দেবদূত ঘোষ ঠাকুর
আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যাদবপুরের অরবিন্দ নগরে। এটি একটি উদ্বাস্তু কলোনি। বেড়ার দেওয়াল, টিনের চাল। মাটির মেঝে। বাবা, কাকা- পিসি রা সর্বস্বান্ত হয়ে প্রায় এক কাপড়ে চলে এসেছিলেন এপার বাংলায়। সঙ্গে ঠাকুরদা,ঠাকুরমা। বিশাল যৌথ পরিবারে তেমন স্বচ্ছলতা ছিল না।
ভোর বেলা ঘুম ভাঙতো এক উদাত্ত গলায় ‘ওঁ জবাকুসুম’…. মন্ত্রোচ্চারণে। কখনও ‘তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে’ গানে। আমার পিতামহের গলার সেই স্লোক, কখনও বা রবীন্দ্রনাথ, অতুল প্রসাদ, রজনীকান্তের গান কানে যেতেই উঠে পড়তাম। দেখতাম বেড়ার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকে পড়েছে বিছানায়।
আমাদের যৌথ পরিবারের যে সব ভাইবোনের ঘুম তখনও ভাঙত না, তাঁদের জন্য ছিল আমার ঠাকুমার কর্কশ, বেসুরো কিন্তু কার্যকরী গলার ‘অ্যালার্ম বেল’-উঠোগো সোনার চাঁদ, সাত ঘড়ি বেজেছে। মাস্টার মশায় এসে বসে বসে রয়েছে। ও পাড়ার লালু- ভুলু পড়তে বসেছে। উঠোগো সোনার চাঁদ সাত ঘড়ি বেজেছে।’
এরপরে আর কারও বিছানায় শুয়ে থাকা সম্ভব হযত না। শুধু আমাদের বাড়ির নয়। আমাদের ওই কলোনির আশপাশের সব বাড়ির। আমাদের ছেলেমেয়েদের যখন ওই সময় শুয়ে থাকতে দেখি তখন ঠাকুমা, ঠাকুরদার কথা খুব মনে পড়ে।
ওই সাত সকালে ওঠার অভ্যাসটা যে কত উপকারী ছিল নরেন্দ্রপুরের হস্টেল জীবনে গিয়ে তা বুঝেছি। ওখানে সাড়ে পাঁচটা- ছটা নাগাদ ঘন্টা পড়ত। রাইজিং বেল। আমার মস্তিষ্কের রাইজিং বেল অবশ্য তার আগেই বেজে উঠত। ঠাকুরদার গলা পরিষ্কার যেন শুনতে পেতাম। চোখ খুলে যেতো। দেখতাম সূর্যের আলো ঘরে ঢুকবো ঢুকবো করছে। আর এই অভ্যাস আমাকে কখনও বাথরুমের সামনে লাইনে দাঁড়াতে দেয়নি। এখনও নয়।
জীবনশৈলির প্রথম পাঠের শিক্ষার জন্য ঠাকুরদা, ঠাকুরমার কাছেসঁপে দিয়ে বেশ নিশ্চিন্তেই ছিলেন আমার বাবা-মা। বাবা অস্বচ্ছল সংসারকে স্বচ্ছল করার লক্ষ্যে জীবন সংগ্রামের ব্রতী। আর মা আটকে হেঁসেলে। যৌথ পরিবারের হেঁসেল সামলানো কিন্তু সোজা কাজ নয়। ঠাকুমার কাছে আমরা যে ভালোই পাঠ নিচ্ছি সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন আমার মা। আমার ভাই একটু বড় হওয়ার পরেই আমরা অন্যত্র উঠে গিয়েছিলাম। ততদিনে ঠাকুরদাও গত হয়েছেন। আমার ছোটো ভাইয়ের ‘মাস্টার ক্লাসের’ সিলেবাস তাই বোধহয় শেষ হয়নি। আমার মাকে পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে আক্ষেপ করতে দেখেছি।
আমরা ঠাকুমার কাছে থেকে তাঁর জীবনের নানা উত্থান পতনের নানা রকম গল্প অবাক হয়ে হয়েছি। ওপার বাংলার বাসাইলের ডাকসাইটে জমিদার কন্যা সব হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে এক বস্ত্রে এপারে এসে হাসি মুখে সব কিছু মেনে নিয়েছিলেন। আর ভাগবৎ শাস্ত্রী ঠাকুরদা শ্রীকৃষ্ণের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে হাসি মুখে গাইতেন, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি যেন না করি ভয়’। কেউ ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞাসা করলে হাসিমুখে জবাব দিতেন, ‘খুব ভালো আছি’। ঠাকুরদার কাছ থেকে এই অল্পে সন্তুষ্ট থাকার শিক্ষাটা পেয়েছিলেন আমার বাবা। হয়তো অফিসে টালমাটাল অবস্থা চলছে, কেউ গুরুতর অসুস্থ, যে কোনও অবস্থাতেই কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করলে তিনিও জবাব দিতেন, ‘খুব ভালো আছি’। বাবার থেকে সেই অভ্যাসটা আমিও পেয়েছি। আর বাবার অভ্যাস অনুকরণ করে বুঝতে পেরেছি কেন বাবা এমনটা বলতেন।
যে কোনও পরিস্থিতিতে ‘খুব ভালো আছি’ বললে দেখেছি আত্মবিশ্বাস বাড়ে। পজিটিভ এনার্জি সক্রিয় হয়। বাবা বলতেন, যে কোনও কাজ তোমার নিজের বলে মনে করে সম্পাদন করলে সেই কাজ কখনোই আর কঠিন বলে মনে হয়না। এখনকার ছেলেমেয়েদের জন্য বড় কষ্ট হয়। তারা ঠাকুরদা –ঠাকুমা তো দূরের কথা, নিজের বাবা মায়ের সঙ্গেই বেশি কথা বলার সুযোগ পায়না। ছোটো থেকে দৌড়চ্ছে গোটা পরিবার। এক জন হিড় হিড় করে টানতে টানতে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন। অন্যজন স্কুল থেকে কোচিং ক্লাসে। সেখানে থেকে বাড়ি ফিরে হোম ওয়ার্ক। তারপরে ডাইনিং টেবিল, বিছানা। বাবা-মা কে নিজের সমস্যার কথাটা পর্যন্ত বলতে পারছেনা ছেলেমেয়েরা। ছুটির দিনে যদিও বা হয়তো বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় মিলছে, কিন্তু বাবা-মা তাদের ব্যক্তিগত সময় কাটাতে চাইছেন অন্য ভাবে। বাচ্চাদের বসিয়ে দিচ্ছেন টিভির সামনে কিংবা হাতে গুঁজে দিচ্ছেন মোবাইল। কারণ একান্নবর্তী পরিবারে তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ ঠাকুরদা- ঠাকুরমা অনুপস্থিত।
ভাগ্যক্রমে একটা ‘অসাধারণ’ প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। বিজয়গড় কলোনির ‘শিশুর দেশ’। সে ছিল এক রূপকথার জগৎ। লোকে বলত প্রিন্সিপালের স্কুল। আমরা সেখানে খেলতে খেলতে, প্রকৃতিকে চিনতে চিনতে পড়তাম। ষাটের দশকে এমন বিজ্ঞানসম্মত প্রাথমিক স্কুলের কথা এখনও আমরা ভাবতেই পারিনা। একটা শিশুর মধ্যে থেকে প্রতিভা বের করার এমন আধুনিক প্রয়াস ছাল সেখানে, এখনও আমাকে চমকে দেয়। মা-ঠাকুমার মাস্টার ক্লাস যথাযথ কী না তা বিচার করে ওই স্কুলে সে সময় ছাত্র ভর্তি করা হযত। যাতে গড়ে পিটে নিতে সুবিধা হয়। এই যে এখন পরিবেশ নিয়ে এখানে ওখানে বক্তব্য রাখছি , ছাত্র পড়াচ্ছি তার ভিত্তি গাছের প্রতি আমার মায়ের ভালোবাসা আর ওই শিশুর দেশের প্রতিপালন। ওই শিক্ষায় ভর করে নরেন্দ্রপুর স্কুলের আবাসিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি খুব সহজেই। পরবর্তী জীবনে তার তর করে এগিয়েও গিয়েছি।
আর এখন?
বাচ্চাদের সামনে এখন মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার সব মজুত। বর্হিবিশ্বটা তাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু আসল শিক্ষাই তাদের হয়নি। সামান্য প্রতিকূলতায় তারা ভেঙে পড়ে।অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সঙ্গে লড়ার সামর্থ না থাকায় তারা দিকভ্রান্ত। ঔদ্ধত্য আর শৃঙ্খলাহীনতা তাই বোধ হয় তাদের গর্ব।
জীবনের সাড়ে ছয়টি দশক কাটিয়ে এখনও মনে হয় আরো কিছু কাজ করার বাকি আছে। অনেকে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের অনেকেই এই জীবনীশক্তির প্রতি ঈর্ষাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। যৌথ পরিবারের শিক্ষা আমাদের প্রজন্মের যাঁরা যথাযথ ভাবে নিতে পেরেছি, তাঁদের কাছে প্রতিকূলতা জয় করার মানসিকতাই ভালো থাকার চাবিকাঠি।
এখন ছোটোবেলা থেকেই জীবনটা বড় বেশি যান্ত্রিক। হাসি, ঠাট্টা, ভালোবাসা সব কিছুই যান্ত্রিক। একমাত্র বন্ধু মোবাইল, ট্যাব, কম্পিউটার। গল্প শোনা, গল্প পড়া-সবই এখন বোতাম টিপে। যন্ত্রের সঙ্গে মিশে আজ ছেলেমেয়েরাও যান্ত্রিক। ঘুরিয়ে বলতে হয় অমানবিক। মানুষের সুবিধা, অসুবিধা, ভালো মন্দ তাঁদের এতটুকুও বিচলিত করেনা। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। দেখা যাবে যন্ত্র নয়, ওই ব্যতিক্রমীরা বেড়ে উঠেছেন মানুষের সাহচর্যে।
সম্প্রতি রাজ্যের এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংবাদ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের কাছে বক্তব্য রাখছিলেন এক আন্তর্জাতিক পর্যায়ের চিত্র পরিচালক। বিষয় সামাজিক মাধ্যম বা সোস্যাল মিডিয়া। সেই প্রসঙ্গে এল গেমিং-য়ের কথা। চিত্র পরিচালক বললেন, গেমিং মানেই যেন ধ্বংস লীলা। যে সব কিশোর–কিশোরী, তরুণ–তরুণী মোবাইলে গেম খেলে তাদের অঙ্গভঙ্গি লক্ষ্য করেছেন কখনও? কে কত তাড়াতাড়ি কত ট্যাঙ্ক ধ্বংস করতে পারছে, কে কত সহজে প্রতিদ্বন্দ্বীর গাড়ি ছিটকে দিতে পারছে সেটাই মূল লক্ষ্য। উত্তেজনায় তার চোখ যেন ছিটকে বেরিয়ে আসছে। আর যখন লক্ষ্যে পৌঁছানো যাচ্ছেনা, হতাশায় ভেঙ্গে পড়ছে। ধাতস্থ হঢয়ে ফের ডুবে যাচ্ছে মোবাইলের স্ক্রিনে। বাবা মায়ের আক্ষেপ, ‘আহা, এই লক্ষ্যভেদ করার রোখটা যদি সব ক্ষেত্রে থাকত!’
শুধু গেম কেন, সামাজিক মাধ্যমের অন্য সব হাতিয়ার ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ইনস্টাগ্রামও কম বেশি একই দোষে দুষ্ট। তবে ঋণাত্মক বিষয় নিয়ে চর্চার ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি অভিযোগ ফেসবুককে ঘিরে। শুধু কি তাই, পোস্ট করা ছবি বা বার্তায় আশানুরূপ মানুষ ‘লাইক’ না দেওয়ায় মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া, এমনকী আত্মহত্যার ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। আর এই তালিকায় তরুণ-তরুণীরা সংখ্যা গরিষ্ঠের নিরিখে অনেকটাই এগিয়ে।
এক তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সেদিন বলছিলেন, ফেসবুক ব্যবহারকারী ৩০ ভাগ তরুণ-তরুণী অন্যকে নিয়ে মজা করেন৷ তারা ট্রল করেন৷ সেটা এক সময় মানসিক নিপীড়নের চেহারা নেয়। অনেক ক্ষেত্রেই ট্রোলড হওয়া ব্যক্তি মানসিক ভারসাম্য পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেন। ওই ব্যক্তির এই ‘অসহায়’ অবস্থা দেখেও কিন্ত ট্রোল করা বন্ধ হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। এটাও একরকম মানসিক বিকৃতি।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বড় একটি অংশ আবার বেশ গুরুগম্ভীর৷ তারা ফেসবুকের মাধ্যমে সমাজে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে চায়৷ এমনকি ফেসবুকে তারা বানান কিংবা ব্যকরণ নিয়েও কথা বলে৷ তবে বাস্তব জীবনে তারা কিন্তু এতটা সক্রিয় নয়৷ অল্প সংখ্যক আছেন, যারা নানা সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত৷ তারা মূলত ফেসবুকে তাদের কাজের প্রচার চালায়৷ এরা বাস্তব জীবনে বেশি সক্রিয়।
ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ‘তৎপরতা’ বিশ্লেষণ করে তথ্যপ্রযুক্তির গবেষকেরা দেখেছেন, তরুণদের বড় একটি অংশ অস্থির৷ সে কারণেই এক-দুই লাইনের স্ট্যাটাস জনপ্রিয় হয়৷ আর অনেকেই না পড়ে লাইক দেয়৷ না বুঝেও লাইক দেয়, শেয়ার করে৷ তবে এই অস্থিরতার কারণ ফেসবুক নয়৷ আমাদের সমাজেই অস্থিরতার কারণ লুকিয়ে আছে৷
এখনকার তরুণতরুণীরা কেন এভাবে সামাজিক মাধ্যম- নির্ভর হয়ে পড়ল তরুণ- তরুণীরা? সমাজ বিজ্ঞানের এক অধ্যাপক বলছিলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় মাঠে যেতাম৷ এখন মাঠ নেই৷ শিশুরা ঘরে থাকে৷ এখন তাদের বিনোদনের মাধ্যম বলতে সোশ্যাল মিডিয়া৷ সেখানে তারা চ্যাট করছে, আড্ডা দিচ্ছে৷ এর ফলে ব্যক্তি যোগাযোগ ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷’
এক সমাজবিজ্ঞানী জানাচ্ছেন, এই সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব সহজেই মেয়ে বন্ধু পাওয়া যায়, ছেলেবন্ধু পাওয়া যায়৷ এই যোগাযোগের জন্য মানুষের আবেগ একটা জায়গায় আবদ্ধ থাকছে না৷ ভুল সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে অনেকে প্রতারিত হচ্ছেন। একটা সংসার ছারখার হয়ে যাচ্ছে। অনেকে এই সমাজ মাধ্যমে নিজেরা একটা দল তৈরি করে। দলগুলি মেয়েদের টার্গেট করে, গৃহবধুদের টার্গেট করে৷ দীর্ঘদিন ধরে একটা সম্পর্ক তৈরি করে, এরপর তারা অনৈতিক সম্পর্ক করে এবং সেটা ভিডিও করে পরে ব্ল্যাকমেল করছে৷ এক আইনজীবী এমন এক মহিলার কথা শুনিয়েছেন যিনি এরকম এক আবেগের চক্রে জড়িয়ে পড়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টটিও তাদের লিখে দিয়েছিলেন৷ তাতেও নিষ্কৃতি পাননি৷ সমাজ মাধ্যমের ওই দুষ্টচক্র তাকে উত্তক্ত করে গিয়েছে। শেষমেষ মহিলার ঠাঁই হয়েছে মানসিক হাসপাতালে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যে তরুণরা আগ্রহী হচ্ছে তার পেছনে কিসের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি?
আসলে আমরা সবাই কিন্তু নিজের কথাটা অন্যের কাছে বলতে চাই৷ এই শেয়ার করার প্রবণতা আগেও ছিল৷ আগে হয়ত এটা বন্ধু–বান্ধবের কাছে বলত৷ এখন সেটা সে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দিয়ে দিচ্ছে৷ সেটা দেখে অনেকে কমেন্ট করছে, অনেক রকম মন্তব্য হচ্ছে৷ সবার হাতেই যেহেতু এখন স্মার্টফোন আছে, সেই ফোনের ব্যবহার এক্ষেত্রে বেশি হচ্ছে৷ মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতার কারণে আমাদের অনুভূতিগুলি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে৷ পাশাপাশি
তরুণরা এমন সব ওয়েবে ঢুকে যাচ্ছে, সেখানে পেশাদার নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত তারা উপভোগ করছে। আসলে আমাদের জীবনশৈলি সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের সঠিক শিক্ষা না দেওয়াতেই ঘুরপথে চটজলদি সব কিছু জেনে ফেলার প্রবণতা বেড়েছে। এতে তরুণ সমাজকে দোষারোপ করা যায়না। তবে সোস্যাল মিডিয়ার সুযোগটা তারা নিচ্ছে। তারপরে নিজেদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে চর্চা করছে। তাদের অনেকেরই বাস্তব জৈবিক চাহিদা বিকৃত হচ্ছে৷ সমাজবিজ্ঞানের এক গবেষিকার মূল্যায়ণ, এইসব সাইটে ঢুকে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ক্ষতিটা হচ্ছে বেশি৷ একটা মেয়ের ঋতুচক্র শুরু হওয়ার সময় আগে ছিল১৩ থেকে ১৫ বছর। এখন অনেক ক্ষেত্রেই সেটা ৮ থেকে ৯ বছরেই হয়ে যাচ্ছে৷ সমাজ মাধ্যমে বিভিন্ন চর্চায় তারাও যোগ দিচ্ছে। অনেকের মধ্যেই তার মধ্যে একটা যৌন চাহিদা তৈরি হচ্ছে৷ তখন সে হয়ত ফেসবুকের সুবাদে খারাপ চক্রে পড়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়ে যাচ্ছে৷
তবে সোশ্যাল মিডিয়ার সবই যে খারাপ তা তো নয়৷ এখানে ভালো-খারাপ দু’টোই আছে৷ তবে সবচেয়ে খারাপ যেটা, সেটা হলো, আমাদের তরুণরা অলস হয়ে যাচ্ছে৷ তাদের শরীরের কর্মক্ষমতা অনেক কমে যাচ্ছে৷ তাদের উল্লাস করার ক্ষমতা বা হইচই করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে৷ তাদের মানসিক শক্তি কমে যাচ্ছে৷ যখনই তারা কোনো স্ট্রেসে পড়ে, সেটা থেকে উঠতে পারে না৷ আমরা যখন ছোটবেলায় মাঠে খেলতে গেছি, তখন হেরে গেলে সেটা সহ্য করার শক্তি অর্জন করেছি, আবার জিতে গেলে সেটা ধারণ করার শক্তিও অর্জন করেছি৷ এখন যেটা হচ্ছে, আমাদের ক্রিকেট দল হেরে গেলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভয়ংকরভাবে গালিগালাজ করা হচ্ছে৷ আবার জিতে গেলে রাস্তায় মিছিল নিয়ে বের হচ্ছে৷ মানে, এই হার-জিতের মধ্যে কোনো ভারসাম্য নেই৷ বিশেষ করে পরাজয় বরণ করার মতো কোনো শক্তিই তাদের মধ্যে নেই৷ খেলাধুলার মাধ্যমে ছোটবেলা থেকে হার-জিতের শক্তি সঞ্চিত হয়৷ এই সঞ্চয় তরুণ প্রজন্মের কম হচ্ছে৷ এতে করে তারা ছোটখাটো বিপর্যয়েও ভেঙে পড়ছে৷
তবে এই সমাজ মাধ্যমের উপকারী দিকগুলি উল্লেখ না করলে এই প্রতিবেদন পক্ষপাতপূর্ণ হয়ে যাবে। যেমন বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির এক গবেষক একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘সমাজ মাধ্যমে যারা বই পড়ে, তাদের একটা গ্রুপ আছে৷ ওই বইগুলোতে কী আছে সেগুলো নিয়ে তারা আলোচনা করছে৷ আমি নিজেও এই ধরনের গ্রুপে ঢুকে ওদের আলোচনাগুলো দেখি৷ ওরা এমন সব বই পড়েছে যে বইগুলো দুর্লভ৷ আমি তাদের আলোচনা দেখে সমৃদ্ধ হই৷‘ পীড়িত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, নির্যাতিতা মেয়েদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো, রক্তদান, চক্ষুদান নিয়ে আন্দোলন গড়া– এ সব নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অনেক গ্রুপ রয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তির এক অধ্যাপক বলেন, ‘যেমন ধরুন আপনার একটি বই বের হয়েছে৷ সেটা আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে দিলেন, আপনার পাঁচশ বন্ধু সেটা দেখল, তারা বইটা নিয়ে সমালোচনা করল, আলোচনা করল, তাতে আপনি সমৃদ্ধ হলেন। আবার আপনার বন্ধুরা অন্যদের এই বইয়ের কথা ছড়িয়ে দিলেন। তাতে পাঠক সংখ্যা বাড়ল।’
করোনার দুই বছর এই সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ অনেককে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। অনেক ছোট ব্যববসায়ী সামাজিক মাধ্যমে যুক্ত থাকায় নিজেদের ছোট্ট ব্যবসাকে সমৃদ্ধশালী করেছে।
কিন্তু এই মাধ্যমের ক্ষাতিকারক দিকগুলি তরুণ সমাজে বেশি প্রভাব ফেলাতেই যতো সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের প্রতিবেদন লিখতে হচ্ছে।
যে ঘটনা দিয়ে এই লেখার সূত্রপাত, পরিশেষেও সেই প্রসঙ্গের অবতারণা করতে হচ্ছে। গেমিংয়ের অপকারিতা নিয়ে বলতে বলতেই ওই চিত্র পরিচালক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন ছাত্রছাত্রীদের কাছে, ‘সোস্যাল মিডিয়া হোক, বা গেমিং আমরা কি অভিমুখটা ঋণাত্মক (নেগেটিভ) থেকে ধনাত্মকে (পজিটিভ) রূপান্তরিত করতে পারি না? কী ভাবে? তাঁর জবাবও দিয়েছেন পরিচালক। বললেন, ‘খেলাটা এমন কেন হয়না যে আমরা মজে যাওয়া সরস্বতী নদীর উৎস খুঁজে বের করি, কিংবা খুঁজে বের করি মাতলা নদীর উৎসটা ঠিক কোথায়!
আসুন ছোটোদের সামাজিক মাধ্যমের ধনাত্মক (পজিটিভ) কার্যকারিতা নিয়ে তরুণ সমাজকে আমরা উদ্বুদ্ধ করি। ওদের বিভ্রান্তি দূর করি।
শেয়ার করুন :