গয়না -

ছবি- গৌতম পাল

গয়না

যার হাতে পিস্তল ছিলো সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো উমার দিকে….

অন্তরা চ্যাটার্জি

পাতালের গভীর অন্ধকার থেকে জ্ঞান ফিরে পেয়ে উঠে এসে এক আকাশ ঝকঝকে তারা আর একফালি ধারালো চাঁদের দিকে তাকিয়ে চোখ মেললো উমা।সর্বাঙ্গে অসহ্য ব্যথা।কোমরের নিচটা অসাড়।কানের লতিতে,গলায়,দুই কব্জিতে যন্ত্রণা ও তীব্র জ্বালা।অতি কষ্টে দেহটাকে কোনমতে হিঁচড়ে টেনে উঠে বসলো উমা।তার দুই পায়ের মাঝখানে রক্ত,যেখানে বসে আছে ও,সেই মাটিও ভেজা ওরই রক্তে।চারপাশে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো উমা।জলার ধারে একটা ঝোপের মধ্যে  নিজেকে আবিষ্কার করলো সে।চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার তীক্ষ্ণ আওয়াজে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়।কোত্থেকে একটা রাতচরা পাখি ককর্শ কন্ঠে ডেকে উঠলো।সেই ডাকে যেন পুরোপুরি এলো সম্বিৎ ফিরে এলো উমার।মুহূর্তে বিগত রাত্রির ভয়াবহ স্মৃতি হুড়মুড় করে এসে ঘিরে ধরলো তার চেতনাকে।

গয়না পরতে বড্ড ভালোবাসে উমা।ননদের মেয়ে দীপার বিয়ের আগের সপ্তাহে গয়নার বাক্স খুলে সবকটা গয়না মেলে বিছানার ওপর বসেছিলো সে।বেশি গয়না নেই উমার,চারগাছা সলিড সোনার চুড়ি,একটা গালাভরা সোনার বালা,একটা মটরদানা হার,একজোড়া রুপোর মল,একটা রুপোর তাবিজ,ব্যস এই।তবুও গরীবের ঘরের পক্ষে যথেষ্ট।মটরদানা হারটা আর মলজোড়া ছাড়া সবই বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া।গয়না কয়খানা প্রাণ উমার।দিনেরাতে টিনের বাক্সটা খুলে গয়নাগুলোকে রোজ পাড়া তোলা করা তার বাতিক।আর গ্রামের যে অনুষ্ঠানই হোক না কেন,উমা তার সবকটা গয়না পরে সেজেগুজে গিয়ে দাঁড়াবে সেখানে।

 গত বৃহস্পতিবার উমার ননদের মেয়ের বিয়ে ছিল জৌগ্রামে,তাদের গ্রাম বদরপুর থেকে সেখানে যেতে কুখ্যাত তেলেভোলার মাঠ পেরিয়ে যেতে হয়।দিনে দুপুরে খুনখারাপি,ডাকাতি হয় সেখানে।উমার বর সোমেন,শাশুড়ি কিরণবালা,দেওর রমেন সকলেই পইপই করে বারণ করেছিল এ বিয়েতে গয়নাগাটি না পরে যেতে।তা উমা কান দিলে তো?নিজেদের পরিবারের বিয়েতে ওরকম খালি গা গলায় দাঁড়ানো যায়?ইজ্জত থাকে তাতে?সোমেন একবার বলেছিল তাকে সিটি গোল্ডের গয়না এনে দেবে,আসল সোনার সঙ্গে কেউ ফারাক করতে পারবে না সে গয়নার।উমা সেকথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বার করে দিয়েছে।সিটি গোল্ডের গয়না!!!ও আবার গয়না নাকি?ধুস!!

বৌভাত ছিল বীরগঞ্জে।দুপুর দুপুর বেরোনোর প্রস্তুতি নিলেও বেরোতে বেরোতে দুপুর গড়িয়ে সেই বিকেলই হলো।কনেযাত্রীদের কুড়ি সিটের ছোট বাসটা দিব্যি ফিরছিলো তেলেভোলার জনমানবহীন ধু ধু প্রান্তর পেরিয়ে। কিছু মেয়ে বৌরা দু চারখানা হালকা গয়না হাতে কানে গলায় পড়েছিল,বাকি সবাই পেটকোমর করে বেঁধে নিয়েছিল।শুধু উমাই জেদ ধরল না খোলার,বলল,”গায়েই থাক,খুললে বরং হারাবে।”

