বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের কিংবদন্তি নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বললেন কমলেন্দু সরকার।
হোয়াটসঅ্যাপে একটা অনুরোধ পাঠালাম– বিভাসদা, একবার ফোন করা যাবে? কমলেন্দু।
তেমনভাবে অপেক্ষা না-করে সরাসরি ফোনই করলাম। আমার মোবাইল নাম্বার বিভাসদার কাছে ছিলই। উনি বললেন, “আমিই ফোন করতে যাচ্ছিলাম।” বললাম, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব, কয়েকটি প্রশ্ন করব। প্রশ্নগুলো আপনাকে হোয়াটসঅ্যাপ করছি। আধঘণ্টা পর বিভাসদার একটা হোয়াটসঅ্যাপ ঢুকল, ‘খুব ভালো প্রশ্ন, কবে আসবে, কাল বলি ?’
আমি আর দেরি করিনি। পরদিন বিকেল পাঁচটায় বিভাস চক্রবর্তীর গলফ গ্রিনের ফ্ল্যাটে হাজির। চিরনবীন বিভাস চক্রবর্তী দরজা খুলে দিয়ে বললেন, “এসো, এসো। অনেকদিন পর।”
ফ্ল্যাটে ঢুকেই বাঁহাতে বিভাসদার ঘর। বইয়ের সমুদ্রে বাস। বেশিরভাগটাই নাটকের। অবাক হলাম একটা মানুষ নাটক সম্পর্কে নিজেকে ওয়াকিবহাল রাখার জন্য এখনো কত পড়াশোনা করেন! আপনার বয়স কত হল বিভাসদা? “৮৭ হল। ১৯৩৭ থেকে ২০২৪, ৬৩+২৪=৮৭-ই হয়।”
কে বলবে বিভাস চক্রবর্তী ৮৭! আগেও কোনওদিন বোঝা যায়নি। ৮৭-তেও পৌঁছেও বুঝলাম না। এখনও কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হন। যদিও বেশি উত্তেজনা বোধহয় তাঁর কাছে ঠিক নয়। কারণ, ইতিমধ্যে তাঁর হৃদয় সামান্য নাড়া দিয়ে গেছে। যাইহোক, বিভাসদা বললেন, বয়স তাঁর ৮৭। আচ্ছা একজন সৃজনশীল মানুষের কাছে বয়স কোনও ব্যাপার নয়। তবে হৃদয়ের সমস্যা হলে জীবন তো নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। তবুও মানুষটা তো বিভাস চক্রবর্তী, তাই বলেই ফেললাম, এই বয়সে নতুন কিছু করতে ইচ্ছা জাগে বা হয়? “আগের মতো স্কেলে কাজ করতে হয়তো আর পারব না, তবে অন্যরকমভাবে করতে পারি। ক্রিয়েটিভ কাজ অল্প শারীরিক ঝুঁকি নিয়ে হয়তো করতে পারব। নতুন ফর্ম নিয়ে মাঝেমধ্যে ভাবি না, তা নয়, ভাবি। এখন অবশ্য অরগানাইজেশনাল কাজ নিয়েই বেশি ভাবি। এখন তো বহু মানুষ থিয়েটার নিয়ে আছেন, ভাবছেন। সবমিলিয়ে বলতে পারি, অনেক মানুষ নিয়ে যেখানে থিয়েটার দাঁড়িয়ে আছে। বলা যেতেই পারে থিয়েটারের পরিস্থিতি অনুকূল। এমনকী সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবা যেতে পারে। আমার তা যাবেও। আমার ধারণা, লোকে টাকাও দেবে। এবং তা চালানোর পক্ষেও সময় এবং পরিস্থিতি উভয়ই অনুকূল,” বিভাস চক্রবর্তী জানালেন।
আরও পড়ুন –
৮৭ বছরের যুবক বিভাস চক্রবর্তীর ভাবনা এইমুহূর্তে একেবারে থিয়েটার কেন্দ্রিকই। তাই উসখুস করতে করতে প্রশ্নটা করেই ফেললাম। ‘শোয়াইক গেল যুদ্ধে’ এবং ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ নাটকে গ্রুপ থিয়েটারের বিন্যাস মধ্যে দাঁড়িয়ে দর্শকদের বিনোদন দেওয়ার যে বাণিজ্যিক ভাবনা ছিল, আমি কিন্তু বাণিজ্যিককরণের কথা বলছি না একেবারেই। পরবর্তী সময়ে বা কালে আপনার এই ধারা বা ভাবনা নিয়ে অন্য গ্রুপ থিয়েটারগুলো এগোলো না কেন? কারণ কি মনে হয়? বিভাস চক্রবর্তী বললেন, “গণ্ডগোলের ব্যাপার। সংগঠনের কাঠামোয় যে-নাটক করতাম ভাবনাটাই ছিল আসল। একজন পরিচালকের ভাবনা থাকে আমার নাটকটি নিয়ে পৌঁছতে হবে দর্শকের কাছে। নাটকটি নিয়ে কখনওই বাণিজ্যিক ভাবনা থাকে না। আমি একটা ব্যাপার ভেবেই কাজ করি, করেছি, দর্শকদের নানাভাবে ভাল লাগানোর। পরিচালকের ভাবনা কখনও লেগে যায়, কখনও লাগে না। আগে থেকে বাণিজ্যিক ভাবনা থাকে তা নয় কিন্তু। দর্শকের ভাল লেগেছিল ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ আর ‘শোয়াইক গেল যুদ্ধে’। আসলে কাজটা জাস্টিস দিয়ে করতে হয়।”
কথায় পেয়েছিল ওই সন্ধ্যায় বিভাস চক্রবর্তীর। নিজের নাটক তো বটেই, অন্য নাটক নিয়েও কথা হচ্ছিল। তবে সেইসব কথার অনেকটা ছিল না-লেখার কড়ারে। কথার ফাঁকে ছুড়ে দিলাম, আগে যে-যুগান্তকারী পালাবদল ঘটিয়েছিলেন বাংলা গ্রুপ থিয়েটার মঞ্চে, এখনও কি ইচ্ছে জাগে তেমন কিছু করতে? “অর্থ এবং শরীরে যদি কুলোয় তাহলে চেষ্টা করব। আগেও অনেক এক্সপেরিমেন্ট করেছিলাম। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিসর্জন’ করেছিলাম। কোনও সেট ছিল না। মঞ্চ ফাঁকা। কেবলমাত্র খালেদদা (চৌধুরী) তিনটি স্ক্রল ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। মন্দিরটা দর্শকাসন। দেবতাকে প্রণাম করা দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বা তাঁদেরই উদ্দেশে। কিন্তু নিল না দর্শক। ব্রেখটের’ গুড পার্সন ইন সেচুয়ান’ নিয়ে করেছিলাম ‘সাধু ও শয়তান’। একজনকে দিয়ে নাটকটা লিখিয়েছিলাম। এ-নাটকটাও সেভাবে চলল না। কেন চলেনি বুঝতে পারিনি তখন। এখনও নাটক নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে পারি যদি শরীর দেয় আর অর্থ, শরীর আর অর্থ এই দুটোই খুব জরুরি,” বললেন বিভাসদা।
আবার আর একটি পুরনো নাটক ‘জোছনাকুমারী’ প্রসঙ্গে আসি। এই নাটকে যে-খেলা বা ম্যাজিক, দিগন্তকারী ভাবনা এবং প্রয়োগ ছিল, তা কিন্তু দর্শক সেভাবে নেননি, কেন? “সুনীলদা (গঙ্গোপাধ্যায়)-র লেখায় একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। একটি মেয়ে তার কোনও দেশ নেই। মেয়েটি না ও বাংলার, না এ বাংলার! সুনীলদারও এমন একটা বেদনা ছিল। নিজের জন্মভূমি ছেড়ে চলে আসার বেদনা। ঋত্বিক ঘটকের যে-বেদনা ছিল। আমিও তো জন্মেছি ওই দেশে। আমার জীবনের সঙ্গে তো জড়িয়ে আছে ওই দেশের মাটি, হাওয়া-বাতাস, জল ইত্যাদি। আমি আমার ওই জায়গা ছেড়ে কেন আসব! এই বেদনা, কষ্ট তো আমারও হয়, আছেও। সুনীলদার লেখার মেয়েটির কষ্ট, বেদনা তো তাই। সে কোন দেশের! আমার মনে হয়, নিজের ভিটে হারানোর মানসিক যন্ত্রণা, বেদনা, কষ্ট আর সেভাবে কাজ করেনি বাঙালির মনে। সেইসময় ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে বাঙালির একটা জাগরণ ঘটেছিল। ক্রমশ বাঙালির প্রাণের স্পন্দন কমে একটা হেরো জাতে পরিণত হতে চলেছে,” বিভাস চক্রবর্তী বেশ উত্তেজিত হয়েছিলেন কথাগুলো বলার সময়।
আচ্ছা, এখন একটা নাটক দেখতে গেলে ২০০ থেকে ৫০০ টাকার টিকিট কাটতে হয়। একজন সাধারণ দর্শকের কাছে এত টাকা খরচ করা সম্ভব! আমার নিজের পক্ষেও তো সম্ভব নয়। কিছু টিকিট কি ৫০-৬০ টাকা রাখা যায় না? এ-ব্যাপারে বিভাস চক্রবর্তী অনেকটাই টিকিটের দাম বৃদ্ধির পক্ষ নিলেন। বললেন, “সেকালে আমরা যখন নান্দীকার থেকে বেরিয়ে এসে ‘চাক ভাঙা মধু’ করেছিলাম, তখন খরচ হয়েছিল মাত্র আড়াই হাজার টাকা। এখন একটা নতুন নাটক প্রোডাকশন করতে গেলে কম করে আড়াই লক্ষ টাকা খরচ হয়।” বিভাসদাকে একটু থামিয়ে বললাম, সেইসময় ২৫০০ টাকা কিন্তু খুব কম টাকা ছিল না। এইসময়ে আড়াই না হোক দেড়-দু’লক্ষ টাকা তো বটেই। বিভাস চক্রবর্তী বললেন, “আগে আমরা নাটক করতাম নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু করতাম। বিকেলে অফিস ছুটির পর বা কাজ-শেষে সবাই মিলে এক জায়গায় মিলিত হয়ে নাটকের রিহার্সাল দিতাম, নাটকের কথা ভাবতাম। এখন যাঁরা নাটক করেন তাঁদের অধিকাংশই তো আর কিছু করেন না। অভিনয়ই তাঁদের রোজগারের মাধ্যম। তাঁদের টাকা দিতেই হবে। ফলে, খরচ অনেক বেড়ে যায়, বেড়ে গেছেও। এখন যেমন একজন নামী অভিনেতাকেও টাকা দিতে হয়, তেমনই পাশাপাশি একজন অনামী অভিনেতাকে টাকা দিতে হয়। আমাদের সেইসময় তো এইব্যাপারটা ছিল না। প্রায় সকলেরই এখন অভিনয়ই পেশা। তবে তোমার কথার প্রসঙ্গে বলি, আমেরিকায় স্কোয়ার ইন দ্যা সার্কেলে দেখেছি, দিনের দিন কাটলে অনেকটাই কম দামে টিকিট পাওয়া যায়, যদি টিকিট থাকে। এমন একটা সিস্টেম চালু করা যেতেই পারে। তবে আমাদের একা করলে তো হবে না সকলকে মিলে করতে হবে।”
এবার বিভাস চক্রবর্তীর কাছে কিছুটা অন্যরকম প্রশ্ন রাখি। এখন তো বাণিজ্যিক নাটক নেই বললেই চলে, বিক্ষিপ্তভাবে দু’একটা হয়। তাহলে গ্রুপ থিয়েটার দলগুলো ওই জায়গাটি নিতে পারছে না কেন? এক শ্রেণির দর্শক তো নাটক দেখতে চান। খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলেন বিভাস চক্রবর্তী, “আমরা যে-নাটকটা করি তা মাইনরিটির জন্য। বাণিজ্যিক নাটক একটা বিশাল গেম। একেবারে ব্যবসার নিয়মেই ল্যান্ড,লেবার,ক্যাপিটালের প্রয়োজন। যিনি টাকা ইনভেষ্ট করবেন তাঁকে তো মুনাফা করতে হবে নইলে তিনি টাকা ঢালবেন কেন নাটকের পিছনে! সেটা কখনওই একটা দলের পক্ষে সম্ভব নয়।ল্যান্ড,লেবার,ক্যাপিটাল যদি পাওয়া তাহলে হতেই পারে। নিজের কথা বলতে পারি, আমি যদি এসবগুলো পাই তাহলে সেরিব্রাল নাটক করব।”
ইতিমধ্যে চা এলো। চিনি ছাড়া লিকার চা। চা-পানের ফাঁকে কিছু কথা হল আবার সেই না-লেখার জন্য। চা-পান শেষ হলে, প্রশ্ন রাখি, আমি যদি আপনার ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ বা ‘শোয়াইক গেল যুদ্ধে’ কে ল্যান্ডমার্ক নাটক ধরি বাংলা গ্রুপ থিয়েটারে, সেখান থেকে কতটা এগিয়েছে? “এখন কয়েকজন পরিচালক হঠাৎ হঠাৎ ভাল কাজ করছেন৷ ধারাবাহিকভাবে খুব যে ভাল কাজ হচ্ছে তা নয়। আগে শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ পরিচালক সবাই ধারাবাহিক ভাল কাজ করতেন, করেছেন। বলতে পারি, এখন বরং মফসসলে কিছু গ্রুপ ভাল কাজ করছে, ভাল কাজ হচ্ছে। ওরা আগের মতো ভাল কাজ করে। এখানে ভাল অভিনেতা, ভাল পরিচালক আছে কিন্তু কন্সট্রাক্টিভ ভাবে এগোনোর কোনও পথ নেই। এখন তো গ্রুপের সংগঠনটাই নেই,” বিভাস চক্রবর্তী জানালেন তাঁর কথা।
এবারের প্রশ্ন ছিল, বর্তমানে কি গ্রুপ থিয়েটারের জনপ্রিয়তা কমেছে? নইলে এখন আর সেইভাবে আর আলোচনা শুনি না কেন! উনি বললেন, “এখন সেভাবে আর আলোচনা শোনা যায় না ঠিক কথা। কিন্তু কিছু নাটক আসে আলোচনার কেন্দ্রে। গ্রুপ থিয়েটার জনপ্রিয়তা নেই নয়, আছে। যে-নাটকটা করব সেই নাটকটি দর্শকদের তো ভাল লাগাতে হবে। লোকে বা দর্শকেরা টাকা দিতে প্রস্তুতও আছে যদি নাটকটি দর্শকের ভাল লাগে।”
এই মুহূর্তে কি আরও একবার ‘অদ্ভুত আঁধার’ করার কথা ভাবছেন বা ভাববেন? “অদ্ভুত আঁধার’ নাটকটির আবার করার কথা অনেকেই বলেছেন তখন একটা পলিটিকাল ক্রাইসিস ছিল। এখন এসব নিয়ে ভাববার জায়গা নেই। যদিও প্রচুর সমস্যা, প্রচুর ক্রাইসিস আছে,” জানালেন বিভাস চক্রবর্তী। এই প্রশ্নের প্রেক্ষিতে বহু কথা হয়েছিল বিভাস চক্রবর্তীর সঙ্গে। কিন্তু সেসব কথা লেখা যাচ্ছে না, তাঁর বারণে।
আর ক’দিন বাদেই বাংলা নববর্ষ। বাংলা নাটকের দর্শকদের কি বার্তা দেবেন? “এখন তো বাঙালির প্রথাগুলো প্রায় বন্ধ হয়েই গেছে। তবে বাংলা নতুন বছর যদি পালন করেন, তাহলে তিনি বা তাঁরা বাংলা সংস্কৃতির জন্য ভাবুন,” বিভাস চক্রবর্তী এই বার্তাটি দিলেন প্রতিটি বাঙালিকে।
শেয়ার করুন :