গত ২৫শে নভেম্বর কলকাতা সোসাইটি ফর এশিয়ান স্টাডিস এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ল্যাংগুয়েজস এণ্ড লিঙ্গুইস্টিক্স বিভাগের সহযোগিতায় আচার্য্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা ৯ আয়োজন করা হয়েছিল বুদ্ধদেব বসু সভাগৃহে।বিষয়:’বাংলা ভাষার গুনগত পরিবর্তন:নবজাগরণের সুদৃঢ় বুনিয়াদ’।
ড: শর্মিষ্ঠা দে বসু, সম্পাদক, কলকাতা সোসাইটি ফর এশিয়ান স্টাডিজের স্বাগত ভাষণ ও সভাপতি অধ্যাপক ইন্দ্রনীল দত্ত, নির্দেশক, স্কুল অফ ল্যাংগুয়েজস এণ্ড লিঙ্গুইস্টিক্স, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রারম্ভিক ভাষণ দেন।
সন্মানীয় প্রফেসর মহীদাস ভট্টাচার্য্য তাঁর সুনিপুণ সমৃদ্ধ ভাষণে আলোকিত করলেন নবজাগরণের সময় ও তারও আগে বাংলার লোকায়ত জীবনে চর্যাপদ থেকে অন্নদামঙ্গল, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, লোকসাহিত্যে বাংলা ভাষা কিভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে তার সানুপুঙ্খ বর্ণনায়।উনি বলেন অধ্যাপক সুনীতিকুমার চ্যাটার্জীর ১৩২ তম জন্মবার্ষিকী স্মরণে এই বক্তব্যের বিষয়, ভাষা, চিন্তা ও সমাজ পরস্পরের পরিপূরক। উনিশশতকে বাংলাভাষার যে পরিবর্তন ঘটেছিল সেটির ফলেই এদেশে পাশ্চাত্যের চিন্তুা অতিদ্রুত এদেশের নতুন নগরসভ্যতায় শিক্ষিত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়িয়েছিল। এর ফলে সমাজ যেমন পরিবর্তিত হয়েছে সমান্তরালভাবে বাংলা ভাষারও গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। বলা যেতে পারে ১৮০০ থেকে ১৮৬৫ পর্যন্ত বাংলা ভাষার কাঠামোর যে পরিবর্তন তা এদেশে মাতৃভাষাগুলি বিকাশের অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করেছিল। যেটি মূলত ফোর্ট উইলিয়ামে রামরাম বসু মৃ্ত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার দের হাত ধরে শুরু হলেও রামমোহন ও তৎপরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, অক্ষয়কুমার দত্ত সমৃদ্ধ করেছিলেন তাঁদের দূরদৃষ্টিতে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংযোগে মানব কেন্দ্রিক একটি নতুন সমাজ গড়ে তোলার কর্মযোগে নিজেদের ব্যাপৃত রেখে।
বাংলা ভাষাকে সর্ববিষয়ে সকলের গ্রহণযোগ্য রূপে গড়ে তোলার প্রয়াসী হয়েছিলেন তাঁরা। গার্হস্থ্য জীবনে বাংলার যে রূপ ছিল সেটির পরিবর্তন ঘটিয়ে ভাষায় পাশ্চাত্যের নতুন নুতন বিষয়বস্তুর সংযোজন ঘটিয়ে ভাষার মর্যাদাকে যেমন বাড়িয়েছিলেন তেমনি ভাষার অঙ্গসজ্জাকে একটি নির্দিষ্ট খাতে বইয়ে দিয়েছিলেন। বিস্ময়ের বিষয় বাংলায় গদ্য উদ্ভবের পরে মাত্র চারপাঁচটি দশকের মধ্যে বিশেষ করে ১৮৪৭এর পর দুটি দশকেই ভাষা তার নিজস্ব রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় মর্যাদায় ও অঙ্গসজ্জায়। এরই পরিণতিতে বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন ও বঙ্কিমের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে। বিশ্বের দরবারে তার অস্তিত্বও প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাকে আজকে সমৃদ্ধ হতে গেলে এবং অন্যান্য মাতৃভাষাগুলিকেও বিকশিত হতে গেলে ভাষা পরিকল্পনায় এই যুগের অবদানগুলি বিবেচনায় আনা প্রাথমিক কর্তব্য।
এই যাত্রাপথে বাংলা ভাষাকে শাসকের বদান্যতার প্রয়োজন হয়নি এবং এই বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টায় যখন সেই সময়ের সংস্কৃত শিক্ষার বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত করে বাংলা নবজাগরণের আদিপুরুষ রামমোহন রায় সকল বিচারের ভিত্তিস্বরূপ বেদান্ত গ্রন্থ প্রকাশ করলেন।যে বাংলাকে উপেক্ষা করেছেন সেই সময়ের আর্য ব্রাহ্মণেরা।বেদান্ত তত্ত্ব সূত্রে রাজা রামমোহনের লেখার অংশ পাঠ করেন যেখানে ভাষার কাঠামো বিষয়ে রামমোহন বলেছেন ‘এ ভাষায় গদ্য অদ্যাপি কোনো শাস্ত্র কিংবা কাব্য বর্ণনে আইসে না, ইহাতে এতদ্দেশীয় কিছু লোক অনভ্যাসপ্রযুক্ত দুই তিন বাক্যের অন্বয় করিয়া গদ্য হইতে অর্থবোধ করিতে হঠাৎ পারেন না ইহা প্রত্যক্ষ কানুনের তরজমার অর্থবোধের সময় অনুভূত হয়….।‘
উনি ভাষার বিভিন্ন স্তর ও ব্যাকরণগত কাঠামো এবং ধ্বনি তরঙ্গর, সংস্কৃত অনুবাদ আর বাংলা অনুবাদের পার্থক্যের বিষয়ে বলেছেন। বিষয়বস্তু নিয়ে ভাষাতাত্বিক সুকুমার সেনকে উদ্ধৃত করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত প্রথম গ্রন্থ বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭), বাঙ্গালার ইতিহাস (১৮৪৮),ঋজুপাঠ (১৮৫১,১৮৫২),সংস্কৃত ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫),বর্ণপরিচয় (১৮৫৫),কথামালা (১৮৫৬),মহাভারত (১৮৬০),আখ্যানমঞ্জরী (১৮৬৩),শব্দ মঞ্জরী (১৮৬৪) এই গ্রন্থগুলির মধ্যে বোধোদয়েরই ৭০ এর ওপর সংস্করণ হয়েছে বলে উল্লেখ করে জানিয়েছেন জনমানসে অর্থাৎ শিক্ষিত লোকায়ত জীবনে এইগুলির ভাষার একটা পরিবর্তন হয়ে চলেছে।
বক্তার পরিচিতি: মহীদাস ভট্টাচার্য্য পড়াশোনা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। গবেষণা ভুবনেশ্বর ত্রিবান্দ্রমে। অধ্যাপনা ও গবেষণা যাদবপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবসর গ্রহণ ২০১৭। অংশ গ্রহণের আনন্দ যাদবপুরে ভাষাবিজ্ঞান পঠনপাঠনের বিভাগ গড়ে তোলা ও পশ্চিমবঙ্গের উপেক্ষিত তিরিশটি ভাষার কাঠামোর অনুসন্ধান সেগুলির মর্যাদা বাডা়নোর জন্য প্রোজেক্ট শুরু করা।পরিগণকি ভাষাচর্চায় অংশ গ্রহণ।বাংলা ওড়িয়া অসমীয়া করপাশ তৈরি, দৃষ্টিহীন মালায়লম তামিল ও ওড়িয়াভাষীদের জন্য তিনটি TTS system, বাংলা-মালায়ালম যান্ত্রিক অনুবাদ, মেশিন রিডেবল ডিকশনারী, বাংলা ভাষা পড়ানো ইত্যাদি বিষয়ে।
বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটির কাউন্সিল সদস্য, আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্নাতোকোত্তরস্তরে ভাষাবিজ্ঞান পঠনপাঠনে অংশ গ্রহণ করা।প্রবন্ধ সংখ্যা ৪০টির মতো।
তথ্য ও ছবি ঋণ- ডঃ ড: শর্মিষ্ঠা দে বসু,ডঃ অর্পিতা বসু।
শেয়ার করুন :