তখন রাত সাড়ে ন’টা।বিয়েবাড়ি বৌভাতবাড়ির লাগাতার ধকলে প্রায় ঢুলে পড়েছে সবাই।এমন সময় একটা রংচটা,পুরোনো অ্যামবাসাডার গাড়ি যেন মাটি ফুঁড়ে এসে ওদের বাসের সামনে পথ আটকে দাঁড়ালো।গাড়ি থেকে মুখ ঢাকা চারটে লোক বাসে উঠে পড়লো তাদের একজনের হাতে পিস্তল, বাকিদের হাতে ছোরা,লোহার রড।তাদের মুখ খুলতেও হলো না,ছেলেরা যার কাছে যা ছিলো সব ওদের হাতে তুলে দিলো।মেয়েদের মধ্যে দু চারজন ওই একই সঙ্গে আংটি বা দুল জাতীয় ছোটখাটো গয়না দিয়ে দিলো।দলের মাথা যে জন,অর্থাৎ যার হাতে পিস্তল ছিলো সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো উমার দিকে,উমার সমস্ত দেহ ততক্ষণে আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে।চোখের নিমেষে সে হ্যাঁচকা টানে উমার কান,গলা,হাত থেকে খুলে নিলো দুল,হার,বালা সবকিছু।উমার কানের লতি কেটে রক্ত গড়াতে লাগলো,গলা হাত বিশ্রীভাবে ছড়ে গেলো।তারপরই ওদের মধ্যে চোখে চোখে সূক্ষ্ম ইশারা হয়ে গেল।কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই উমাকে পাঁজাকোলা করে নামিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নিলো ওরা।উমা বাসের মধ্যে থেকে একটা আর্তরব উঠতে ও ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যেতে শুনলো।তারপর জ্ঞান হারানোর আগে হাতবাঁধা অবস্থায় ক্রমাগত চড়থাপ্পড় আর নিজের দেহে একাধিক ভারী,ধুমসো পুরুষশরীরের নির্দয়,আক্রমণাত্মক,যন্ত্রণা ছাড়া উমার আর কিছুই মনে নেই।

কোনমতে আলগা হয়ে আসা হাতের দড়িটা খুলে ফেলে দিয়ে উমা অতিকষ্টে উঠে দাঁড়ালো।যন্ত্রণায় শরীরটা ভেঙে পড়ছে তার।ভোর হয়ে আসছে।পুব দিকে হালকা,মিষ্টি আলোর আভাস।কিন্তু উমা বুঝতে পারলো তার জীবনে চিরতরে নেমেছে এক অদ্ভুত অন্ধকার,যে অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা প্রায় অসম্ভব।একটু দূরে দলামোচড়া পাকিয়ে পড়ে থাকা তার প্রিয় জরিপাড় সিল্কের শাড়িটা কুড়িয়ে এনে কোমরে গায়ে কোনমতে জড়ালো সে।ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠলো একবার।তারপর চোখের জল মুছে,তলপেট চেপে ধরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাঁটা দিলো,কোথায় যাবে,কি করবে কিচ্ছু না জেনে।

******************************

সোমেন আর রমেন তখন মাঠ থেকে মুনিষ খেটে  ফিরে সবেমাত্র ভাতের সানকি নিয়ে বসেছে।শাশুড়ি একটা বড় কলাইএর বাটিতে ডাল নিয়ে ছেলেদের পাতে দিতে যাচ্ছেন।হঠাৎ দোরগোড়ায় চোখ পড়তে হাত কেঁপে ডালের বাটি থেকে বেশ খানিকটা ডাল পড়ে গেল উঠোনে।আধখোলা দরজায় হেলান দিয়ে একহাত ঘোমটা টেনে জবুথবু হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে উমা।তেলেভোলার মাঠের ওই ঘটনার পর এই প্রথম অনেক লজ্জা,অনেক দ্বিধার পর বাড়িমুখো হলো উমা।থানায় সে যায়নি,শ্বশুরবাড়ির সম্মানের কথা ভেবে নিজের অসম্মানের বিষগাছটাকে নিজের ভিতরই পুঁতে ফেলবে ঠিক করেছিল তখনই।শুধু গয়নাগুলোর জন্যই তার প্রাণটা হা হুতাশ করে মরছিল।অতগুলো গয়না!! বাবার দেওয়া, শ্বশুরবাড়ির দেওয়া!!না পড়লেই হতো সেদিন!!আর কি সে কোনদিনও বানাতে পারবে ওগুলো?

বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েও চূড়ান্ত সংকোচে আটকে গেছে তার পা।কোন মুখ নিয়ে সে দাঁড়াবে বাবা,দাদাবৌদিদের সামনে?শ্বশুরবাড়িতেই বা এই নষ্ট শরীর নিয়ে কি করে স্বামী,শাশুড়ি,দেওরের চোখে চোখে চোখ রাখবে?সপ্তাহখানেক উমা কাটিয়েছে আরামবাগ বাস ডিপোর আশেপাশে।আর দিন দশেক রেলস্টেশনে,নদীর ঘাটে এমনকি শ্মশানেও।সর্বত্র শেয়াল শকুনের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে একলা যুবতী মেয়েকে ছিঁড়ে খাওয়ার লোভে।নিরুপায় হয়ে,মরিয়া হয়ে,যেটুকু সাহস ছিল বুকে বেঁধে আজ সে এসে দাঁড়িয়েছে তার শ্বশুরবাড়ির ভিটেয়।

উমাকে দেখে প্রথমে ভূত দেখার মতো হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সোমেন,তারপর ভাত ফেলে ছুটে দরজার দিকে এগিয়ে এসে তীব্র স্বরে বলল,

“ওখানেই দাঁড়িয়ে থাক,মাগী।একটা পা যেন বাড়ির ভিতরে ফেলবি না।নষ্ট মেয়েছেলে কোথাকার!”

উমা নীরবে চোখের জল ফেলছিল,এমনটা হবে এ আশাই করেছিল সে।আবার তেড়ে এল সোমেন,

“বেরিয়ে যা,বেরিয়ে যা,এখান থেকে,যে চুলোয় ছিলি, সে চুলোয় ফিরে যা।কেন,এলি কেন এখানে?”

উমা কাতর স্বরে বলল,”আমি কোন খারাপ জায়গায় যাই নি গো, বিশ্বাস কর,আরামবাগ রেল ইস্টিশন,বাস ডিপোতে লুকিয়ে লুকিয়ে দিন কাটিয়েছি।আর যে বাইরে থাকতে পারি না।ঘরের এককোণে আমারে একটু ঠাঁই দ্যাও।”

দেওর রমেন ঠান্ডা,কঠিন গলায় যেন নিদান হাঁকল,

“এ বাড়িতে তোমার আর ঠাঁই হবেনা,বোঠান।তোমার জন্য গেরামে বড় অপমান্যি হয়েছে আমাদের।তুমি চলে যাও।”

উমার পায়ের তলায় মাটিটা একবার কেঁপে উঠল।তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে ঘোমটা টেনে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়ালো সে।পেছন থেকে ভেসে এলো শাশুড়ির ঝাঁঝালো প্রশ্ন,

“আমাদের গয়নাগুলো কি হল,বউ?সব খোয়ালে?”

সোমেন এক পর্দা গলা চড়িয়ে বলল,

“কতবার মানা করা হল গয়নাগুলো পরতে,কথা শুনলে তো!বলে গয়না না পড়লে ইজ্জত থাকে না!খুব থাকল ইজ্জত এখন!মাঝখান থেকে অত টাকার সোনা,সোমসারে আপদে বিপদে পড়লে কাজে লাগতো…বেরো, বেরো,শালী গতরখাকি,অকম্মার ঢেঁকি কোথাকার…”

আর একবারও পিছনে না তাকিয়ে শ্বশুরবাড়ির চৌকাঠ ছেড়ে সবেগে বেরিয়ে এল উমা।

******************************

“উমা…কোথায় তুই?দারুণ খবর আছে।”

মৃদুলাদির উচ্ছ্বসিত গলার আওয়াজ পেয়ে কৌতূহলী চোখে তাকালো উমা।ওয়ার্কশপের কোণে বসে লেড ল্যাম্পের আলোয় ফ্ল্যাট ফাইল দিয়ে একটা আংটির ভেতর দিকটা আরো নিখুঁতভাবে গোলাকার করছিল সে।

-“কি খবর,দিদিভাই?”

-তোর তৈরি তারের কাজের গয়নাগুলো ‘মণিকাঞ্চনা’ এপ্রুভ করেছে।কলকাতায় এ বছরের স্বর্ণমৃগয়া উৎসবে তোর গয়নাগুলোই ডিসপ্লে করবে ওদের সংস্থা।এই নে,তোর নামে তিরিশ হাজার টাকার এডভান্স পেমেন্ট এর চেকও পাঠিয়ে দিয়েছে ওরা।ধর,সাবধানে রাখ এটা।আর বিকেলে একবার আমার অফিসে দেখা করিস।

চেকটা হাতে ধরে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না উমা।তিরিশ হাজার টাকা!যে মেয়ে একবস্ত্রে কপর্দকশূন্য অবস্থায় তার গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছিল,তার নিজের রোজগার!

উমার মনে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে মৃদুলা দিদিভাইয়ের পা দুটো বুকে জড়িয়ে ধরে।এই মৃদুলাদি ছিল বলেই আজ ভদ্রমেয়ের মতো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে,নিজের মনের মতো কাজ করে সসম্মানে বাঁচতে পেরেছে উমা।নাহলে যে কি হত,তা কল্পনা করারও সাহস নেই তার।

শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে উমা আবার এসে আশ্রয় নিয়েছিল আরামবাগ রেল স্টেশনে।একটা রাত কোনমতে সেখানে কাটিয়ে সে ভেবেছিল পরদিন যে কোন ট্রেনে চড়ে বসবে,যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবে,যা হয় হবে।একটা মরিয়া,ভয়শূন্য,ভোঁতা জেদ তার বোধবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল।এমন সময় স্টেশনের একটা ভবঘুরে পাগলাটে লোক তার কাছে এসে হঠাৎ বলে গেল,”বিরিজ পেরিয়ে কেলাবে যা না,খাওয়া দিচ্ছে।”

পায়ে পায়ে ওভারব্রিজ পেরিয়ে নীচে নেমে এল উমা।পুরো একটা দিন সে শুধু কলের জল খেয়ে আছে,একদানা খাবার জোটেনি তার।খিদের চোটে নাড়িভুঁড়ি যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে তার।ওভারব্রিজের নীচে ইউথ ক্লাব।ক্লাবের সামনে ছোট মাঠে মনে হয় কোন সভা হচ্ছে।স্বল্প লোকজন জড়ো হয়েছে সেখানে।উমা শেষ সারিতে জড়োসড়ো হয়ে বসতে একজন তার হাতে একটা খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দিল।প্যাকেট সামান্য ফাঁক করে উমা দেখল ভেতরে কচুরি,আলুর দম আর মিষ্টি রাখা আছে।খিদেটা আরো চাগিয়ে উঠল উমার।প্যাকেটটা আঁচলে জড়িয়ে উঠে আসতে যাবে সে,তখনই তার চোখ পড়ল মৃদুলা দিদিভাই এর দিকে আর মনোযোগ গেল তাঁর কথায়।কি সুন্দর করে তিনি মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন!খিদে ভুলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো উমা তাঁর কথা শুনতে লাগল।মৃদুলা দিদিভাইদের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় সহায়সম্বলহীন মহিলাদের নানা কাজ শেখানো হয়।ফ্যাশন এমব্রয়ডারি, হ্যান্ডিক্রাফটস মেকিং,পটারি, ফেব্রিক পেইন্টিং,জুয়েলারি মেকিং এন্ড ডিজাইনিং ইত্যাদি।তাদের ভালো ভালো কাজের নমুনা পাঠানো হয় নামী বুটিকে বা ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিতে।নমুনা পছন্দ হলে সেখানেই কাজ পেতে পারে মেয়েরা।পরবর্তী সময়ে নিজস্ব শপ বা আউটলেটও দিতে পারে তারা,দিয়েওছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত মেয়েরা,এমন কিছু বয়সও নয় তাদের।

উমার মনে হচ্ছিল যেন রূপকথার গল্প শোনাচ্ছে কোন পরী।এমনও হয়?সে পারবে কাজ শিখতে?দোকান দিতে?যাবে নাকি একবার?ওই মিষ্টি দিদিভাইএর সঙ্গে একবার কথা বলে দেখবে এখনই?

যেমন ভাবা তেমন কাজ।মৃদুলা দিদিভাইকে ওখানেই দাঁড়িয়ে এক নিঃশ্বাসে সব কথা বলল উমা।বাকিটা উমার কাছে কিছুটা স্বপ্নের মতো।

মৃদুলা একটা হোমে একবেলা রান্নার কাজের বিনিময়ে উমার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।আর ওর ইচ্ছেমতো একটা নামকরা জেমস এন্ড জুয়েলারী ওয়ার্কশপে ওকে জুয়েলারী ডিজাইনিং শেখার একটা কোর্সে ভর্তি করে দিলেন।

পাখির ডানায় ভর দিয়ে যেন আটটা মাস কেটে গেল উমার।সকালে হোমের রান্না সেরে ওয়ার্কশপে ছোটা।সেখানে যেন এক অসম্ভব স্বপ্নের জগতে নিত্য প্রবেশ উমার।কোনদিন কি সে ভেবেছিল গয়না বানাতে পারবে সে নিজের হাতে?এজন্য তাকে দু মাস ধাতুবিদ্যা শেখানো হয়েছে।তারপর তাকে শিখতে হয়েছে গয়নার মোল্ডিং,ইলেক্ট্রোপ্লেটিং,কাস্টিং,পলিশিং এর কাজ।এরপর নিয়মিত গয়না বানানোর অর্ডার পেয়েছে সে,নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে রূপ,রং আর নতুন নতুন সৃষ্টির জগতে,তার মনের মতো কাজের জগতে।

নিজের বানানো হার, চুড়ি,বালা,দুল,লকেট,বাজুবন্ধ,আংটিগুলোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে,ফুল,পাখি,লতা,পাতার নিত্যনতুন নকশা ভাবতে ভাবতে ক্রমে পায়ের তলায় মাটি পেয়েছে সে,পেয়েছে স্বনির্ভরতার আস্বাদ,দেহমনে পুরনো ক্ষতগুলো অনেকটা ভরে গিয়েছে সাহসে,পরিতৃপ্তিতে,আত্মবিশ্বাসে।তারপর আজকের এই খবরটা!’মণিকাঞ্চনের’ স্থায়ী স্বর্ণকার যদি হতে পারে উমা,তাহলে ভবিষ্যতে নিশ্চিত নিজের মনের মতো করে স্বাধীনভাবেও গয়না তৈরি করতে পারবে ও,’মণিকাঞ্চন’ এ কাজ করার অভিজ্ঞতাটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবে সে।এক অজানা সুখের,সাফল্যের কল্পনায় বুকের ভিতরটা তিরতির করে কাঁপতে লাগল উমার।

******************************

পি সি চন্দ্র গার্ডেনে আজ অন্য অনেক জুয়েলারী ম্যানুফ্যাকচারিং সংস্থার সঙ্গে ছিল উমার ডিজাইনার গোল্ড এন্ড সিলভার জুয়েলারি ব্র্যান্ড “সীতা’স সোল”এর প্রদর্শনী।ব্র্যান্ডের নামটা মৃদুলারই দেওয়া।মৃদুলা নিজেও উপস্থিত ছিলেন উমার সঙ্গে।প্রদর্শনী শেষে সম্বর্ধনার পর উমা গাড়িতে বসে তার অল্পবয়সী সেক্রেটারি মেয়েটিকে নির্দেশ দিল স্টক থেকে সোনার চুড়ি,বালা,হার ও রুপোর মল সহ বেশ কয়েকটা বাছাই গয়নার একটা সুন্দর গিফট হ্যাম্পার তৈরি করে রাখতে, আর ড্রাইভারকে বলল গাড়ী ফুল ট্যাংক তেল ভর্তি করে কাল ভোর ছ’টায় যেন সে রেডি থাকে।আগামীকাল আরামবাগ স্টেশন পেরিয়ে বদরপুর যাবে সে।তার স্পেশাল কাস্টমার রয়েছে সেখানে, “সীতা’স সোল” এর বেস্ট কালেকশনটা গিফট করতে যেতে হবে তাকে কাল।

লেখক পরিচিতি -অন্তরা চ্যাটার্জি নাট্য প্রযোজক, নির্দেশক, চিত্রনাট্যকার,শিক্ষিকা,ব্লগার। ওর যুগ্ম প্রযোজনা ও চিত্রনাট্যে দেবান্তরা আর্টসের ‘ কাইট রানার ‘ নাটক আবির্ভাবেই জনপ্রিয়।আজকের নাট্যজগতে সুপরিচিত প্রাণোচ্ছল, উদ্যমী সৃষ্টিশীল।

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *