লাল মৃত্যুর মুখোশ -

অলংকরণ -শুভেন্দু সরকার

লাল মৃত্যুর মুখোশ

… মৃদু গুঞ্জরণ আরম্ভ হল… এ লোকটা কে? এ লোকটা কে? এ লোকটা কোত্থেকে এল?

এডগার অ্যালান পো-র ‘দ্য মাস্ক অফ দ্য রেড ডেথ’  ভাষান্তর:সন্মাত্রানন্দ   

সারা দেশটাকে বহুদিন ধরে তছনছ করে দিচ্ছিল ‘লাল মৃত্যু’-নামের অসুখ। এর আগে কখনও কোনো মহামারীর প্রকোপ এত বিধ্বংসী, এত ভয়ানক হয়ে ওঠেনি। এ রোগের লক্ষণ হচ্ছে অবিশ্রান্ত রক্তপাত আর এর অমোঘ চিহ্ন—লালিমা ও ভীতিপ্রদ রক্তক্ষরণ। প্রথমে শরীরে তীব্র যন্ত্রণা, হঠাৎ মাথা ঘুরতে থাকা, তারপর শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবিশ্রান্ত রক্তস্রাব, শেষে অনিবার্য মৃত্যু। সারা শরীরে, বিশেষত রোগীর মুখমণ্ডলে রক্তের কালচে দাগ ফুটে উঠে সংক্রামক মারণ-জীবাণুর আক্রমণ নিশ্চিত করে দেয়; আত্মীয়-স্বজন সংক্রমণের ভয়ে দূরে পালায়, সেবা ও সহানুভূতি পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনাই থাকে না। এবং এই রোগের আক্রমণ, রোগবৃদ্ধি এবং অন্তিমে মৃত্যু—সবটাই মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে ঘটে যাচ্ছিল।                  

অথচ এমন অবস্থাতেও রাজপুত্র প্রসপেরো কিন্তু একেবারে দিব্যি ফূর্তিতে, নির্ভয়ে, বিন্দাস মেজাজে দিন কাটাচ্ছিল। যখন তার রাজ্যের আদ্ধেক লোক মরে ঢিবি হয়ে গেল, তখন রাজপুত্র তার রাজসভার নাইট আর সুন্দরীদের মধ্য থেকে হাজারখানেক চমচমে, আমোদগেড়ে-গোছের লোক বেছে নিয়ে দুর্গজাতীয় এক মঠে নির্জনে বসবাস করতে চলে গেল।         

বিস্তৃত, বিপুল সেই প্রাসাদ—রাজপুত্র প্রসপেরোর নিজস্ব পাগলাটে অথচ মহিমামণ্ডিত মেজাজের সৃষ্টি। সুদৃঢ়, সমুচ্চ প্রাকার দিয়ে ঘেরা সমস্ত কেল্লাটা। প্রাকারের গায়ে আবার লোহার সিংদরজা; সেখানে কেউ প্রবেশ করে সাধ্য কী! দুর্গে প্রবেশ করে সভাসদরা বড়ো বড়ো আগুনের চুল্লি আর হাতুড়ি নিয়ে এসে দরজার বড়ো বড়ো খিল কীলক গড়াই-পেটাই করতে লাগল। মনে কোনো হতাশা বা উন্মত্ততা ঢুকবার বা মন থেকে ওসব বেরোবার সমস্ত পথ তারা অবরুদ্ধ করে ছাড়ল। দুর্গের ভেতরেই যাবতীয় ভোগসুখের ঢালাও ব্যবস্থা, কাজেই বাইরে যাওয়ার কোনো দরকারই নেই। সর্বপ্রকার সাবধানতা অবলম্বন করে সভাসদরা সংক্রমণকে দুর্গের বাইরেই ঠেকিয়ে রেখে ভাবল, খাও, পিও আর মজা করো! ও বাইরের জগৎ তার নিজের মামলা নিজেই সামলাক গে!        

