২০২৩ সালে বছর সেরা সুকন্যাদের কথা।মেয়েবেলার এক আকাশে এই দীপ্তিময়ীদের অমূল্য অসামান্য দৃষ্টান্তমূলক কাজ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে আলো দেখাবে অসংখ্য মেয়েকে যারা রোজ অসম জীবনযুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে।সমাজমাধ্যমে শুধু পেজ থ্রি সেলেব্রিটিদের নিয়ে অবিরাম চর্চার পাশে প্রচারের আলো এড়িয়ে এই সুকন্যাদের উন্মীল উদ্ভাস।
রঙিলী বিশ্বাস
পেশায় অর্থনীতিবিদ,সঙ্গীতশিল্পী এবং লেখিকা।লোক সঙ্গীত ও গণসঙ্গীতের দিকপাল গায়ক, গীতিকার সুরকার ,আই পি টি এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা,সমাজকর্মী মান্য হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কন্যা। রঙ্গিলী দ্বিভাষিক লেখিকা।লিখেছেন ফিকশন,নন ফিকশন,প্রবন্ধ, ভ্রমণকথা, সম্পাদনা করেছেন ৩টি বই।পেয়েছেন বাংলা অ্যাকাডেমি পুরস্কার এবং কথা পুরস্কার ,এছাড়া পাবলিক অ্যান্ড পলিটিকাল ইকোনমিক্স সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ লিখেছেন।
ইন্ডিয়ান ফাউন্ডেশন ফর আর্টসের ফেলোশিপ নিয়ে বর্তমানে প্রথিতযশা ভূপেন হাজারিকা ও পিতা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের একসঙ্গে করা কাজ যা ১৯৪০ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত ব্যাপ্ত সেই সংরক্ষণের কাজে সম্পৃক্ত।
১৯৮৭ সালে হেমাঙ্গবাবুর চলে যাওয়ার পর ওনার বাড়ি জিরনী থেকে সংগৃহীত ওনার প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত লেখা,ডায়েরি,বই,নোটস ,রেকর্ড,ক্যাসেট,গুরুত্বপূর্ণ পুরোনো ছবি,লোকসঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্র,আর দৈনন্দিন ব্যবহৃত জিনিসপত্র থেকে রঙ্গিলী আহরণ করছেন ১৯৪০-৬০ সাল অবধি ওনার এবং ভূপেন হাজারিকার একসঙ্গে যুগান্তকারী কাজ।এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের সূত্রে রঙ্গিলী ঘুরছেন নানা জায়গায় ,কথা বলছেন আর সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন সেই সময়ের গণনাট্য সংঘের মানুষদের সঙ্গে,লিপিবদ্ধ করছেন তাদের মুখে সেই সময়ের কথা,সংগ্রহ করছেন গানের অংশ, অনুবাদ করছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের লেখা সেই সময়ের কথার।ওনাদের একসঙ্গে করা কাজ ‘হারাধন রংমন কথা’,’ঝক ঝক রেল চলে’,’পথে নামো আলোকের সেনা শিল্পী দল’ গান সৃষ্টি ও গান গাওয়ার স্মৃতিফলক ।এর সঙ্গে একটি সিডিতে রঙ্গিলীর কণ্ঠে বাবার ৩টি গান রয়েছে,এছাড়া রয়েছে একটি ডিভিডি যেখানে রঙ্গিলীর সঙ্গে নানা মানুষের সাক্ষাৎকার ও কাজের ধারার বিবরণ রয়েছে।
রঙ্গিলীর নিজের কথায় এই কাজের গুরুত্ব অপরিসীম কারণ এই ডকুমেন্টশন প্রজেক্ট অতীতের হারিয়ে যাওয়া সঙ্গীতসৃষ্টি,গণনাট্য আন্দোলনে এই দৃপ্ত গানের সংযোগ, ভূমিকা এবং সংস্কৃতিকে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব।
যে গান প্রতিবাদী,যে গান হিংসা রুখতে পারে,যে গান সাধারণ খেতে খাওয়া নিপীড়িত মানুষের দলবদ্ধ প্রতিরোধের গান,সেই গানের সময়কাল নিয়ে রঙ্গিলীর এই গবেষণা বাংলা লোকসঙ্গীত, গণসঙ্গীতে দুই কিংবদন্তি হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও ভূপেন হাজারিকার ভূমিকা ও অবদানকে সংরক্ষণ করার এই মহৎ কাজের দীপ্তিময়ী এই সুকন্যা।
পদ্মশ্রী প্রীতিকণা গোস্বামী
নকশি কাঁথা শাড়ির ঐতিহ্য ও পরম্পরা সমৃদ্ধ সত্তরোর্ধ প্রীতিকণা গোস্বামী এই বছরে পদ্মশ্রী পুরস্কার পেলেন। মাত্র ১০ বছর বয়েস থেকে বাবার মৃত্যুর পর মা ও ৫ বোনের সংসারের হাল সামলাতে সুদীর্ঘ ৬০ বছরের অক্লান্ত,অসামান্য সৃষ্টিশীল পরিশ্রমের সুবাদে অনেক মেয়ের কাজের সুযোগ করে দিতে পেরেছেন এবং ওনার কন্যা মহুয়ার কথায় মা সবচাইতে আনন্দ পান যখন শোনেন তাঁর ছাত্রীরা কাজের সুযোগ পেয়েছে ।
বাবার চলে যাওয়ার পর মা ও পাঁচ বোনকে নিয়ে জেঠুর বাড়ি,সেখানে বন্ধু রমা দাসের সেলাইয়ের কাজ দেখে উৎসাহ,সেখান থেকে পিতাম্বরী সংস্থার কাছে সেলাইয়ের কাজের অর্ডার,১৯৯০ সালে ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্রাফ্টস কাউন্সিল থেকে নকশিকাঁথার কাজের সুযোগ,সেই কাজে অভাবনীয় সাফল্যের পরেই ওই কাউন্সিলে নকশিকাঁথা কাজ শেখানোর দায়িত্ব পাওয়ার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি এই মহীয়সীকে।
২৫০ বছরের প্রাচীন এই নকশি কাঁথা বাংলার সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন।সোনারপুরের এই সুকন্যার কাজ এখন বিদেশে রপ্তানি হয়।তাঁর প্রতিষ্ঠিত কমলাদেবী কাঁথা সেন্টারে বিনামূল্যে কাজ শিখে কাজ করছেন অসংখ্য মেয়েরা।
তিতাস সাধু
দুটো স্পেল। ৪ -০ -৬-২ আর ৪-০ -৬ -৩ ।প্রথমটি ফাইনালে ইংল্যান্ডের সঙ্গে,দ্বিতীয় সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যা ভারতকে গোল্ড মেডেল এনে দেওয়ার অন্যতম দুর্দান্ত নিদর্শন।চুঁচড়োর সুকন্যা তিতাস রাজেন্দ্র স্মৃতিসংঘের মাঠে স্কোর লিখত।একদিন প্লেয়ার না আসায় নেটে বল করায় জীবন পাল্টে যায় তিতাসের।বর্ডার পরীক্ষায় ৯০% নম্বর পেয়েও এর পরে ক্রিকেটই ধ্যানজ্ঞান করে নেওয়া ।তিতাসের প্রতিভা দেখে কোচ প্রিয়াঙ্কর মুখার্জি বাংলা দলের সতীর্থ শিবশঙ্কর (ম্যাকো) পালকে তিতাসের কথা বলায় অনুর্ধ ১৬ বাংলা দলের ক্যাম্পে ৫ফুট ৯ ইঞ্চি উচ্চতার তিতাসের বলের লেংথ আর অফ দ্যা সারফেস বলের দক্ষতা মুগ্ধ করে ম্যাকোকে যিনি স্নেহাশিস গাঙ্গুলিকে বলে সিনিয়র বেঙ্গল টিমে সুযোগ করে দেন যার পর ভারতের হয়ে এই দুর্দমনীয় দূরন্ত সাফল্য। ভারতের ফাইনালে জেতার পর কোচ ম্যাকোকে ফোন করে তিতাস ধন্যবাদ জানিয়েছেন বলেছেন কোচ ম্যাকো।
রিচা ঘোষ
শিলিগুড়িতে যে ক্লাবে খেলতেন সেখানে রিচা একমাত্র মেয়ে।সেখান থেকে তার যাত্রা শুরু করে এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রিচা ঘোষ যে বিপুল সাফল্য অর্জন করেছে ,টি টোয়েন্টিতে বিগ ব্যাশ লীগ এবং আরসিবির তাকে ১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা দিয়ে দলে নেওয়া রিচার তুঙ্গস্পর্শী সাফল্যের স্বীকৃতি। রিচার আশ্চর্য দক্ষতা তিনি উইকেটকিপার আর বোলার যা ক্রিকেটে বিরল। সচিন তেন্ডুলকার ও মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ভক্ত রিচার ভারতীয় ক্যাপ্টেন হারমানপ্রীত কৌরের খেলার অনুরাগী।শুরুর দিনে একদিন বোলার আর একদিন উইকেটকিপার এভাবেও বহু ম্যাচ খেলেছেন রিচা।এশিয়ান গেমসে সোনা জিতে শিলিগুড়িতে ফিরে রিচা জানালেন একজন খেলোয়াড়ের বাদ পড়া তাকে আরো ভালো খেলতে উদ্বুদ্ধ করে। বাঘাযতীন ক্রিকেট কোচিং সেন্টারের প্রশিক্ষক বিবেক সরকার জানালেন শিলিগুড়ির ঋদ্ধির মতন রিচারও ছোটবেলা থেকে জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন ছিল তা এত তাড়াতাড়ি সম্ভব হওয়াতে সবাই খুব খুশি।এর সঙ্গে আর একটি অত্যন্ত তাৎপর্য্যপূর্ণ বিষয় হল এখন সেই ক্লাবে ক্রিকেট খেলা শিখতে আসা শ্রেয়া,শিঞ্জিনীদের স্বপ্ন রিচা ঘোষ হওয়ার। আগামী দিনে রিচার আরো অনেক সাফল্যের প্রত্যাশায় শিলিগুড়ি সহ গোটাবাংলা আর ভারত।
দামিনী বেণী বসু
সম্প্রতি ওয়েব সিরিজ ‘ছোটোলোক ‘এ পুলিশ এস আই সাবিত্রী মন্ডলের অভিনয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছেন ।সমাজ মাধ্যমে,পত্র পত্রিকায় প্রশংসা,মুঘ্ধতায় আচ্ছন্ন সিনেপ্রেমী সবাই।গ্রূপ থিয়েটারের মান্য শ্রী অসিত বসু ও ভদ্রা বসুর কন্যা দামিনী বেণী বসু বাবা মার্ পলিটিকাল থিয়েটারের সান্নিধ্যে বড় হওয়া।একসময়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের বাড়িতে থাকা ,বাবা মার কাছ ছেড়ে উষা গাঙ্গুলির থিয়েটার গ্রূপে নাটক করা,পরে বিভাস চক্রবর্তী,অরুন মুখোপাধ্যায়,সুজন মুখোপাধ্যায়,অঞ্জন দত্ত,সৃজিতের সঙ্গে কাজ করা। জ্যেষ্ঠপুত্র ছবিতে নিজের প্রতিভার বিচ্ছুরণে চমকে দিয়েছিলেন।
এহেন দুর্দান্ত অভিনেত্রীকে অনেক ঝড় ঝাপ্টা সামলাতে হয়েছে।বিয়ে ভেঙে যাওয়া ,সন্তানের কাস্টডি পাওয়ার যুদ্ধ,অর্থনৈতিক সঙ্কট পেরিয়ে ঋতুপর্ণর পরামর্শ মেনে অভিনয় শেখার ক্লাস নেওয়ার সঙ্গে ঋতুপর্ণ ঘোষ,বিশাল ভরদ্বাজ,কৌশিক গাঙ্গুলি,সুজিত সরকারের ছবির কনসালটেন্ট হওয়ার কৃতিত্ব, দুর্দান্ত অভিনয়,ওনার অ্যাকটিং ওয়ার্কশপে অভিনয় শিখতে আসা অঞ্জনা বসু,উষশী,রাহুল বসু,সোহিনী সরকার,মিমি,নাইজেল। অভিনয়,সিনেমা,থিয়েটারের সঙ্গে এই দীপ্তিময়ী ইউংগিয়ান ও এসোটেরিক সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি থিয়েটার আমেরিকান নাট্যশিক্ষক কিংবদন্তি এরিক মরিসের সিস্টেম অফ বিয়ন্ড মেথড অ্যাকটিং শিখছেন স্বয়ং এরিক মরিসের কাছ থেকে।
নাম টা মনে রাখবেন। দামিনী বেণী বসু।
শেয়ার করুন :