ঝুমুর দত্তগুপ্ত
যতটা ঝাঁকুনি বা বাম্পি হবে ভেবেছিলাম। ততটা নয়। খুব জোরে আমাদের স্পিডপোটটা আন্দামান সাগরে জল কেটে চলতে থাকল। হাত বাড়ালে একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে ছোটো ছোটো পাথুড়ে টিলা , পাহাড়। ঠিক যেন মনে হচ্ছে পাহাড়ি দ্বীপগুলো জলের উপরে ভাসছে। ওই সব দ্বীপে বেশিরভাগেই নামা যায় না।
ফুকেট থেকে স্পিডবেটে চেপে আমাদের গন্তব্যস্থল হল ফি ফি আইল্যান্ড। স্পিডবোটে চেপে ফি ফি আইল্যান্ড ট্যুরটা সারাদিনে। শুধু ফি ফি আইল্যান্ডেই যাবে না আমাদের স্পিডবোট, সারাদিন ধরে স্পিডবোট সমুদ্রের বুক চিরে ঘুরে বেড়াবে আর আমাদের নিয়ে যাবে অনেক ছোটো ছোটো দ্বীপে। ছোটো ছোটো দ্বীপের মধ্যে ফি ফি আইল্যান্ডটাই বড় দ্বীপ।
স্পিডবোটে ওঠার আগে গাইড অনেক কিছু নির্দেশবালী দিল। দ্বীপে ঘোরার জন্য কী ধরনের চটি পরতে হবে, সমুদ্রের জলে তলার জগৎ দেখতে গেলে, এবং সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গেলে পরতে হবে বিশেষ ধরনের চশমা এবং জলে ভাসার জন্য লাইফ জ্যাকেট। সবই পাওয়া গেল ওই গাইডের কাছ থেকে। সেই সঙ্গে গাইড বলে দিল প্রতিটি দ্বীপ সম্পর্কে নানা তথ্য। সেই সঙ্গে বলে দিল সমুদ্র অশান্ত থাকলে স্পিডবোট ঝাঁকুনি খাবে। তাই স্পিড বোটে হাঁটাহাঁটি না করে বসে থাকাই ভাল।
স্পিডবোটে আমাদের সঙ্গে বেশিরভাগি বিদেশি পর্যটক। স্পিড বোট চলতে শুরু করতেই সমুদ্র ও তার চারিদিকে ছোটো ছোটো পাথু়রে টিলা ও পাহাড় দেখে সবার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠছে।
প্রায় আধঘন্টা স্পিড বোট যাওয়ার পরে আমাদের বোট থামল একটা জঙ্গল ঘেরা ছোটো পাহাড়ি আইল্যান্ডে। এই ছোট্ট আইল্যান্ডে যে বিচ সেই বিচে সাঁতার কাটা যায়। যারা সাঁতার জানেন তারা তো সাঁতার কাটতেই পারেন আর যারা জানেন না তারা লাইফ জ্যাকেট পড়ে নামলে ভেসে থাকতে পারবেন। ডুবে যাওয়ার কোনও ভয় নেই। সাঁতার কাটতে কাটতে বিশেষ চশমা পড়ে সমুদ্রের নিচে তাকালে দেখা যাবে সমুদ্রের প্রবাল, ছোটো ছোটো রঙিন মাছ।
এই সুযোগ হাতছাড়া অনেকেই করতে চাইলেন না। প্রায় সবাই স্পিড বোট থেকে নেমে গেল সাঁতার কাটতে। আমি এমনিতেই সাঁতার জানি না। তাও সবার দেখাদেখি স্পিড বোট থেকে এক পা সমদ্রের জলে দিতেই নিচে কোনও তল পেলাম না। ভয়ে ফের উঠে এলাম স্পিড বোটে। যদিও অনেকেই অভয় দিয়ে জানাল নিচে কোনও তল না পেলেও ভয়ের কিছু নেই। দিব্যি ভেসে থাকা যাচ্ছে। সাঁতরে একটু দূরে চলেও যাওয়া যাচ্ছে।
মাথার উপরে ঝকঝকে নীল আকাশ। আর সেই আকাশের নীল ঠিকরে পড়ছে সমুদ্রের জলে। সমুদ্রের এরকম জলের রং আগে কখনও দেখিনি। শুধু নীল রং নয় নীল রংয়ের নানারকম আভা থড়িয়ে পড়ছে সমুদ্রের জলে। যেন এক অপার্থিব দৃশ্য। জলের সেই নানা রং কেটে কেটে ভাসমান পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে স্পিড বোট আবার এগোচ্ছে অন্য একটা দ্বীপের দিকে। আরেকটা ছোটো দ্বীপ ছুঁয়ে আমরা চলে এলাম ফি ফি আইল্যান্ডে।
এই ফি ফি আইল্যান্ড এই এলাকার সবথেকে বড় আইল্যান্ড। এখানে রয়েছে অনেক হোটেলও। অনেক পর্যটক ফুকেটে না থেকে এই ফি ফি আইল্যান্ডেও থাকেন। ফি ফি আইল্যান্ডে জঙ্গলে নানা অ্যাডভেঞ্চারের মজাও রয়েছে। তবে আমাদের এই দ্বীপে সময়সীমা তিন ঘন্টা। দ্বীপে নামতেই আমরা চলে গেলাম স্কুবা ডাইভিং করতে। স্কুবা ডাইভিং করতে সাঁতার জানার দরকার নেই। স্কুভা ডাইভিং এর সময় একজন গাইড থাকেন। তিনিই গভীর সমুদ্রে সমুদ্রে নিয়ে যান।
প্রায় আধঘন্টার স্কুবা ডাইভিংয়ে দেখতে পেলাম সমুদ্রের তলার অচেনা জগৎকে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা, নিশ্বাস প্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে অনুভব করা গভীর সমুদ্র যেমন সুন্দর সেরকমই রহস্যময়। মনে হয় যেন সমুদ্রের গভীরের এক অনন্ত সময়কালকে স্পর্শ করে দেখছি।
ফি ফি আইল্যান্ডেই লাঞ্চ সেরে ফের স্পিড বোট করে রওনা দিলাম অন্য কোনও আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। একটা দ্বীপে গিয়ে দেখলাম সেখানে বাঁদরের উৎপাত। আরেকটা দ্বীপ আবার শুধুই শান্ত ও নির্জন। ওই আইল্যান্ডে ঢুকতে গেলে দুই পাথরের মধ্যে নিয়ে ঢুকতে হয়। আইল্যান্ডে বালির রং সাদা। ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম আরেকটি বিখ্যাত আইল্যান্ড যার নাম জেমস বন্ড আইল্যান্ড। এই আইল্যান্ডে জেমস বন্ড সিনেমার শ্যুটিং হয়েছিল বলে এই আইল্যান্ডের নাম জেমস বন্ড আইল্যান্ড।
এই ভাবে ঘুরতে ঘুরতে বেলা শেষে আমাদের স্পিডবোট ভিড়ল একটা ছোট্ট সাদা বালির দ্বীপে। ওই দ্বীপের বিচে অনেকেই স্নান করছে। বিকেলে সূর্য তখন প্রায় পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। ওই দ্বীপটা এমনই যে পিছন দিকে তাকালে মনে হয় পৃথিবীটা যেন এই দ্বীপের পরেই শেষ হয়ে গিয়েছে। এই দ্বীপে আমাদের থাকার সময়সীমা একঘন্টা। বিকেলের সূর্যের নরম আলোতে ওই দ্বীপের বিচে স্নান করে আমরা ফের উঠে পড়লাম স্পিডবোটে। এবার স্পিডবোট আমাদের নিয়ে যাবে ফুকেটে। যেখান থেকে স্পিড বোট ছেড়েছিল সেখানেই পৌঁছে যাব কিছুক্ষণের মধ্যেই। সারা দিনের সফর মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ইস আরেকটু যদি ঘোরা যেত ইতিউতি দ্বীপে। সমুদ্রের বুক চিরে স্পিডবোট চলছে ফুকেটের দিকে আর তখনই নামল ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামল। সফর শেষ হওয়ার সব মন খারাপ ধুয়ে গেল বৃষ্টিতে।
শেয়ার করুন :