বাঙালির পঞ্জিকা, বটতলা এবং পঞ্জিকা পড়া -

গ্রাফিক্স -সৌরভ হাজারী

বাঙালির পঞ্জিকা, বটতলা এবং পঞ্জিকা পড়া

আগে পয়লা বৈশাখ বলে কিছু ছিল না। কিন্তু পঞ্জিকা ছিল।

কমলেন্দু সরকার

বাংলায় সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বইয়ের নাম জানেন? কার লেখা? এমন প্রশ্নের উত্তর ধেয়ে আসবে প্রথমেই, এ আর এমনকী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রমুখের নাম। বিশেষ করে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কোনও একটি বইয়ের নাম। আজ্ঞে না, কোনটাই হল না, একেবারে ডাঁহা ফেল৷ বাংলা ভাষায়  সবচেয়ে বিক্রিত বইটি হল পঞ্জিকা। আসা-যাওয়ার পথে দেখেন খবরেরকাগজের হকারের কাছ থেকে বইয়ের স্টল সর্বত্র শোভা পাচ্ছে– বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত, গুপ্তপ্রেস, বেণীমাধব ফুল পঞ্জিকা, বেণীমাধব হাফ পঞ্জিকা ইত্যাদি ইত্যাদি।

শহর থেকে মফসসল, মফসসল থেকে গ্রামগঞ্জ সব বাড়িতে শোভা পাচ্ছে একটি হাতে গরম পঞ্জিকা। হাতে গরম কেন! বিস্মিত হচ্ছেন? হওয়ারই কথা। পুরনো পঞ্জিকা কোনও কাজে লাগে না কোনও শুভকাজ পালনে। তাই মাঘ কাটলেই আধা মাঘে কম্বল কাঁধের মতো হাতে পাঁজি নিয়ে বাড়ির কর্তার আগমন ঘটে ঘরে।

সেকালের বটতলায় একটি ছড়া খুব প্রচলিত ছিল: কর্ম শেষে নববর্ষে বাবু ঘরে আসে।হাতে মিষ্টি এসেন্স শিশি আর পাঁজি পাশে।

মোদ্দা কথা, গ্রাম মফসসল থেকে অনেকেই চাকরি করতে আসতেন শহর কলকাতায়। বছর শেষে বাঙালিবাবুরা যখন বাড়ি ফিরতেন তখন নতুন বছরের মিষ্টির সঙ্গে একটি পাঁজিও থাকত। বাড়ির গৃহিণীও খুশি হতেন। তাঁর অমাবস্যা, পূর্ণিমা, একাদশী ইত্যাদি তাঁকে মনে রাখতে হত। পঞ্জিকা ছাড়া আর কেইবা মনে করাতেন তাঁকে। এমনকী, বাড়ির কর্তা কর্মস্থলে ফিরবেন, সদরের আদালতে মামলা আছে– এসব তো যাত্রা শুভ কখন সে তো পঞ্জিকাই খবর দেবে। বাড়ির গিন্নি বাতের ব্যথা হঠাৎ বাড়ল কেন! সামনে কি অমাবস্যা আছে কিংবা পূর্ণিমা? চট করে ঠাকুরের কুলুঙ্গি থেকে চট করে একবার পাঁজিতে চোখ বুলানো ছিল গিন্নির কাজ।পঞ্জিকাই ছিল ডাক্তারের বিধান আবার অভিভাবকও বটে!

আরও পড়ুন –

এছাড়াও কন্যা বা পুত্রের বিয়ে ঠিক হয়েছে, সামনেই বিয়ে কিংবা বাড়িতে নতুন অতিথির আগমন ঘটেছে তার অন্নপ্রাশন, বা গৃহপ্রবেশ ইত্যাদি ইত্যাদির শুভদিন দেখতে হবে।পাঁজি বা পঞ্জিকা ছাড়া এর হদিশ দেবে কে? বাঙালি আবার পঞ্জিকা সংক্ষিপ্তকরণ করে পাঁজি বলতে পছন্দ করেন। আমরাও পাঁজি শব্দটিই গ্রহণ করলাম।

আগে পয়লা বৈশাখ বলে কিছু ছিল না। কিন্তু পঞ্জিকা ছিল। পয়লা বৈশাখের আচার-অনুষ্ঠানের অনুপ্রবেশ বাঙালির জীবনে ঘটেছে অনেক পরে। কিন্তু পঞ্জিকা ছিল। পঞ্জিকা পড়াও ছিল।একটা সময় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পঞ্জিকা পড়া হত বাড়ি বাড়ি৷ এমনকী, যাঁদের পঞ্জিকা কেনার সামর্থ্য ছিল না তাঁদের বাড়ি গিয়ে পঞ্জিকা পড়ে আসতেন গ্রামের যে-বাড়ির লোকটির কাছে থাকত। তিনি হিন্দুও হতে পারেন বা মুসলমান। সেকালে এসব ভাগাভাগি কিছু ছিল না বলেই জানা যায়।

বাংলাদেশের এক গুরুত্বপূর্ণ লেখক আহমেদ ছফার লেখায় পাওয়া যায় পঞ্জিকা পড়ার কথা পাশাপাশি গ্রামবাংলার এক চমৎকার চিত্র। লেখকের জন্ম চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে। তিনি লিখছেন, ‘…আমরা ছোটবেলায় দেখেছি বেলা আট-নয়টা বাজার সাথে সাথে বাড়িতে আচার্য বামুন আসতেন। তিনি পাঁজি খুলে অনেকটা আবৃত্তির ঢঙে বলে যেতেন, এই বছরের রাজা কোন গ্রহ,মন্ত্রী কোন গ্রহ, এ বছরে কত বৃষ্টি হবে, কত ভাগ সাগরে আর কত ভাগ স্থলে পড়বে, পোকামাকড়, মশা-মাছির বাড় বৃদ্ধি কত। তারপর আমাদের কোষ্ঠী দেখে দেখে গণকঠাকুর বলে যেতেন। এ বছরটি কার কেমন যাবে। সমস্ত মুসলিম বাড়িতে কোষ্ঠী রাখা হতো না- সব বাড়িতে গণকঠাকুরও আসতেন না।…আমাদের পরিবারের সঙ্গে যেসব হিন্দু পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল সেসব বাড়ি থেকে মুড়ি-মুড়কি, মোয়া, নাড়ু এগুলোর হাঁড়ি আসতো। এ হাঁড়িগুলো ছিল চিত্রিত। আমাদের গ্রামে এগুলোকে বলা হতো ‘সিগ্যাইছা পাতিল’। আমার মা এ হাঁড়িগুলো যত্ন করে ছাদের ওপর রেখে দিতেন। আমরা সুযোগ পেলেই চুরি করে খেতাম।… কৃপণ সাধু ময়রা পর্যন্ত সেদিন দাম না নিয়ে দু-একটা কদমা অথবা দু-চারখানা গজা অম্লান বদনে খাইয়ে দিত। তখন এইটুকু সৌভাগ্যের জন্যেই পয়লা বৈশাখকে স্বাগত জানাতে দ্বিধা হয়নি।’ সেকালে পঞ্জিকা-পাঠ শ্রবণ ছিল মহা পুণ্যের কাজ।’

বাংলা পঞ্জিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে বটতলার অবদান অনস্বীকার্য। উনিশ শতকে বটতলা কেবলমাত্র প্রকাশনা শিল্পের ঠিকানাই ছিল না, হয়ে উঠেছিল বাংলার সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির প্রতীক। বহুরকম বিষয়ের ওপর বই প্রকাশিত হত বটতলা থেকে। সেইসব বইয়ের ফাঁকে উঁকি মারত পঞ্জিকা। পঞ্জিকা বরাবরই ছিল বাঙালির জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। রেভারেন্ড জেমস লঙ জানিয়েছিলেন, বইয়ের ক্ষেত্রে এক একটা সংস্করণ ছাপা হত পাঁচশো থেকে হাজার। পঞ্জিকা ছাপা হত পাঁচহাজার কপি। বছরে মোটামুটি একলক্ষ পঞ্জিকা বিক্রি হত। বটতলা ছিল পঞ্জিকা প্রকাশের পুরোধা।

