বৈশাখী হাওয়া -

ছবি -শুভেন্দু সরকার

বৈশাখী হাওয়া

তিনতলার ওপর থেকে –দাঁড়া পারুল, এই বলে টিয়ার হাত ধরে নিচে নেমে আসে বনানী।

অনিন্দিতা পাত্র

ঘর মোছাটা হাতে নিয়েই গজগজ করে উঠল বাসন্তী …গরিব মানুষ আর পশুর মধ্যে কোনো তফাত নেই! সারা জীবন শুধু খেটে মরো! ছোট বৌদির ঘর মুছতে মুছতে বাসন্তী একবার দেখে নিল, ছেলেকে বারান্দায় ভাত খাওয়াচ্ছে বৌদি। ঘড়িতে একটা বাজলো। প্রতি রবিবার তার দেরি হয়ে যায়। এরপর বাসন্তী বাড়ি যাবে, রাজ্যের কাজ পড়ে আছে। সব গিয়ে সারতে হবে। ছেলে মেয়েদুটো কোথায়, কাদের বাড়ি খেলছে কে জানে।

উপেন সেই রাত থাকতে বেরিয়ে যায়। কোনো কোনো দিন রতন ডাকতে আসে। তিনটে থেকেই জাল দেওয়া শুরু হয় পুকুরে। পশুপতি বাবুর দুটো মহাজাল আছে। অনেক পুকুর লিজে নিয়ে রেখেছে। বারুইপুর বাজারে মাছের আড়ৎও আছে একটা। রমরমা ব্যবসা। এই দুবছর হল, পশুপতি বাবুর কাছে কাজে লেগেছে উপেন। মহাজালের সঙ্গে সে জলে নামে। জাল টেনে পুকুর ঘেরে। মাছ তোলে, জাল ঝাড়ে, ধোয় -সবই করতে হয়। শীতকালে ভোরে জলে নামতে কষ্ট হয় উপেনের, কিন্তু পেটের দায় বড় দায়! তারপর আবার জাল হয়ে গেলে, তাকে ভ্যানে তুলে বাড়িতেও পৌছে দিয়ে আসে। এ তো গেল, যেদিন জাল হয় সেদিনের কথা। এমনিতে সারা বছর ভোরে আড়তে ছোটে। পাল্লায় মাছ মাপে। মণ মণ বরফের মাছ মেপে হাতের আর সাড় থাকে না। তাও বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় তেল মেখে যায় দু’হাতের তালুতে। বাসন্তী মাঝে মাঝে হাতের দিকে তাকিয়ে বলেছে, “ছেড়ে দে এ কাজ, অন্য কাজ খোঁজ।” কান দেয়নি সে কথায় উপেন। কাজ পাওয়া কি এতই সোজা। দু’বছর তো কলকাতায় কাটিয়ে এলো। ফ্যাক্টরির কাজে কত কষ্ট করেছে, ছেলে মেয়ে বউকে ছেড়ে থেকেছে। তবুও কি তাদের ভালমন্দ দুটো খাওয়াতে পেরেছে না ঘরের চালটা সারাতে পেরেছে! তার থেকে এ কাজ অনেক ভাল। দুটো টাকা হাতে আসে, উপরি পাওনা মাছ পায়। আড়ৎ ধোয়ামোছা করে সকালে বাড়ি আসার সময় আড়ৎ কুড়োনো মাছ নিয়ে আসে রোজ। ছেলে মেয়েদুটো মাছ দিয়ে ভাত খায় -এই এক সান্ত্বনা উপেনের।

আরও পড়ুন –

গিন্নিমা সকালে উঠেই মনে মনে ভাবলেন, আজ বাসন্তীকে দিয়ে ঠাকুর ঘরের পেতেন থেকে বাসনগুলো বের করে মাজাতে হবে। বোতল থেকে খানিকটা তেঁতুলও বের করে রাখলেন। তেঁতুলের সঙ্গে ছাই মিশিয়ে ঘষে ঘষে মাজলে, তবেই ঝকঝক করে পেতলের বাসনকোসন। বাসন্তী কলতলা থেকে মেজে আনলে তারপর না হয় নিজেই ভাল জলে ধুয়ে গুছিয়ে রাখবেন ঠাকুর ঘরে। বাতের ব্যাথার জন্যে নেহাত পা মুড়ে বসতে পারেন না। না হলে কারো ধার ধারতেন না তিনি আজও। কর্তা চলে গেছেন প্রায় সাত বছর হতে চলল, ছেলেরা এখনো মায়ের সাথে পরামর্শ করে ব্যবসায় সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁর বুদ্ধি আছে বলেই না ছেলেরা তাঁকে মেনে চলে! এই কারণেই কিনা গিন্নিমা জানেন না, দুই বউমা তাঁকে এড়িয়ে চলে! এমনকি সংসারের কাজকর্ম, রান্নাবাড়া সবই কাজের লোককে দিয়ে হয় অনেকদিন হল। এসব কাজে বউমাদের আগ্রহের অভাব দেখেই গিন্নিমা এমন ব্যবস্থা করেছেন। তাঁদের যুগ তো আর নেই যে বাড়ির বউ রেঁধেবেড়ে সংসারের সবাইকে খাওয়াবে! তবে তাঁর ইচ্ছে ছিল ঠাকুর ঘরের কাজটা অন্তত বউমারা নিজে হাতে করুক।

তো ছোট বউমা, তার ছোট বাচ্চাকে নিয়ে নিজের ঘরেই ব্যস্ত থাকে। বাচ্চা ছাড়া অবশ্য বাকি সময়ে পায়েল নাকি ফোনে ডুবে থাকে। বাসন্তীই এসে সেসব কথা বলে। তাছাড়া এ যুগের মেয়ে, নিয়মের মধ্যে বাঁধতে গিয়ে হিতে বিপরীত না হয়। এমনিতেই বড় বৌমার বেলায় যা হয়েছে, তার খেসারত তাঁকে আজও দিতে হচ্ছে। এক বাড়িতে বাস করেও বহুদিন হলো সে শাশুড়ির মুখ দেখে না। বিজয়ার প্রণামটুকুও করতে আসে না বনানী। শাশুড়ি তাকে চাকরি করতে দেয়নি, কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনতে দেয়নি! তার জীবনকে শেষ করে দিয়েছে -এই হল তার অভিযোগ। তবে সে যা বলে বলুক, এই নিয়ে গিন্নিমার মনে কোন আফসোস নেই। সেদিন বনানীকে চাকরি করতে দিলে, কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনতে দিলে, তার পেছন পেছন বড়খোকাকেও তো যেতে দিতে হত! এত বড় ব্যবসা কি তখন একা হাতে সামলাতে পারত ওর বাবা? ছোটখোকা তখন কতটুকু, তাছাড়া বাবার মত পাকা ব্যবসায়ী মাথা বড়খোকাই যে পেয়েছে! এই অর্থ, প্রতিপত্তি, সুনাম বজায় থাকত পুরকায়স্থ বাড়ির! তবে বউ যা করুক, বড়খোকা কিন্তু কোনদিন বাড়ির প্রতি, মায়ের প্রতি তার কর্তব্যে কোন অবহেলা করেনি। গিন্নিমার মনের এই এক সান্ত্বনা! অবশ্য একদিক থেকে, বনানী তাঁকে এড়িয়ে যাওয়ায় গিন্নিমার সুবিধেই হয়েছে। শেষদিকে তাকে দেখলেই মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি যেন খচখচ করত। আর এখন তো এই দু’বছর হলো নাতনিটা বাঙ্গালোরে পড়তে গেছে। ছুটিছাটায় বাড়ি ফেরে। বনানীও এখন ঝাড়া হাত পা, কলকাতায় তার যাতায়াত লেগেই থাকে! বড় খোকাও সারাদিন বারুইপুর গঞ্জের দোকানে পড়ে থাকে। গঞ্জের মোড়ে হার্ডওয়্যারের ব্যবসা কর্তামশাই শুরু করেছিলেন বটে, তবে সেই ব্যবসা বাড়িয়েছে বড় খোকাই। না হলে পুরকায়স্থ বাড়ির আদি ব্যবসা জামাকাপড়ের। গঞ্জের বাস স্ট্যান্ডের পাশেই ‘পুরকায়স্থ ড্রেসেস’ তাদের অনেক পুরনো দোকান। রমরমা ছিল সে ব্যবসায়।

তারপর যখন মফস্বলের দিকে একে একে শপিংমল গজিয়ে উঠছে, কর্তামশাই বুদ্ধি করে হার্ডওয়্যারের ব্যবসা শুরু করেন। তবে জামাকাপড়ের চালু দোকানটা বন্ধ করে দেননি, এখনো চলছে সে দোকান। তাতে চাপ কম। একটা কর্মচারী নিয়ে ছোটখোকা বসে সে দোকানে। আর হার্ডওয়্যারের দোকানে বসে বড়খোকা। চারটে কর্মচারী নিয়েও সে হিমশিম খেয়ে যায়।

পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। বাড়িগুলোর মাথায় লালছে ছোপ ধরেছে সূর্যাস্তের আলোর। চৈত্রের শেষের বাতাসে এখনো গরমের ছোঁয়া লাগেনি। রেল লাইনের ধারে শিমুল গাছগুলো লালে লাল হয়ে ফুল ফুটেছে! ওদিকটা এখনো গ্রামাঞ্চল। পঁচিশ বছর আগে যখন বিয়ে হয়ে এসেছিল বনানী, চারদিকে এত ঘরবাড়ি ছিল না। এদিকেও জলা আর ঝোপে ভরে ছিল। দেখতে দেখতে সব কেমন বদলে গেল! ভাবতে ভাবতে বনানীর কানে এলো- দূরে কোথাও রশিদ খান বাজছে! চোখ বন্ধ করে শোনার চেষ্টা করল বনানী। দখিনা বাতাসে সেই সুর ভেসে এসে যেন তার খোলা চুল ছুঁয়ে খেলা করতে লাগল। সন্ধ্যের এই মুখটায় কিছুতেই ঘরে মন টেকে না। টিয়া যখন এখানে ছিল তখন ওর স্কুল পড়াশোনা টেনিস এসব নিয়ে তবুও সে মেতে ছিল। বারুইপুর থেকে বাসে ঘন্টাখানেক দূরে কলকাতার দিকে যেতে মহেশতলা টাউনশিপে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ত টিয়া। স্কুল বাসে করেই যেত। আর স্কুলের পরে টিউশন, টেনিস সেরে একেবারে বাড়ি ফিরত, বাড়ির গাড়িতে। বনানী যেত তাকে আনতে।

কিন্তু এখন তার দিন যেন কাটতেই চায় না। বিশেষ করে এই বিষন্ন বিকেলগুলো যেন গিলতে আসে বনানীকে। কখনো বাপের বাড়ি তো কখনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে, এটা ওটার বাহানায় সে কলকাতায় চলে যায় মাঝে মাঝেই। কিন্তু কতক্ষণের জন্যে আর, ফিরে তো তাকে এই বারুইপুরেই আসতে হয়! ব্যবসা ফেলে বনানীর সাথে কলকাতায় যাওয়ার সময় হয় না প্রবীরের। অবশ্য বনানী এক্সপেক্টও করে না আর। তবে বনানীর এই হুটহাট কলকাতায় যাওয়া নিয়ে কখনো আপত্তি করেনি প্রবীর। আসলে, আপত্তি করবে কোন মুখে! সেই বিয়ে হয়ে এসে থেকে তার কোনো ইচ্ছেকেই তো গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি প্রবীর, তাই এখন পাপবোধে ভোগে! -এই হল বনানীর যুক্তি! মায়ের কথায় সে উঠেছে আর বসেছে। অথচ বিয়ের আগে বনানীকে প্রবীর বলেছিল, বারুইপুর শহর না হলেও, আমাদের বাড়ির ভাবনাচিন্তা একেবারে অন্যরকম! বিয়ের পর তুমি নিজের মতো করে বাঁচতে পারবে। নিজের মতো বাঁচা না ছাই! চাকরি বাকরি তো দূর, বিয়ের তিন বছরের মাথায় টিয়া হয়ে, একদম ঘরবন্দি হয়ে পড়ল বনানী। তারপর তো বাকি জীবনটা…! আজও মনে মনে সে আফসোস করে, কেন যে কলেজে পড়তে প্রবীরের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল! চিন্তার রেশ কেটে গিয়ে বেজে উঠল ফোনটা! কানে ছোঁয়াতেই টিয়ার গলা, –কী করছিলে মা?

–কী করবো, ছাদে ঘুরছি।

–জগন্নাথদাকে দিয়ে ফুলগাছের টব আনিয়েছিলে?

–ধুস, বাদ দে ওসব।

–ধুস কেন? ফুল গাছের যত্ন করলে ভাল সময় কাটবে তোমার।

–আচ্ছা সে পরে হবে। তুই এখন কী করছিস বল।

–আমি এইমাত্র কলেজ থেকে ফিরলাম। আজ বিপাশার বার্থডে। একটু পরে সবাই মিলে বেরোব।

–আচ্ছা। ওর জন্যে গিফ্ট নিস আর আমার হয়ে ওকে উইস করে দিস। 

–ওকে মা! বাই ।

–বাই।

টিয়াটা একটু বেশিই চিন্তা করে তাকে নিয়ে, বোঝে বনানী। আসলে বড় হচ্ছে, মায়ের মনের ছোট ছোট ক্ষতগুলোর গভীরতা যে অনেক, একথা সে জানে। তাই নানাভাবে সেই ক্ষতগুলোকে ভরাট করার চেষ্টা করে। কিন্তু বনানী চাইলেও যে ভুলতে পারে না, বিয়ের পর বাবা মায়ের সামনে প্রবীরের সেই জুজু হয়ে থাকা! তাদের সব হ্যাঁ-তে, হ্যাঁ মেলানো! যা দেখে সে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল। আর তারপর স্বাধীনভাবে বড় হওয়া বনানীর ডানা কেটে ঘরে বসিয়ে দেওয়া সেই অতীত! তবে এতগুলো বছর পেরিয়ে শাশুড়ির ওপর বনানীর যত না রাগ, তার থেকেও বেশি রাগ জমে আছে প্রবীরের ওপর। বনানীর অযত্ন হয়তো সে করেনি কোনদিন, কিন্তু তার হয়ে সে স্ট্যান্ডও তো নেয়নি কখনো!

বড় বৌদির যেদিন মুড ভালো থাকে, ঘর বারান্দা মুছতে মুছতে অনেক গল্প করে বাসন্তী। নানান প্রশ্ন করে বৌদিও, বাসন্তী তার উত্তর দেয় টুকটুক করে। যেমন আজই জিজ্ঞেস করছিল, ছেলে মেয়েরা ইস্কুলে যাচ্ছে কিনা, বরের কাজকাম কেমন চলছে। বড় বৌদি অনেক লেখাপড়া করেছে, কথার মধ্যে ভার আছে। বাসন্তীর ভালো লাগে, বড় বৌদি তার খোঁজ খবর নেয়। তবে মুড ঠিক না থাকলে, বাসন্তী বৌদির মুখ দেখেই বুঝে যায়। সেদিন বাসন্তী চুপচাপ ঘর মুছে চলে আসে। কথায় কথায় বৌদি কলকাতায় যায়। নকুড় ড্রাইভার এসে গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে কলকাতায় নিয়ে যায় বৌদিকে। এমনিতে মানুষটা খারাপ নয়। তবে শাশুড়ির সঙ্গে মুখ দেখাদেখি নেই। অবশ্য গিন্নিমা দোতলায় থাকেন আর দুই বৌদিই তিনতলায়। শুধু খাবার সময় দোতলায় খাবার ঘরে যায়। তবে বাড়ির সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া করলেও বড় বৌদি দুবেলা একা একা খাবার খায়। এসব কথা বাসন্তী সব সময়ের কাজের মেয়ে মিনুর কাছ থেকে জানতে পেরেছে। রাঁধুনি দিদি রেঁধে দিয়ে গেলে, সে-ই সবাইকে যত্ন করে খাবার বেড়ে গুছিয়ে খেতে দেয়। আবার দুই বউয়ে নাকি ঝগড়াঝাটি না থাকলেও, তেমন কথাবার্তা নেই। ছোট বৌদি কাছেই পদ্মপুকুরের মেয়ে। বছর পাঁচেক হল বিয়ে হয়ে এসেছে এ বাড়িতে। দেখাশোনার বিয়ে। ছোট বৌদির ছেলেটার বয়স এই দুবছর। ছোটাছুটি করে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখে। তবে বড় বৌদির ঘরে তেমন একটা যায় না বরং মিনুর খুব ন্যাওটা হয়েছে! সারাদিন তার পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায়। আর ছোট বৌদি তো সারাক্ষণ ফোন নিয়ে খুটখাট করে। বাসন্তী ডাকলেও ওই, হুঁ হ্যাঁ -র বেশি উত্তর পায় না। মাঝে মাঝে ছোটদা বউ ছেলেকে নিয়ে যদিও বা ঘুরতে যায়, বড়দাকে ব্যবসা ছেড়ে কখনো কোথাও যেতে দেখেনি বাসন্তী।

এই পুরকায়েত বাড়ির সবই দেখে বাসন্তী, কিন্তু কিছুতেই কৌতুহল দেখায় না। মালিকদের ব্যাপারে কাজের লোকের নাক না গলানোই ভাল। আসলে তার পারুল এই বারো বছরে পড়ল, আর ক’বছর পরে তো তাকে পার করতে হবে! তাছাড়া বাড়ির চালটাও নড়বড় করছে, সেটাও সারাতে হবে। সেদিন ঠাকুরের বাসন মেজে এসে গিন্নিমার কাছে কথাটা পেড়েও রেখেছে বাসন্তী। 

অনেকবার মাকে টিয়া বুঝিয়েছে, –বাবা তোমার সাথে যা করেছে, ঠিক হয়নি মানছি। কিন্তু এতগুলো বছর পরেও অভিমান পুষে রেখে তুমি নিজেকেই কিন্তু কষ্ট দিচ্ছ!

–বয়ে গেছে আমার অভিমান পুষে রাখতে! তাছাড়া কার ওপরেই বা অভিমান করবো? মিথ্যেবাদী একটা লোক!

–ও কে! অভিমান যখন নেই, তাহলে কেন লেট গো করতে পারছ না পুরনো সবকিছুকে? কেন এখনও ঠাম্মার সব কাজেই বিরক্ত হও?

–হবো না? এত বয়স হয়ে গেল, এখনো দুই ছেলেকে কান ধরে ওঠায় আর বসায়। ব্যবসা, সংসার সব একদম হাতের মুঠোয় করে রেখেছে। মেয়ের ওপর ঝাঁঝিয়ে ওঠে বনানী!

–রাখুক না। সে তো ভালোই একদিক থেকে। কাউকে না কাউকে তো এ দায়িত্ব নিতেই হতো। তুমি বরং নিজে কিছু একটা করো। তোমার পছন্দের কিছু। অনুরোধের স্বর ঝরে পড়ে এবার টিয়ার গলায়। আসলে এই নিয়ে বাবার সঙ্গেও আলাদা করে কথা হয়েছে টিয়ার। প্রবীর মেয়েকে বলেওছে- দেখ, আমি মেনে নিচ্ছি, তোর ঠাম্মা বরাবরই একটু ডমিনেটিং। আর মা যা চেয়েছে, আমি তাই করেছি; মাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা আমার ছিল না। কিন্তু এটাও তো ঠিক, বাড়ির প্রথম সন্তান আমি, বাবার বয়স হয়েছে, বাড়ির ব্যবসা তখন অনেকটাই আমার ওপর নির্ভর করছে। আমি না হাল ধরলে…! এসব শোনার পর বাবাকে আর কী বলা উচিত, বুঝতে পারেনি টিয়া। তাছাড়া সে বড় হওয়ার পর থেকে দেখে এসেছে, মায়ের কোন কাজেই কখনো বাবা বা ঠাম্মা কোনো বাধা দেয়নি। কিন্তু পুরনো ক্ষতস্থান যে এখনও মাকে ব্যথা দেয়, সেও তো বেশ বুঝতে পারছে টিয়া।  বনানীকে শান্ত করার জন্য টিয়া আবার বলে–বাবা, ঠাম্মাকে যতই মেনে চলুক, তোমার কাজে তো কোনো বাধা দেয় না। পুরনো কথা ভুলে যাও মা। এত বেশি গুরুত্ব দিও না কাউকেই। তুমি তো আবার গানটা শুরু করতে পারো। কলেজে পড়ার সময় দক্ষিণীতে যে গান শিখতে, ওখানে নতুন করে আবার ভর্তি হয়ে যাও! গান নিয়ে ব্যস্ত থাকো। কাকিমা তো দিব্যি ভালো আছে এ বাড়িতে, এদের মাঝেই।

–পায়েল তো ফেসবুকের বাইরে পৃথিবীটাকে চেনেই না। আর কথায় কথায় শাড়ি গয়না কেনে, তাতেই তার সব সুখ! তাছাড়া রুকু আছে। তাকে নিয়েই তো ওর সময় কেটে যায়।

–হ্যাঁ সে কথাই তো বলছি। ইনভলভমেন্ট! তোমারও দরকার এমন কিছু ইনভলভমেন্টের। যাতে করে তোমার সময় কাটে।

একটা বিড়ি ধরালো উপেন। এদিক ওদিক দেখে নিয়ে বটগাছের তলায় গিয়ে বসে টান দিল ক’টা। তার মনটা কদিন থেকে কু’গাইছে। বাসন্তীর ভাবগতিক যেন কেমন ঠেকছে! আড়ৎ সেরে বাড়ি ফেরার সময় একটা বিড়ি খায় উপেন। বাড়িতে ছেলে মেয়ে আছে তাছাড়া বাসন্তীও গজগজ করে বিড়ি খেলে। বাসন্তীর এক কথা, টাকা জমাবে, চাল সারাবে, প্রেসার কুকার কিনবে গিন্নিমাদের মত। কেরোসিনের স্টোভ কিনবে; বর্ষায় দাওয়ায় বসে রাঁধে, বৃষ্টির ছাঁট লাগে গায়ে। তাছাড়া শুকনো জ্বালুন পাওয়ারও ঝামেলা বর্ষাকালে। স্টোভ হলে কেমন, তোলা উনুনের মতো ঘরে নিয়ে গিয়ে রান্না করতে পারবে। এক দিক থেকে ঠিকই বলে বাসন্তী। একটু ভালো থাকার জন্যেই তো এত খাটাখাটনি। উপেনও সায় দেয় বাসন্তীর কথায়। সেই জন্যে সে দাদার কাছে কলকাতায় গিয়েছিল।

উপেনের দাদার কলকাতায় বড় মিষ্টির দোকান। শ্বশুরের দোকান আসলে। শ্বশুর মরে যেতে এখানের দু’কামরা ঘরে চাবি মেরে, বউ ছেলেকে নিয়ে সেখানে চলে গেছে। দাদাই এখন মালিক সে দোকানের। বেচাকেনাও হয় ভালো। অনেক আশা নিয়ে, দাদার কাছে উপেন গিয়েছিল। কাজ করবে, মাসে মাসে বাড়িতে টাকা পাঠাবে। কিন্তু দাদা তাকে কাজে রাখল না, বলল -এই তো ছোট দোকান, আমি আর তোর বৌদি মিলে সামলে নেবো। চলে আসার সময় কিছু টাকা দিতে চেয়েছিল উপেনকে। সে নেয়নি। কাজ চেয়েছিল, ভিক্ষে কেন নেবে! উপেনের একটাই ইচ্ছে, ছেলে মেয়ে দুটোকে অনেকদূর লেখাপড়া করাবে। কিন্তু বাসন্তী মেয়ের সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার ধান্দায় আছে, বুঝতে পারে উপেন। কিছু তো একটা প্ল্যান করছে সে! বলে, মেয়েছেলে ঘরে থাকা মানেই চিন্তা। তার থেকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া ভাল। উপেন তার ইচ্ছের কথা জানিয়েছিল, পড়ে আগে নিজের পায়ে দাঁড়াক। তাছাড়া, বয়স না হলে এখন আইনে কড়াকড়ি হয়েছে। মুখ ঝামটা দিয়ে বাসন্তী বলে, আইন কি এসে আমার মেয়েকে খাওয়াবে? এই নিয়ে ঝগড়া বাঁধে বাসন্তী আর উপেনের। উপেন বলে, –দরকারে আরও খাটব। তবুও লেখা পড়া করাব দুজনকে। চাকরি করবে ওরা। মানুষের মত মানুষ হবে।

–মানুষ হবে! টাকা না থাকলে ওসব হওয়া যায় না। নিজে কী হইছিস?

–আমি যাই হই। আমার ছেলেমেয়ে মানুষ হবেই। এই তোকে বলে রাখলুম!

–উঁহ্, ইনকামের মুরোদ নেই, বড় বড় কথা!

চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভেঙে যায় টিয়ার। কলেজের সেমিস্টার শেষ হতে দিন তিনেক হল বাড়ি ফিরেছে সে। বিছানা থেকে নেমে পায়ে পায়ে বাইরে এসে দেখল, মা বারান্দার গ্রিল ধরে নিচের উঠোনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টিয়া কাছে গিয়ে মায়ের গলাটা জড়িয়ে ধরে আধো গলায় বলল –কী হয়েছে মা, কে এত চেঁচাচ্ছে? বনানী অন্যমনস্ক গলায় বলল –বাসন্তীর বর। মেয়েটাকে নাকি বাসন্তী বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে! নালিশ করতে এসেছে তোর ঠাম্মার কাছে। মায়ের কথা শুনে বিস্ময়ে টিয়ার ঘুমের ঘোর কেটে গেল। বলল –কী, ওইটুকু মেয়ের বিয়ে? বাসন্তী মাসি কি পাগল নাকি?

–তাই তো দেখছি! দাঁড়া ভাল করে শুনি ব্যাপারটা।

উপেনর হাতে ধরা পারুল। পাশে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বাসন্তীও। রাগে যেন সে ফুঁসছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে গিন্নিমা শুনে চলেছেন উপেনের কথা -পারুলকে তার মাসির বাড়ি, সরবেড়ে হাটে পাঠিয়ে দিচ্ছিল বাসন্তী। মাসি তাকে আজ আনতে এসেছিল। উদ্দেশ্য নাকি,  সেখানে গিয়ে সে ভাল খাবে, পরবে। কিন্তু উপেন বলছে, বাসন্তী নাকি সেখানে পাঠিয়ে, মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কদিন থেকে সে আড়ি পেতে, বাসন্তী আর তার বোনের ফোনালাপ শুনেছে। কোন্ এক দুই ছেলের বাপ, বউ মরে গেছে বলে আবার বিয়ে করবে, তার সাথেই নাকি পারুলের…! আজ উপেন আড়তে চলে যেতে মাসি এসে পারুলকে নিয়ে যাচ্ছিল। রতন দেখতে পেয়ে উপেনকে খবর দিতে, সেই মাসির হাত থেকে পারুলকে ছাড়িয়ে নিয়ে টানতে টানতে সে সোজা গিন্নিমার কাছে এসেছে। সে গরিব হতে পারে, কিন্তু মেয়েটাকে তো খেতে দিতে, স্কুলে পড়াতে পারে সে। তাহলে কেন তাকে কথায় কথায় গরিব হওয়ার খোঁটা দেয় বাসন্তী! কেন সে নাবালক মেয়েটার বিয়ে দিতে চায়? আজ উপেন একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে! বাড়ির সবাই একে একে চেঁচামেচি শুনে নিচের বারান্দায় এসে হাজির হয়েছে। বাসন্তী এই সময় বেগতিক দেখে দমে না গিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে উপেনের ওপর -বেশ করব মেয়েকে বোনের বাড়ি পাঠিয়ে দেব! হাজার লেখাপড়া করলেও, ঝিয়ের মেয়ে ঝি-ই হয়। এর থেকে ভালো ওর বিয়ে হয়ে যাক! এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল পারুল, মায়ের মুখ ঝামটা শুনে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। এবার গিন্নিমার গলা শোনা গেল, –সবাই চুপ। আর কোন কথা নয়। এখন উপেন বাড়ি যাও, পরে আমি ভেবে দেখছি কী করা যায়। গিন্নিমার কথার ওপর আর কথা হয় না। সবাই যে যার কাজে পা বাড়ায়, উপেনও মেয়ের হাত ধরে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায়। এমন সময় তিনতলার ওপর থেকে –দাঁড়া পারুল, এই বলে টিয়ার হাত ধরে নিচে নেমে আসে বনানী। মনে মনে ভাবে, এ অন্যায় তো হতে দেওয়া যায় না! মেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়াবে, তবেই না স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারবে। তবেই না বাঁচতে পারবে নিজের শর্তে! নিজের জীবন দিয়ে একথা উপলব্ধি করেছে বনানী! বড় বৌদির গলা পেয়ে, পেছন ফিরে থমকে দাঁড়ায় উপেন। বাকিরাও সবাই কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে বনানীর দিকে। টিয়ার বুকের ভেতরটা দুরদুর করে ওঠে, মা আবার কী বলবে এর মধ্যে! নিচের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট গলায় বনানী বলে –পরে নয়, আজই শুনে যাও উপেন। আর বাসন্তী তুমিও শোনো। পারুলের সব দায়িত্ব আজ থেকে আমার। সব মানে সব। আর পারুলকে আমি নিজে পড়াবো আর হ্যাঁ, গানও শেখাবো। মার কথা শুনে হতভম্ব ভাবটা কেটে যেতে যেতে টিয়ার মনে পড়ে যায় ইনভলভমেন্টের কথা! আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে বলে –মা, তাহলে আর দেরি কেন, কাল তো পয়লা বৈশাখ! বছরের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়ে যাক পারুলের ট্রেনিং! টিয়ার কথা শুনে হইহই করে ওঠে সবাই। বনানীর মুখে হাসি ফোটে! বাসন্তী তার শিরাওঠা হাতের চেটো দিয়ে চোখের জল মোছে, তার মুখেও হাসি! ওদিকে সবার অলক্ষ্যে তখন ধীর পায়ে দোতলার সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে উঠতে গিন্নিমার মনে হয়, অনেক দিনের থমকে থাকা হাওয়াটা যেন আজ সারা বাড়ি জুড়ে চলাচল করতে শুরু করেছে। আর সেই হাওয়ায় তাঁর বুকের ভেতরের গুমোট ভাবটাও যেন কেটে যাচ্ছে!

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *