কুরকুট থেকে বুরানশ-পুজোয় এক অন্য ভ্রমণের সন্ধানে -

ছবি- লেখক

কুরকুট থেকে বুরানশ-পুজোয় এক অন্য ভ্রমণের সন্ধানে 

কুরকুট, বেবিনকা, মুশি ক্রাজ, শ্রীভিলিপুথুর পালকোভা,কেন্দ্রাপাড়া রসাবলী অথবা বুরানশ… ফুড ট্যুরিজম।

দীপঙ্কর দাশগুপ্ত 

কুরকুট, বেবিনকা, মুশি ক্রাজ, শ্রীভিলিপুথুর পালকোভা, আত্রেয়পুরম পুথারেকুলু  কিংবা সিলাও খাজা, ঢেঙ্কানল মাগজি, কেন্দ্রপাড়া রসাবলী অথবা বুরানশ — এই নামগুলি কি চেনা লাগছে, নাকি একেবারে অচেনা? দেশের নানা প্রান্তের এমন প্রতিটি খাবার ও পানীয় নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্যের জন্যেই বিখ্যাত। কাজেই সেগুলি পেয়েছে জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জি আই) ট্যাগ। এগুলির কোনটির স্বাদ গ্রহণের সুযোগ হয়েছে নাকি কখনও? ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি ভোজনপ্রিয়ও বটে। বিরিয়ানি, কাবাব, মোমো, পাস্তা, পিৎজা, চাওমিনের বাইরে আরও অনেক ইন্টারেস্টিং খাবার রয়েছে যেগুলির পরিচয় পেলে আমাদের উৎসাহ কিন্তু বাড়বে। এবার পুজোয় কোথায় চললেন? যেখানেই যান সেখানকার দ্রষ্টব্য জায়গাগুলি যেমন দেখবেনই, তেমনই চাখতে ভুলবেন না সেখানকার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নানান আঞ্চলিক খাবার। ইদানিং দেশে-বিদেশে খুবই জনপ্রিয় ফুড ট্যুরিজম। অর্থাৎ আঞ্চলিক খাবারের নিরিখেও তৈরি করা যেতে পারে নিজস্ব ভ্রমণ-সূচি।

ঘরের কাছে আরশিনগর দিয়েই শুরু করা যাক। মনে পড়ে, বছর কুড়ি আগে জঙ্গলমহলে কয়েকজন আদিবাসী মহিলার ‘অনাহারে’ মৃত্যুর খবর রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে আলোচনার ঝড় তুলেছিল। তাঁদের নাকি সম্বল ছিল শুধুই কুরকুটের ডিম — বিশেষ ধরণের যে লাল পিঁপড়ে মেলে ঝাড়গ্রাম এবং ওড়িশা ও ছত্তিশগড়ের আদিবাসী অঞ্চলে। চমকপ্রদ ব্যাপার হল, সেই কুরকুটই হয়ে উঠেছে আজ সুপারফুড। ওড়িশার ময়ূরভঞ্জে আদিবাসীদের তৈরি কুরকুটের চাটনি বা কাই চাটনি গত বছরের গোড়ায় পেয়েছে জি আই ট্যাগ। ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ির জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ বা ওই অঞ্চলের নানা হোম স্টে-তে খোঁজ নিয়ে দেখুন, পর্যটকদের কাছে কাই চাটনির চাহিদা তুঙ্গে। সেটি এমনই এক ডেলিকেসি! সেই লাল পিঁপড়ের কামড় মারাত্মক। তীব্র জ্বালা যন্ত্রণার সঙ্গে গায়ে ফোস্কা পড়ে যায়।

ছবি-লেখক

প্রকৃতির কী অদ্ভুত লীলা! আবার সেই পিঁপড়ে আর তার ডিম দিয়ে তৈরি কাই চাটনি তেঁতুলের মতো টক-টক, অতি মুখরোচক, দুর্দান্ত  পুষ্টিকর এবং রোগ প্রতিরোধক। ব্রিটিশ শেফ গর্ডন র‍্যামসে ভারতীয় খাবারের ওপরে তথ্যচিত্র তৈরির কাজে তখন ছত্তিশগড়ে ঘুরছেন। সেই সময়ে তিনি কাই চাটনির সন্ধান পান যার স্বাদে তিনি একেবারে মোহিত! সেখানে থাকার সময় রোজ তাঁর খাবার পাতে একটু কাই চাটনি না হলে আর চলত না। আর এই কাই চাটনির কথা তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়া জুড়ে সেটি বিখ্যাত হয়ে ওঠে। তবে আদিবাসী জনজাতিদের মধ্যে কাই চাটনি খাওয়ার রীতি চলে আসছে সহস্রাধিক বছর ধরে। ‘কাই পিম্পুড়ি’ — ইংরেজিতে বলে ‘রেড  উইভার অ্যান্ট’। আদা, রসুন, ধানিলঙ্কা, সর্ষের তেল ও স্বাদমতো লবণ সহযোগে পিঁপড়ে ও পিঁপড়ের ডিম শিলপাটায় বেটে নিয়ে তৈরি করা হয় অতি সুস্বাদু কাই চাটনি। পিঁপড়ের পেটে থাকা ফরমিক অ্যাসিড কামড়ের সঙ্গে যেমন জ্বালা ধরায়, তেমনই সেই অম্লই আবার পিঁপড়ের স্বাদ-গন্ধও বাড়িয়ে তোলে। অনেকে পিঁপড়ের চাটনিতে টোম্যাটো, ধনেপাতা আর একটু চিনি বা গুড়ও যোগ করে। রুটি বা ভাতের সঙ্গে এই চাটনি খাওয়ার চল। কোন কোন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ উষ্ণ জলে পিঁপড়ে বাটা আর গোলমরিচ গুঁড়ো দিয়ে চমৎকার স্যুপ বানিয়ে খায়। তবে নিছক স্বাদই তো নয়, কাই চাটনি বিপুল জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করছে তার অসাধারণ ওষধি গুণের জন্যেও। বনবাসী মানুষ নিজেদের তাকত বাড়াতে পারিবারিক জীবনচর্যায় যা এতদিন ধরে পালন করে চলেছেন, আধুনিক গবেষণায় আজ তারই সত্যতা প্রমাণিত হচ্ছে। গবেষক বা সংশ্লিষ্ট সরকারি মহলে আজ আর জানতে বাকি নেই যে সাধারণ সর্দি-কাশি, জ্বরজারি, হুপিং কাশি থেকে শুরু করে জন্ডিস বা পেটের অসুখ সারিয়ে তুলতে, খিদে বাড়াতে, গাঁটের ব্যাথা উপশমে, বাতের ব্যাধি দূর করতে কিংবা শ্বাসকষ্ট লাঘব করতে কাইয়ের জুড়ি নেই। শরীরের ক্লান্তি ঘোচাতে, স্নায়ু শক্তি বাড়াতে, মস্তিষ্ক সচল রাখতে, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করতে ম্যাজিকের মতো কাজ করে কাই চাটনি। কাজেই ঝাড়গ্রাম, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা বা ছত্তিশগড়ে গিয়ে কাই চাটনি টেস্ট করতে ভুলবেন না।

ছবি- গ্রেসিয়ান ডি’সুজা

সামনে গোয়া যাওয়ার প্ল্যান আছে নাকি? তাহলে সমুদ্রের বিচে বসে পমফ্রেট বা ম্যাকারেলের রিচিডো মশলা ফ্রাই আর ফেনি যেমন উপভোগ করবেন তেমনই একদম মিস করবেন না ময়দা, ডিমের কুসুম, নারকেলের দুধ, লবণ, চিনি, ঘি ও জায়ফলের গুঁড়ো মিশিয়ে তৈরি অন্তত সাতটি লেয়ারের আশ্চর্য পুডিং বেবিনকা — গোয়ার মিষ্টান্নদ্রব্যের মহারানি। গাঢ় খয়েরি রঙের এই পুডিংয়ের ওপরে একটু আইসক্রিম দিয়ে খেতে অনেকের ভালো লাগে। বেবিনকা বানানো ধৈর্যের পরীক্ষা কারণ, প্রতিটি পরত ঠিক মতো বেক করে আস্ত পুডিং তৈরি হতে আট-দশ ঘন্টাও লেগে যায়। আগে ১৬ টি লেয়ারের বেবিনকা তৈরির চল থাকলেও এখন মোটামুটি তা হয় সাতটির। সারা বছর গোয়ার দোকানে বেবিনকা পাওয়া গেলেও বিয়ের ভোজে, নানা অনুষ্ঠানে, খ্রিসমাসের উৎসবে স্পেশাল এই পুডিংয়ের বিপুল সমাদর। পর্তুগিজরা নানারকম কেক বানাতে ছিল পটু। ডিমের কুসুম আর নারকেলের দুধ মিলিয়ে নতুন কিছু খাবার তৈরির পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে বেবিনকার সৃষ্টি। কথিত আছে, পুরনো গোয়ায় বিবিওনা নামে জনৈকা খ্রিস্টান নান পর্তুগালের রাজধানী লিসবন ও গোয়ার সাতটি পাহাড়ের প্রতীক হিসেবে সাত স্তরের বেবিনকা বানিয়ে গির্জার যাজকের কাছে নিয়ে যান। কিন্তু সেই পুডিংয়ের আকার ছোট হওয়ায় পরে কুড়িটি পর্যন্ত লেয়ারের বেবিনকা তৈরি করা হয়। ক্রমে তা ১৬ বা সাত লেয়ারে বানানোর প্রচলন ঘটে। ঠিক দু’ বছর আগে বেবিনকা জি আই ট্যাগ পেয়েছে। এমন পুডিং না খেলে গোয়া যাওয়া বৃথা।

কাশ্মীরে গেলে অন্তত একদিনের জন্যে হলেও সফর সূচিতে রাখুন উধমপুর। ঠকবেন না। সেখানে ডোগরাদের জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুড ‘মুশি ক্রাজ’ (Maeshi Kraj) বা ‘মিল্ক চাপাটি’ যার প্রধান উপকরণ হল হিমালয়ের অসাধারণ এক মেঠো পনির ‘কালারি’। মোষ, গরু বা ছাগলের দুধ থেকে মোৎজারেলা চিজের মতো সেই পনির বিগত কয়েকশত বা হাজার বছর ধরে বংশ পরম্পরায় বানিয়ে আসছে যাযাবর গুজ্জর সম্প্রদায়। সেই ঐতিহ্যের স্বীকৃতি স্বরূপ উধমপুর কালারি পেয়েছে জি আই ট্যাগ।  লোহার পাত্রে কাঠের ঘোটা দিয়ে প্রবল ভাবে দুধ মন্থন করে তাতে ‘মাঠা’র বা ছানার জল যোগ করে ছানা তোলা হয়। লোহার চাটুতে সেই ছানা বিছিয়ে ঠান্ডা করে পাতার বাটিতে রেখে আটার তালের মতো শক্ত করা হয়। তারপরে চড়া রোদে রেখে পুরো শুকনো হয়। এর বৈশিষ্ট্য হল, বাইরে শুকিয়ে গেলেও ভিতরে কালারি নরম থাকে। গরম তাওয়ায় চ্যাপ্টা করে কালারি রেখে তাতে কুচনো সবজি আর পেঁয়াজ দিয়ে নেড়েচেড়ে তার ওপরে স্থানীয় কুলচা বা পাঁউরুটি দিয়ে সেঁকা হয়। লঙ্কা, রসুন ও টম্যাটোর চাটনি সহযোগে গরম গরম কালারি কুলচা জনপ্রিয় এক জলখাবার।

ছবি-লেখক

দক্ষিণ ভারতে যদি যান তাহলে সফর তালিকায় রাখুন মাদুরাই — মৌর্য যুগের প্রাচীন শহরের আদি নাম ছিল মাদুরা। পাণ্ড্য রাজাদের আমলে ধ্রুপদী তামিল সঙ্গম সাহিত্যে মাদুরার গৌরবজনক উল্লেখ রয়েছে। মীনাক্ষী মন্দিরের জন্যে বিখ্যাত এই শহর তামিলনাড়ুর সাংস্কৃতিক রাজধানী। আর মাদুরাইয়ের কাছে আরেকটি বিখ্যাত মন্দির শহর শ্রীভিলিপুথুর। দক্ষিণ ভারতের দ্বাদশ বৈষ্ণব ঋষি-কবিদের মধ্যে একমাত্র মহিলা সাধিকা কবি বা ‘আলওয়ার’ ছিলেন অন্ডাল বা গোদা দেবী। কথিত আছে তুলসী তলায় শিশু অন্ডালকে আবিষ্কার করেন এক রাখাল। সেই পালক পিতার স্নেহচ্ছায়ায় বড় হতে থাকা অন্ডালের মধ্যে দেখা যায় বিষ্ণুর প্রতি সুগভীর ভক্তি। বিষ্ণু বন্দনায় সপ্তম শতকে তাঁর রচিত কবিতা ও গানের মাধুর্য আজও মাতিয়ে রেখেছে ভক্তদের। তাঁকে মনে করা হয় স্বয়ং মা লক্ষ্মীর অবতার। তাঁর তিনটি কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন শ্রীঅরবিন্দ। দ্রাবিড় ও বৈষ্ণব স্থাপত্যরীতির মেলবন্ধনে গঠিত অপূর্ব কারুকাজ সমন্বিত শ্রীভিলিপুথুরের মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয়েছে দেবী অন্ডালকে — ভক্তই যেখানে ভগবান। সেই মন্দিরের বিশেষ প্রসাদ হল পালকোভা। ১০০, ২০০, ২৫০ ও ৫০০ গ্রাম ওজনে বাটার পেপারে মোড়া হলুদ বা হালকা বাদামি রঙের কড়া ও নরম পাকের মাঝামাঝি এই সুস্বাদু মিষ্টি বিক্রি হয় শহরের সব মিষ্টির দোকানে। পাহাড় আর শ্যামল সবুজ মনোরম তৃণভূমিতে ঘেরা এই শহরের গরুর দুধের স্বাদই আলাদা। কারণ, ঘাস, খড়ের কুচি, ধানের তুষ, ভুসি, খোল সহ শুধু প্রাকৃতিক উপাদানই গরুকে জাবনা হিসেবে দেওয়া হয়। বাড়তি স্নেহপদার্থ থাকায় খাঁটি ঘন দুধ থেকে উৎকৃষ্ট খোয়া ক্ষীর ও ঘি দিয়েই তৈরি হয় পালকোভা। তামিল শব্দ ‘পাল’ মানে দুধ আর ‘কোভা’ অর্থাৎ খোয়া। দুধ জ্বাল দেওয়া এবং খোয়া পাক দেওয়া হয় তেঁতুল কাঠের ঢিমে আঁচে। প্রতি দশ লিটার দুধে মেশানো হয় মাত্র সোয়া কেজি চিনি। দশ কেজি দুধ থেকে তৈরি হয় সাড়ে তিন কেজি পালকোভা। এই জিনিস আস্বাদন না করে থাকা যায়!

তামিলনাড়ু থেকে চলুন এবারে অন্ধ্রে যাই। হায়দরাবাদের হালিম তো খাবেনই। কারণ, সেটিই হল রান্না করা একমাত্র পদ যা জি আই পেয়েছে। প্রতি বছর রমজানের সময় ‘হালিম ট্যুরিস্ট’দের সৌজন্যে হায়দরাবাদে বিক্রিবাটার পরিমাণ ছাড়িয়ে যায় ৮০০ কোটি টাকা। রান্নার অভিনব পদ্ধতি ও বংশ পরম্পরায় মুসলিম কারিগরদের অর্জিত অভিজ্ঞতার জন্যেই হায়দরাবাদের হালিম সুবিখ্যাত। বিশেষ ধরণের মাটির উনান বা ভাটিতে একমাত্র কাঠের আঁচে তামার ডেগে ১২ ঘন্টা ধরে তৈরি হয় হালিম। সম পরিমাণ গম, তেলেঙ্গানা ‘পোতলা’ বা বিশেষ প্রজাতির ভেড়ার মাংস আর ঘি হল হালিমের মূল উপাদান। তবে হালিম ছাড়া অভিনব একটি মিষ্টি খেতে হলে যেতে হবে আত্রেয়পুরমে। বিজওয়াড়া থেকে ট্রেনে দু’ঘন্টা। গাড়িতে ঘন্টা তিনেক। সেখানে মুখে-দিলে-গলে-যায় কাগজের মতো পাতলা আশ্চর্য এক মিষ্টির নাম পুথারেকুলু। তেলুগুতে পুথা মানে প্রলেপ আর রেকুলু মানে পাতলা চাদর। মহর্ষি অত্রির স্মৃতিধন্য তিনশ বছরের ঐতিহ্যসম্পন্ন এই মিষ্টান্ন আনন্দানুষ্ঠানে খেতেন রাজা রাজড়ারা এবং তাঁদের পরিবার। অন্ধ্রের বিয়েবাড়ির ভোজে এখনও তা জনপ্রিয়। মিষ্টির মহিমা এমনই যে আত্রেয়পুরম পুথারেকুলুর মর্যাদা রক্ষায় একটি ডাক টিকিটও প্রকাশিত হয়েছে। কথিত আছে মাটির হাঁড়িতে টগবগ করে ফুটতে থাকা ভাতের মাড় পাশের চুলায় বসানো তপ্ত মাটির পাত্রে উথলে পড়ে এক খন্ড পাতলা সাদা চাদরের রূপ নিয়েছিল। তার সঙ্গে চিনি মিশিয়ে ঘটে নতুন মিষ্টির উদ্ভাবন। আত্রেয়পুরম গ্রামবাসীদের অসামান্য কারিগরি দক্ষতা ও ব্যবসায়িক উদ্যোগে এই মিষ্টান্ন তৈরি এখন অর্থনৈতিক ভাবে সফল এক দুর্দান্ত কুটির শিল্প। সারা দেশে বিপণনের জন্যে অনলাইনে তো পাওয়া যায়ই, তাছাড়া রপ্তানি হয় বিদেশেও। নারকেল পাতার আঁচে উল্টো করে বসানো মাটির হাঁড়িতে চালের গোলার প্রলেপ দিলেই ম্যাজিকের মতো তা থেকে উঠে আসে বৃত্তাকার পাতলা চাদর। দোসার চেয়ে অনেক পাতলা তিনটি চাদর পরপর বিছিয়ে তাতে দেশি ঘি বুলিয়ে নরম করে ভিতরে দেওয়া হয় গুড় ও কাজুর কুচির পুর। অনেক সময় তার সঙ্গে থাকে ড্ৰাই ফ্রুটস ও চকোলেট। সেটিকে রোল করে বাটার পেপারে মুড়ে বাক্সে প্যাক করা হয়।

পাশের রাজ্য বিহারের গয়া, বুদ্ধগয়া, নালন্দা, রাজগীরে গিয়েছেন অথচ সিলাও খাজা খান নি, এটা হতেই পারে না! বারো থেকে ষোল পরতের মুচমুচে, সুস্বাদু এই গজার জন্যে বিখ্যাত নালন্দা জেলার সিলাও। খাজার রং ও আকার বিশেষে কোনটির নাম আবার পালবিদর, চাঁদশাহি ও গান্ধিটোপা। এই খাজায় নির্দিষ্ট অনুপাতে ব্যবহার করা হয় মে-জুন মাসে খেত থেকে ওঠা উচ্চ প্রজাতির মুরারিয়া গমের আটা, ময়দা, দেশি ঘি, গুড়, এলাচ ও মৌরি। কেজিতে খাজা ওঠে ৩৫-৪০ টি। বিহারের সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত সিলাও খাজার উল্লেখ মেলে ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ জে ডি বেগলারের রিপোর্টে। তিনি সিলাও গিয়েছিলেন ১৮৭২-৭৩ সালে। রাজা বিক্রমাদিত্যের আমল থেকেই এই খাজা চলে আসছে বলে বেগলার একটি কাহিনির উল্লেখ করেছেন। আবার গ্রামবাসীদের প্রচলিত বিশ্বাস ভগবান বুদ্ধ শিষ্যদের নিয়ে রাজগীর থেকে নালন্দা যাওয়ার পথে এই খাজা আস্বাদন করে সিলাওকে ধন্য করেন। খাজা তৈরির সঙ্গে বংশ পম্পরায় যুক্ত হালোয়াই সম্প্রদায়ের শাহরা। কালী শাহ ও কোকিল শাহের বংশধরেরাই এখন সিলাওয়ে ৫০-৬০ টি খাজার দোকান চালান।

ছবি- লেখক

পাশের রাজ্য ওড়িশায় পুরীর খাজার বাইরেও দুটি বিখ্যাত মিষ্টি হল ঢেঙ্কানলের মাগজি আর কেন্দ্রপাড়ার রসাবলি। ব্রাহ্মণী নদী তীরে ঢেঙ্কানলের গোন্ডিয়া, ভুবন, কামাখ্যানগর পূর্বঘাট পর্বতমালার শৈলশ্রেণীতে ঘেরা সবুজ অরণ্য ও গবাদি পশুর চমৎকার চারণভূমি। প্রাচীন রাজাদের আমল থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ জমানা এবং এখনও সমগ্র অঞ্চল মোষ পালনের জন্যে প্রসিদ্ধ। ফলে এটি মোষের দুধ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। দুধ, দই, চিজ যেমন প্রচুর তৈরি হয়, তেমনই মোষের দুধের ছানা, চিনি ও এলাচের গুঁড়ো মিশিয়ে ঢেঙ্কানল মাগজি তৈরি হয়ে আসছে অন্তত শতবর্ষ ধরে কাশীপুর, মন্দার, সদাঙ্গি, ভুবন, বিদরপুর, গোন্ডিয়া সহ ঢেঙ্কানলের সর্বত্র। আধুনিক ঢেঙ্কানলের ইতিহাস অনুযায়ী, ১৩০০-১৪০০ সালের মধ্যে শ্রীধর স্বামী নামের এক সন্ন্যাসী কপিলাস পাহাড়ে থাকার সময় শ্রীচৈতন্য তাঁর কাছে এসেছিলেন শ্রীমদ্ভাগবতের পাঠ নিতে। শ্রীধর স্বামী তাঁকে তখন রস মাগজি খেতে দেন। পরবর্তীকালে সেটি ঢেঙ্কানল মাগজি নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। না খেলে বোঝা যাবে না মাগজির অনন্য স্বাদ।

ব্রাহ্মণী, বৈতরণী ও মহানদীর শাখানদী দিয়ে ঘেরা ব-দ্বীপ হল কেন্দ্রপাড়া। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম পীঠস্থান কেন্দ্রপাড়ার উল্লেখ রয়েছে নানা পৌরাণিক গ্রন্থে তুলসীক্ষেত্র, গুপ্তক্ষেত্র, ব্রহ্মক্ষেত্র ও কেন্দ্রপালি নামে। মহাকাব্যের বিবরণ অনুযায়ী প্রভু জগন্নাথের দাদা বলদেব এখানে কান্দ্রাসুর দৈত্যকে বধ করেছিলেন। সেই থেকে জায়গাটির এই নাম। অসুর-কন্যা তুলসীকে বিবাহ করে বলদেব সেখানে অধিষ্ঠান করেন। কেন্দ্রপাড়ায় ২৬৪ বছরের প্রাচীন বলদেব জিউয়ের মন্দির বিখ্যাত। এছাড়া ভিতরকণিকা অভয়ারণ্য এবং জনপ্রিয় বৌদ্ধ তীর্থস্থান উদয়গিরি ও রত্নগিরি এই জেলাতেই। ব্রহ্মতালধ্বজ নামে পরিচিত বলদেবের রথযাত্রা বৃহত্তম উৎসব। কোজাগরী পূর্ণিমায় মহা সমারোহে আয়োজিত হয় গজলক্ষ্মী পুজো। এখানকার বিখ্যাত মিষ্টান্ন রসাবলীর সঙ্গে রয়েছে গভীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংযোগ। জগন্নাথদেবের ছাপান্ন ভোগ এবং বলদেব জিউয়ের মন্দিরে ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয় এলাচ-গন্ধী ঘন দুধে ডোবানো খাঁটি ছানার মিষ্টি রসাবলী। গৌড়ীয় পান্ডা ও সূপকারেরাই অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এই মিষ্টি বানিয়ে আসছেন বংশ পরম্পরায়। রসাবলী ছাড়াও জগন্নাথ ও বলদেবের পুজোয় নিবেদন করা হয় বিচিত্র নামের নানা মিষ্টি — জগন্নাথবল্লভ, খাজা, গজা, ফেনি, লুনি খুর্মা, মিষ্টি খুর্মা, কাকাতুয়া ঝিল্লি, চন্দ্রকান্তি, বড় কদম্ব, গোপালবল্লভ, খুয়া মন্ডা, ছেনাপিঠা, মাগজি লাড্ডু, পোড়া পিঠা, তাল, পুতুলি পিঠা, মুঠা গজা ইত্যাদি। ভিতরকণিকায় বিলুপ্তপ্রায় অলিভ রিডলি টার্টল বা বৌদ্ধ পর্যটনকেন্দ্র উদয়গিরি দেখার ফাঁকে কেন্দ্রপাড়ায় বলদেবজিউ মন্দিরটিও দেখুন আর তার অমৃতসম প্রসাদ রসাবলীর স্বাদে তৃপ্তি লাভ করুন।

ছবি- লেখক

মিষ্টির বাহার তো অনেক হল। এবারে তাহলে স্বাস্থ্যকর প্রাকৃতিক শরবতে কিঞ্চিৎ গলা ভিজিয়ে নেওয়া যাক। সেক্ষেত্রে আমাদের যেতে হবে দেবভূমি উত্তরাখণ্ডে। পাহাড় পর্বতে ঘেরা উত্তরকাশী, চামোলি, আলমোড়া, মায়াবতী, আউলি সহ গাড়োয়াল ও কুমায়ুনের পবিত্র শৈলশহর ও পাহাড়ি গ্রামগুলিতে শত শত প্রাচীন মন্দির আর সবুজ অরণ্য। আদতে মুনি-ঋষি, সাধু-সন্ন্যাসীদের নির্জন তপস্যাস্থল। শরীর ধারণের জন্যে তাঁদের অবলম্বন ছিল পাহাড়ি ফুল, ফল-মূল, বনের শাক-পাতা, সবজি। ক্রমে  স্থানীয় মানুষেরাও আবিষ্কার করলেন বুনো ফুল, ফল, শিকড়-বাকড়ের ওষধি গুণ। বুরানশ এমনই এক অসীম ওষধি গুণ-সম্পন্ন ফুল। অসাধারণ এই প্রাকৃতিক সম্পদকে উত্তরাখন্ড সরকার রাষ্ট্রীয় ফুল হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ, তুষারপাত বেশি হলে কখনও এপ্রিল-মে মাস অবধি পাহাড় হয়ে ওঠে অপরূপ লালে লাল — ‘উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রন গুচ্ছ।’ সাড়ে সাত হাজার ফিট অবধি উঁচু এই পর্ণমোচী গাছের ফুল রডোডেনড্রন। হিমালয়, কাশ্মীর, সিকিমে বুরানশ প্রচুর দেখা গেলেও এর নামের উৎপত্তি গ্রিক রডো অর্থাৎ গোলাপ এবং ডেনড্রন অর্থাৎ গাছ থেকে। গোলাপের মতো কিছুটা দেখতে বটে। লালি গুরাস বা গুরাস নামেও এই ফুল স্থানীয়দের কাছে পরিচিত। উজ্জ্বল লাল ছাড়াও ফুলের রং কোথাও গোলাপি, বিরল কিছু ক্ষেত্রে সাদাও। শরীর স্নিগ্ধকারী শরবত ছাড়াও এই ফুলের বহু ব্যবহার। পাহাড়ে গিয়ে শ্বাসকষ্ট হলে যেমন এই শরবতে নিরাময়, তেমনই ফুলের পাপড়ি বেটে কপালে প্রলেপ দিলে মাথা ধরা ছেড়ে যায়। বুরানশের পাপড়ি, তেঁতুলের ক্কাথ, একটু পুদিনা, কাঁচালঙ্কা বা শুকনোলঙ্কা আর রসুন দিয়ে বেটে সুস্বাদু চাটনি ভাতের পাতে বা পরোটার সঙ্গে চমৎকার। শুধু মুখরোচক নয়, এই চাটনি নিয়মিত খেলে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, ঋতু বদলের সময় অহেতুক জ্বরজারি, সর্দি-কাশি থেকে রেহাই মেলে। বিকেলে চা-কফির সঙ্গে বুরানশের পাকোড়া খেয়েই দেখুন একবার হোম-স্টের বারান্দায় বসে পাহাড় দেখতে দেখতে। শরীর সুস্থ রাখতে উত্তরাখণ্ডের মানুষ তো বুরানশ ফুলের টক-মিষ্টি পাপড়ি এমনিই চিবিয়ে খান। নাক দিয়ে রক্ত পড়া, বাতের ব্যথার উপশম করে। হার্ট, লিভার ভালো রাখে, ডায়াবেটিসের পক্ষেও উপকারি। বুরানশের আচার, জ্যামও জনপ্রিয়। পাহাড়ে এই ফুল আর তার রসের তো অভাব নেই, তাই খাট-বিছানা-বালিশ-কম্বলে ছারপোকা তাড়াতেও বুরানশ ভরসা। মোক্ষম প্রাকৃতিক দাওয়াই!  

তাহলে আর অপেক্ষা কেন? পুজো বা শীতের ছুটিতে বেরিয়ে পড়ুন আর গন্তব্যে পৌঁছে খুঁজে নিন এমন কিছু খাদ্য-পানীয়। জি আই স্বীকৃতি পাওয়া বিভিন্ন রাজ্যের এই সব খাবার অমূল্য জাতীয় সম্পদ কারণ সেগুলির মাধ্যমে সারা দেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই প্রতিফলিত। এমন ধরণের খাদ্য পর্যটনে বের হলে তাই তার অন্য সার্থকতা।

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *