সন্মাত্রানন্দ
চাঁদের রাতে বানভাসি হলে সুদূর আকাশ থেকে কজ্জলা নদীটিকে ঘুমিয়ে পড়া রূপসীর অসহায় নাভির মতো দেখায়; মধ্যে স্ফীত, দুপাশে শীর্ণ রেখাকার। বস্তুত, উত্তর থেকে দক্ষিণে নেমে আসতে আসতে সুখচরঘাট অবধি কজ্জলা শীর্ণস্রোতা, কিন্তু তারপর হরিহরপুর আর চন্দনমাটি—এই দুই গাঁয়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় নদীটি যেন প্রেমভরে পৃথুলা হয়েছে। আবার চন্দনমাটি ছাড়িয়ে আরও দক্ষিণে যুগলকিশোরের ঘাটের কাছে বাঁক নিয়ে আকার তার তপোক্লিষ্ট সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে। এরপর শুধু ঝিঁঝিডাকা গহন অরণ্যকে দুপাশে রেখে নিরালা বান্ধবীর মতো সে একা একা আরও দক্ষিণে বহে যায়। ঘুমের মধ্যেও তার বহে যাওয়া থামে না।
এখন অবশ্য জ্যোৎস্নার রাত নয়, এখন আতপ্ত মধ্যাহ্নবেলা। কাজলার স্রোত বেয়ে মাঝনদীতে একটি ডিঙিনৌকা হরিহরপুর থেকে চন্দনমাটির দিকে আসছে।
ঠিক। কিন্তু আমার মনে হয়, এইভাবে এত দূর থেকে দেখলে গল্পটাই আরম্ভ করা যাচ্ছে না। কারা আছে সেই ডিঙিতে, কেন আসছে তারা এদিকে, কী কথা বলছে তারা পরস্পর, সেসব খুঁটিয়ে দেখা চাই, শোনা চাই। তা না হলে কি আর গল্প গড়ে ওঠে?
অথবা গল্প হয়তো গড়া হয়েই আছে এ মায়াভুবনে। আমার দেখার চোখ নেই, শোনার কান নেই; তাই এই কাজলার চরে বেভুল হয়ে বসে আছি প্রেমহীন, পরিণতিবিহীন।
ডিঙিনৌকাটার কাছাকাছি গেলাম এবার। দুটি মাত্র লোক। একজন ডিঙা বাইছে, তার পরনে মলিন লুঙ্গি, ঊর্ধাঙ্গ অনাবৃত, মুখে আধপাকা দাড়িগোঁফ; রোদে পুড়ে জলে ভিজে গায়ের রং তামাটে হয়েছে। অন্যজন নৌকার অন্যধারে জবুথবু হয়ে বসে আছে, পরনে ধুতি, ঊর্ধ্বাঙ্গে ফতুয়া একখানা, এরও মুখে দাড়িগোঁফ, এলোমেলো চুল মাথায়, উন্মনা দৃষ্টি মেলে জলের দিকে তাকিয়ে বসে আছে সে গৌরবর্ণ।
যে-লোকটা ডিঙা বাইছে, ধরে নেওয়া যাক, তার নাম হামিদ শেখ। আর নৌকার অপর প্রান্তে বিমর্ষদৃষ্টি মানুষটার নাম, ধরে নিচ্ছি—ধনঞ্জয় সাহা।
ধরে নিচ্ছি নয়, ওগুলোই ওদের আসল নাম। দাঁড় টানতে টানতে হামিদ কাষ্ঠ হাসি হেসে ধনঞ্জয়কে বলল, ‘চন্দনমাটির হাটে যে যাতিছ, ধনঞ্জয়, তেনাকে আজ সেখেনে পাবে, তার কি নিশ্চিত? তিনি তো আর তোমার কাছে ওয়াদা করেননি যে, প্রতি শুক্কুরবার চন্দনমাটির হাটে আসি তিনি তোমার জন্যি বসি থাকবেন!’
জলের দিক থেকে উদাস চোখ না-সরিয়েই একটু পরে ধীরে ধীরে উত্তর দিল ধনঞ্জয়, ‘সে-কথা তুমি ঠিকই বলিচ, হামিদ! তিনি মুসাফির মানুষ, আজ এখেনে তো কাল সেখেনে। তবু যদি তিনি আসেন… যদি দয়া হয়… আমার আশা হয়, তিনি আসবেন আজ চন্দনমাটির হাটে।’
‘ওই আশা করেই তো মল্লে, ধনঞ্জয়। জমিজমা গেল, বাড়িঘর ভাঙি পড়তিছে, রূপ-যৈবন জলাঞ্জলি হল, কত বড় ঘরের ছেল্যা তুমি, দশ বছরে সব শেষ। একজনের জন্যি বসি থেকি থেকি এমন দুরবস্তা করিচ নিজের। এখন আবার আরেকজনের আশায় আশায় নিজেকে পোড়াকাঠ কচ্চ বসি বসি। তোমার বুদ্ধির বলিহারি… ন্যাও, ন্যাও, বিড়ি ধরাও… তোমাকে দেখি আমারই বুক জ্বালা করতিছে,’ কথাগুলো বলতে বলতে নদীর হাওয়া থেকে আগুন বাঁচিয়ে নিজে বিড়ি ধরালো হামিদ। তারপর বিড়ির বাণ্ডিল আর দেশলাই ধনঞ্জয়ের দিকে বাতাসে ছুঁড়ে দিল।
বিড়ি খেতে ইচ্ছে জাগছিল না ধনঞ্জয়ের। তবু বিড়ি না নিলে রাগ করবে হামিদ, এই কথা ভেবে বিড়ির বাণ্ডিল থেকে একটা বিড়ি টেনে বের করে কোনোমতে ধরালো সে। ভল্ ভল্ করে একমুখ নীলচে ধোঁয়া ছেড়ে এবার গলুইয়ের উপর ঘুরে বসে চন্দনমাটির দিকে আশাভরে চেয়ে রইল।
দুই তিন টান মেরে হামিদ জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার হইচেটা কী, বলবে না মোকে? শরীল খারাপ?’
‘শরীল ঠিকই আছে, হামিদ ভাই। মনটা বেজায় খারাপ হইচে!’
‘সে তো বুজতেই পাচ্চি, কিন্তু মন খারাপ হল কী কারণে? আবার কে ব্যাতা দিল?’
হামিদ শেখের কথায় ম্লান হাসল ধনঞ্জয়। বলল, ‘ব্যাতা নয়, ভাই, অশান্তি। তা সেই কতা মুরশিদকেই গিয়ে বলব না হয়। তখন তুমি শুনো।’
বিরক্ত হয়ে নদীজলে পোড়া বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হামিদ বেজার স্বরে উত্তর দিল, ‘আমার বয়েই গ্যাচে ওই সব আটভাট শুনতি। চন্দনমাটি থিকে হাট সের্যে আমি বেলা পড়তি না পড়তিই দুয়েকজন হাটফেরতা লোক নৌকায় তুলি হরিহরপুর ফিরি যাব। তুমি ততক্ষণ তোমার মুরশিদের সাদা দাড়ি মেহেন্দি দে রাঙাও বসি বসি। আমি দেখতিও যাবো না, শুনতিও যাবো না। যত্তোসব বে-ফিকির কাজকাম!’
হামিদ শেখ নিতান্তই বিরক্ত হয়েছে দেখে ধনঞ্জয় বলল, ‘আরে চটো ক্যানে, মিঞাভাই? রাতে আমার ঘুম হয় না মোটে আজ কত দিন হল… তাই যাতিছি মুরশিদের কাছে…যদি কোনো উপায় করি দ্যান তিনি…’
হামিদ মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল, ‘ক্যানে? তোমার মুরশিদ আব্বাস গনি শাহ্ কি এখন আবার হেকিমি ধরেচে, নাকি? ওষুদ গিলিয়ে তোমাকে ঘুম পাড়াবে?’
উত্তরে কিছু বলল না আর ধনঞ্জয়। সেসব কথা হামিদকে বলা অর্থহীন। হামিদ বুঝবে না। এটা ঠিক যে, হামিদ শেখ ধনঞ্জয়কে ভালোবাসে সত্যিই খুব। ছোটোকালের মিতে তার। ধনঞ্জয়ের অনেক কথাই সে জানে, কিন্তু ইদানীং যে-সমস্যা ধনঞ্জয়কে ভিতরে ভিতরে উদ্বিগ্ন করে রেখেছে, সেই সমস্যার মাথামুণ্ডু হামিদ বুঝবে না বলেই ধনঞ্জয় আর মুখ খুলছে না। তা সে যতই রাগ দেখাক আর যাই করুক।
আরও পড়ুন –
কিন্তু হামিদের রাগ দীর্ঘস্থায়ী হল না। ক্রমশ যতই ডিঙিনৌকাটি চন্দনমাটির দিকে ভিড়তে লাগল, কজ্জলার স্বচ্ছ জল তীরভূমির মাটি মেখে যতই গেরুনিম হতে লাগল, হামিদের ক্রোধ-পারুষ্য-অভিমান ততই গাঢ়তা হারিয়ে ফিকে হয়ে যেতে লাগল। কেমন একটা নরম পলির গন্ধ গ্রাস করতে লাগল হামিদের মন। গলুইয়ের উপর উঠে দাঁড়িয়ে লগি দিয়ে ঠেলে নৌকাকে তীরবর্তী করছিল হামিদ ধীরে ধীরে; কিছুদূর এইভাবে যাওয়ার পর সহসা ধনঞ্জয়ের দিকে সরে এল সে একবার। ডিঙা টলমল করে উঠল তাতে, কিন্তু সে-টালমাটাল সামলাতে তেমন অসুবিধে হল না তার। ওর মধ্যেই ধনঞ্জয়ের চোখে তীক্ষ্ণ চোখ রেখে বলল হামিদ, ‘রাতে ক্যানে তোমার ঘুম হয় না, আমি কি জানিনি ভাবিছ, ধনঞ্জয়? রুকসানা—সে তো আমারই ভাতিঝি—তার সব খবরই আমি রাখি, সে মেয়াঁ এখন তার নানুবাড়িতে আচে—ওখেন থেকেই তার শাদি হই যাবে। তুমি ও রুকসানার আশা এবার ছাড়ো। এমনিতেই গাঁয়েঘরে তোমাদের দুজনকে নিয়ে অনেক কতা চালাচালি হতিছে বহুদিন হল। তুমি জাতপাত মানোনি, কিন্তু তা বলেই গাঁয়ের লোক কি বেবাক কানাবোবা হই যাবে? তা হয় না, ধনঞ্জয়, তা হয় না। ও আশা তুমি ছাড়ো। রুকসানা এখেনে ফিরি আসবে না আর…’
হামিদের দিকে ভাবলেশহীন দৃষ্টি মেলে কথাগুলো শুনল ধনঞ্জয়। তারপর জলের দিকে চোখ নামিয়ে নিয়ে আপন মনে বলল, ‘আশা তার আমি আর কচ্চি, কে তোমাকে বল্লো, হামিদভাই? আমি জানি, সে আর আসবেনি। খুব কষ্ট হত পেথম পেথম, তারপর মুরশিদ আব্বাস গনি শাহ্-কে পেলাম। তিনি আমার এ রোগের নিদানও বলে দিলেন। কিছুদিন শান্তিও পেলাম, কিন্তু আবার… এবার আর কষ্ট নয়, শুধু কী যে এক অশান্তি…’
কিন্তু ধনঞ্জয়ের শেষ কথাগুলো আর হামিদ স্পষ্ট শুনতে পেলো না। ততক্ষণে নৌকা চন্দনমাটির দিকের তীরে এসে লেগেছে। ডিঙা সামলে ঘাটে বাঁধতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল হামিদ। শুধু বিড়বিড় করে বলল একবার, ‘দ্যাখো হাটে গে যদি তেনাকে খুঁজে পাও। যে-রোগের যে-ডাক্তার, আমরা আনজন আবাল মানুষ, আমরা আর কী বুঝব এসব…’
হামিদ বুঝুক আর না বুঝুক, আমরা অবশ্য এতক্ষণে খানিকটা হলেও বুঝেছি, কারা আসছে নৌকা চেপে চন্দনমাটির দিকে, কেন আসছে, কী উদ্দেশ্যে আসছে। খানিকটা বুঝলেও সবটা বুঝতে পারিনি এখনও। তা কথায় আছে, সবুরে মেওয়া ফলে। সবুর করেই দেখা যাক না হয়। এরই মধ্যে জল ছেড়ে ডাঙায় নেমেছে ওরা দুজন। হাটের দিকেই যাচ্ছে গুটি গুটি। ধনঞ্জয় সামনে, হামিদ শেখ পেছনে। হামিদের সঙ্গে অবশ্য আর দেখা হবে না আমাদের। এর পর সে এ গল্প থেকে বেরিয়ে যাবে।
দুই
কজ্জলার চর ধরে কিছুটা এগোলেই হাটখোলা পড়ে। আজ একে শুক্রবার, তায় বেলা পড়ন্ত। হাট বেশ জমে উঠেছে। ধনঞ্জয় একা একা হাটে ঘুরছিল। তার চোখ দুটো আব্বাস গনি শাহ্-কে খুঁজছে। শুরুর দিকটায় ময়রারা মিষ্টির পসরা নিয়ে বসেছে। বড়ো বড়ো লোহার কড়ায় চিনির রসে মুগের জিলিপি ভাজছে। নানারকম মণ্ডা, মিষ্টি, সিঙাড়া, চপ, তেলেভাজার দোকান। সেই সব সুঘ্রাণ খাদ্যদ্রব্যের দোকান পেরিয়ে শাকসবজির বাজার। চারপাশের সাত গ্রাম থেকে ঝাঁকায় করে শাকসবজি নিয়ে এসে ব্যাপারিরা বসেছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। তারপর ঘর-গেরস্থালির দোকান সব…রান্নার সামগ্রী… ঝাঁঝরি, হাঁড়িকুড়ি, হাতা, বেড়ি, খুন্তি… তারপর কৃষিসামগ্রী… গোরুর গাড়ির চাকা, লাঙল, মই, নিড়ানি, খইল, সার… সেসব পেরিয়ে গোহাট… বড়ো বড়ো গোরু-বলদের বেচাকানা… গোবরের গন্ধে আর দরদামের শব্দে তিষ্ঠানো দায়।
আরও কিছুটা পেরিয়ে গেলে মেয়েদের সাজসজ্জা… ‘রংপরং’ কাচের চুড়ি, ‘খুকুমণি’ তরল আলতা, ‘মনে রেখো’ পাতাটিপ, ‘কাছে এসো’ কাজল, ‘ভুলিয়ো না’ নেলপালিশ, ‘হৃদি সুরভিত’ স্নো-পাউডার, ‘ফিরে দেখো’ রঙিন ফিতের রিল দোকানগুলোর সামনে সব বাহার তুলে নদীর বাতাসে দুলছে। এ দোকানের চারদিকে কমবয়েসি মেয়েদের গলা, হাসিঝিলিৎ… ওদিকে একবার অন্যমনস্ক চেয়েই মুখ নামিয়ে নিল ধনঞ্জয়, আর চোখ তুলে তাকালোও না ওদিকে।
অবশিষ্ট দিনমান সে হাটে ঘুরে ঘুরে আব্বাস গনিকে খুঁজল। কিন্তু কোথাও দেখতে পেল না তাঁকে। এর আগে বার চারেক চন্দনমাটির হাটে সে এসেছে। প্রতিবারই এই বেলাসমাপ্তির দিকে আব্বাস গনি-র দেখা পেয়েছে। কোথাও দাঁড়িয়ে হয়তো গানবাজনা করছেন, নয়তো ভিড়ের মধ্যে গলা বাড়িয়ে নিজেই রং-তামাশা দেখছেন। কিশোর বালকের মতো সরল কৌতূহলী দৃষ্টি। গলা থেকে ধুলামাখা খালি-পা পর্যন্ত একটা শতচ্ছিন্ন তালিমারা জোব্বা পরা, মাথায় বাসন্তী রঙের পাগড়ি, কালো কুচকুচে দাড়িগোঁফ, গালে গালপাট্টা, মুখের আর কপালের চামড়ায় অজস্র বলিরেখার কাটাকুটি। হাতে একখানা দোতারা; ইচ্ছে হলে বাজান, না-হলে নেই। আব্বাস গনি-র গলাটি সুখশ্রাব্য; গান গাইবার সময়েতে অনেক উপরের গ্রামে উঠে যেতে পারে, আবার খাদে নেমে এসে কালো ভোমরার মতো গুঞ্জরায়।
আজ কিন্তু সারা দিন সারা হাটে মুরশিদের দেখা মিলল না। অগত্যা ক্লান্ত হয়ে পড়ে ধনঞ্জয় হাটের আঁচল যেখানে ফুরিয়ে এসেছে, সেইখানে নদীচরায় ঝাঁকড়া একটা প্রাচীন তেঁতুলগাছের নীচে এসে বসল। মন তার আরও হতাশ হয়েছে ঠিকই, ভাবছে কী করবে এখন। সেই প্রথম দিনটার কথা মনে পড়ছে খুব হুহু করে, সেই যেদিন আব্বাস গনি-র সঙ্গে প্রথমবার দেখা হয়েছিল এই হাটে এই বৃক্ষটির তলায়। আব্বাস হাঁটু মুড়ে তেঁতুলতলায় বসে চোখ মুদে কী একটা সুর গুনগুন করছিলেন আর টুং টাং করে দোতারা বাজাচ্ছিলেন আনমনে। সে বড়ো কঠিন সময় ছিল ধনঞ্জয়ের, বড়ো কঠিন সময়; আব্বাস গনি না বাঁচালে হয়তো তার মাথাটাই খারাপ হয়ে যেত।
ধনঞ্জয় সাহারা হরিহরপুরের পাঁচ পুরুষের বাসিন্দা। এক সময় জমিজমা অনেক ছিল; বিত্তবান, সম্পন্ন পরিবার। তারপরে সাহা-পরিবারের প্রায় সকলেই এক এক করে ভিনগাঁয়ে কিংবা কলকাতায় অথবা আরও কোনো বড়ো শহরে চলে গেল। পড়ে রইল খালি ধনঞ্জয় আর এক বুড়ি পিসি—যিনি শৈশবে মাতৃপিতৃহীন ধনঞ্জয়কে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিলেন। সরু সরু ইটে গড়া এত বড়ো দোতলা বাড়ি, এই উঁচু পাঁচিল, প্রশস্ত বাগান, ছড়ানো চবুতরা—সব ভেঙে পড়ছে, পলেস্তারা খসে পড়ছে, বেশিরভাগ ঘরেরই জরাজীর্ণ দশা। দিনমানে শেয়াল ঢুকে পড়ে আর কি! যে-অংশটা ধনঞ্জয়ের ভাগে, সেদিকটার অবস্থাও মোটেই ভালো নয়—তবু কালের গ্রাস থেকে দুখানা ঘর আর একটা হেঁসেল কোনোমতে আলাদা করা গেছে।
তা এই বাড়িতে হামিদদের পরিবার কাজবাজ করে আসছে কয় পুরুষ ধরে কে জানে! হামিদের সঙ্গে শিশুকাল থেকেই ধনঞ্জয়ের বন্ধুত্ব; দুজনেই একসাথে বিদ্যালয়ে পড়ত। হামিদ পড়া ছেড়ে দেয় ক্লাস এইটে উঠে। ধনঞ্জয়েরও পড়াশোনায় তেমন মাথা ছিল না; ক্লাস টেন অবধি সে এগিয়েছিল কোনোমতে। তারপরে ধনঞ্জয় নিজেদের ধানকোটা কলের ব্যবসায় মন দেয়। সেভাবেই চলছিল। তারপর হঠাৎ ম্যানেনজাইটিসের কবলে পড়ল ধনঞ্জয়। ভয়ানক অসুখ, বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম—শহরে নিয়ে যাওয়ার মতন লোকবল নেই, চালকল বন্ধ হয়ে থাকায় পয়সাকড়িও তেমন নেই; গ্রাম্য চিকিৎসা আঁকড়ে পড়ে ছিল মরণের দিন গুণতে গুণতে। বুড়ি পিসি নিজেই নিজেরটা পেরে উঠতেন না কিছু, তা ধনঞ্জয়ের সেবা করবেন কেমনে?
সবাই ধরে নিয়েছিল, ধনঞ্জয় মরে যাবে। কিন্তু সে বেঁচে উঠল। বেঁচে উঠল শুধু একজনের অক্লান্ত শুশ্রূষায়। সেই একজন—হামিদের ভাইঝি রুকসানা।
সম্পর্কে হামিদের ভাইঝি, কিন্তু তার বয়েস হামিদ কিংবা ধনঞ্জয়েরই কাছাকাছি। জ্বরের ঘোরে পড়ে থাকত ধনঞ্জয় বেঁহুশ হয়ে। সে জানত না, কে তার শিয়রে বসে রাত জাগছে, কপালে জলপটি দিচ্ছে, পথ্য তৈরি করে এনে খাওয়াচ্ছে। ধীরে ধীরে হুঁশ যখন ফিরতে লাগল, ততদিনে রুকসানা যেন ধনঞ্জয়ের রোগশয্যার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। এ বাড়িতেই কাজ করত রুকসানা, কাজেই অপরিচিতা সে একেবারেই নয়, কিন্তু তাকে আলাদা করে দেখার প্রয়োজন বা অবকাশ—কিছুই হয়নি এর আগে। ধীরে ধীরে রুকসানার পরিচর্যায় ভালো হল ধনঞ্জয়; অসাধ্য-সাধন করে রুকসানা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল যমের মুখ থেকে।
কিন্তু এই মরণের ঘর থেকে ফিরে আসার পথে যেন মুখোমুখি দেখা হল দুজনের, পরস্পর চোখে চোখে তাকিয়ে এ ওর মনের কথা পড়তে পারল, ভালোবাসল। যেমন করে বিকেলের রোদ ভালোবাসে নদীর চর। যেভাবে ডিঙানৌকা ভালোবাসে কজ্জলার স্রোত। ধীরে ধীরে ধনঞ্জয়ের ফিরে আসা জীবনের সঙ্গে কখন যেন অতর্কিতে জড়িয়ে গেল রুকসানা।
রুকসানা পড়ে থাকত ধনঞ্জয়ের ভিটাতেই; তা এ নিয়ে কথা হবে না গ্রামীণ সমাজে? হল। তার উপর আবার এরা হিন্দু, ওরা মুসলমান—এমন সম্পর্ক নিয়ে ছিছিক্কারের কালি ছেটাতে কি আর দ্বিধা করে গ্রাম্য সমাজ? সেসব কথা চাপা দিতেই রুকসানার বাড়ির লোকজন মেয়েকে পাঠিয়ে দিল কলকাতায় তার নানার বাড়িতে। ভোরের শুকতারা রোদ উঠতেই লুকিয়ে গেল।
এ পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছিল, তার সবটাই শুধু বাস্তব জীবনেই নয়, যেকোনো বাস্তবনিষ্ঠ ভালোবাসার গল্পেও হামেশাই ঘটে থাকে। যদি এইটুকুই হত, তাহলে ধনঞ্জয় না হয় কষ্টেসৃষ্টে রুকসানাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করত। তারপরে বিয়ে-থা করত অন্য কোনো মেয়েকে, স্ত্রীসন্তান নিয়ে আর পাঁচজনের মতনই জীবন কাটিয়ে দিত ধনঞ্জয় তারপর। এভাবেই বেশিরভাগ মানুষের জীবন কাটে, এসব নিয়েই মানুষ বাঁচে—তাতে তো কোনো দোষ নেই।
কিন্তু তা হল না। হল না কেন?
তিন
হল না, কেননা বহু চেষ্টা করেও রুকসানাকে মুছে ফেলতে পারল না ধনঞ্জয় মন থেকে। হয়তো তার মন দুর্বল, কিংবা সে অতিশয় স্মৃতিপ্রবণ। ক্রমাগত তার মনকে অনুপস্থিত রুকসানা যেন অদৃশ্য আকর্ষণে টানতে লাগল। মনে হতে লাগল, রুকসানা যেন এ বাড়িতেই আছে, হয়ত রান্নাঘরে কাজ করছে, এখুনি ডাক দিলে হরিণীর মতো ছুটে আসবে। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ধনঞ্জয়ের মনে হত, কার যেন কাজলপরা দুটি চোখ শয্যার শিয়রে নির্নিমেষ দৃষ্টি মেলে তার দিকেই চেয়ে আছে। এ গ্রামে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট লেগেই আছে, কোনো কোনো দিন কারেন্ট না থাকলে, মাথার কাছে টেবিলের উপর জ্বলতে থাকা হ্যারিকেন মাঝরাতে কেরোসিনের অভাবে নিভে যাওয়া মাত্র ধনঞ্জয়ের মনে হত, কে যেন এই মাত্র হ্যারিকেনের পলতে ঘুরিয়ে আলো নিভিয়ে দিল। ধনঞ্জয় বালিসে মাথা রেখে খোলা জানালাটার দিকে তাকাত, মনে হত জানালার রেলিং ধরে অস্পষ্ট অন্ধকারে কে যেন বাইরে থেকে তাকে আকুল দুটি চোখ মেলে দেখছে। জানালার ওপাশে অবিশ্রান্ত বনজঙ্গল চান্দ্রমায়ায় অনিয়ত ছায়ারূপ ধরে স্তব্ধ হয়ে আছে। একটা গুলঞ্চ ফুলের গাছ তার ঊর্ধ্বমুখী আঁকাবাঁকা শাখাপ্রশাখা চাঁদের আকাশে তুলে ধরেছে অপরিপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা-সমুচ্চয়ের মতো।
সেদিক থেকে পাশ ফিরে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে চাদরে মাথা ঢেকে ঘুমোনোর চেষ্টা করত ধনঞ্জয়। হঠাৎ মনে হত তার, কে যেন ঘরের অন্ধকারের মধ্যে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এসব মনের ভুল—এই কথা নিজেকে কতবার বোঝাত ধনঞ্জয়। ঘুমিয়েও পড়ত সে, কিন্তু মাঝরাতে ঘুম ভেঙে চমকে উঠে তার মনে হত, কে যেন তার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে একই শয্যায় শুয়ে আছে, দুটি কোমল বাহুলতার আতপ্ত বন্ধনে তাকে সর্বাঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে। বিছানা থেকে উঠে পড়ত ধনঞ্জয়, জল খেত ঢক ঢক করে, বিড়ি ধরাত অন্ধকারে। রাত্রি নিশুত; জানালার ওদিকের বনভূমির মাথায় ক্লান্ত চাঁদ হেলে পড়েছে। নিজেকে বলত ধনঞ্জয়—‘এসব আমার মনের ভুল। রুকসানা তো চলে গেছে কতদিন হল। সে তার নানার বাড়িতে কলকাতায় আছে। সেখানেই তার বিয়ে হয়ে যাবে ভালো ঘরে। এখানে এ গাঁয়ে তার না-ফেরাই ভালো আর। এখানে লোকজন বহু কথা কয় তাদের নিয়ে। কলকাতায় সুখে থাক রুকসানা!’
রাত চলে গেলে, দিন এলে, ধানকোটা কলের দোকানঘরে বসে থেকে থেকে সে ভাবত, রুকসানা তো বেঁচে আছে। সে তো মরে গিয়ে ভূত হয়ে যায়নিকো! তাহলে রাত্রিকালে তার এই যে সব অনুভব—এসব কোনো প্রেতচ্ছায়া নয়, এসব তার মনের ভুল। তার অপরিসমাপ্ত প্রেমের, অপরিপূরিত আকাঙ্ক্ষার ফল। এখনই যদি সে বাস ধরে কলকাতা যায়, যদি ফুলবাগানে রুকসানার নানাবাড়িতে যায়, তাহলেই তো ধনঞ্জয় এখনই রক্তমাংসের বাস্তব রুকসানার দেখা পেয়ে যাবে।
কিন্তু সে-কথাটা ভাবলেই ভয়ে বুক অসাড়, হিম হয়ে যেত ধনঞ্জয়ের। বাস্তব রুকসানার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়া যেন কী ভয়ের একটা ব্যাপার! সমাজের কানাকানির ভয় নয় তা একেবারেই। অন্য একপ্রকার ভয়। তার মনে হত, বাস্তব সেই রুকসানা—তার সঙ্গে দেখা হওয়া—সে যে কী আতঙ্কের ব্যাপার হবে! রাতের পর রাত যে-রুকসানাকে সে কল্পনা করে চলেছে, আদর করে চলেছে, আস্বাদ করে চলেছে… কল্পনা নয় জ্যান্ত… কল্পনা যে কীভাবে জ্যান্ত হয়… কেমন করে সে বোঝাবে কাউকে… সেই কল্পজিয়ন্ত রুকসানাকে যদি সে হারিয়ে ফেলে বাস্তব রক্তমাংসের রুকসানাকে দেখে? তখন কী হবে? বাস্তব রুকসানাকে তো পাবেই না সে কোনোদিন পরিমাপযোগ্য অভিজ্ঞতার ভিতর, তার উপর এই কল্পজিয়ন্ত রুকসানাকেও মনে মনে কাছে পাওয়ার যে-অভিজ্ঞতা, তাকে স্পর্শ করার, তার সঙ্গ-আসঙ্গ, সাধ-অসাধের খেলা—সেও যদি শেষ হয়ে যায়, তবে তখন কী নিয়ে আর বাঁচবে ধনঞ্জয়?
কলকাতায় যেন তার কখনই যাওয়া না হয়! যেন কোনোদিন আর বাস্তবে তার দেখা না হয় রুকসানার সঙ্গে! ধনঞ্জয় মনে মনে বলে।
মনের একটা অংশ বলত, ‘চলো না, চলো না কলকাতা যাবে, রুকসানাকে একবার চোখের দেখা দেখে আসবে। ছুঁতেও পারবে হয়তো!’
মনের আরেকটা অংশ বলত, ‘না-না! যেও না, যেও না কলকাতা শহরে। তাহলে তোমার ঘরে রাতের বেলা রুকসানা আসবে না আর। আর তাকে বুকের মধ্যে পাবে না ঘুমের মধ্যে। তার চোখের পাতায় চুমা দিয়ে ঘুম পাড়াতে পারবে না আর তুমি। এক মুহূর্তের দেখা-শোনার লোভে সারা জীবনের এত তৃপ্তি, এত সুখ, এত অসাধ্য সাধ হারিয়ে ফেলো না তুমি, ধনঞ্জয়!’
সমস্ত দিন মনের ভিতর এই দ্বিমেরু দ্বৈরথ ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলছিল ধনঞ্জয়কে। যুদ্ধ করতে করতে অবসাদগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছিল মন। শরীর ক্ষয়ে আসছিল দিনে দিনে। শুধু একটা নির্জন ঘর, নীরস ধানকোটা কলের দোকান, বুড়ি পিসি, বিস্বাদ আহার, কুৎসিত কুৎসাপ্রিয় গ্রামের লোকজন—এই সব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজের কাছে ফিরে এসে রাতে রুকসানাকে গভীরভাবে ভাবত ধনঞ্জয়, কাছে পেত রাত্রিকালে গভীরভাবে… তবু ভোরের আলো ফুটলেই ফুরিয়ে ফেলত সে নিজেকে। রুকসানাকেও।
ধনঞ্জয় বুঝতে পারছিল, সে ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে। তার কেউ নেই, যাকে এসব বলবে। রুকসানা ছাড়া আর কেউ কোনোদিন আপন হবেও না তার। রুকসানা এ তার কী করে দিয়ে গেল! শিশিরভেজা ধানক্ষেতের আলে শুয়ে থাকত সে ভোরবেলায়, মনে হত মাঠের সমস্ত কুয়াশা, শিশির, পাতাকুটো, খড়, মাকড়সার জাল তার গায়ের উপর জমে জমে তাকে মাটির নীচে ঘুমের দেশে নিয়ে চলে যাক। এই মানসিক অস্থিরতা থেকে, দ্বন্দ্ব থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে সে একটু ঘুমোবে—যে-ঘুমে স্বপ্নের ফেনাটুকুও নেই, রুকসানাও নেই, এমন এক গভীর নিতল ঘুম। তবু সে ঘুমোতে পারত না। রুকাইয়ার মুখ যেন হাসি-হাসি হয়ে তার মুখের উপর দূরের নীল আকাশের মতন ঝুঁকে পড়ত।
এমনই একটা সময়ে কোনোদিন কী জানি কোন ভাবাবেগে সে চন্দনমাটির হাটে এসে আব্বাস গনি-র দেখা পেয়েছিল এই প্রাচীন তেঁতুলগাছটির তলায়। আব্বাস গনি হাঁটু মুড়ে তেঁতুলতলায় বজ্রাসনে বসে চোখ বুজে কী একটা সুর ভাঁজছিলেন আর অন্যমনস্ক ভঙ্গিমায় দোতারাটা বাজাচ্ছিলেন আপনমনে।
কিছুক্ষণ পরে দোতারা আর গান থামিয়ে সুরমা-পরা বড়ো বড়ো চোখ খুলে হাসিমুখে ধনঞ্জয়ের দিকে চাইলেন আব্বাস গনি। চেয়েই আছেন, চেয়েই আছেন—সে যেন অতল চোখের চাওয়া। ধনঞ্জয়ের অসোয়াস্তি হচ্ছিল। অবশেষে তিনি মুখ খুললেন। বলে উঠলেন, ‘মাশুকের জন্যে দেওয়ানা হয়েছিস, আশেক! মাশুক তোর থেকে কত দূরে?’
অবাক হয়ে গেছিল ধনঞ্জয়। ইনি তার জীবনের কথা, তার মনের কথা কীভাবে জানলেন? তবে কি আব্বাস ফকিরের কোনো অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা আছে?
যেন ধনঞ্জয়ের মনের কথা বুঝতে পেরেই ঝোড়ো হাওয়ার মতো হো-হো করে হেসে উঠলেন আব্বাস গনি। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘আমার কোনো তেলেসমাতি কারবার নাই রে, দোস্ত। যদি থাকত, তাহলে তো তোর মাশুকের নামটাও বলে দিতে পারতাম। বল, কী নাম তোর মাশুকের? সে তোর থেকে কত দূরে?’
ধনঞ্জয় ভয়ে ভয়ে বলেছিল, ‘তার নাম রুকসানা। আমার থেকে অনেক দূরে সে এখন, হুজুর!’
তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন আব্বাস ফকির, ‘ধুর, পাগল! কোথায় সে দূরে? মাশুক কি আশেককে ছেড়ে দূরে থাকতে পারে নাকি? কাছেই সে আছে। তোর গলার শিরা তোর থেকে যতটা কাছে, তার থেকেও বেশি কাছে আছে তোর মাশুক।’
‘কিন্তু হুজুর, আমি তো তা বুঝতে পারছি না।’
আব্বাস গনির দুই চোখ জলে ভরোভরো পুকুর হয়ে উঠল কেন যেন। কীসব চিন্তা করে পাশে পড়ে থাকা ঝোলা থেকে একটা স্ফটিকের মালা বের করে আপনমনে জপ করতে লাগলেন। তাঁর দুই গাল বেয়ে অশ্রুর ধারা নামল। কিছুক্ষণ জপ করার পরে মালাটি ধনঞ্জয়ের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এই মালাতে তুই জপ করিস, বেটা! সব বুঝতে পারবি।’
কিন্তু কী জপ করবে ধনঞ্জয়? তার তো কোনো মন্ত্র নেই।
নিচু স্বরে বলল ধনঞ্জয় তখন আব্বাস ফকিরকে, ‘বাবা, তাহলে আমাকে কোনো মূলমন্ত্র দ্যান, যাতে খুদা পহ্চান হয়ে যায়!’
অমনই আবার হা-হা করে হেসে উঠলেন আব্বাস গনি। জোরে জোরে বললেন, ‘খুদা? খুদ-ই খুদা রে বান্দা! কিন্তু সেই খুদা-কে তুই কি দেখেছিস? দেখা যায়? যাকে তুই দেখিসনি, তার নাম তুই জপ করবি কী করে? শোন। তুই এই মালায় তোর মাশুকের নামই জপ করবি।’
‘মাশুকের নাম? মানে রুকসানার নাম?’ নিতান্ত অবিশ্বাসের সুরে প্রশ্ন করল ধনঞ্জয়। মালায় ভগবানের কোনো নাম জপ করা হয়, এমনই তো সে জানত! রুকসানা তো ভগবান নয়, সে তো মানুষ!
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, রুকসানা-র নাম,’ জোরের সঙ্গে বলে উঠলেন ফকির, ‘যে রুকসানা, সে-ই রুক্মিণী। যে-রুক্মিণী, সে-ই রুক্মিণীনাথ। এসব বড়ো গুহ্য কথা, বাপ। এখন এসব কিছুই তোর দিলদিমাগে সেঁধুবে না। যা বললাম, তাই-ই কর। রুকসানার নাম কর এই মালায়। প্রথম প্রথম গা-হাত-পা আউটাবে, মন উচাটন হবে। কিন্তু খবরদার! জপ ছাড়িসনি। খুব ভালোবেসে তোর মাশুকের নাম করে যা রে! দেখবি, তোর মাশুক তোর ভিতরেই বসে আছে। যা, যা, পালা!’
বলতে বলতে ঝোলা, দোতারা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন আব্বাস গনি। এক মুহূর্ত পরেই তেঁতুলতলা ছেড়ে দ্রুত পায়ে হাটের ভিড়ের মধ্যে মিশে গেছিলেন।
এর পরেও কয়েকবার তাঁর দেখা পেয়েছিল ধনঞ্জয়। জিজ্ঞেস করেছিলেন, সে ঠিকমতো জপ করছে কি না।
ধনঞ্জয় আব্বাস গনি-র কথা মেনে চলেছিল। যখনই সময় পায়, তখনই মালাটি নিয়ে যত্ন করে জপ করে। রুকসানার নাম জপত সে। রুকাইয়া, রুকাইয়া, রুকাইয়া… প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হত। ভাবাবেগ আসত। শরীর জেগে উঠত। মনে পড়ে যেত রুকাইয়ের মুখ, বুক, বাহু, জানু, নাভি। চোখ দিয়ে জল পড়ত অবিরত। তবু ধৈর্য ধরে নিজেকে সংযত করে জপে মন লাগাত ধনঞ্জয়। এইভাবে অনেক দিন চলে গেল। তারপর কেমন করে যেন মন স্থির হয়ে যেতে লাগল একটু একটু। যেন সেই নাম থেকে কী এক অনির্বচনীয় মধুস্বাদ ক্ষরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল তার স্নায়ুশিরায়। সেই শান্তিই যেন রুকসানা। অথবা তার মাশুকের কোনো নাম নেই। রূপ নেই। শুধু শান্তি। শ্মশানে চিতা পুড়ে ছাই হয়ে গেলে যে-শান্তি, ঠিক যেন সেই প্রকারের শান্তি।
চার
এভাবেই চলছিল। কিন্তু মুশকিল হয়ে গেল গত বুধবার। দুপুর দেড়টা নাগাদ দোকানঘর বন্ধ করে বাড়ি ফিরেছিল ধনঞ্জয়। পাতকুয়োর ঠান্ডা জলে স্নান সেরে দুটি ডালভাতে পেটের জ্বালা শান্ত করে নিজের ঘরে এসে বসেছিল খাটের উপর। জানালার ওপাশে চারিদিকে ঝিলমিল করছে ভাদ্রের দুপুর। বুড়িপিসিও ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয় নিজের ঘরে। অন্যদিনের মতো হামানদিস্তা ঠোকার শব্দ নেই। ধীরে ধীরে প্রাণ শান্ত হয়ে এলে মালাটি হাতে নিয়ে চোখ বুজে জপ করছিল ধনঞ্জয়। জপ করছিল স্ফটিকমালায় প্রিয়তমা রুকসানার নাম। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ অস্পষ্ট একটা ঠিন্ ঠিন্ শব্দ শুনতে পেল সে, চোখ মেলে জানালার দিকে তাকাল। দেখল, জানালার ওধারে খঞ্জনী হাতে এক বোস্টমী দাঁড়িয়ে আছে। বোস্টমীর বয়েস হয়েছে, মাথায় পলিত কেশ, শিরা-ওঠা দুখানি বিশীর্ণ হাত।
মালাখানি নামিয়ে রেখে দুমুঠো চাল রান্নাঘর থেকে নিয়ে এসে বোস্টমীর ঝুলিতে দিল ধনঞ্জয়। বোস্টমী দুহাত তুলে আশীর্বাদ করে চলেই যাচ্ছিল। হঠাৎ কী জানি হল তার। ফোকলা দাঁতে হেসে উঠে বোস্টমী বলল, ‘জপ করছ, বাবা? খুব ভালো! ভগবানের নাম জপ করলে কত পুণ্যি হয়।’
ধনঞ্জয় মনে মনে ভাবল, পুণ্যির জন্যে সে জপ করছে থোড়াই? আর ভগবানের নামও যে সে জপ করছে, তাও তো নয়। সে জপছে রুকসানার নাম। যেমনটা তার মুরশিদ তাকে বলে দিয়েছেন। যাই হোক, বোস্টমীর কথার উত্তর না দিয়ে সে ফিরে আসছিল, কিন্তু তার মধ্যেই বৃদ্ধা বলে উঠল, ‘তা মালাটিকে মাঝে মাঝে চান করান তো, বাবা?’
ধনঞ্জয় অবাক হয়ে গেল। এমন তো কিছু বলেননি মুরশিদ আব্বাস গনি! সে প্রশ্ন করল বোস্টমীকে, ‘চান করাতে হয়, নাকি?’
বোস্টমী বলল, ‘তা আর হবে না? গঙ্গাস্নান করাতে হয় মালাকে মাঝে মাঝে। গঙ্গাতে ডুবিয়ে আনতে হয়। আমাদের কত মনের মলিনতা, কত কামনা-বাসনা, কত সাংসারিক আবিলতা—সেসব মালায় লেগে থাকে যে! ওই জন্যেই তো মধ্যে মধ্যে মালাকে গঙ্গায় ডুবিয়ে শোধন করতে হয়।’
‘এখেনে গঙ্গা কোতায় পাবো? এখেনে তো কাজলা নদী শুদু!’ ধনঞ্জয় বলল।
‘তা সক্কাল সক্কাল বাস ধরে কলকেতা যান না ক্যানে আজ্ঞে? কলকেতায় গঙ্গা-মা আচেন। সেখেনে গিয়ে মালাকে গঙ্গায় শোধন করি আনতি পারেন।’
এই বলেই খঞ্জনীতে ঠিন্ ঠিন্ শব্দ তুলে বোস্টমী চলে গেল দুপুর রোদে। জানালার গরাদ ধরে ধনঞ্জয় বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল একা।
দুপুরে যা বিহ্বলতা ছিল, সন্ধ্যায় তা ধীরে ধীরে সংশয় হয়ে দাঁড়াল। রাত্রে সেই সংশয় থেকে অশান্ত হয়ে উঠল মন। তবে কি সে কিছু ভুল করছে? মালা শোধন করতে গঙ্গাতীরে কলকাতায় যেতেই হবে তাকে? কই এমন তো কিছু কোনোদিন মুরশিদ বলেননি। কলকাতা? ভাবতেই বুকটা হিম হয়ে এল ধনঞ্জয়ের।
তাছাড়া মালা যদি সে গঙ্গায় ধুতে যায়, তাহলে মালার গায়ে তার মুরশিদ গুরু আব্বাস গণি শাহ্-র যে স্পর্শ লেগে আছে, তাও কি ধুয়ে যাবে না? মালাটি তাকে দেবার আগে আব্বাস গনি ওই মালা ধরে জপ করে দিয়েছিলেন যে! তাছাড়া এতদিন ওই মালার প্রত্যেকটি দানায় রুকসানার নাম অজস্রবার জপ করেছে ধনঞ্জয়। মালা গঙ্গায় ডুবিয়ে শোধন করতে গেলে যদি ধুয়ে যায় মালার গা থেকে রুকসানার নাম?
অশান্তি বেড়েই চলছে দিন দিন। আর জপও করতে পারছে না ধনঞ্জয়। আবার রাতে ঘুম নেই। এই ভাবে অশান্তি ভোগ করতে করতে ধনঞ্জয়ের মনে হল, যিনি মালা দিয়েছিলেন, তাঁকেই গিয়ে শুধোই না কেন মালাশুদ্ধির প্রয়োজন আছে কি না?
এই কথা ভেবেই সে আজ হাটে এসেছিল, যদি আব্বাস গনি-র দেখা পায়। কিন্তু কোথায় তিনি? তিনি আজ হাটে আসেননি মোটেই। এলে এতক্ষণে কি দেখা পেত না তাঁর ধনঞ্জয়?
দিন শেষ হয়ে এল। আরও কিছুক্ষণ তেঁতুলতলায় বসে বিফলমনোরথ হয়ে ধনঞ্জয় উঠে দাঁড়াল। মেয়েদের সাজসজ্জার আড্ডা, গোহাট, কৃষিসামগ্রী-রন্ধনসামগ্রীর দোকান, শাকসবজির হাট, মিষ্টি আর তেলেভাজার পসরা… সব পেরিয়ে পেরিয়ে আসছিল ধনঞ্জয়। চারিদিকে হাট-ভাঙার আয়োজন। কুপীর আলোতে পসারিরা জিনিসপত্র গোছাতে ব্যস্ত।
মনটা খারাপ হয়ে গেছে ধনঞ্জয়ের। হাটে এসে মুরশিদকে পেল না। অশান্তিও মিটল না তার, শুধুমুদু আসা হল—বেকার। হতাশ পায়ে পায়ে সে চলে আসছিল খেয়াঘাটের দিকে। নৌকা ধরে হরিহরপুর ফিরে যাবে একমাথা উদ্বেগ নিয়ে।
খেয়াঘাটের দিকে যাওয়ার পথে ঝাঁকড়া একটা নিমগাছ। গাছের তলাটা মুখ-আঁধারি মতো হয়ে আছে। নিমতলার দিকে আরেকটু এগোতেই হঠাৎ আশরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল ধনঞ্জয়। নিমঘাটের বাথানে আচম্বিতে সে চেয়ে দেখল, আব্বাস গনি তাঁর সেই চিরপরিচিত দোতারা আর ঝুলি নিয়ে, সেই চিরচেনা হাসিটি মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন ধনঞ্জয় এ পথ দিয়ে ফিরবে—একথা জেনেই তিনি অপেক্ষা করছেন।
আনন্দে উদ্বেল হয়ে ধনঞ্জয় কুর্নিশ করল মুরশিদকে। বলল, ‘আপনি আজ হাটে আসিছিলেন? আর আমি আপনাকে কত যে খুঁজছি!’
আব্বাস গনি হাসিমুখে বললেন, ‘আমি কি শুধু তেঁতুলতলায় বসে থাকার বান্দা রে, আব্বু? আমি যে মানুষরতন দেখে বেড়াই…’ এই পর্যন্ত বলেই উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাকে খুঁজছিলি ক্যানে, বাপ? কিছু কি মুশকিল হয়েছে তোর আবার?’
ধনঞ্জয় উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, হুজুর। মুশকিল বলে মুশকিল! এক বোস্টমী আমাকে বলিছে, মাঝেমধ্যে জপের মালাকে গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে ধুতি হবে। আপনি তো বাবা আমাকে এসব কিছুমিছু বলেননি?’
‘ক্যানে? মালাকে গঙ্গায় চুবাতে হবে ক্যানে?’
‘সেই বোস্টমী বলল, এভাবেই নাকি মালাকে মাঝে মাঝে শোধন করতি হয়। হয় নাকি, বাবা?’
‘এমন তো কোনোদিন শুনিনি রে, বান্দা!’
এই কথা বলে আব্বাস গনি অন্ধকারে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কী যেন ভাবছেন গভীরভাবে। তারপর কী যেন তাঁর হল। হঠাৎ আপন মনে হেসে উঠে বললেন, ‘তা তুই কলকেতা গিয়ে মালাকে গঙ্গায় চুবাতেই পারিস। তাতে মালার কী ক্ষতিবৃদ্ধি হবে, আমি তা জানি নে। তবে মা গঙ্গা দুনিয়ার কত পাপ নিয়ে, কত পাপ বয়ে বয়ে কলকেতার পাশ দিয়ে সমুদ্দুরে যাচ্ছেন। মালাকে গঙ্গায় ডোবালে… তুই যে-ভালোবাসা দিয়ে তোর মাশুকের নাম মালায় জপ করিস, সেই ভালোবাসার স্পর্শ পেয়ে গঙ্গা-মা নিশ্চয়ই পবিত্র হয়ে যাবেন!’
খেয়াঘাট থেকে নৌকা ধরে কজ্জলার নাভি পেরিয়ে হরিহরপুরে ফিরছিল ধনঞ্জয়। খেয়াঘাট অবধি ধনঞ্জয়কে পৌঁছে দিয়ে কোথায় যেন চলে গেছেন আব্বাস গনি। নদীর উপর জ্যোৎস্না উঠেছে খুব। স্রোতের বুকে চাঁদের কিরণ পড়ে রুপোর পাতের মতন চকচক করছে। নৌকাতে আরও অনেক হাটফেরতা যাত্রী আছে। তারা কথা বলছে পরস্পর। ধনঞ্জয়দের নৌকাখানা স্রোত কেটে এগিয়ে চলেছে হরিহরপুরের দিকে। অপলক চেয়ে আছে ধনঞ্জয় জলের পানে। রুকাইয়ার ভালোবাসার মতন আশ্চর্য রহস্যময়ী জ্যোৎস্নার আলো-অন্ধকারে তার বোবা চোখের জল মিশে গেছে, তাই নৌকার যাত্রীরা কেউ তার কান্না দেখতে পাচ্ছে না।
শেয়ার করুন :