শ্রীপান্থ লিখছেন, ‘কলকাতার ছাপাখানার যুগ শুরু হয় বলতে গেলে পঞ্জিকা হতে। অবশ্য সে পঞ্জিকা সাহেব অ্যালমানাক। কলকাতার ছাপাখানার ইতিহাস লেখক গ্রাহাম শ’ বলেন এই শহরে প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব সাংবাদিক জন অগাস্টাস হিকির। সরকারি উদ্যোগে হালেদের ‘আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ ছাপা হওয়ার আগেই হিকির ছাপাখানা থেকে বেরিয়েছিল ইংরেজি অ্যালমানাক। বাংলা পঞ্জিকা অবশ্য হাতে হাতে ফিরছিল অনেককাল ধরেই। তবে সে-সব পঞ্জিকা ছিল হাতেলেখা। বিভিন্ন এলাকার ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা হাতে লেখা পঞ্জিকা তৈরি করে তা প্রচার করতেন। কিছু কিছু বিক্রিও হত’। (বটতলা, শ্রীপান্থ, আনন্দ পাবলিশার্স)।

প্রথম পঞ্জিকা প্রকাশে স্যান্ডার্স কোম্পানির শোনা গেলেও তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে, চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যাচ্ছে, প্রথম ছাপা পঞ্জিকা ১৮১৮-তে। রামহরি নামে কোনও ভদ্রলোক ১৩৫ পৃষ্ঠার পঞ্জিকাটি ছেপে বার করেন। খুব বড় নয়, এই পঞ্জিকাটিতে একটিই মাত্র ছবি ছিল, কোনও এক দেবী সূর্যের রথ টানছেন। প্রশ্ন জাগে সূর্য কেন? আসলে আমাদের সবই তো সূর্য কেন্দ্রিক।

নানাবিধ বিষয়ে বটতলা ছিল অনেক এগিয়ে। এখনকার কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকেরাও অত বিষয়ে বই ছাপেন না। শুধু কি তাই, পঞ্জিকা প্রকাশেও বটতলার ছিল অগ্রগণ্য ভূমিকা। সেইসময় বহুরকম পঞ্জিকা ছিল– ফুল পঞ্জিকা, হাফ পঞ্জিকা, ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা, খ্রিস্টান পঞ্জিকা, বৃহৎ মোহম্মদীয় পঞ্জিকা ইত্যাদি। সেকালে কোনও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও আবার পঞ্জিকা ছাপত৷ তারা তাদের বিক্রিত সামগ্রীর সঙ্গে একটি করে পঞ্জিকা উপহার দিত। রেভারেন্ড জেমস লঙ সাহেবের একটি তথ্য থেকে জানা যায়, ১৮৫৭ অর্থাৎ সিপাহী বিদ্রোহের বছরে কেবলমাত্র কলকাতা শহরে পঞ্জিকা বিক্রি হয়েছিল প্রায় দেড় লক্ষ কপি। বালির গোস্বামী পাড়ার গোস্বামী বাড়ি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল দু’খণ্ডে পুরাতন পঞ্জিকা। ১৮৭৫ থেকে ১৯০৪, মোট ৩০ বছরের পঞ্জিকা ছিল এটি। এই পুরাতন পঞ্জিকাটি করেছিলেন শ্রীচন্দ্র বিদ্যানিধি। বিধবা বিবাহের পূর্বে এঁর সঙ্গে আলোচনা করতে আসতেন বাড়িতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব ব্যবহার করতেন এই ‘পুরাতন পঞ্জিকা’। তিনি মানতেনও এই পঞ্জিকাটি। এছাড়াও আশপাশের বহু মানুষ আসতেন শ্রীচন্দ্র বিদ্যানিধির কাছে। তাঁরা জানতেন চাইতেন তিথি, নক্ষত্র,শুভ সময় সম্পর্কিত ব্যাপারস্যাপার। আর তিনি পঞ্জিকা পড়তেন আগত মানুয়দের সামনে। এইসব তথ্য দিলেন গোস্বামী বাড়ির বর্ষীয়ান সদস্য জয়দেব গোস্বামী।

বটতলা প্রকাশকদের সুবাদেই বাংলা পঞ্জিকার রমরমা। শুধু রমরমাই বা বলি কী করে! পঞ্জিকার একটি প্রতিনিধিত্ব রূপ দিতেও কোনওরকম কার্পণ্য করতেন না প্রকাশকেরা। অনেকেই বলতেন কী থাকে বা থাকত পঞ্জিকায়। এর উত্তর একটাই, কি থাকত না। শুভ দিন, অশুভ দিন, যাত্রার শুভ সময়, তিথি-নক্ষত্র, জ্যোতিষ,  সরকারি অফিস সংক্রান্ত খবরাখবর, এমনকী আদালতে মামলা সংক্রান্ত শুভ সময় ইত্যাদি। সবমিলিয়ে বাঙালি গৃহস্থর কাছে পঞ্জিকা ছিল তথ্যের খনি বিশেষ। এ-বিষয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয়  ছিল পি এম বাগচির ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা। এই পঞ্জিকা থেকে পাওয়া যেত কোন রাস্তার কোন বাড়িতে কার বাস, কোথায় কোন দোকান আছে৷ শোনা যায়, বেশ্যালয়ের খোঁজও থাকত।

প্রথম প্রথম পঞ্জিকাতে দু’চারটে করে ছবি থাকত। প্রকাশকেরা যখন ছবিগুলো পঞ্জিকার মান বর্ধন করছে, তখন ছবির সংখ্যা ক্রমশ বাড়ে। এত ছবি আর কোনও বইয়ে থাকত না। সেকালের সুদক্ষ শিল্পী কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকারের খোদিত ছবি শোভাবর্ধন করত পঞ্জিকার। ছবির মতোই মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ছিল বইয়ের বিজ্ঞাপন। বটতলার প্রকাশকেরা পাতাজুড়ে বইয়ের বিজ্ঞাপন ছাপতেন তাঁদের প্রকাশিত বইয়ের। অনেকসময় বইয়ের চিত্রিত বিজ্ঞাপনও ছাপা হত পঞ্জিকার পৃষ্ঠায়। ফলে, বটতলার প্রকাশকেরা যখন  ঝাঁকামুটের মাথায় বই তুলে সেকালের কলকাতা শহরের রাস্তায়, অলিগলিতে বই বিক্রি করতেন বাড়ি বাড়ি। বিক্রিও হত মন্দ নয়। পঞ্জিকার পৃষ্ঠায় বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখে পাঠকেরা বা বাড়ির বাবুরা আগাম ঠিক করে রাখতেন তাঁরা কোন কোন বইটি কিনবেন।

সেকালের পঞ্জিকায় কী থাকত না! বহুরকম বিজ্ঞাপন থাকত! কেবলমাত্র পঞ্জিকার পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন পড়েই বহুকিছু জানা যেত। থাকত কাঠখোদাই, ধাতুখোদাই করা নানারকম ছবি ছাপা হত। তার মধ্যে হালখাতা, ভাইফোঁটা, চড়কপুজো, শিবপুজো, দোলযাত্রা-সহ বিভিন্ন দেবদেবীর ছবিগুলো ছিল খুবই আকর্ষক! বইয়ের বিজ্ঞাপনের লেখাগুলো ছিল অতীব সুখপাঠ্য। যেমন, দুই হাজার মুষ্টিযোগ শিক্ষা, গৃহস্থের কবিরাজী শিক্ষা, বৃহৎ রতিশাস্ত্র, অদ্ভুত বশীকরণ মন্ত্র শিক্ষা ইত্যাদি বইগুলোর বিজ্ঞাপনের লেখাগুলো পড়লে পাঠককে বাধ্য করাত বইটি কিনতে। গোয়েন্দা বইগুলোর ছিল অসাধারণ সব বিজ্ঞাপনের কপি। যেমন, সেকালের জনপ্রিয় গোয়েন্দা লেখক ছিলেন পাঁচকড়ি দে। তাঁর ‘নীলবসনা সুন্দরী’ বইয়ের বিজ্ঞাপনের কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করলেই বুঝতে পারবেন কত চমৎকার কপি লেখা হত সেকালের কলকাতায় বা বলা ভাল বটতলায়, ‘… পাঁচকড়ি বাবুর অসাধারণ ক্ষমতা, সে পরিচয় সকলে অবগত আছেন। তিনি দুর্ভেদ্য রহস্যাবরণের মধ্যে হত্যাকারীকে এরূপভাবে প্রচ্ছন্ন করিয়া রাখেন যে, পাঠক যতই নিপুণ হউন না কেন, যতক্ষণ গ্রন্থকার নিজের সুযোগমত সময়ে, স্বয়ং ইচ্ছাপূর্ব্বক অঙ্গুলি নির্দেশে হত্যাকারীকে না দেখাইয়া দিতেছেন, তৎপূর্ব্বে কেহ কিছুতেই প্রকৃত হত্যাকারীর স্কন্ধে হত্যাপরাধটা চাপাইতে পারিবেন না– অমূলক সন্দেহের বশে পরিচ্ছেদের পর পরিচ্ছেদে কেবল বিভিন্ন পথে চালিত হইবেন।…’

‘বৃহৎ রতিশাস্ত্র’র বিজ্ঞাপন: ‘ইহাতে নরনারীর সৃষ্টি, চারিজাতি স্ত্রী পুরুষ বর্ণন, ত্রিবিধ কুমারী লক্ষণ, স্ত্রী পুরুষের শুভাশুভ কখন, শয্যাবর্ণন, তুষ্টিসাধন, রোগের ব্যবস্থা, সতী অসতী পরিক্ষাদি আরও বহু জ্ঞাতব্য বিষয় আছে’। বৃহৎ রতিশাস্ত্র’ ছিল সচিত্র। মেয়েদের ছবি দেওয়া হত বইয়ে।

দু’টি বইয়ের বিষয় দু’রকম। ভাবা যায় সেকালের পঞ্জিকায় এমন ধরনের বিজ্ঞাপন লেখা হত! দু’টি বইয়ের পাঠক দু’রকম হতে পারে একইরকম। এক-দু’রকম নয়, সব ধরনের পাঠককেই আকর্ষণ করতে পারে এমনভাবে বইয়ের বিজ্ঞাপনগুলো লেখা হত। সেকালের বটতলার সব পঞ্জিকাগুলোই ছিল সচিত্র।

পঞ্জিকা এবং বাঙালি জীবন নিয়ে অনেক কথা লেখা, বলা যায়। বাঙালি-জীবনে পঞ্জিকা হল চা-কফির মতো, সেকালে তো আর চা-কফি ছিল না তাই ছিল পান-তামাকুর মতো। এখনও অনেকেই বিশ্বাস করেন, পাঁজি বা পঞ্জিকার ভিতর লুকিয়ে আছে মানুষ তো বটেই সারা দুনিয়ার ভূত-ভবিষ্যৎ! পঞ্জিকার ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ হয় না, ফলবেই। অনেকেই মনে করেন, পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চলে গ্রহ-নক্ষত্রের অঙ্গুলিহেলনে। গ্রহ-নক্ষত্র সামান্য কুপিত হলেই সব ছারখার হয়ে যেতে পারে। মানুষ বিপদে পড়লেই এসবে বিশ্বাস করেন। আসলে দৈনন্দিন জীবনে পঞ্জিকার প্রভাব এখনও রয়ে গেছে। তাই আমরা দেখি, নতুন কিছু শুরু করতে গেলে টুক করে শুভসূচনার সময়টুকু দেখে নিই। পুরোহিতের শরণাপন্ন হই। উনি নতুন পঞ্জিকাটি বার করে বলে দেন। এমনকী পুজোপাঠের পর একটি সিঁদুরের টিপ পরিয়ে কম্পিউটারের খালি একটি জায়গা দেখে। হয়তো সেই কারণে সেকাল থেকে একালেও বাংলা বইয়ের দুনিয়ায় বেস্টসেলার পঞ্জিকা৷ এখনও পঞ্জিকার সার্কুলেশন প্রতি বছরে  ২৫-৩০ লক্ষ !

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *