পূর্ব পুরুলিয়ার কুলটির সবুজ গ্রামসীমা থেকে উঠে এসে আজ অনুপর্ণা রায় বিশ্ব চলচ্চিত্রের মানচিত্রে ইতিহাস তৈরি করেছেন। তাঁর প্রথম ছবি সংস অফ ফরগটেন ট্রিস Songs of Forgotten Trees-এর জন্য ২০২৫ সালের ৮২তম ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের অরিজোন্টি বিভাগে সেরা পরিচালক পুরস্কার জয় করে তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন , প্রথম ভারতীয় পরিচালক হিসেবে।
এই সাফল্য নজিরবিহীন ,অসামান্য এবং অভুতপূর্ব কারণ সংস অফ ফরগটেন ট্রিস ঐ বিভাগে একমাত্র ভারতীয় ছবি।এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হচ্ছে বর্তমান বাংলা মেনস্ট্রিম ছবির কথা যেখানে এই ধরণের ছবি করার জন্য উৎসাহ দেওয়া তো অনেকদূর কাল থেকে এখন অবধি অনুপর্ণার এই দুর্দান্ত দিগ্বিজয়ী সাফল্যের কথা বলতে তথাকথিত মেনস্ট্রিম মিডিয়ার অতলান্তিক নৈঃশব্দ।কিন্তু ভরসার কথা এখন সমাজমাধ্যম আছে।ফেসবুকে দুটি লেখার অংশ ব্যবহার করা হচ্ছে ,একটি নির্দেশক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর অন্যটি সাংবাদিক প্রতীকের।
ইন্দ্রনীল লিখেছেন – অনুপর্ণা রায়ের ছবি ‘Songs of the Forgotten Trees’ ভেনিসের ‘ অরিজন্তি’ ( Horizons) বিভাগে সেরা ছবির পুরস্কার পেয়েছে। শুনেছি তিনি পুরুলিয়ার মেয়ে এবং তার খুবই কম বয়স। ভেনিসের Orizzonti, কান এর Un Certain Regard আর বার্লিনের Encounters বিভাগের সমতুল্য। এগুলি মেইন কম্পিটিশন এর পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ।
এটি নিঃসন্দেহে গত পঁচিশ-তিরিশ বছরে একজন বাঙালি পরিচালকের পাওয়া সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এবং ছবির খবর, আই রিপিট, খবর হিসেবে সবচেয়ে বড়।
ছবি নিয়ে আমার কিছু বলার অধিকার নেই, কারণ ছবি আমি দেখিনি এবং এটাও সত্য যে পুরস্কার আর উৎকর্ষ সব সময় সমার্থক নাও হতে পারে।কিন্তু বাংলা বিনোদন সংবাদ, যারা নায়কের পায়ের ফুসকুড়ি ও বিগত প্রেম নিয়ে ভাইরাল নিউজ করার জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থাকে তাঁদের গত রাত থেকে এই প্রায় চিৎকৃত নৈঃশব্দ আমাদের পরিষ্কার দেখিয়ে দেয় আমরা কারা। আর বাঙালি সংস্কৃতমনা গর্বিত ভদ্রলোক, যারা অনির্বাণের একটি আধা গান নিয়ে প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ রচনা করতে পারে তারাও বা কোন দিকে ধাবমান আর তাদের কুয়োর আকাশটুকু কত বড় তারও একটা পরিষ্কার মাপ পাওয়া যায়।ফলে কেউ যখন আমাদের দিকে বেঙ্গল ফাইলস ছুড়ে দেয়, , ওটা গু বলে বেশি রাগারাগি না করাই ভালো। আমরা জাতি হিসেবে ওটার জন্যই হাঁ করে বসে আছি।”
প্রতীক লিখেছেন – ‘অনুপর্ণা রায় বাংলা মাধ্যমের ছাত্রী কিনা জানি না, তবে পরিষ্কার শুনলাম, আমরা যারা বাংলা মাধ্যমের ক্যাবলা, তাদের মত করেই “অ্যাওয়ার্ড” বললেন। নাতিদীর্ঘ বক্তৃতার সবটাই অ্যাকসেন্ট-সচেতন বাঙালিকে লজ্জিত করবে। কলকাতার কনভেন্ট এবং পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে ওঠা ইংলিশ মিডিয়ামের সায়েব, মেমরা আড়ালে আবডালে “সো এম্ব্যার্যাসিং” বলছেন হয়ত। কিন্তু ব্যাপার হল, তাতে ঘন্টা এসে যায়। গত ৪০-৪৫ বছর ধরে বাঙালি একটা জিনিস নিয়ে তর্ক করে গেল — বাংলা মিডিয়াম ভাল, না ইংলিশ মিডিয়াম ভাল। কোনো বাপ-মাকে বোঝানো যায় না (আমাদের সময়ে তাও যেত, এখন একেবারেই যায় না), যে মিডিয়ামেই পড়াও, পড়ার বিষয়গুলো ভাল করে না শিখলে হবে লবডঙ্কা।
হচ্ছেও তাই। অ্যাকসেন্টের ধার না ধেরে একটা পুরুলিয়ার মেয়ে অত বড় মঞ্চে পুরস্কার পাওয়ার মত ছবি বানিয়ে ফেলল। ওদিকে কলকাতার যেসব নির্দেশক দাড়ি চুলকে একটা বাক্যে দশটার মধ্যে আটটা ইংরিজি শব্দ বলেন আর সিনেমায় আর্বানা, সাউথ সিটির পরিবার দেখান তাঁরা ধারে কাছে পৌঁছতে পারছেন না। যদি দর্শক টানার মত ছবি বানাতে পারতেন তাহলে অবশ্য এসব কথা বলতাম না। তরুণ মজুমদারও সারাজীবনে ভেনিস, কান, মাথা কোথাও গিয়ে উঠতে পারেননি। তাতে তিনি ছোট হয়ে যান না। কিন্তু এই যারা দরকচা মারা, তাদের যে আমরা দরকচা মারা বলে চিনতে পারছি না- এটা আমাদের শিল্প উপভোগ করতে পারার দৈন্য প্রকাশ করে।‘

ছবিটি দুটি মুম্বইয়ের অভিবাসী নারীর (নাজ শাইখ ও সুমি বাঘেল অভিনীত) জীবন ও সম্পর্কের নীরব আবেগ ও যুদ্ধকে সামনে নিয়ে আসে; শহুরে জীবনে টিকে থাকার সংগ্রাম আর বন্ধুত্বের নরম আবরণে আবৃত।
পুরস্কার ঘোষণা অনুষ্ঠানে ফরাসি পরিচালক জুলিয়া ডুকুর্নাও পুরস্কার তুলে দেন; অনুপর্ণা বাঙালি লাল পাড় সাদা শাড়িতে অভিষিক্ত হয়ে জানান, এই মুহূর্তটাই যেন “অবিশ্বাস্য’’। তিনি তাঁর টিম, অভিনেত্রী, প্রযোজক ও চলচ্চিত্রটিকে সমর্থন করা সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন বিশেষ করে অনুরাগ কাশ্যপকে।অনুপর্ণা রায় নিজেদের গ্রামের অনুষঙ্গ ও মুম্বইয়ের বাস্তব জীবনের গল্পকে মোহনীয়ভাবে চিত্রায়ন করে; দুটি মহিলার জীবনকে ঘিরে আবর্তিত গল্পের আবেগ, সহমর্মিতা ও চতুরতার রেখাকে পটভূমি করে তুলে ধরেছেন।
পারিবারিক প্রতিক্রিয়াও মর্মস্পর্শী। কুলটির মধ্যবিত্ত পরিবার, বাবা ব্রহ্মানন্দ ও মা মণীষা রায় ভেবেছিলেন চলচ্চিত্র তাঁর জন্য অস্থির ভবিষ্যৎ উপহার দিতে পারে, এবং বিয়ে-পরিচয় নিয়েও চিন্তিত ছিলেন। তবে এখন প্রতিটি উদ্বেগ আনন্দে মিশে গেছে: গ্রামের বাসিন্দারা, পরিবারের মানুষ সবাই তাঁর সাফল্য উদযাপন করতে ব্যাকুল।
এই জয় শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত সাফল্য নয়,বাংলা ও ভারতীয় নারী নির্মাতাদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা যাত্রা। অনুপর্ণা বলেন, “এই ফিল্মটি প্রত্যেক মহিলাকে উৎসর্গ, যাকে বরাবর চুপ করানো, অদৃশ্য করা বা হাল্কা করে দেখা হয়েছে। মুম্বাইয়ের পথে এই জয় যেন পৃথিবীর প্রতিটি গল্পকে বলার শক্তি জোগায়”
শেয়ার করুন :