১০টি প্রথম থেকে শেষ পাতের অচেনা বাঙালি রান্না -

ছবি -সুশীল সেন (১৯৪০)

১০টি প্রথম থেকে শেষ পাতের অচেনা বাঙালি রান্না

এমন সুস্বাদু শুক্তো,ভাজা, ডাল, তরকারি, মাছ,মুরগি,পাঁঠা, আগে খেয়েছেন ?

আজকের আধুনিক উন্নত প্রযুক্তি আর সময়কালে দেশে বিদেশের নানান রকমের নতুন পুরোনো রেসিপি তার নানান স্বাদে বাঙালি মজেছে।কিন্তু বাঙালি দায়িত্ব নিয়ে ভুলতে বসেছে আমাদের মা ঠাকুমার হাতের স্বর্গীয় সুস্বাদু দেবভোগ্য নানা ধরণের আপাত অচেনা অজানা রান্না।সেই মা ঠাকুরমার ঝুলি থেকে ১০টি জিহ্বায় লালাক্ষরণ সারস্বত বাঙালি রেসিপি: 

লাউয়ের ডগা পাতা শুক্তো:

কী চাই : ১টি (ছোট)কচি লাউয়ের ডগা পাতা:১ আঁটি,উচ্ছে (চাকা চাকা করে কাটা ):৫০ গ্রাম ,বড়ি :১০টা,আদাবাটা :২ টেবিল চামচ ,সাদা তিল বাটা: ২ টেবিল চামচ ,নারকেল কোরা:১ বড় হাতা,দুধ :২ হাতা,মেথি ফোড়ন (পরিমান মতো )।

কী করে : লাউ সরু সরু করে কুচিয়ে দুধে নুন দিয়ে সেদ্ধ করুন।লাউয়ের ডগাপাতা নুন ও জল দিয়ে সেদ্ধ করুন।এবার সর্ষের তেল গরম করে প্রথমে বড়িগুলো ও পরে উচ্ছে ভেজে নিন।ওই তেলে একটু ঘি দিয়ে সর্ষে,মেথি ফোড়ন দিন।লাউ দুধ থেকে ছেঁকে এবং ডগাপাতা ডাল থেকে ছিঁড়ে তাতে দিয়ে দিন।সামান্য কষিয়ে আদাবাটা,তিল বাটা,নারকেল এবং নুন -মিষ্টি দিন।একটু নেড়ে চেড়ে বড়ি যোগ করুন।ঝোল ঘন হয়ে গেলে লাউ সেদ্ধ করা দুধ আর উচ্ছে ভাজা দিন।কিছুক্ষন পর ওপর থেকে ঘি ছড়িয়ে নামিয়ে রাখুন ।          

শাপলা ভেলা :

কী চাই :শাপলা :১ আঁটি,টুথপিক :১০-১২টি ,বেসন :১কাপ,চালের গুঁড়ো :৩/৪ অংশ টেবিল চামচের ,নুন: স্বাদমতো,লঙ্কাগুঁড়ো :পরিমাণমতো,তেল :২০০ গ্রাম।

কী করে:শাপলা কেটে ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে ২ ইঞ্চি করে কেটে নিন।কাঠিতে পরপর ৪টে করে সাজিয়ে নিন।বেসন,চালগুঁড়ো,লঙ্কাগুঁড়ো ও নুন একসঙ্গে মিশিয়ে ঘন গোলা তৈরি করুন।কড়াইয়ে তেল গরম করে শাপলাগাঁথা কাঠিগুলো বেসনের গোলায় ডুবিয়ে ছাঁকা তেলে মুচমুচে ভেজে তুলুন।ওপরে একটু চাট মশলা ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।(না,আসল রেসিপিতে চাট মশলা ছিল না )। 

চিংড়ি মাছ দিয়ে মুগ ডাল

কী চাই :মাঝারি মাপের চিংড়ি মাছ :৫০০ গ্রাম,মুগের ডাল :২০০ গ্রাম ,নুন- চিনি :পরিমাণমতো ,সর্ষের তেল :৫টেবিল চামচ,তেজপাতা -১-২ টো,গোটাজিরে: আধ টেবিল চামচ,হলুদগুঁড়ো -আধ টেবিল চামচ,আদাবাটা :২ টেবিল চামচ,জিরেবাটা :১ টেবিল চামচ,লঙ্কাবাটা :১ টেবিল চামচ।

কী করে : প্রথমে চিংড়িগুলো নুন-হলুদ মাখিয়ে রাখুন।মুগডাল ভেজে নুন- মিষ্টি (প্রয়োজনে অল্প হলুদগুঁড়ো দিতে পারেন)দিয়ে সেদ্ধ করে রাখুন।এবার কড়াইয়ে তেল ও ঘি গরম করুন।এতে তেজপাতা ও জিরে ফোড়ন দিন।ফাটতে শুরু করলে চিংড়িগুলো দিয়ে ভাজতে শুরু করুন।একটু ভাজা হলে এতে আদাবাটা ,জিরেবাটা ও লঙ্কাবাটা দিয়ে ভালো করে কষতে থাকুন।ভাজা হলে ফোড়ন হিসেবে ডালের মধ্যে ঢেলে দিন।

এঁচোড়ের দমপোক্ত

কী চাই :এঁচোড়:অর্ধেক,আলু :২টো(মাঝারি),লঙ্কাবাটা :স্বাদ অনুযায়ী,আদাবাটা :১ টেবিল চামচ,এলাচ :৪টি,লবঙ্গ :৮টি,কিশমিশ :৮/১০টা,বাদাম:৮/১০টা,খোয়াক্ষীর :১ ছোট কাপ,টক দই:৬/৭ টেবিল চামচ,নুন ও মিষ্টি :প্রয়োজনমতো ,ঘি :২ চামচ ,সর্ষের তেল :৫০ গ্রাম,গরম মশলা।

কী করে :অল্প বীজযুক্ত এঁচোড় খোলা ছাড়িয়ে চৌকো চৌকো করে কেটে সামান্য ভাপিয়ে রাখুন।আলু বড় টুকরো করে কাটবেন।বাদাম (খোসা ছাড়া ) ভিজিয়ে বেটে রাখুন।আলু ,সর্ষের তেল ও সামান্য নুন মাখিয়ে ভেজে নিন।এবার সেদ্ধ এঁচোড়,আলুতে আদাবাটা ,লঙ্কাবাটা,বাদামবাটা,টকদই, নুন,চিনি,দিয়ে মেখে রাখুন।কড়াইতে ঘি দিয়ে খোয়াক্ষীর গুঁড়ো করে কিশমিশ দিয়ে ভেজে নিন।ক্ষীর ,কিশমিশ ভাজা তুলে রেখে গরম মশলা থেঁতো করে ওই ঘিয়ে ফোড়ন দিন।প্রয়োজনে আরো ১চামচ ঘি দিতে পারেন।এতে মশলা মাখা এঁচোড় ও প্রয়োজনমতো জল দিন।কিছুক্ষণ নেড়ে চেড়ে ওপর থেকে ভাজা ক্ষীর ও কিশমিশ ছড়িয়ে দিন।পাত্রটির মুখ ঢাকা দিয়ে রান্না হতে দিন।গা মাখা মাখা হলে নামিয়ে নিন।

আদা মাগুর

কী চাই: মাগুর মাছ:৮০০ গ্রাম,জিরে:৪চামচ,শুকনোলঙ্কা:৭টা,আদা:৫০গ্রাম,ছোট এলাচ:৫টা,সর্ষের তেল:১৫০ গ্রাম,নুন ও ঘি পরিমাণ মতো।

কী করে : আদা খানিকটা থেঁতো করে বাকিটা রেখে দিন/মাছ কুটে(মাথা আলাদা করে রাখুন) ধুয়ে নুন হলুদ মাখিয়ে রেখে দিন।উনুনে করা বসিয়ে সব তেল ঢেলে তেল গরম হলে মাছ ছেড়ে,মাছ সামান্য ভেজে তুলে নিন।এবার তেলে আদা থেঁতো দিয়ে মাছের মাথা ভেজে নিন।বাকি সব মশলা বেটে জলে গুলে দিয়ে দিন।মশলা সব ভাজা হয়ে গেলে,পরিমাণ মতো জল ও মাছ দিন।আদাবাটার কিছুটা করে ভাজার সময় আর বাকিটা নামাবার সময় দিতে হবে।একটু গাওয়া ঘি ছড়িয়ে কিছুক্ষন রেখে নামিয়ে নিন।

মাখন মাছ

কী চাই:কাতলা বা রুই মাছের পেটি ৪০০ গ্রাম (বড় মাপের ৪ টুকরো করা),পেঁয়াজের রস :আধ কাপ,আদার রস:১ টেবিল চামচ,টক দই :২ টেবিল চামচ (জল ঝরিয়ে),লাল লঙ্কাগুঁড়ো :আধ চা চামচ ,গোটা কাঁচালঙ্কা :১/২ টা,কোরানো চিজ -২ টেবিল চামচ ,মাখন -ভাজার জন্য ,নুন-চিনি :পরিমাণমতো ,ভিনিগার :১ টেবিল চামচ।

কী করে : মাছ ভালো করে ধুয়ে জল ঝরিয়ে নিন।ধোয়া মাছে ভিনিগার মাখিয়ে ১৫-২০ মিনিট রেখে দিন।তারপর আবার ধুয়ে,শুকনো করে মুছে নিতে হবে।মাছের গায়ে ৩-৪ জায়গা সামান্য চিরে অল্প নুন মাখিয়ে রাখুন,এতে মশলা মাছের ভেতর ভালো করে ঢুকতে পারবে।এবার একটি ছড়ানো পাত্রে মাখন গলিয়ে এক এক করে মাছগুলো দুপাশ হালকা সোনালি করে ভেজে তুলতে হবে।বেঁচে যাওয়া মাখনে পেঁয়াজের রস,আদার রস,লাল লঙ্কাগুঁড়ো দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে অল্প আঁচে ২/৩ মিনিট ফুটিয়ে নিন।মাছ দিয়ে কষা মশলা মাছের গায়ে ভালো করে মাখিয়ে অল্প আঁচে ঢাকা দিয়ে ২ মিনিট রান্না করুন।এবার ঢাকা খুলে ফেটানো টক দই,কোরানো চিজ ও পরিমাণমতো চিনি দিয়ে আরো ১মিনিট নেড়ে চেড়ে নিন যাতে ঘন গ্রেভি হয়।ওপর থেকে কাঁচালঙ্কা কুচি ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।    

আম কাসুন্দি ভেটকি

কী চাই: ভেটকি মাছের পিস ৪/৫ টি,আধ চামচ হলুদ,৩/৪ চামচ সর্ষের তেল,১ টি মাঝারি ফালি করে কাটা কাঁচা আম,আধ চামচ কালো আর সাদা সর্ষে গুঁড়ো,২ তেজপাতা,১ লেবু টুকরো করে কাটা,৪ টি রসুন কোয়া,১ চামচ পাঁচফোড়ন,২ টি শুকনো লঙ্কা,এক চিমটে শুকনো লঙ্কা গুঁড়ো, ৩টি কাঁচালঙ্কা চেরা, ১ টি বড় পেঁয়াজ কুচি,২ টি মাঝারি টমেটো কুচি,এক চিমটে জিরে,নুন,চিনি,জল প্রয়োজন মত।

কী করে- প্রথমে ভেটকি মাছ হাল্কা ভেজে তুলে নিতে হবে,এর পরে সাদা,কালো সর্ষে বেটে মিক্সিতে পেস্ট তৈরী করে (আসল রান্নাতে বেটে, এখানে আজকের সুবিধের জন্য মিক্সি)  তাতে আমের টুকরো দিয়ে তিন চার ফোঁটা লেবুর রস দিয়ে একটা বাটিতে রেখে দিতে হবে,এর পরে প্যানে।কড়াইতে তেল গরম হলে তেজপাতা,গোটা জিরে দিয়ে গন্ধ বেরোলে পেঁয়াজ কুচি,কাঁচা লঙ্কা,টমেটো কুচি নিয়ে সিমে কষতে হবে,সঙ্গে হলুদ আর শুকনো লঙ্কা গুঁড়ো দিতে হবে।এর পরে বাটিতে রাখা কাঁচা আমি,সর্ষের পেস্ট দিতে হবে/২/৩ মিনিট কষানোর পরে মাছ দিয়ে পরিমাণমতো নুন,চিনি,পাঁচফোড়ন,জল দিয়ে সিমে ঢাকা দিতে হবে/৪/৫ মিনিট পরে গ্যাস বন্ধ করে কিছুক্ষণ রেখে গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন।

গন্ধরাজ মুরগি

কী চাই :চিকেন :১ কেজি,গন্ধরাজ লেবুর রস :১ টেবিল চামচ,গোলমরিচ :১ ছোট টেবিল চামচ,পেঁয়াজবাটা :২ চামচ,কাঁচা লঙ্কা :৫টি ,লেবুপাতা :৪টি,সর্ষের তেল :৫০ গ্রাম।

কী করে :চিকেন লেবুর রস,গোলমরিচ ,নুন দিয়ে ১ ঘন্টা ম্যারিনেট করে রাখুন।কড়াইয়ে তেল গরম করে পেঁয়াজ রসুন বাটা দিয়ে ২ মিনিট ভেজে নিন।এতে ম্যারিনেটেড চিকেন দিয়ে  ২০ মিনিট রান্না করুন।গ্রেভির জন্য কিছুটা জল দিয়ে ঢাকা দিয়ে (ঢিমে আঁচে ) লো ফ্লেমে আরো ১০ মিনিট রান্না করুন।গ্যাস অফ করার আগে ওপর থেকে কাঁচালঙ্কা চেরা আর লেবুপাতা কুচিয়ে দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিন। একটু পরে গরম ভাত অথবা রুটির সঙ্গে পরিবেশন করুন। 

মাংসের কালিয়া খাসা

কী চাই :পাঁঠার মাংস :১ কেজি,ঘি :১৫০ গ্রাম,দারচিনি:১ ইঞ্চি মাপের ১টি ,এলাচ :৩/৪টে,লবঙ্গ: ২/৩টে,লঙ্কাকুচি :আধ চামচ,কাশ্মীরি লঙ্কাগুঁড়ো :১ চামচ,জাফরান :১ চিমটে,আদাবাটা :১ টেবিল চামচ,পেঁয়াজ:৩০০ গ্রাম,কাঁচা পেঁপে:২০০ গ্রাম,গাজর:৫০গ্রাম,ধনে:১ চা চামচ,নুন :স্বাদমতো।

কী করে : কড়ায় ঘি গরম করুন।এতে প্রথমে পেঁয়াজকুচি ও পরে মাংসের টুকরো গুলো বাদামি করে ভেজে নিয়ে আলাদা রেখে দিন।কাঁচা পেঁপে ,গাজর কেটে নিন।অন্য পাত্রে পরিমাণমতো জলে আদাবাটা,ধনেবাটা,নুন ও কাটা সবজি সেদ্ধ করুন।সেদ্ধ হওয়ার পর স্টক ছেঁকে নিন।কড়ায় ঘি গরম করে লবঙ্গ ফোড়ন দিন।এতে মাংস ,পেঁয়াজভাজা দিয়ে দিন।একটু কষিয়ে নিয়ে স্টক ঢেলে দিন।তাতে নুন,লঙ্কাগুঁড়ো দিয়ে মাংস সেদ্ধ হতে দিন।মাংস সেদ্ধ হলে এলাচ,দারচিনিগুঁড়ো দিয়ে অল্প আঁচে ফোটান।শেষে ওপর থেকে জাফরান ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।      

তেঁতুলের শরবত

 কী চাই- ১ টি তেতুল,১/২ চা চামচ চিলি ফ্লেক্স,১/২ চা চামচ লবণ,১ চা চামচ চিনি/ মধু,১/২ চা চামচ ধনে পাতা কুচি,১/৪ চা চামচ ভাজা জিরে গুড়ো,১/৪ চা চামচ বিট লবণ,১/৪ চা চামচ গোল মরিচ গুড়ো।

কী করে : তেতুল এক গ্লাস জলে ভালো করে গুলে ছেকে নিতে হবে। জলের মধ্যে উপরের সব উপকরণ ভাল করে মিশালেই রেডি হয়ে যাবে তেঁতুলের শরবত।

সবিনয় নিবেদন : আগেকার মা ঠাকুমার এইসব দুষ্প্রাপ্য দুর্লভ রান্নার রেসিপিতে এখনকার সময়োচিত পরিমার্জিত পদ্ধতির উল্লেখ করা হয়েছে।মাটির উনুনের কাঠকয়লার পরিবর্তে গ্যাস,শিলে বাটনার পরিবর্তে মিক্সার গ্রাইন্ডার ইত্যাদি।

সৌজন্যে:জয়শ্রী গাঙ্গুলি,বিপাশা মুখার্জি,ডাঃ শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত ,শর্মিষ্ঠা দে, শিখা পাল,পাক প্রণালী -বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়। 

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *