তাহাদের কথা -

গ্রাফিক্স - সৌরভ হাজারী

তাহাদের কথা

নারীদিবস কবে ওরা জানেনা ,কিন্তু রুখে দাঁড়ায়।

অদিতি মজুমদার

“প্রতিবারই যখন একজন মহিলা নিজের পক্ষে দাঁড়ান, সম্ভবত না জেনেই, দাবি না করেই, তিনি সমস্ত মহিলাদের পক্ষে দাঁড়ান।” – মায়া অ্যাঞ্জেলোউ       

কোহিনূরের সঙ্গে আমার আলাপ হয় বউবাজারে, কোহিনূরের তখন বয়েস প্রায় পঞ্চাশ। রোগা গড়ন, কিন্তু সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা , তার চেহারায় সব থেকে উজ্জ্বল তার দুটো চোখ! কোহিনূর একজন নাবালিকাকে রাত বিরেতে যৌন পল্লী তে নিয়ে আসতে দেখতে পায়! আর তারপর থেকে সারারাত সে ওই বাড়ির পাহারায় ছিল … আমি তখন একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রিসার্চের কাজ করি … খবর পেয়ে আমিও ছুটে গিয়েছিলাম বৌবাজারে … গিয়ে দেখলাম কোহিনূর  ততক্ষণে লোক জড়ো করে ফেলেছে … বলছে একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে এসেছে  … আমি ছাড়বো নাকি? আমার সামনে দিয়ে কোন বাচ্চাকে এইখানে নিয়ে আসা যাবেনা … আমি যা ভোগ করেছি … আমি কাউকে ভোগ করতে দেবনা! আমি কোহিনূরের তেজ দেখে এক মুহূর্ত বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম!   

কোহিনূরের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয় আরো পরে, কিন্তু সেদিনের কোহিনূরের দাপট আমার চোখে এখন লেগে আছে! কোহিনূর এর বাড়ি ছিল কোচবিহারে … ছিল মানে এখনও হয়তো আছে! কিন্তু কোহিনূর  ষোল বছর বয়েসে বাড়ি ছেড়ে এসেছিল । আর কোনোদিন ফিরে যায়নি! কারণ সে জানতো সে ফিরে গেলে তাকে কেউ আর বাড়িতে  ঢুকতে দেবেনা! বাবা ছোট  বেলায় মারা যান, অভাবের সংসার,  গেঞ্জির কারখানায় কাজ দেবে বলে গ্রামেরই একজন তাকে কলকাতায় নিয়ে এসে চেতলার যৌন পল্লীতে বিক্রি করে দেয়! সেই থেকে কোহিনূর কলকাতাতেই আছে! চেতলা থেকে চলে এসেছে বউবাজারে! তার যখন বছর আঠেরো বয়েস তখন তার একজন লোকের সঙ্গে সম্পর্কও তৈরি হয় …  সেই সম্পর্ক থেকে তার পুত্রের জন্ম! যদিও সেই লোকটি ছেলের যখন বছর দুয়েক বয়েস তখন থেকেই আর কোহিনূরের কাছে আসেনি! অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম … জানো সে কোথায় আছে? কোহিনূরের সোজা সাপটা উত্তর … কে জানে বেঁচে আছে কিনা! আর ছেলে? কোহিনূর ম্লান হেসে বলে সেও বড় হয়ে মায়ের এমন কাজ মেনে নিতে পারেনি … অন্য জায়গায় থাকে , ভদ্র সমাজে …! যাকে গতর খাটিয়ে মানুষ করলাম সেই আর আমাকে … এক মুহূর্তের জন্য চোখ টা যেন ঝাপসা হয় তার … পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বলে … ভালই হয়েছে … ! আমি নিজের মত ভাল আছি! এত জবাবদিহি করতে পারবনা দিদি!

কোহিনূর পড়াশোনা জানেনা … কিন্তু তার জীবন বোধ আমাকে বিস্মিত করে, নিজের শরীরের ওপর তার নিজেরই অধিকার আর কারোর না … আমি শরীর বিক্রি করেছি … তার মানে এই না আমার ওপর অত্যাচার করা যাবে! … কোহিনূর আমাকে বলেছিলো … এখানে কত রকমের লোক আসে … কার কোন ধর্ম কেউ জানতে চায়না … কিন্তু বাইরে দেখো তো  জাত পাত ধর্ম নিয়ে কত বাছ বিচার! … আমি বলি কোহিনূর … এখানে এসে মার খেয়েছ? কোহিনূর  বলে খেয়েছি … প্রথম দু একবার … তারপর নিজের রক্ষা নিজেই করতে শিখে গেছি … ! আর এখন অন্যদের রক্ষা করার চেষ্টা করি … সব যে পারি এমন না … যতদিন এই খানে থাকব … চেষ্টা আমি করেই যাবো! বাড়ি যেতে ইচ্ছে করেনা? কোহিনূর হাসে … কে আছে আমার ওখানে যে ইচ্ছে করবে?

কোহিনূর ক্লারা জেটকিন্স জানেনা … কোহিনূর জানেনা ন্যায্য শ্রমের মূল্যের জন্য আন্দোলনের কথা … কিন্তু সে জানে তাকে লড়ে নিতে হবে নিজের অধিকার! সারা জীবন সে লড়েই যাবে …! এই নারী  দিবস কোহিনূরের … আর কোহিনূরের মত মালা, শিখা, আয়েশা, পিংকিদেরও!

পুতুল হঠাৎ করেই চুপি চুপি দেখা করতে এল , পুতুল এসেই বললো আমাকে একটা জিনিস জোগাড় করে দেবে? … খেয়াল করলাম পুতুলের চোখের নিচে কালশিটে … পুতুল ভয়ে ভয়ে এও বললো আমি যে তোমার কাছে এসেছি কেউ যেন জানতে না পারে! পুতুল কে আমি দেখছি গত পনেরো বছর ধরে … বাড়ি বাড়ি ঠিকে কাজ করে … বাঙালি … কিন্তু বিয়ে করেছে অবাঙালি ট্যাক্সি ড্রাইভার কে … দুই ছেলে … ! আমি জানি পুতুলের বর রাজেশ তাকে খুবই মারধোর করে … অনেক বার পুতুল কে বলেওছি ব্যাবস্থা নিতে …! কিন্তু পুতুল ভাবতেও পারেনা নিজের স্বামির বিরুদ্ধে পুলিশে যাওয়া যায় … যাওয়া উচিত! জানতে চাইলাম কি জোগাড় করে দিতে বলছিস? পুতুল বললো শুনেছি মদ ছাড়ানোর ওষুধ হয়? রাস্তায় লেখা থাকে দেওয়ালে … আমাকে জোগাড় করে দেবে দিদি? আবার মার খেয়েছিস? … পুতুল চুপ … আমি হতাশ গলায় বললাম সারাদিন এত পরিশ্রম করে বাড়ি গিয়ে মার খেতে ভাল লাগে তোর? … পুতুল খুব উৎসাহ নিয়ে বললো … দিদি মানুষ টা খারাপ না … শুধু একটু পেটে পড়লেই … কেমন হয়ে যায়! পেটে না পড়লে তোকে মারবেনা আর? পুতুল বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে  … তা জানিনা … কিন্তু আমি আর কি করব বলো? তুমি দিদি যে ভাবে হোক ওষুধটা আমায় জোগাড় করে দাও … যদি বলিস আমি পুলিশ কে জানাব … পুতুল হাত জোড় করে না দিদি … ছেলে দুটো র কি হবে? কি হবে মানে? রোজগার করিস তুই … রাজেশ তো শুধু নামেই বাবা … পুতুল বোঝেনা … বুঝতে চায়না! সে লেখাপড়া জানে সামান্যই …  সে যা শিখেছে তা এত সহজে কিভাবে বদলে ফেলবে? পুতুল চলে যায় … আমি ভাবি … পুতুল কে দোষ দিয়ে লাভ কী? কত মেয়েই তো সহ্য করে যায় এত কিছু … তাদেরও তো এসব সামলে চলতেই

শেখানো হয়েছে! মানিয়ে নিতে বলা হয়েছে! এখন ঘরে ঘরে মেয়েদের সেই শিক্ষাই তো দেওয়া হয়! পুতুলের কাছে নারী দিবসের মূল্য কী আমার জানা নেই … পুতুল শুধু চায় শান্তিতে থাকতে … এই নারী দিবস কি পুতুলের নয়?

আমার বাড়িতে থাকেন শুভা দি … শুভা হালদার … ধর্মে খ্রিস্টান …! কবর ডাঙ্গায় বাড়ি … ! আমার ছেলেদের দেখাশনা করার জন্য এসেছিলেন দশ বছর আগে … তারপর বাড়ির একজন হয়ে গেছেন! শুভাদির গল্প আবার অন্য রকম … খুব কম বয়েসে এক পাদরীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সম্বন্ধ করে, বয়েসে ফারাক ছিলো  আঠেরো বছরের । শুভা দি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছেন … তারপর আর পড়াশনা করা হয়নি …! বিয়ের এক বছরের মধ্যে মেয়ের জন্ম আর পাঁচ বছর পরে স্বামী মারা যান! সে সময় পাশে কেউ ছিল না … শুভা দি আয়ার কাজ শুরু করেন , এখন শুভা দির বয়েস আটান্ন, এখন কাজ করে যাচ্ছেন , যতদিন সুস্থ থাকবেন কাজ করবেন। শুভা দির শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছিল … শুভাদি কোর্ট পর্যন্ত করেছেন একার চেষ্টায়! শুভা দির দার্ঢ্য আমাকে মুগ্ধ করে! শুভা দি নিজেই নিজের জায়গা করে নিয়েছেন … এমন মেয়েরা নারী দিবসের প্রধান মুখ হয়ে উঠুক!

আমার মা ছিলেন বরিশালের মেয়ে … এই পশ্চিম বঙ্গে এসে আর পাঁচ টা উদ্বাস্তু পরিবারের মতই ছিল আমার মামার বাড়ির জীবন … শুধু একটাই জোর ছিল তাদের … ভাই বোনেরা সবাই পড়াশোনায় খুব ভাল! আমার মা সেই যুগে ইকনমিক্স পড়েছেন বেথুন কলেজে … মা এর নাম এখনো কৃতী ছাত্রী হিসেবে লেখা আছে বেথুন কলেজের দেওয়ালে! মা বাড়ির সম্বন্ধ ফিরিয়ে দিয়ে বিয়ে করেছিলেন আমার বাবা কে …! বাড়ির অমতে এক বস্ত্রে চলে এসেছিলেন এক ঘটি পরিবারে! মা কলেজে পড়াতেন … পরে স্কুলে বাবা হাওড়ার স্কুল শিক্ষক! অভাবের সংসার … তার মধ্যেই মা একটু একটু করে বদলে দিয়েছিল আমাদের বাড়ি টাকে! মার অবসর যাপন ছিল বই পড়া … সারাদিন সারাক্ষণ বই এ মুখ গুজে কেন থাক মা? … সেকি … আমি তো শেষ দিন অব্দি পড়ে যেতে চাই … কত কি ই তো পড়া জানা বাকি রয়ে গেল! মা জানতেন অসহায় মেয়েদের পাশে কিভাবে দাড়াতে হয় … বিশ্বাস করতেন সব মেয়ের আর্থিক স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন। কখন আমাকে আর দাদা কে আলাদা করে দেখেন নি … ব্যবহারে কখনো কোনও ডিস্ক্রিমিনেশন টের পাইনি কোনোদিন!

এতজনের কথা লিখলাম শুধু নারী দের কথা লিখতে নয়! সামনেই আটই মার্চ … এক ঐতিহাসিক দিন! ১৮৫৭ থেকেই হয়তো একটু একটু করে সেকেন্ড সেক্স এর এম্পাওয়ারমেন্ট ঘটতে শুরু করেছে! ১৯০৯ এ হয়েছিল প্রথম নারী সম্মেলন! তারপর কেটে গেছে অনেক বছর,  কিন্তু এখনো খামতি থেকে গেছে বলেই আমার বিশ্বাস! আমি বা আমরা যে শ্রেণির মানুষ সেখানে হয়তো আর আলাদা করে দেখা হয়না কন্যা বা পুত্র সন্তান কে … সেখানে আমরা মেয়েদের অলিম্পিকে সোনা পাওয়া … চন্দ্রযানের সাফল্যে মেয়েদের অবদান উদযাপন করি ! কিন্তু এখনো সন্ধে ছটা থেকে দশ টা টিভি খুললেই মেয়েদের দশভূজা হয়ে ওঠার উপাখ্যান … যেন ঘর বাড়ি স্বামী সংসার সব সামলাতে পারলেই সে আদর্শ নারী হয়ে উঠতে পারবে! ওদিকে গুগল বলছে প্রতি সতেরো মিনিটে ভারতে একটি ধর্ষণ এর ঘটনা ঘটে! চোখের সামনে নিজের সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দেখেছি নামী নার্সিং হোমে তৃতীয় বার কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য বাড়ির বউটির হেনস্থা! আরণ্যক এ পড়েছিলাম ভানুমতী কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ভারতবর্ষের নাম শুনেছে কিনা  … ভানুমতী বলেছিলো সে শোনে নি !

আমি স্বপ্ন দেখি একটা বিশাল মিছিলের, যার সামনে থাকবে প্রান্তে থাকা মেয়েরা, তারাই পথ দেখাবে … আমরা যারা সুবিধা ভোগী শ্রেনি … যারা মনে করি আমরা অনেক এগিয়েছি … তারা হাঁটবো পেছনে … এভাবেই পালিত হোক আগামীর নারী দিবস!  

লেখক পরিচিতি- অদিতি মজুমদার সাহিত্যিক,চিত্রনাট্যকার (‘এক আকাশের নিচে’ ,’জিও কাকা’ ) ও গবেষক।

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *