সাবর্ণী দাস
পৃথিবীটা ছোট হতে হতে আর বোকা বাক্সের মধ্যে আবদ্ধ নেই, চলে এসেছে মুঠোর মধ্যে, বলাই বাহুল্য মুঠো ফোনের মধ্যে! সারা বিশ্বের সব কিছুই যখন এই হাতের তালুর নাগালে তখন আর চিন্তা কী? সব কিছুর পরিবর্তন, অদলবদল ঘটে যাচ্ছে নিমেষের মধ্যেই। তবে বদল যেটা ঘটেনি সেটা হল বাঙালি মেয়েদের পোশাক পরিকল্পনা সরস্বতী পুজো, পয়লা বৈশাখ এবং পুজোতে শাড়ি পরতেই হবে। কিন্তু এখানে একটা ‘ক্যাচ’ আছে। শাড়ি তো পরব, কিন্তু কিভাবে পরব? পয়লা বৈশাখের প্রাকক্কালে আসুন সেটা নিয়েই একটু মক্শো করা যাক। এবং সব পুজোর আগে যেমন গণেশ পুজোটা ‘কম্পালসারি’, তেমনই জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে একবার স্মরণ করে নেওয়া যাক সবার আগে।
বাংলাতে তখন ঘোর কলিকাল। ঠাকুরবাড়ির দৌলতে বাংলার ঐতিহ্য, বিশেষ করে মেয়েদের অবস্থান একেবারে নরকের তেলের কড়াইতে ডুবন্ত। পারলে হিদুরা গঙ্গার বুকেই চিরআশ্রয় গ্রহণ করেন! এমতাবস্থায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের বড়ছেলের বউ দুটি মহাপাপ করে ফেল্লেন (১) বম্বে থেকে পার্শিদের দেখাদেখি শাড়ি ঘুরিয়ে পরলেন আর (২) গা ঢাকা ব্লাউজ পরলেন শাড়ির সঙ্গে। কি ঘেন্না, কি ঘেন্না! একে তো শাড়ি পরল ঘুরিয়ে তাই আবার তার সঙ্গে গা ঢাকা জ্যাকেট? এখনকার মেয়েদের বুঝতে একটু অসুবিধা হলেও সেকালে এটা ছিল পূর্ণ বিপ্লব। যাই হোক গণেশ পুজো শেষ, এবার বাকি কার্যকলাপের দিকে এগোন যাক।
জ্ঞানদানন্দিনী ব্লাউজ পরাতে শেখালেন বটে, প্রগতিশীল কিছু পরিবার ও মহিলারা গ্রহণও করলেন এই পোষাকী পরিবর্তন। কিন্তু ‘আম আদমি’র ঘরে ঢুকতে তা সময় লাগল অনেক। যদিও মেয়েরা স্কুলে যাওয়া শুরু করাতে এবং মহিলারা স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়াতে ব্লাউজের প্রচলন ধীরে হলেও সরগড় হতে শুরু করল। তবে গ্রামে বা মফস্বলে ব্লাউজ বিশেষ পাত্তা পায়নি বহু বছর। এরই সঙ্গে শাড়িও পরা হত বাংলার আটপৌরে স্টাইলেই।
আরও পড়ুন –
সময় এগোনর সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দিকে সততই পরিবর্তন ঘটে। বিশ্বযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন, শিক্ষার প্রগতি, বায়স্কোপ ইত্যাদি সব কিছুই প্রভাবিত করল প্রাত্যহিকীতে, পোশাকেও ঘটল বিবর্তন। বহুকালই বাঙালি মেয়েরা আটপৌরে শাড়ি পরার ধরন ছাড়েননি। এখনও তা বলবৎ আছে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে। তবে মেয়েরা যেদিন থেকে বাইরে বেরোলেন, তা সে ইস্কুলে পড়তে যেতে হোক বা আন্দোলনের ঝান্ডা ধরতে, শাড়িটা কুঁচি দিয়েই পরতে স্বচ্ছন্দবোধ করতেন। সে সময় বিবাহিতদের মাথায় ঘোমটা দেওয়া এবং অবিবাহিতাদের আঁচল গায়ে দেওয়ার প্রচলন ছিল।
চট করে চলে আসা যাক সিনেমার নায়িকাদের কথায়। পিয়ানোর পাশে দাঁড়িয়ে গান গাওয়ার সময় বা লুকিয়ে গাছের আড়ালে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাঁরা স্বচ্ছ শিফন পরতে শুরু করলেন। পাশাপাশি দিশি তাঁতের শাড়ি বা মোটা খাদিও প্রবল পরাক্রমে রাজ করত। সঙ্গে ‘মডেস্টি’ বজায় রাখা গা ঢাকা ব্লাউজ। এই সময় নিঃশব্দে স্লিভলস ব্লাউজও কোন কানাগলি দিয়ে ঢুকে পড়েছিল যেই। তবে তা অনেক ক্ষেত্রে ভাল-খারাপ মেয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করত। বোঝাই যাচ্ছে যে মেয়েটি ভিলেন, তাকে দেওয়া হত হাতকাটা ব্লাউজ। লজ্জাবতী, নম্র নায়িকার পরনে তখনও আব্রু মোড়ানো হাতাওয়ালা ব্লাউজ! তবে মেট্রো শহরগুলির শিক্ষিত প্রগতিশীল পরিবারে মেয়েরা কিন্তু সহজেই স্লিভলেস ব্লাউজ পরতেন। সময় টা ৬০-এর দশকের শেষ এবং ৭০ দশকের শুরুর কথা। শোনা গেছিল নকশাল আমলে নাকি এর বিরুদ্ধে একদল মানুষ সোচ্চার ছিলেন। তাঁরা নাকি ধারালো ব্লেড নিয়ে ঘুরতেন। বাসে ট্রামে রাস্তাঘাটে ব্লাউজের হাতা বাড়ন্ত দেখলে ব্লেড চালাতেন। ‘ব্লাউজ অ্যাক্টিভিস্ট’?
যাই হোক শাড়ি এবং ব্লাউজের ব্যবহার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছিল খুব ‘সিম্পল’ এবং অবশ্যই তা বিকশিত হত সেই মানুষগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থানের ওপর। মিলের লাল পাড় সাদা শাড়ি পরতেন নাকি বালুচরী সেটা তো নির্ধারণ করার কাজ অর্থনীতির। যাই হোক স্লিভলেস ব্লাউজ, শাড়ির সঙ্গে যখন মিলেমিশে গেছে তখন বাংলায় শাড়িও অনেকরকম এসে গেছে। শোনা যায় গৌরী দেবী, উত্তমকুমারের স্ত্রী নাকি সিনেমায় দেখতে যেতেন বেনারসী শাড়ি পরে, অবশ্য, বেনারসী শাড়ি বাঙালি বাড়িতে ঢুকে গেছে বহুকাল আগেই। বাড়ির কর্তারা শিবচতুর্দশীতে কাশী যেতেন শিবের আরাধনা করতে আর ফিরতেন বাড়ির মেয়েদের জন্য বেনারসী শাড়ি নিয়ে। তা সে পুজোয় পরার জন্যই হোক বা বিয়েতে। এই ‘প্র্যাকটিস’ ছিল বেশ কিছুকাল আগের। পরে বেনারসিওয়ালাদের দৌলতে বাংলার ঘরে ঘরে বেনারসীর ঝলকানি। বোধহয় একমাত্র বাংলাতেই বিয়ের সময় মেয়েরা নিজস্ব দিশি বুনোটে (আগে বালুচরীর চল ছিল) না সেজে অন্য দেশের শাড়ি পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসতেন। বেনারসী সব থেকে জনপ্রিয় ছিল এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না কিন্তু এরই সঙ্গে অন্যান্য প্রাদেশিক শাড়িও বাঙালি মেয়েদের প্রিয় হয়ে উঠল। সম্বলপুরী (যার ডাকনাম কটকি), কাঞ্জিভরম, কেরালা কটন বা তেলিয়া বাঙালি মেয়েদের ওয়ার্ডোব এসেনশিয়ালস হয়ে উঠল।
ধীরে ধীরে মেয়েদের সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন ঘটল, সেই সঙ্গে পোশাকের। শাড়ির প্রতুলতা কমল। সালোয়ার কামিজ, স্কার্ট টপ, জিনস টি শার্ট, স্যুট শার্ট ইত্যাদির প্রভৃতি সনাতনী শাড়ির একাধিপত্যের ভিত দূর্বল করতে শুরু করল। এখন আর কলেজে অধ্যাপিকা হতে গেলে কেবল শাড়ি না পরলেও চলে। মিডিয়াতে তো চিরকালই পোশাকের ব্যাপারে অনেক ছাড় ছিল, এখন অন্যান্য অফিসগুলোতেও রশি আলগা। তবে এই ধরুন চার-পাঁচ বছরে চাকাটা কিন্তু আবার ঘুরতে শুরু করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে শাড়ির একটা মেটামরফসিস ঘটেছে। ব্যাপারটা একটু খোলসা করা যাক।
সোশ্যাল মিডিয়া, মূলত ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে আজকাল প্রচুর হাট বসে। এই হাটে শাড়ি আছে এক বড় অংশ জুড়ে। এর জন্য দোকানে যেতে হয় না, গাড়ির তেল খরচ হয় না, বাড়ি বসেই চলে বিকিকিনি। এছাড়াও আছেন স্টাইলিশরা যাঁরা প্রতিনিয়তই শেখাচ্ছেন কেমন শাড়ির সঙ্গে কেমন সাজবেন। ঘটল এখানেই পরিবর্তন। তাঁরা বললেন, কে বলেছে শাড়ির সঙ্গে কেবল ব্লাউজ পরতে হবে? কেন? শার্ট পর, লম্বা কুর্তা পর, বিকিনি পর, এমনকি টি শার্টও পরে ফেল। হোয়াট অ্যান আইডিয়া স্যরজি!! অ্যান আইডিয়া নয়, লক্ষ লক্ষ আইডিয়াজ। ব্লাউজের লক গেটটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আপন মনের মাধুরী মিশায় আপনি তো মশাই মঙ্গলেও পৌঁছে যেতে পারবেন। এতটাই তীব্র তার তেজ।
আগে শাড়ি কিনে ব্লাউজ ম্যাচ করাতে হত। এখন ব্লাউজ কি ডিজাইন হবে সেটাই মূল ভাবনা, এরপর শাড়ি। একবার যদি কলকাতার (কলকাতার বাইরেও একই ছবি) বিভিন্ন বাজার পরিক্রমা করা যায় তাহলে দোকানে এবং ফুটপাতের দিকে নজর পরলে বুঝতে এক সেকেন্ডও লাগবে না যে ব্লাউজের কী বিপুল জনপ্রিয়তা। এক একটা ‘পিস আর আর্ট’ বললেও কোনও ক্ষতি নেই। যাঁরা নিজেদের সৃষ্টিশীলতা নিয়ে কোনও দ্বন্দ্বে ভোগেন না তাঁরা তো নিজেরাই ডিজাইন নিয়ে নীরিক্ষা করে ফেলেন।
প্রসঙ্গত আর একটি বিষয় উল্লেখ না করলে লেখাটা অসমাপ্ত মনে হবে। আর সেটি হল শাড়ি পরার ধরন। মাথায় ঘোমটা বা গায়ে কাপড় বহুকাল আগেই তামাদি হয়ে গেছে। অন্তত শহরে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পকেটে আজও অবিশ্যি এর কিছু চল থেকে গেছে কিন্তু ফ্যাশানের প্রেক্ষাপটে তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত। এবারে আসা যাক পরার ধরনে। শাড়ির আঁচল যখন কাঁধের উপর দিয়ে নামে তখন মেয়েদের বুকের পুরোটা ঢেকে তবে কাঁধের উপরে উঠত। এটাই ছিল প্রচলিত ধরন। এখন তার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। আঁচল পেটের কাছে এসে কেবল বাঁদিক দিয়ে উপরে ওঠে। তবে সবাই যে এইভাবে পরেন তেমনটা নয়, মূলত নবীনরা এই পরার বিষয়টা আয়ত্তে এনেছেন। প্রচুর বিতর্ক এই নিয়ে। একটু প্রাচীনরা এই স্টাইলকে ‘অসভ্যতা’ নামকরণ করেছেন। নবীনরা বলেছেন ‘আমার শরীর, আমার শাড়ি, আমার ইচ্ছা’।
ষাটের দশকের গোড়ায় ‘মহানগর’ ছবিতে সত্যজিৎ রায় এক সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছিলেন। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সেক্রেটারি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল নায়িকাকে, সিঁথিতে বা কপালে লাল সিঁদূর পরলে দোষ নেই, তবে ঠোঁটে লাল রং লাগালে তা কেন দোষের হবে? ঐতিহ্যের একটা অবস্থান থাকে। সেটা ভাঙার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।
তাহলে এই পয়লা বৈশাখে কীভাবে শাড়ি পরব? সাদা লিনেন শার্টের সঙ্গে লালপাড় সাদা বেগমপুরী? নাকি অ্যানিমাল প্রিন্টের ক্রপটপের সঙ্গে ইন্ডিগো ডাই করা কোটপাড়। খোলা বাজারে দিল খোলা কোটি কোটি স্টাইল। কেবল অপেক্ষা বেছে নেওয়ার নবীনতম সৃষ্টিশীল ইচ্ছার।
শেয়ার করুন :