ্ধদেবের মানসলোকের গঠন, তাতে ইওরোপের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন করতে চায়নি, প্রাগাধুনিক কাব্যবীজ, আরবি ফারসির গন্ধে তাঁর মন মজেনি। এত নজরুল গবেষক এসেছেন, গিয়েছেন, স্বাধীনোত্তর দেশে নজরুলের কাব্যগ্রন্থ নতুন করে প্রকাশের উদ্যম চোখে পড়েনি।কাব্যের যে অভিঘাতকে বুদ্ধদেবরা ছোট করে দেখেছেন, তাৎক্ষণিক শব্দটি ব্যবহার করছেন,  সেই অভিঘাতের জন্যেই ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দরবিশ সারা বিশ্বের শরণার্থী মানুষের নয়নের মণি। অথচ একজন স্বাধীনতার জন্য জেলখাটা কবিকে কী হেনস্থাই না হতে হলো আজীবন।  কেউ প্রশ্ন করল না, ১৯২২ থেকে ১৯৩১ পাঁচটি বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে নজরুলের। সারা দেশে আর কোন কবির এতগুলি কাব্যগ্রন্থ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে?

শনিবারের চিঠিতে বিদ্রোহীর প্যারোডি প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদক সজনীকান্ত দাশ নিজেই ভবকুমার প্রধান ছদ্মনামে এই কাব্যের বিদ্রুপ রচনা করেছেন। মোহিতলাল মজুমদার ‘সত্যসুন্দর দাস’ ছদ্মনামে, নীরদ সি চৌধুরী ‘বলাহক নন্দী’ ছদ্মনামে একের পর এক লেখা লিখেছেন নজরুলকে ছোট করে। নীরব নজরুলের ছবি দেখে মনে হয় দুঃখ পেতে পেতে দুঃখের সাকার স্বরূপ হয়ে উঠেছেন তিনি। ১৯২৭ সালের শেষের দিকে ইব্রাহিম খাঁকে দেওয়া চিঠিতে নজরুল লেখেন-

“লোকে বললেও আমি মনে করতে ব্যথা পাই যে, তাঁরা আমার শত্রু। কারণ একদিন তাঁরাই আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আজ যদি তাঁরা সত্যি সত্যিই আমার মৃত্যু কামনা করেন, তবে তা আমার মঙ্গলের জন্যই, এ আমি আমার সকল হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করি। আমি আজও মানুষের প্রতি আস্থা হারাইনি – তাদের হাতের আঘাত যত বড়ো এবং যত বেশিই পাই।”

কায়স্থ সন্ন্যাসী, এই ‘অপরাধে’ আজীবন যে পরিমাণ লাঞ্ছনা বিবেকানন্দকে সহ্য করতে হয়েছে তা-ও কহতব্য নয়। তাকে খুন করতে লোক গিয়েছে বরানগর মঠে। প্রাণে বাঁচিয়েছেন নিরঞ্জন মহারাজ। শিকাগোর সাফল্যে বাঙালি খুশি হবে ভেবেছিলেন বিনেকানন্দ। পরে তাঁকেই লিখতে হয়, “এক বৎসরের ভিতর ভারত থেকে কেউ আমার জন্য একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না–আর এখানে সকলে আমার বিপক্ষে।” শিকাগোয় উপস্থিত ছিলেন আরেক বাঙালি, ব্রাক্ষ্ম প্রতাপচন্দ্র মজুমদার। মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায় পাই, “প্রতাপচন্দ্র মজুমদার মহাশয় ফিরিয়া আসিয়া বলিতে লাগিলেন, নরেন, সেই ছোঁড়াটা, যে ভ্যাগাবন্ডের মত পথে পথে ঘুরে বেড়াত, সে এক লম্বা জামা পরে মাথায় পাগড়ি বেঁধে চিকাগো পার্লামেন্টে তো গিয়ে হাজির। সে আবার লেকচার করতে উঠলে, আবার বেদান্তর উপর কথা কয়, মায়াবাদ–সে সব অযৌক্তিক কথা, আর পৌত্তলিক ধর্ম সমর্থন করে। এসব জিনিস কি এযুগে আর চলে। যত সব বাজে জিনিস। ছোঁড়া এমনি অসভ্য রমণীদের সম্মুখে বসিয়াই চুরুট টানিতে লাগিল। আর কি লেকচার করে তার মাথামুণ্ডু কিছুই নেই, হাউড়ের মতন যত সব আবোল তাবোল বকে।”

নজরুলের অভিমানী চিঠিটির কথা লিখেছি পূর্বেই। একটি পত্রের কথা লিখে সাঙ্গ করি। বিবেকানন্দ প্রতাপ মজুমদারদের রটনার কথা শুনে লিখছেন, “আমার বুড়ি মা এখনও বেঁচে আছেন, সারাজীবন তিনি অসীম কষ্ট পেয়েছেন, সেসব সত্ত্বেও মানুষ আর ভগবানের সেবায় আমাকে উৎসর্গ করার বেদনা তিনি সহ্য করেছেন। কিন্তু তার সবচেয়ে ভালবাসা যে ছেলেটিকে তিনি দান করেছেন, সে দূরদেশে গিয়ে–কলকাতার মজুমদার যেমন রটাচ্ছে–জঘন্য নোংরা জীবনযাপন করছে, এ সংবাদ তাকে একেবারে শেষ করে দেবে।”

বিবেকানন্দর যদি এই পরিণতি হয়, তবে লাঞ্ছনা  থেকে কে বাঁচবে? বাঙালি সহমানুষের সঙ্গে ঈর্ষা, ঘৃণা, ল্যাং মারা, টেনে নামানো বাদে আর কোনো সম্পর্কে কখনও আগ্রহী ছিল কি? যখন দেখি উপরে ওঠার নেশায় এক বাঙালিই অন্য বাঙালিদের হেয় করছে, নেতাজি সুভাষকে তোজোর কুকুর বলা মনে করি। ছোটখাটো অপমান, লাঞ্ছনা, আঘাত, মাড়িয়ে যাওয়া, স্বীকৃতির প্রশ্নে অসূয়া তাই আর গায়ে মাখি না। জানি, বাঙালি মারবেই।

তথ্যঋণ:

১. পলাশির অজানা কাহিনি: সুশীল চৌধুরী, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০০৪

   ২.  বুদ্ধদেব বসু : নজরুল      ইসলাম, প্রবন্ধসংকলন, দে’জ পাবলিশিং, ১৯৮২

৩. বুদ্ধদেব বসু : রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক, প্রবন্ধসংকলন, দে’জ পাবলিশিং, ১৯৮২

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *