অর্ক দেব
বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, “কাব্যের স্বাদে যে অভ্যস্ত, তার কাছে রবীন্দ্রনাথের গান শোনা যতখানি রোমাঞ্চকর, তাঁর গান পড়া তার চেয়ে কম নয়; তাঁর গান পড়তে-পড়তেও সেই রহস্যময় জগতের দুয়ার খুলে যায় যা আমাদের প্রত্যেকের মনের মধ্যেই আছে, অথচ দৈনন্দিন জীবনে যাকে প্রায়ই ভুলে থাকি।”[1][2] আমার ব্যক্তিগত অক্ষমতা আমি রবীন্দ্রনাথের গান সুর বিযুক্ত ভাবে পড়তে পারি না। পড়ার সময়ে সুরটা মাথায় ঘুরতে থাকে। কিন্তু এই অক্ষমতার কথা বাদ দিলে একমাত্র রবীন্দ্রনাথের গানই, প্রায় প্রতিদিন, যখনই তার কাছে আসি, চৈতন্যের দ্বার খুলে দেয়। নতুন করে ভাবায়। চেনা শব্দের নতুন অর্থ সামনে মেলে ধরে। ভাবি এই যে চৈতন্যের আবরণ ক্রমে সরে যাওয়া, ভাবতে পারা, অর্থহীনতার সাগরে ভাসতে ভাসতে এক মুষ্টি অর্থে পরিত্রাণ, নিত্যনতুন দ্বীপ আবিষ্কার– এই কি পূজা নয়? পূজা তো উপাচার চায় না, চায় মগ্নতা। বিনিময়ে মেলে নিরাময়সুধা। একেকদিন একেকটা গানের আদলে ভর করে এই সুধাসাগরের পারাবারে এসে দাঁড়াই। রবীন্দ্রনাথের নানা বয়সের গানের দিকে তাকিয়ে থাকি।
ধরা যাক, ৫৩ বছর বয়সের কথা। নোবেল প্রাপ্তির পরের বছর। শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন- সুখে আমায় রাখবে কেন। বেহাগে বাঁধা গান। রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে প্রিয় রাগ বেহাগ। গানের লোক দেখিয়ে দেন, বেহাগে তিনি শুদ্ধ নিষাদের জায়গায় কোমল নিষাদ বসিয়ে ছোট ছোট অন্তর্ঘাত ঘটাতে থাকেন অন্তরা-সঞ্চারী অংশে। আর কথা? এখানে রাখা যাক-
সুখে আমায় রাখবে কেন, রাখো তোমার কোলে।
যাক-না গো সুখ জ্বলে॥
যাক-না পায়ের তলার মাটি, তুমি যখন ধরবে আঁটি–
তুলে নিয়ে দুলাবে ওই বাহুদোলার দোলে॥
যেখানে ঘর বাঁধব আমি আসে আসুক বান–
তুমি যদি ভাসাও মোরে চাই নে পরিত্রাণ।
হার মেনেছি, মিটেছে ভয়— তোমার জয় তো আমারি জয়
ধরা দেব, তোমায় আমি ধরব যে তাই হলে॥
প্রথমেই ধাক্কা দেয় ‘জ্বলে’ শব্দটি। আমরা বলার সময়ে কি বলি, সুখ জ্বলে যাচ্ছে? হয়তো বলি, সুখ নেই, আমি সুখী নই। আমার সুখ জ্বলে গিয়েছে- একথা বলি না। ছবি জ্বলে যায়। যা কিছু দাহ্য তা জ্বলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় সুখও দাহ্য। সুখ যে আমি দেখিনি, ছুঁতে পারিনি তেমন নয়। কিন্তু আমি সুখে থাকিনি। সুখ- একটা অবস্থা। যা চিরকালীন হবে এমন অভিপ্সায় ভাসতে ভাসতেই মানুষ দুঃখের সাগর অতিক্রম করে। আমি সুখ নামক অবস্থার ছোঁয়াচ পেয়েছি কিন্তু অবস্থাটা ক্রমে তা আমায় ছেড়ে গেছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি, সুখহীন, আমার সুখটুকু জ্বলে গিয়েছে। জ্বলা শব্দটা ধরে রেখেছে দীর্ঘ দহনঋতু। ভাবি, কোনো কিছুই তো একবারে পুড়ে যায় না, দীর্ঘক্ষণ ধরে জ্বলে। সুখ জ্বলে গিয়ে যা পড়ে রইল তা কি স্রেফ বেদনাপ্রবণ দগ্ধ দেহ-মন, যার অস্তিত্ব বেলা যত বাড়ে তত মানুষ বুঝতে পারে?
রবীন্দ্রনাথের এই গানে ‘আমায়’ কথাটি প্রথম লাইনেই প্রকট। আমায় সুখে রেখো না, এই বার্তাটির অর্থ- আত্ম-সুখবাদের সঙ্গে রবীন্দ্রভাবনার সংঘাত ঘটছে। কেন মনান্তর? বুঝতে হবে, আত্মসুখবাদের চরিত্র কেমন? গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাস বলেছেন, সুখকে পাখির চোখ করেই সকল প্রাণ বাঁচে। বেদনা সদাই পরিত্যাজ্য। সুখ বলতে ব্যথার অনুপস্থিতি। কিন্তু উল্টোমেরুর প্রশ্ন, যা অনুপস্থিত তা কি নেই? ব্যথাকে আড়ালে রাখলে তা কি উবে যাবে? প্রকৃত বেদনাহীনতা একটি কল্পিত অবস্থা, একটি খোয়াবনামা নয়? শেলি তো লিখেছেন, আমাদের সুন্দরতম গানগুলি সেই যা বেদনাবিধুর ভাবনার গল্প বলে (Our sweetest songs are those that tell of saddest thought)। ফলে পূর্ণ সুখ বলে কিছুই হয় না। এটি একটি আকাঙ্খা, বেদনামুক্তির সীমিত অনুভতি। তাকে চিরকাল চাওয়া বাতুলতা। এপিকিউরাস দেখিয়েছিলেন সুখ দু’ধরনের। গতিময় সুখ আর প্রকৃত সুখ। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন, ক্ষুধার্থ মানুষ যখন খেতে খেতে একটু একটু করে ক্ষুধানিবৃত্তি করেন, তখন তা গতিময় সুখ, এই গতি তাকে একধরনের তৃপ্তি দিচ্ছে, শূন্যতা ভরাট করছে। আর পূর্ণ বা প্রকৃত সুখ পাওয়া যেতে পারে ক্ষুধানিবৃত্তির পর। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন, ক্ষুধানিবৃত্ত হলে আবার খিদে পাবে না? কাজেই পরমসুখ বলে কিছুই হয় না। সারাক্ষণ পেট ভরে থাকুক, এই চাহিদা একই সঙ্গে অশ্লীল, অসম্ভবও। পূর্ণসুখও অনেকটা তেমন। আমরা যে সুখ কামনা করি, সূক্ষ হোক বা স্থূল তা দুঃখের আড়াল। রবীন্দ্রনাথ এই আড়াল রাখতে চান না। যা চিরায়ত নয়, তার দিকে না তাকিয়ে গানে এক নিশ্চিন্ত সমর্পণের কথা বলেন। মরণকূপে ঝাঁপের প্রত্যয়ে বলেন,
যাক-না পায়ের তলার মাটি, তুমি যখন ধরবে আঁটি–
তুলে নিয়ে দুলাবে ওই বাহুদোলার দোলে॥
সুখ জ্বলে গেছে। পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছে। এমন কত মানুষকে আমরা দেখেছি, কোভিডের সময়ে। রেলপথ ধরে হাঁটছেন, হাইওয়ে ধরে হাঁটছেন, কোলে শিশু, সাইকেল করে যাচ্ছেন তিন রাজ্য পেরিয়ে নিজের গ্রামে। নিজের প্রকৃত অবস্থাটা বুঝতে পারলে তার মন নিশ্চয়ই বলে উঠত, অসম্ভব। কিন্তু এই যে শরীর চলেছে, মনও দূরগামী, পথ চলছে তো চলছেই, এর মূলে আছে বিশ্বাস। যে বিশ্বাসে একটা বাচ্চাকে শূন্যে ছুঁড়লেও সে হাসে। সে জানে পায়ের তলায় মাটি সরে গেলেও সে ডুববে না, পিতা-মাতা তাকে বাহুডোরে জড়িয়ে নেবে। তারাই ওর ঈশ্বর। তার সমর্পণ তাই শর্তাতীত, ভানহীন। বরং পিতার ওই তাকে লুফে নেওয়ার ভঙ্গিটির মধ্যে, সাফল্যের মধ্যে তারও সাফল্য মিশে আছে, শিশুটির হাসি বুঝিয়ে দেয়। সমস্ত বিপদের ভাবনা তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরভাবনার বীজতলা এমনই, সেখানে অনায়াসে বলা যায়,
তোমার জয় তো আমারি জয়
ধরা দেব, তোমায় আমি ধরব যে তাই হলে॥
এই গানটি লেখার আট বছর পরে রবীন্দ্রনাথের ৩৯টি গল্প সমন্বিত একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। নাম ‘লিপিকা’। গ্রন্থে অন্তর্গত গল্পগুলিকে রবীন্দ্রনাথ কথিকা বলতে পছন্দ করতেন। এমনই একটি কথিকা সওগাত। রবীন্দ্রনাথ সেখানে দেখান এক মা ও সন্তানের সম্পর্ক। মা তার অন্য সন্তানদের, যারা দূরে থাকেন, পুজো উপলক্ষ্যে সওগাত দিচ্ছেন। সওগাত যখন শেষ হয়ে যাচ্ছে তখন মায়ের নজর পড়ে ছোট সন্তানের উপর।
“ছেলে কাঁদোকাঁদো সুরে বললে, ‘সওগাত পাব না?’
‘যখন দূরে যাবি তখন সওগাত পাবি।’
‘আর, যখন কাছে থাকি তখন তোর হাতের জিনিস দিবি নে?’
মা তাকে দু হাত বাড়িয়ে কোলে নিলেন; বললেন, ‘এই তো আমার হাতের জিনিস।’
গানের বাণীই যেন অন্য একটি ফ্রেমে নির্মিত হলো। যে দূরে আছে, সে সুখে থাকুক, যে কাছের তার পাওনা সুখ নয়, কোল। এ তার হাতের জিনিস। আমার ধারণায় এই ছোট ছেলেটি বিষয়টি রূপকের সুন্দর আড়াল। ছোট মানে যে অশক্ত, অবলা, যে নিজেরটা বুঝে নিতে পারবে না, সমর্পণই যার নিয়তি, সে। অর্থাৎ একার্থে ক্ষমতাস্তম্ভের সবচেয়ে নীচুতলাও বটে। আজকের ভারতের সাপেক্ষে ধরে নিতে পারি দলিত মুসলমান। খেটে খাওয়া মানুষ। যারা মুখ বুজে কাজে যায় ফেরে। আদিতে, অনন্তে। একটি বিশ্বাস আঁকড়েই বাঁচা তো এই ছোট-র।
মনে পড়ে, কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে গানটির কথা-
কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে–
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।
ভুলে গেছি কবে থেকে আসছি তোমায় চেয়ে॥
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়॥
নোবেল প্রাপ্তির আগের লেখা গান। গীতাঞ্জলিতে অন্তর্ভুক্ত। এই গানেও দ্বিতীয় শব্দ ‘আমি’। কিন্তু এই আমি আর স্রেফ একজন আমি নয়। সমগ্র জীবের ওয়াননেস বোঝাচ্ছে এই আমি। আমার আসা তো আমার হাতে নেই, আমরা আসছি সেই ২০ লক্ষ বছর আগে থেকে। এই আমি নিত্য আবর্তনের শরিক, একটি বৃহৎ জীবনচক্রের অংশ। যে যায় আসে। যে ভাগ্যবান ও ভাগ্যহত। কারণ এই যাওয়া এবং আসায় তার হাত থাকে না। থাকে স্রেফ বিশ্বাস। অন্বেষণ। একটা খোঁজ। অসীমের সঙ্গে, বিপুলের সঙ্গে নিজেকে মেলানোর অভীপ্সা। গর্ভপথ থেকে জীবনের আলোয় আসা আর তারপর ছুটে চলা, প্রকৃতি থেকে তুলনা টেনে গানের কবি বলছেন,
ঝরনা যেমন বাহিরে যায়, জানে না সে কাহারে চায়,
তেমনি করে ধেয়ে এলেম জীবনধারা বেয়ে–
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়॥
কতই নামে ডেকেছি যে, কতই ছবি এঁকেছি যে,
কোন্ আনন্দে চলেছি তার ঠিকানা না পেয়ে–
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।
প্রশ্ন হলো যে আসে, কালের স্রোতে ভাসে, চলে যায়, সে কি তাকে পায়? কবে থেকে চাওয়া, কত নামে ডাকা, পেলেই তো সুখী হওয়া, চিরসুখের হাতছানি। এখানেও ক্রিয়াপদের ম্যাজিক। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন-
তেমনি তোমার আশায় আমার হৃদয় আছে ছেয়ে–
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়॥
লেখা শুরু করেছিলাম জ্বলে ক্রিয়াপদটি দিয়ে। এখানে লক্ষ করার, ছেয়ে ক্রিয়াপদটির প্রয়োগ। আকাশ মেঘে ছেয়ে থাকে। শব্দটির মধ্যে যেন একটা বিস্তার আছে। হৃদয়কে রবীন্দ্রনাথ আকাশই ভাবেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে কাফি রাগে বেঁধেছিলেন- কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না-গানটি। ২৫ বছর পরে তিনি লিখছেন, তেমনি তোমার আশায় আমার হৃদয় আছে ছেয়ে-। মনে হয় আশা যেন সেই মেঘ যা হৃদয়ের আকাশে আধিপত্য বিস্তার করছে একটু একটু করে। এই মেঘ কি বৃষ্টি আনবে? বৃষ্টি হবে দুঃখহরা? জন্ম নেবে সুখ? দেখার-পাওয়ার সুখ? রবীন্দ্রনাথ সুখসন্ধানের পথকে অস্বীকার করেন। পথচলাতেই তাঁর আনন্দ।
[1] বুদ্ধদেব বসু, রবীন্দ্রনাথের গান,কবিতা রবীন্দ্র-সংখ্যা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অশীতিতম জন্মদিনে প্রকাশিত, ২৫ বৈশাখ, ১৩৪৮ (৮ই মে ১৯৪১)। ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ- বিকল্প প্রকাশনী, কবিপক্ষ, ১৪১২
লেখক পরিচিতি – অর্ক দেব পেশায় সাংবাদিক। বর্তমানে ইনস্ক্রিপ্ট নামক গণমাধ্যমে সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের অতিথি অধ্যাপক, অতীতে কাজ করেছেন প্রখ্যাত সংবাদ মাধ্যমে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা ব্লুমসবেরি থেকে প্রকাশিত হয়েছে গবেষণাগ্রন্থ- কাজী নজরুল ইসলাম’স জার্নালিজম, এ ক্রিটিক৷ সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার সঙ্গে জুটি বেঁধে লিখেছেন- ফেসবুক: মুখ ও মুখোশ নামের একটি অন্তর্তদন্তমূলক গ্রন্থ। মান্দাস থেকে প্রকাশিত অর্কর উপন্যাস- দিয়েগো থেকে মারাদোনা পাঠকমহলে সমাদৃত। করোনাকালে প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ- অসুখী সময়ের বৃত্তান্ত। কবি তুষার রায়ের সামগ্রিক লেখালেখি এক জায়গায় করে গড়ে তুলেছেন ‘তুষার’। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ ‘কথাবার্তা’ ধরে রেখেছে বাঙালির ১০০ বছরের উল্লেখযোগ্য কথপোকথন।সম্পাদিত আরেকটি গ্রন্থ গণিকাসম্বাদ,পশ্চিমবঙ্গের তামাম যৌনপল্লির ইতিহাস ও বর্তমানের দলিল। বলিউড পরিচালক তিগমাংশু ধুলিয়ার দলে গবেষক হিসেবে কাজ করেন অর্ক। ইদানিং পডকাস্ট করছেন।
শেয়ার করুন :