এর মধ্যে শোক বা চিন্তা করা বেজায় বোকামো, দুর্গের ভেতরেই রাজপুত্র যেখানে ভোগবিলাসের সমস্ত আয়োজন করে রেখেছে। দুর্গে ভাঁড় আছে, নকলনবিশ আছে, ব্যালে নর্তকীরা আছে, গায়ক-গায়িকা, সুন্দরী নারী, মদের ফোয়ারা—হে হে, সবই যাকে বলে একেবারে রীতিমতো মজুত! এসব তো আছেই, তার উপরে আছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। দুর্গের বাইরে টহল দিয়ে বেড়াক ‘লাল মৃত্যু’-মহামারী!           

দুর্গে বসবাসের পাঁচ কি ছয় মাস গত হয়েছে, বাইরে তখন মহামারীর যমযন্ত্রণা তুঙ্গে; রাজপুত্র প্রসপেরো দুর্গের বাসিন্দা সেই হাজারজন আমোদগেড়ে লোকের বিনোদনের জন্যে মুখোশ-নাচের অভূতপূর্ব আয়োজন করল।             

সে মানে যাকে বলে একেবারে ধ্বকধ্বকে উত্তেজক দৃশ্য—সেই মুখোশ-নাচ। কিন্তু সেসব কথা পরে হবে, যে-ঘরগুলোতে এই নাচবাহানাটা হচ্ছিল, সেই ঘরগুলোর কথাই আমি আগে বলব।

মোট সাতটা বড়ো বড়ো ঘর। এ ধরনের প্রাসাদে সাধারণত এরকম বড়ো বড়ো ঘর সোজাসুজি একই সরলরেখায় থাকে, ঘরগুলোর মধ্যেকার দরজার পাল্লা দু’পাশের দেওয়ালের দিকে সড়াৎ করে সরে গিয়ে দীর্ঘ উন্মুক্ত অলিন্দের আভাস রচনা করে; ফলতঃ এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত কোথাও দৃষ্টি অবরুদ্ধ হয় না। কিন্তু এ প্রাসাদের ঘরগুলির বিন্যাস ওরকম সরলরৈখিক নয়। তা অবশ্য হওয়ারই কথা, কেননা ‘কর্তা যিনি, ক্ষ্যাপা তিনি ক্ষ্যাপার মূলাধার’ প্রসপেরো; কাজেই তার কিম্ভূতকিমাকার কল্পনার ফল যে প্রাসাদের গঠনশৈলীর উপরেও এসে পড়বে, তাতে আর সন্দেহ কী? প্রাসাদের ঘরগুলো এমনই উদ্ভটমার্কাভাবে এলোমেলো সাজানো যে, এক জায়গা থেকে এক নজরে একটা ঘরের বেশি কিছু দেখাই যায় না। বিশ ত্রিশ গজ অন্তর অন্তর দেওয়ালের গায়ে একটা করে তীব্র কৌণিক মোচড় এবং প্রত্যেকটি মোচড়ে এক-এক প্রকারের উদ্ভাবনী কৌশল। প্রত্যেক দেওয়ালের মধ্যিখানে ডাইনে বাঁয়ে একটি করে গথিক স্থাপত্যের জানালা; জানালার ওপারে বদ্ধ বারান্দা—দেওয়াল যেমন যেমন বাঁক নিয়েছে, বারান্দাগুলোও অমনই ব্যাঁকাত্যাড়া হয়ে যে যার নিজের জায়গা ঠিক করে নিয়েছে। জানালাগুলোতে রঙিন কাঁচ বসানো, প্রতিটি কক্ষের জানালার কাঁচের রং কক্ষটির গৃহসজ্জার রঙের অনুরূপ। যেমন ধরা যাক, একেবারে পুব দিকের ঘরটার সবকিছু—দেওয়াল, আসবাবপত্তর সবই নীল; তার জানালার কাঁচও নীল। পরের কক্ষে দেওয়ালের পর্দা, অলংকরণ সব গোলাপি—জানালার কাঁচও গোলাপি। তৃতীয় কক্ষটি সবজেটে, জানালাটাও সবুজ। চতুর্থ কক্ষের অঙ্গসজ্জা কমলা রঙের, এমনকি সে-কক্ষের আলোটাও কমলা রঙের। এইভাবে পঞ্চম কক্ষ সফেদময়, ষষ্ঠ কক্ষ বেগুনিময়। একেবারে শেষ কক্ষ, মানে সপ্তম কক্ষটির ছাদ, দেওয়াল সমস্ত কালো ভেলভেটের ভারী পর্দা দিয়ে ঢাকা, পর্দা ভাঁজে ভাঁজে কার্পেটের উপর এসে লুটিয়ে পড়েছে; কার্পেটের রঙও এ ঘরের ঘোর কালো। কিন্তু জানালার কাঁচের ব্যাপারে ব্যতিক্রম ঘটেছে শুধু এই ঘরটাতেই। এ ঘরের জানালাটার কাঁচের রং কালো নয়। জানালার রং টকটকে লাল—গাঢ় রক্তবর্ণ।                     

এখন এই সাতটা ঘরের একটাতেও কোনো আলো কিংবা বাতিদান নেই। ঘরের মধ্যে সোনাদানার অলংকার এলোমেলো বহুৎ ছড়ানো আছে, ছাদ থেকেও ঝুলছে অলকা-তিলকা কত কিছু, অথচ একটা ঘরেরও চার দেওয়ালের মধ্যে আলো কিংবা বাতি কিচ্ছুটি নেই। আলো যা আছে, তা হচ্ছে ওই জানালার ওপাশের বদ্ধ বারান্দাগুলোতে। একেকটি জানালার ওদিকে একটি করে ওজনদার তিনপেয়ে আলোকস্তম্ভ, তাতে দাউ দাউ করে জ্বলছে মশাল, আর সেই মশালের তীব্র আলো জানালার রঙিন কাঁচের মধ্য দিয়ে ঘরের ভিতরে এসে ঘরটাকে সমুজ্জ্বল করে রেখেছে। ফলতঃ ঘরের মধ্যেকার মানুষ ও জিনিসপত্তরের জাঁকালো, অদ্ভু্ত, মজাদার সব অতিকৃত আকার ফুটে উঠছে।      

কিন্তু একেবারে শেষের ঘরটা, মানে পশ্চিমদিকের সেই কালো ঘরটা—সেটাতে গাঢ় রক্তরঙা লাল কাঁচের জানালা দিয়ে মশালের আলো ভেতরে ঢুকে ঘরের কালো দেওয়াল, কালো মেঝের উপর এসে পড়ে ঘরটাকে যেন একেবারে আতঙ্কজনকভাবে বীভৎস করে রেখেছে; এতটাই বীভৎস যে, পারতপক্ষে ও ঘরের ভেতরে রাজপুত্র প্রসপেরো-র প্রিয় সভাসদদের কেউই কখনও পা রাখতে সাহ্স করে না। 

এই ঘরটাতেই পশ্চিমের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আবলুশ কাঠের বিশাল একটা ঘড়ি। ঘড়িটার পেন্ডুলাম এপাশ ওপাশ দুলতে দুলতে ভোঁতা, ভারী, একঘেঁয়ে শব্দ করে চলেছে। মিনিটের কাঁটা ঘড়ির চারপাশে যখন একপাক খেয়ে আসে, ঘণ্টা পূরণ হয়, ঘড়িটার পিত্তলনির্মিত ফুসফুস থেকে স্পষ্ট, গমগমে, গম্ভীর এবং যথেষ্ট সাংগীতিক মূর্ছনা নিঃসৃত হয়। তবু সে এমনই একটা অদ্ভুত জোরালো সুর যে, প্রত্যেক ঘণ্টায় ঘড়ির সেই আওয়াজে অর্কেস্ট্রার গায়নদার বাজনদারেরা গাইতে গাইতে বাজাতে বাজাতে হঠাৎ চুপ মেরে যেতে বাধ্য হয়। নাচুনেরা নাচের বিভঙ্গ মাঝপথেই থামিয়ে ফেলে। সমস্ত উল্লাসের মাঝে যেন নেমে আসে মুহূর্তের ছন্দপতন। এবং যতক্ষণ ধরে ঘণ্টা বাজতে থাকে, যে-লোকটা সবচেয়ে বেশি মাতাল হয়েছে, সবচেয়ে সে-ই ফ্যাকাশে মেরে যায়। আর যারা বুড়োটে, হাবড়াটে, ঠান্ডাগোছের লোক, তারা ওই শব্দের অভিঘাতে কপালে হাত বুলোতে বুলোতে কী যেন কী কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় গম্ভীর হয়ে এতোল-বেতোল কীসব ভাবতে লেগে যায়। কিন্তু ঘড়ির আওয়াজের শব্দ যখন একেবারে থেমে যায়, অমনি সভার মধ্যে একযোগে হাসির হররা উঠে আসে; এ ওর মুখের দিকে চেয়ে নিজেদের এই মৌহূর্তিক ভয় আর নির্বুদ্ধিতা নিয়ে যেন মস্করা করে। ফিসফিস করে এ ওর কাছে শপথ নেয় এই বলে যে, পরের বার ঘড়ির ঘণ্টা শুনে আর এরকম ভয়টয় পাবে না। অথচ আবার ষাট মিনিট অর্থাৎ কিনা তিন হাজার ছ’শো সেকেন্ড পরে ঘড়ি যেই না বেজে ওঠে, অমনই আবার সেই একই ভয়, একই কাঁপুনি, সেই একই ত্রস্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় যা-তা একটা অবস্থা!   

কিন্তু এসব সত্ত্বেও মোটের উপর আনন্দ ফূর্তি বেশ জমেই উঠেছিল। রাজকুমারের পছন্দ সব জবরদস্ত; রং ঢং রুচি সমস্তই মিহি। নিছক ফ্যাশনবন্দী কেতায় প্রসপেরো-র অরুচি; তার পরিকল্পনাগুলো সব সাহসী আর জ্বালাময়ী, ভাবনাচিন্তা সমস্তই বর্বরোচিত উজ্জ্বলতায় দেদীপ্যমান। কেউ কেউ তাকে ভাবত পাগল, কিন্তু তার বশংবদ অনুচরেরা ওকথা মনেও স্থান দিত না। তাকে দেখলে, শুনলে, ছুঁলে—অর্থাৎ কিনা রাজপুত্তুরের সঙ্গে দহরম-মহরম থাকলে কেউ তাকে অন্তত পাগল বলত না।          

এই উৎসব উপলক্ষ্যে সাত কক্ষের সাত রকম অলংকরণ, মুখোশধারী নর্তক-নর্তকীদের বেশবাস সব কিছুই রাজকুমার প্রসপেরোর বিচিত্র রুচিমাফিক। সেসব রংচং যে যথেষ্ট কিম্ভূতকিমাকার হয়েছিল, তাতে আর সন্দেহ কী? চোখ-ঝলসানো চমক, চপলতা, উদ্ভট কল্পনা সবই এসে মিশেছিল এই মুখোশ-নাচের আঙ্গিকে; যার অনেকটাই ভিক্তর হুগোর ‘হারনানি’ নাটকের মধ্যে দেখা গিয়েছিল এর আগে। বেমিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর বেঢপ সাজসরঞ্জামের লতাপাতাসমন্বিত কারুকাজ-করা বিচিত্র সব আকার, পাগলের মতন সব উদ্ভট কল্পনায় ভরে থাকা সেই নাচের অনুষ্ঠান— যার মধ্যে অনেকটাই সুন্দর, অনেকটাই বিশৃঙ্খল, অনেকটাই বিকট, কিছুটা বা ভয়ানক, এবং বিরক্তকর উপাদানও যে খুব কম ছিল, তাও বলা যায় না।

এই সাতটা ঘরের মধ্যে যেন বিচিত্র স্বপ্নসমূহ এদিক থেকে ওদিকে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। এবং এরা—এই সমুদায় স্বপ্ন সামনে পেছনে পাক খাচ্ছিল ঘরগুলোর রং নিজেদের শরীরে শুষে নিয়ে, তাদের নাচের তাল আর পায়ের চাল নিয়ন্ত্রণ করছিল অর্কেস্ট্রার খামখেয়ালি বাজনা। এবং কিছুক্ষণ পরে পরে হঠাৎ অন্তপ্রান্তের সেই কালো কক্ষের আবলুশ কাঠের ঘড়ি বেজে উঠছিল… ঢং ঢং ঢং… এবং তখন… এক মুহূর্তের জন্যে সমস্ত চুপচাপ, সমস্ত স্থির, শুধু সেই ঘড়িটার গম্ভীর আওয়াজ, আর কিছু নয়… যেন এক লহমায় এই সব স্বপ্নরা পাথর হয়ে গেছে। কিন্তু একটু পরেই যখন ঘণ্টাধ্বনি-প্রতিধ্বনি মরে আসছিল… একটি লহমার নিস্তব্ধতা শুধু…তারপর আবার সেই হালকা হাসির চাপা ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল…আবার উত্তাল হয়ে উঠছিল জীবনসংগীত, স্বপ্নগুলো জীবন্ত হয়ে উঠছিল আবার, আগের থেকেও অনেক বেশি উদ্দাম হয়ে উঠছিল নাচের চলন, জানালার ওদিকে দাঁড়িয়ে থাকা তেপায়া স্তম্ভের উপর মশালের আলো ঘরের রঙিন কাঁচের মধ্য দিয়ে পরিশ্রুত হয়ে স্বপ্নসমূহের গায়ের উপর এসে পড়ে আরও রঙিন, আরও বর্ণোজ্জ্বল করে তুলছিল তাদের।         

কিন্তু পশ্চিমদিকের সেই কালো ঘর, সেখানে মুখোশধারীদের কেউ প্রবেশ করতে সাহস করছিল না। এদিকে রাত নিবিড় হচ্ছে, রক্তাভ জানালার কাঁচের মধ্য দিয়ে চুনিরঙা আলো চুঁইয়ে পড়ছে কালো ভেলভেটের বিমর্ষতার উপর। কার্পেটের উপর দুয়েকটি পায়ের স্পর্শে কখনও কখনও আবলুশ কাঠের সেই বিশালাকার ঘড়ির ভেতর থেকে চাপা একটা আর্তনাদ উঠে আসছিল, অন্যান্য কক্ষসমূহের ভিতর বহে চলা আমোদ-আহ্লাদের থেকেও গভীরভাবে মর্মস্পর্শী সেই নিহিত বিষাদ।

সে যাই হোক, অন্যান্য ঘরগুলোতে কিন্তু মানুষের সন্নিবিষ্ট ভিড়; জীবনের উদগ্র উচ্ছ্বাস বল্‌গাহীনভাবে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে বহে চলছিল। উৎসবের সেই জাঁকজমক চলতেই লাগল, যতক্ষণ না ঘড়িটাতে মধ্যরাত্রির ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠে। আমি আগেই যেমন বলেছি, ঘণ্টা বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই গান থেমে গেল, শান্ত হয়ে গেল নর্তক-নর্তকীদের বিভঙ্গ, সব কিছু সহসা নিস্তব্ধ যাওয়ার সেই অসহজ আড়ষ্ট অনড় এক নৈঃশব্দ্য। অন্যান্য প্রত্যেক ঘণ্টাতেই যে এটা হচ্ছিল, হ্যাঁ, আমি তো তা আগেই বলেছি, তবে এবারে একটু বিশেষ—কেননা এবার ঘড়িতে পরপর বারোটা ঘণ্টা বাজার আওয়াজ… এবং সম্ভবতঃ তার ফলেই চিন্তা করার আরও একটু বেশি সময়… উল্লাসকারীদের মধ্যেও যারা একটু অধিক চিন্তাশীল, তাদের জন্যে আত্মনিমগ্ন হওয়ার আরও অধিক অবসর। আর সেই অবসরের মধ্যে যখন অন্তিম ঘণ্টাধ্বনির শেষ প্রতিধ্বনিটুকুও অতলান্ত নীরবতার ভিতর হারিয়ে গেল, ঠিক তখনই ভিড়ের মধ্যে অনেকেরই চোখে পড়ল মুখোশপরা একটা নতুন আকার…একটা সম্পূর্ণ নতুন লোক, যাকে এর আগে কেউ কখনও দেখেনি। সঙ্গে সঙ্গে এই নতুন ব্যক্তিটির আবির্ভাব ফিসফিসানি গুজবের রূপ ধরে ভিড়ের মধ্যে চাউর হতে লাগল… মৃদু গুঞ্জরণ আরম্ভ হল… এ লোকটা কে? এ লোকটা কে? এ লোকটা কোত্থেকে এল?—প্রথমে অসন্তোষ, পরে বিস্ময়, তদনন্তর ভয়, আতঙ্ক আর সব শেষে কেমন একটা অপরিতৃপ্ত বিতৃষ্ণা!               

মুখোশধারীদের সেই নৃত্যে কতটা অদ্ভুত সব পোশাক পরে সেদিন লোকজন নাচানাচি করছিল, আমি সে-কথা আগেই বলেছি। সেই সব বিচিত্র আকারের ভিড়ের মধ্যে কোনো সাধারণ বেশবাস পরিহিত মানুষ যে এতটা উত্তেজনা উৎপন্ন করতে পারত না, তা সহজেই অনুমেয়। সত্যি বলতে কী, সে-রাতের মুখোশনাচে বাড়াবাড়ির কোনো সীমা ছিল না, কিন্তু ভিড়ের মধ্যে নবাবির্ভূত ব্যক্তিটি যেন খোদার উপরেও খোদকারি করে দিয়েছিল। রাজপুত্র প্রসপেরোর খামখেয়ালিপনাকেও বুঝি হার মানিয়ে দিয়েছিল এই নবাগত মুখোশধারী। সবচেয়ে বেপরোয়া লোকের হৃদয়েও অনুভবের সেই সূক্ষ্ম তন্ত্রী থাকে, যাকে আবেগ ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ছোঁয়া যায় না। একেবারে নষ্ট হয়ে যাওয়া লোক, যার কাছে জীবন ও মৃত্যু দুটোই নেহাৎ তামাশা হয়ে গেছে, এমন মানুষও কিছু কিছু জিনিস নিয়ে মোটেই খিল্লি করতে পারে না। ভিড়ের মধ্যে সবাই এটা বেশ অনুভব করতে পারছিল, এই অপরিচিত আগন্তুক লোকটির চেহারায়, পোশাকআশাকে না আছে কোনো পরিকল্পনা, না আছে ছিরিছাঁদ। লোকটার চেহারা লম্বা, সিড়িঙ্গে। পা থেকে মাথা কবরের পোশাকে ঢাকা। যে-মুখোশে মুখটা আচ্ছাদিত, সেটা দেখলেই মনে হয় যেন শক্ত কড়কড়ে হয়ে যাওয়া একটা মৃতদেহের মুখ, খুব কাছ থেকে পরীক্ষা করলেও সেটা নকল কি না, তা বুঝবার উপায় নেই। এতটাও, মেনে নিতে না-পারলেও, যা হোক তা হোক করে অন্ততঃ সহ্য করে নেওয়া যেত, কিন্তু বাধ সাধল এই যে, ওই মড়ার মতো লোকটার চেহারায় ‘লাল মৃত্যু’-র বিভীষিকা লেগে ছিল যেন। তার পোশাকআশাকে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ, তার চওড়া কপাল আর মরা মুখে যেন জমাট-বাঁধা ভয়ের রক্তচিহ্ন…          

হলঘরের মধ্যে সমবেত নর্তক-নর্তকীদের মধ্যে লোকটা ধীর গম্ভীর পদক্ষেপে এদিক থেকে ওদিক হেঁটে যাচ্ছিল, যেন এখানে সে কী একটা গুরুভার দায়িত্ব পালন করতে এসেছে। বিচিত্রদর্শন লোকটার উপর রাজপুত্র প্রসপেরোর নজর পড়তেই ভয়ে ঘৃণায় চেঁচিয়ে উঠে রাজপুত্র তো প্রথমে অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়; কিন্তু পরমুহূর্তেই সামলে নিয়ে রেগে আগুন হয়ে উঠল প্রসপেরো।        

‘কার এত সাহস রে,’ নিকটস্থ সভাসদদের উদ্দেশে গাঁক গাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল প্রসপেরো, ‘কার এত সাহস রে যে এমন একটা কুচ্ছিত সং সেজে আমাকে অপমান করতে এসেছে? ধর ওই লোকটাকে, ওর মুখোশ খুলে নে—দেখি কে এ লোকটা, দুর্গের চূড়োয় কাকে কাল সূর্যোদয় হলেই আমাকে ফাঁসিতে লটকাতে হবে।’           

একেবারে পুবদিকের নীলরঙা কক্ষটাতে দাঁড়িয়ে প্রসপেরো প্রাণপণে চেঁচাচ্ছিল। প্রসপেরো বলিষ্ঠ, ডাকাবুকো লোক, তার গমগমে কণ্ঠস্বর তখন সাতটা ঘরের মধ্য দিয়েই শোনা যাচ্ছে। রাজপুত্রের ইশারায় গানবাজনা থেমে গেছে ইতোমধ্যেই…     

রাজপুত্র দাঁড়িয়ে ছিল নীল ঘরে, তার চারপাশে ফ্যাকাশে মেরে যাওয়া সভাসদদের একটা জটলা। প্রথমে রাজপুত্রের হুঙ্কার শুনে জটলার একাংশ ওই অনুপ্রবেশকারীর দিকে ধেয়ে গেল। তখনও লোকটা কাছেপিঠেই দাঁড়িয়ে ছিল। অতঃপর সে-লোকটা সচেতন রাজকীয় পদক্ষেপে রাজপুত্রের দিকে সরে আসতে লাগল। কিন্তু কী এক অজানা ত্রাসে, এতক্ষণ যারা খুব হম্বিতম্বি করছিল, তাদের একজনও এখন আর লোকটাকে ধরবার জন্য এগিয়ে যেতে সাহস করল না। ফলতঃ কোনো বাধা না পেয়ে মড়ার মুখোশপরা সেই লোকটা রাজপুত্র প্রসপেরোর এক গজ দূর দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে যেতে লাগল। সমস্ত সভাসদের দল যেন ত্রস্ত হয়ে ঘরের মাঝখান থেকে ছিটকে দেওয়ালের দিকে সভয়ে সেঁটে যেতে লাগল, আর সেই ভয়ানকদর্শন আগন্তুক ওদের মধ্য দিয়ে অবাধে পথ করে সামনে এগিয়ে গেল।  

সেই এক গম্ভীর মাপা পদক্ষেপ, যা লোকটাকে প্রথম দর্শনেই সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছিল, সেই এক রাজকীয় সচেতন ভঙ্গিমা। নীল ঘর থেকে গোলাপি ঘর—গোলাপি থেকে সবুজ—সবুজ থেকে কমলা—কমলা থেকে সাদা— সাদা থেকে বেগুনি… তাকে ধরবার জন্যে নির্দিষ্ট প্রয়াস করার আগেই সেই ছায়ামূর্তি এগোতে লাগল সামনে, আরও সামনে। এতক্ষণে হুঁশ ফিরে পেয়ে রাজপুত্র প্রসপেরো নিজের এক মুহূর্তের কাপুরুষতার লজ্জাকে অতিক্রম করে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ছ’টা ঘরের মধ্য দিয়ে লোকটাকে ধরবার জন্যে ছুটে গেল, যদিও তার তাঁবেদারদের প্রত্যেকেই তখন ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছে; একজনও রাজপুত্রকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল না। খাপ থেকে উদ্যত ছুরি বের করে রাজপুত্র সম্মুখে ধেয়ে যাচ্ছিল… অপস্রিয়মাণ ছায়ামূর্তির তিন কি চার ফিটের মধ্যে এসে পড়েছে যখন, কালো ভেলভেটে মোড়া ঘরটায় ঢুকে পড়েছে প্রায়… ঠিক এমন সময় সেই ছায়ামূর্তি রাজপুত্রের দিকে মুখোমুখি ফিরে দাঁড়াল।  

ভয়ানক একটা চিৎকারের আওয়াজ… তারপর কার্পেটের উপর খসে পড়ল প্রসপেরোর হাতের ছুরিটা, ঠিক তার পরমুহূর্তেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল প্রসপেরোর নিষ্প্রাণ শরীর।    

এতক্ষণে মরিয়া হয়ে শেষ সাহস সঞ্চয় করে আমোদগেড়ে সভাসদের দল সেই কালো ঘরটায় ছুটে গিয়ে ঢুকল। আবলুশ কাঠের ঘড়ির সুগম্ভীর ছায়ার ভিতর সেই মুখোশধারীর দীর্ঘাকার শরীর স্থির ঋজু ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে ছিল। লোকটাকে তখনই তারা ঘিরে ধরল। কিন্তু লোকটাকে শক্ত করে পাকড়ে ধরতে গিয়ে অনুচ্চারিত ভয়ে সকলেই শিউরে উঠল ততক্ষণাৎ; সেই কবরের পোশাক আর মরা-মানুষের মুখোশের নীচে কোনো শরীরই নেই—শুধুই হাওয়া… শুধুই ভয়াবহ নিরবয়ব শূন্যতা!

এবার আর অণুমাত্র সন্দেহ রইল না, দুর্গে লাল মৃত্যু প্রবেশ করেছে। সে এসেছে রাত্রে চোরের মতো পা টিপে টিপে। একের পর এক আমোদপ্রিয় লোকগুলো সেই আমোদগৃহের রুধিরসিক্ত মেঝের উপর লুটিয়ে পড়তে লাগল। এবং পতনের সঙ্গে সঙ্গেই সকরুণ মৃত্যু। শেষ মানুষটা যখন আছড়ে পড়ল মেঝেতে, আবলুশ কাঠের ঘড়িটাও বন্ধ হয়ে গেল। তেপায়া বাতিস্তম্ভের উপর নিভে গেল মশালের আগুন। অন্ধকার, অপক্ষয় এবং রুধিরস্রাবী মৃত্যুর নিঃসীম আধিপত্যে ডুবে গেল সমস্ত দৃশ্যাবলী।   

(অনুবাদকের টিপ্পনি:১৮৪২-এ এডগার অ্যালান পো-র লেখা এই গল্পখানি অনুবাদ করতে করতে ২০১৯-এ আরম্ভ হওয়া দুনিয়াব্যাপী করোনা মহামারীর সময়কার প্রসপেরো-সম কতগুলো স্বার্থান্ধ মানুষের মুখ আমার মনের  মধ্যে জেগে উঠছিল বারবার। অনুবাদ-গল্পটি পড়তে পড়তে নিশ্চয়ই আপনাদেরও সেসব কথা মনে পড়বে )      

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *