সুহাসিনী -

গ্র্যাফিক্স - সৌরভ হাজারী

সুহাসিনী 

পুজোর আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। মুখার্জি বাড়িতে ব্যস্ততা তুঙ্গে।

অনিন্দিতা পাত্র

কেউ যেন দূর থেকে মিঠাইয়ের নাম ধরে ডাকছে। খুব চেনা গলা! ধীরে ধীরে ডাকটা এগিয়ে আসছে একদম কানের কাছে। ঘুমটা ভেঙে গেল দুম করে! মা ধাক্কা দিয়ে বলছে —উফফ্! এই অবেলায় কী যে ঘুমোস! বৃষ্টি এসেছে ছাদে চল। একছাদ জামাকাপড় মেলা আছে। এই এক সমস্যা হয়েছে। আষাঢ় পেরিয়ে গেল বৃষ্টির দেখা নেই, আর এই শ্রাবণে এসে হরদম ঢালছে আকাশ! আর মা ও তেমন, রোজ এককাঁড়ি করে জামাকাপড় কাচে। বিছানা থেকে নেমে অনিচ্ছা স্বত্বেও ছাদের সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল মিঠাই। ছাদে গিয়ে অবশ্য দেখল মা, জেঠিমা, রাঙাকাকিমা, ফুলপিসি, বুলিদিদি, মণি সবাই ছোটাছুটি করে জামাকাপড় তুলছে। বৃষ্টিও পড়ছে সামান্য, দু’চার ফোঁটা। মিঠাই চিলেকোঠার দরজায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আকাশ দেখল। তেমন মেঘ নেই। সূর্য ডুববে এবার, পশ্চিমের আকাশে লালচে ছোপ! জামাকাপড় তুলে কার্নিসের ধারে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল সবাই। ওকে কেউ খেয়াল করল না। ধীরে ধীরে দোতলায় নেমে নিজের ঘরে আবার ঢুকে গেল মিঠাই। ফোনটা অন করে দেখল প্রতীকের দুটো মিসড্ কল। টাইম দেখে বুঝল প্রায় চল্লিশ মিনিট সে ঘুমিয়েছে। মিঠাইয়ের ফোনটা এমনিতে ভাইব্রেট মোডে থাকে। ঘুমানোর সময় সাইলেন্ট করে দেয়। এই নিয়ে প্রতীক তাকে অনেক কথা শোনায় —কত জরুরি কল থাকে, একেবারে সাইলেন্ট করেই ঘুমতে হয়?

—সারাদিন গেল, আমি ঘুমালেই লোকের জরুরি কথা কেন মনে পড়বে? আর যদি পড়েও, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে ক্ষতি কী? মিঠাইয়েরও সাফ কথা! এখনই প্রতীককে কল ব্যাক করতে ইচ্ছে করল না মিঠাইয়ের। পরে কথা বলবে ব’লে একটা টেক্সট করে দিল। মা এক্ষুনি নিচে আসবে, তার হাতে ফোন দেখলেই খ্যাচ খ্যাচ করে আজকাল। যেন মিঠাই কী গর্হিত অপরাধ করছে! তাছাড়া এখন তার একটু চা খেতে ইচ্ছে করছে। আজকাল কলেজের ক্যান্টিনে চা খেয়ে খেয়ে নেশাটা ধরেছে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে এ বছরেই কলকাতার কলেজে অ্যাডমিশন নিয়েছে মিঠাই। ওদের শেরপুর থেকে বাসে আধঘন্টা যেতে লাগে কলকাতা। মর্নিং কলেজ, ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যায়। ফিরে এসে ভাত খেয়ে একটু না ঘুমালে রাতে পড়তে পারে না। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে মিঠাই বলল —মা, একটু চা করে দাও না। মা ঘরে এসে ঢুকল, হাতে শুকনো জামাকাপড়। চাপা গলায় বলল —তোকে যে ডেকে গেলাম! আজকাল কোন কথাই শুনতে চাস না!

—বা রে, গেলাম তো! তোমরা অত জন মিলে জামাকাপড় তুলছিলে অলরেডি!

—হ্যাঁ। আমি একা তুলছি দেখে হাত লাগাল ওরা। আমি কি না বলব?

—না বলবেই বা কেন? নির্লিপ্ত গলায় বলল মিঠাই। মা ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে মিঠাইয়ের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় বলে গেল, বাবা অফিস থেকে ফিরলে তবেই চা হবে। মা সব সময় ইনফিরিয়র কমপ্লেক্সিটিতে ভোগে! কাকিমা জেঠিমারা বড়লোকের মেয়ে। মিঠাই কতবার বুঝিয়েছে, বড়লোক হওয়াটা কোন ক্রেডিটের নয়। মানুষকে পারসোনাল কোয়ালিটি দিয়েই জাজ করা হয়! কিন্তু কে কার কথা শোনে!  

সুহাসিনী বসেছিল খোলা জানলার পাশে। আজ মনটা তার ভাল আছে। অনেকদিন পরে আজ রণের সাথে কথা হয়েছে। ওইটুকু ছেলে আধো আধো গলায় কত কথা বলল ঠাম্মার সাথে। ছড়া শোনালো ‘বাবুরাম সাপুড়ে’। সুহাসিনীর চোখ জলে ভরে গেল। মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় বাপ্পাকে ছড়া শেখানোর দিনগুলোর কথা। সুহাসিনীর কানে ফোন, চোখে জল দেখে জয়া বলল —নাতি বুঝি মাসিমা? অত ভালো ছেলে বউমাকে ছেড়ে শুদুমুদু পড়ে আছেন বৃদ্ধাশ্রমে! ওদেশে গিয়ে তো থাকতে পারেন। জয়াকে আঙ্গুলের ইশারার চুপ করতে ব’লে রণের কথায় মন দিয়েছিল সুহাসিনী। জয়া বিকালের ছানার বাটিটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে। ইচ্ছে কি সুহাসিনীরও করে না, ছেলের সংসারের একজন হয়ে থাকতে? নাতিটাকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ঘুমতে? খুব করে ইচ্ছে! বুক ফেটে যায় মাঝে মাঝে! কিন্তু কী এক অপেক্ষা, নাকি লোভ তাকে আটকে রাখে এদেশে! কলকাতায়। বাপ্পা আজ প্রায় সাত বছর চাকরি নিয়ে সাউথ আফ্রিকায় চলে গেছে। তিনটে শহর ঘুরে এখন কেপটাউনে থিতু হয়েছে। রণের জন্মও ওদেশে। জন্মের পরে ছ’মাস সুহাসিনী ওখানে গিয়ে ছিলও। বাপ্পা বৌমা পাকাপাকিভাবে তাকে ওখানে থাকার জন্য পীড়াপীড়ি কম করেনি! তবু সুহাসিনী ফিরে এসেছিল। এরপর রণের দু’বছরের জন্মদিনে আবার সুহাসিনী গিয়ে মাসছয়েকের জন্য থেকে এসেছে। ওরাও প্রতিবছর আসে। শেষ পর্যন্ত গতবছর এসে সুহাসিনীর কথায় বাপ্পা বারাসতের অত বড় বাড়িটাতে চাবি মেরে, নিউটাউনের এই ‘নিজ নিকেতন’ বৃদ্ধাশ্রমে তার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে। তার আগে অবশ্য সুজিত বৃদ্ধাশ্রমের ব্যাপারে সব খোঁজখবর নিয়ে রেখেছিল। সুজিতের আশ্বাসেই  বাপ্পা তাকে এখানে রাখতে রাজি হয়েছে। এই নিয়ে মা ছেলেতে অনেক মন কষাকষিও হয়েছে। বাপ্পার বক্তব্য —তোমার যদি একাকীত্বই হয়, তবে বৃদ্ধাশ্রম কেন, তুমি আমাদের কাছে কেন যাবে না? কিন্তু শেষমেষ মায়ের মনের গভীরের ক্ষততে আর খোঁচাখুঁচি না করে, রাজী হয়েছে মায়ের সিদ্ধান্তে। ইচ্ছে হলেও মুখ ফুটে মাকে জিগ্যেস করতে পারেনি —যারা তাড়িয়ে দিল, তারা আমার থেকেও আপন হল তোমার কাছে!? তবে অজিতেশ বেঁচে থাকতে বহুবার বুঝিয়েছিল —সুহাস, যে আশা নিয়ে তুমি বেঁচে আছো, সে আশা এ জীবনে পূরণ হবে না। তোমার দাদারা যদি বোনকে ভালইবাসত, তবে অনেক আগেই তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেত মুখার্জি বাড়িতে। সুহাসিনী চুপ করে থেকেছে অজিতেশের কথায়। তার মনেও যে এমন আশঙ্কা আসেনি তা নয়। কিন্তু সব আশঙ্কা পেরিয়ে কী যেন এক আশায় বুক বেঁধেছে সে বার বার। 

—দেখ মেজ, তোর বাপেদের না হয় নামডাক নেই। কিন্তু আমার বাপেদের, দিদিদের এই পুজোআচ্চায় না নিমন্ত্রণ করলে আমার নাক কাটা যাবে!

—সে তো বুঝতে পেরেছি দিদি। আসলে পৃথিবী জুড়ে যে মারণরোগ গেল, তারপর থেকে ব্যবসার অবস্থার কথা ভেবেই বলছিলাম, এবার না হয় …..

—তুই আমি নয় বাদ দিলুম। কিন্তু বড়জনেরা কি বাদ দেবে? তাদের গুষ্টিশুদ্ধ সব তো নিমন্ত্রণ হবে!

—তা বটে! ব’লে চুপ করে যায় অপর্ণা। বড় জায়ের মুখের ওপর আর কথা বলে না। বড় জা শুধু বয়সে অনেকটা বড় ব’লে নয়, সংসারী বুদ্ধিতে, অভিজ্ঞতায়ও তার থেকে অনেক এগিয়ে। অপর্ণার বয়স যখন সতেরো, শেরপুরের মুখার্জি বাড়িতে বিয়ে হয়ে এসেছিল। বাপ মা মরা অপর্ণা, মামাবাড়িতে মানুষ। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বাড়িতেই বসেছিল। মামার এক বন্ধু ঘটকালি করে বিয়ে দেয়, অপরূপা সুন্দরী অপর্ণার সাথে এ বাড়ির মেজ ছেলের। প্রায় খালি হাতেই বউ হয়ে এ বাড়িতে এসেছিল অপর্ণা। বাড়িতে তখন শ্বশুর শাশুড়ি ছাড়া ভাসুর জা, জায়ের দুই ছেলে মেয়ে, এক দেওর আর দুই ননদ! বড় ফ্যামিলি মুখার্জিদের। তবে জাহাজের মত বাড়িটা মাঝখান থেকে ভাগ করা। একদিকে যেমন তার শ্বশুরের বাস, উল্টোদিকে শ্বশুরের বড় দাদা থাকেন তাঁর ফ্যামিলি নিয়ে। তাঁদেরও গুষ্টি কম নয়। তবে এক বাড়িতে থাকলেও ব্যবসা, সংসার বহুদিন থেকেই আলাদা। শুধু ভাগ হয়নি বাড়ির চৌহদ্দির ভেতরের পাঁচ পুরুষের বাঁধানো দুর্গাদালান! প্রতি বছর দুর্গাপুজোর পাঁচটা দিন দুই ভাইয়ে একসাথে খাওয়া দাওয়া, ওঠাবসা করে আজও। শেরপুরের মুখার্জিদের কয়েকশো বছরের পুরনো দুর্গাপুজোর কথা দূর দূরান্তের মানুষ জানে। পোটো পাড়া থেকে তৈরি করে আনা মাটির দূর্গা নয়, বহু প্রাচীন পেতলের একচালার দূর্গাই মুখার্জিবাড়ির ঐতিহ্য! বাড়িতে আত্মীয়কুটুম, লোকলস্কর, ঢাকিঢুলির মেলা বসে এই পুজো উপলক্ষে। বাড়ির বৌদের বাপের বাড়িতে নিমন্ত্রণ হয়, বিবাহিত মেয়েরা আসে বাপের বাড়ির পুজো দেখতে, এছাড়া বাড়ির ছোটছোট ছেলেমেয়েদের স্কুল কলেজের বন্ধুরাও আসে মুখার্জি বাড়ির ঐতিহ্যশালী পুজো দেখতে। এখন এ বাড়ির মেয়েরাও কলকাতার কলেজে পড়তে যাচ্ছে। অপর্ণার একটাই মেয়ে মিঠাই, সল্টলেকের কাছে নামকরা একটা কলেজে মাস-কম্যুনিকেশন নিয়ে ভর্তি হয়েছে এ বছর। অপর্ণার বড় জায়ের ছেলে সুমন কলকাতার কলেজ থেকে বিএসসি পাস করে এখন এমএসসি পড়ছে। অপর্ণার জায়ের মেয়ে বুলি অবশ্য এখানকার কলেজ থেকেই বিএ পাস করেছে। তার বিয়ের দেখাশোনা চলছে। রঘুনাথপুরের নামকরা বাড়ির মেয়ে অপর্ণার বড় জা। শাশুড়ি মারা যাওয়ার পরে তার কথা মতই সবকিছু চলে তাদের সংসারে। অপর্ণাও জা’কে মেনে চলে। মিঠাইকেও শিখিয়েছে বড়দের কথা শুনে চলতে। তবে সে আজকাল খুব একটা অপর্ণার কথার ধার ধারে ব’লে মনে হয় না। বেশি কিছু বলতে গেলে বলে, “আমাকে কী করতে হবে, আমি জানি।” শ্বশুরমশাই বেঁচে আছেন এখনও, তবে সংসারের ব্যাপারে তিনি খুব একটা মাথা ঘামান না। তিনি নাকি বরাবরই এমন ছিলেন, এমনকি এক সংসারে থাকতে বড় দাদার কথায় উঠতেন বসতেন। এমনটাই শুনেছে অপর্ণা বড় জায়ের কাছে। অপর্ণার ছোট দেওর ইঞ্জিনিয়ার। কলকাতায় চাকরি করে।  বউ ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় থাকে। দুর্গাপুজোয়, ছুটিছাটায় বাড়ি আসে। মিঠাই প্রায়ই কলকাতায় তার কাকা কাকিমার কাছে যায়। 

—দ্যা গ্রেট মুখার্জি বাড়ির গর্ব তুই!

—ফালতু বকিস না! মা বরং আমাকে মুখার্জি বাড়ির কুলাঙ্গার মনে করে!

—কেন? তুই তো এত ভাল রেজাল্ট করেছিস? বাই দা ওয়ে, তুই তো মেয়ে, কুলাঙ্গারটা পুংলিঙ্গ না?

—ফাজলামি করিস না প্রতীক! আমি অত লিঙ্গ ফিঙ্গ বুঝি না। মোটকথা বাড়ির সবার মন জুগিয়ে চলতে পারলে, মার চোখে আমি ভাল হতাম! এই বলে মিঠাই প্রতীকের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল। ছুটি হয়েছে সেই কখন, প্রতীকটা সমানে হেজিয়ে চলেছে। নানান কথায় তাকে আটকে রেখেছে। কী যে আনন্দ পায় ছেলেটা এভাবে বকবক করে, বোঝে না মিঠাই। আসলে ঠিক বোঝে না নয়! প্রতীক কলকাতার ছেলে। দু’কামরার ফ্ল্যাটে বাবা মাকে নিয়েই ওর পৃথিবী! আত্মীয় স্বজনের সাথে মাপা মাপা সম্পর্ক! আর ওদের হাউজিং কমপ্লেক্সের লোকজনের সাথে ভদ্রতার সম্পর্ক। অথচ প্রতীকের মনের মধ্যে যে একটা আস্তো আকাশ আছে! সেটার সন্ধান সে কাউকে দিতে চায় বা তার মতোই কারো মনের আকাশের সন্ধান সে পেতে চায়, এটা মিঠাই বেশ বুঝতে পারে! আর মিঠাইয়ের ভেতরে যে একটা বড় গল্প আছে, এটার সন্ধান প্রতীক, মিঠাইয়ের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার প্রথম দিন থেকেই পেয়েছে। কিন্তু মিঠাইয়ের মনের শক্ত সিন্দুক ভেঙে সে গল্প সে কিছুতেই বার পারছে না। তাই সে মিঠাইয়ের পেছনে পড়ে থাকে সারাদিন। কলেজে অ্যাডমিশন নেওয়ার পর প্রতীকের সাথেই প্রথম বন্ধুত্ব হয়েছিল মিঠাইয়ের। তখন অবশ্য প্রতীক ওকে বহ্নিশিখা মুখার্জি নামেই চিনত। পরে গল্পে গল্পে অনেক কথা জেনেছে। তবে এই জানার আগ্রহটা যে তার দিক থেকেই বেশি, এটা প্রতীক বেশ গর্বের সাথে স্বীকারও করে। বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ফোনে টাইম দেখে, মিঠাই বুঝল খুব দেরি হয়ে গেছে। চটপট একটা ওলা বাইক বুক করল। সুহাসের কাছে ঘুরে, বাড়ি ফিরতে হবে তাকে। দুদিন ধরে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছে সুহাসকে। বছর দুয়েক আগে প্রথম সুহাসিনীর সাথে দেখা হওয়ার দিনটা মনে পড়ে গেল মিঠাইয়ের। ছোটকার বাড়ি এসেছিল পুজোর কেনাকাটা করতে। বাবা পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। দুদিন কলকাতায় থেকে জামা কিনে শেরপুরে ফিরিয়ে দিয়ে আসবে ছোটকা। ছোটকাকিমা কলকাতার কলেজে পড়ায়, মিঠাইকে খুব ভালবাসে। গত কয়েক বছর ধরে এভাবেই পুজোর জামা কেনে মিঠাই। সেবার ছোটকা বলল, চল তোকে এক আপনজনের সাথে দেখা করিয়ে আনি। অবাক হয়েছিল মিঠাই, কে রে বাবা! কলকাতায় তার কে আপনজন আছে? একটা বাগান ঘেরা বড় বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল ছোটকা। শ্বেত পাথরের মেঝে, পরিষ্কার একটা ঘরে, অচেনা এক ভদ্রমহিলাকে দেখে অবাক হয়েছিল মিঠাই। তার মুখের সাথে অদ্ভুত মিলের সেই মহিলা, মিঠাইকে কাছে টেনে নিয়ে নিঃশব্দে কেঁদেছিলেন। সে সময় ছোটকার চোখেও জল দেখেছিল মিঠাই! আর তাই দেখে মিঠাইয়ের চোখটা ছলছল করে উঠেছিল!

—সুজিত, মিঠাইকে যে নিয়ে এলি, সমর জানতে পারলে রাগ করবেনা তো? ভদ্রমহিলার কথায় অবাক হয়ে গিয়েছিল মিঠাই। উনি ছোটকা বাবা, এমনকি তাকেও চেনেন! অথচ মিঠাই চেনে না ওনাকে! মিঠাইয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে, ছোটকা বলেছিল —শোন মিঠাই, উনি হচ্ছেন আমাদের ছোট পিসি। আমার বাবার ছোট বোন। মানে মুখার্জি বাড়ির ছোট মেয়ে! ছোটকার কথা শুনে হতবাক হয়ে মিঠাই তাকিয়ে থাকে ভদ্রমহিলার দিকে। আর ভদ্রমহিলা তখন দুহাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে ওঠেন! 

পরে মায়ের কাছে মিঠাই শুনেছিল, এতদিন এ বাড়িতে যে পিসিদিদাকে তারা আসতে দেখেছে, তাঁর আরও এক বোন ছিলেন। অর্থাৎ তার দাদুরা চার ভাইবোন। বাবাদের ছোটপিসি পড়াশোনায় অসম্ভব ভাল ছিলেন। স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। বাবারা, বিশেষ করে ছোটকা সেই পিসির খুব ন্যাওটা ছিল। কলেজে পড়ার সময় তিনি এক সহপাঠীর প্রেমে পড়েন। ছেলেটি জাতে মাহিষ্য জানতে পেরে পিসির কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। পড়াশোনা শেষ করতে চেয়ে বাবা মা, দাদাদের পায়ে পড়ে পিসি। বাবা মা রাজী হলেও বড় দাদা নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তখন পাশের গ্রামের সেই ছেলের সাথে পালিয়ে বিয়ে করেন পিসি। শ্বশুরবাড়ি থেকে শেষও করেন কলেজের পড়া। পরে পিসি বার বার ক্ষমা চাইতে এসেছিলেন এ বাড়িতে। কিন্তু বাড়ির গেট থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এমনকি দুর্গাদালানে মা দুর্গাকে প্রণাম করতেও দেওয়া হয়নি। মা এসব ঘটনা জেঠিমার মুখ থেকে শুনেছিল। জেঠিমাই মাকে বলেছে, দাদু তার দাদা বৌদির ভয়ে ছোট বোনের পক্ষ নিয়ে কিছু বলতে পারেননি তখন! এরপর বাকিটা বলেছে ছোটকা। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় প্রিয় ছোটপিসির খোঁজ করতে গিয়ে ছোটকা জানতে পারে, বারাসতের একটা কলেজে প্রফেসারি করেন পিসির বর, আর সেখানেই একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তাঁরা থাকেন। তখন থেকেই ছোটকার সাথে যোগাযোগ তৈরি হয় পিসির। আর এবার কলকাতায় কলেজে যেতে শুরু করতে, প্রতি মাসে মিঠাই পিসিদিদার কাছে আসতে শুরু করে। সুহাসিনীর মুখেই একে একে শোনে তার আর অজিতেশের প্রেমের গল্প। শুনতে শুনতে কখন যেন পিসিদিদা ওর কাছেও সুহাস হয়ে ওঠে! মিঠাইয়ের মুখে সুহাস ডাক শুনে উচ্ছল কিশোরী হয়ে ওঠে পিসিদিদা। তবে জাতধর্ম নিয়ে মুখার্জি বাড়ির এই  সংকীর্ণতার গল্প জেনে যেমন ঘৃণায় ভরে যায় মিঠাইয়ের মন তেমনই ছোটকার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বহুগুণ বেড়ে যায়! 

পুজোর আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। মুখার্জি বাড়িতে ব্যস্ততা তুঙ্গে। মিঠাইয়ের ঠাকুমা মারা গেলেও, বড়দাদু আর বড়দিদা এখনও জীবিত। বড়দাদুর চেহারা ভেঙে গেছে, কিন্তু স্বভাবে এখনও দাপট বজায় আছে। তুলনায় মিঠাইয়ের দাদু স্বভাবে বরাবরই নরম প্রকৃতির। বড়দাদু এখন সারা বছর দোতলা থেকে না নামলেও প্রতি বছর ষষ্ঠীর দিন নেমে আসেন দুর্গাদালানে। নিমন্ত্রিত সকলের সাথে দেখা করেন। মিঠাই কথাটা কিভাবে মাকে বলবে বুঝে উঠতে না পেরে বলল —সবাইকে পুজোয় নিমন্ত্রণ করা হচ্ছে যখন এ বাড়ির ছোট পিসিদিদাকেও বলা উচিত।

—কোনোরকম গন্ডগোল করার চেষ্টা করিস না মিঠাই। সবকিছুতে ছোটদের নাক গলানো ভাল নয়। মিঠাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা আন্দাজ করে রাগের গলায় কথাটা বলল অপর্ণা।

—আমি আর ছোট নেই মা। আর যেটা বলছি, সেটা কোন অন্যায্য কথা নয়।

—এত বছর ধরে যে নিয়ম চলে আসছে তাকে কী করে অস্বীকার করবি? আর সবথেকে বড় কথা বড়দাদু এখনও বেঁচে আছেন!

—কিসের নিয়ম? একটা অন্যায়কে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছ তোমরা। আর বড়দাদুর তো উচিত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা!

—চুপ! একটা কথা বলবি না আর। চাপা গলায় এবার শাসিয়ে উঠল অপর্ণা। মিঠাই কিছু বলতে যাবে, তার আগে ঘর থেকে বেরিয়েও গেল। মিঠাই বুঝল সোজা পথে কিছু করা যাবে না, যা করতে হবে চালাকি করেই করতে হবে। ছোটকার সাথে প্ল্যান হয়েছিল ষষ্ঠীর দিন পিসিদিদাকে নিয়ে এ বাড়িতে আসবে ছোটকা। তার আগে মাকে হাত করবে মিঠাই। জেঠিমার যা ট্যারাবেঁকা কথা, না হলে সে জেঠিমাকে একবার ব’লে দেখত! যাইহোক, মায়ের সমর্থনটা ভাইটাল! মা যদি পিসিদিদাকে অ্যাপ্রুভ করে, তারপর তো ছোটকা থাকলই! বড়দাদুর বাড়ির জেঠু পিসিদের সাথেও ছোটকার আন্ডারস্ট্যান্ডিং বেশ ভাল। আর ছোটকার কথাবার্তাও বেশ কনভিন্সিং! কিন্তু এতদূর এগিয়ে এখন মা -ই যে বেঁকে বসছে, এ কথা ছোটকাকে জানালে কেলো হবে! তাই মা দুর্গার নাম করে মিঠাই ছোটকাকে হোয়াটসঅ্যাপ করেই দিল —অল ডান! 

আজ ষষ্ঠী! সকাল থেকে ভয়ে যেন হাত পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে মিঠাইয়ের। বাড়ি ভর্তি লোক। ভোর থেকে নিচের দুর্গাদালানে ঢাক বাজছে। দালানের চারকোণে কলাগাছ, ঘট, ডাব লাগিয়েছে সনাতন দাদু। ফুল বেলপাতা দূর্বা এনে কলাপাতা পেতে  প্রতিমার সামনে সাজিয়ে রাখছে। সনাতন দাদু, বড় দাদুর খাস কাজের লোক। এ বাড়ির পুজোর বাসঘরিও। সেই ছোটবেলা থেকে দাদুকে দেখছে মিঠাইরা। বড়দিদা আর বড় পিসিদিদা স্নান সেরে বসে দূর্বা বাছছে। মা জেঠিমা কাকিমারাও ছোটাছুটি করে কাজ করছে। নিচের প্যান্ডেলের থামে ফুলের তোড়া লাগাচ্ছে ফুলের লোকেরা। তারই এককোণে দাঁড়িয়ে ঢাক বাজাচ্ছে সুরথ কাকারা। সুরথ কাকাকেও ছোটবেলা থেকে ঢাক বাজাতে দেখছে মিঠাই। দাদু আর বড়দাদু এখনও নিচে আসেনি। ঘড়িতে তখন ন’টা পনেরো, ছোটকার সাদা রঙের সুইফট্ গাড়িটা সদর দরজায় এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে প্রথমে কাকিমা আর পিকলু নেমে এলো। তারপর ছোটকা নেমে এসে হাত বাড়িয়ে যাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে এল তাকে দেখে বাবা জেঠুদের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল! তাই দেখে জেঠিমা কাকিমারা চাপা গলায় কিছু বলাবলি করতে লাগল। মিঠাইদের ভাই বোনেরা কিছুই না বুঝতে পেরে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। হঠাৎ করেই কী যেন এক ছন্দ পতন ঘটেছে মুখার্জি বাড়িতে! ততক্ষণে ঢাকের বাজনাও থেমে গেছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। পিন পড়ার নিস্তব্ধতা সারা বাড়িতে। বড়দিদা ছানি কাটানোর পর আবছা দেখে চোখে। বড় পিসিদিদাকে জিজ্ঞেস করল —ওটা কে এলো ঠাকুরঝি?

—ছোট! আমাদের সুহাসিনী! কাঁপা গলায় উত্তর দেয় বড় পিসিদিদা।

—বাবা গো! ব’লে অস্ফুটে আর্তনাদ করে মুখে হাত চাপা দেয় বড়দিদা।

ছোট পিসিদিদার পা তখন যেন মাটির সাথে আটকে গেছে! ছোটকা তাকে দু’হাতে জড়িয়ে প্রায় কোলে তুলে দালানের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। সনাতন দাদু ছোট পিসিদিদাকে দেখামাত্রই বড়দাদুকে খবর দিতে দোতলায় গিয়েছিল। যারা যারা এতক্ষণ বাড়ির অন্দরমহলে ছিল তারাও এখন দুর্গাদালানে এসে ভিড় করেছে। মিঠাইয়ের দাদু খবর পেয়ে নেমে এসেছেন দোতলা থেকে। ছোট বোনকে দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটতে মৃদু গলায় বললেন —ওকে চেয়ারে বসিয়ে দাও সুজিত! দাদুর কথায় যেন সম্বিত ফিরে পেল সবাই। সুমন তাড়াতাড়ি একটা চেয়ার নিয়ে এগিয়ে দিল। চেয়ারে বসিয়ে দিতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ছোট পিসিদিদা। সবার মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন উঠল। বড় পিসিদিদা এইসময় দালান থেকে নেমে এগিয়ে গেল ছোট বোনের দিকে। আর ঠিক তখনই দোতলা থেকে তীক্ষ্ম গলায় বড়দাদু বলে উঠল —ওকে ফিরে যেতে বলো এ বাড়ি থেকে! সেই ডাকে কেঁপে উঠল যেন সারা বাড়ি। থেমে গেল গুঞ্জন, আবার নেমে এল নিস্তব্ধতা। কিন্তু একজনের মুখ বন্ধ হ’ল না। মিঠাইয়ের জেঠিমা দোতলার দিকে মুখ তুলে বলল —কিন্তু জ্যাঠামশাই, এক ভুলের শাস্তি আর কত পাবে মানুষটা? এবার তো ক্ষমা করে দিন! না, শুধু জেঠিমার কথায় বড়দাদুর জেদ ভাঙেনি। এরপর দুর্গাদালান থেকে একে একে দু’বাড়ির সব জেঠিমা কাকিমারাই সওয়াল করল ছোট পিসিদিদার হয়ে! আর সব শেষে বড়দিদা বললেন –দোহাই তোমার! সময় বদলেছে, এবার তো জেদ ছাড়ো! ছোট ছোট নাতি নাতনিদের পায়ে পা মিলিয়ে চলতে না পারলে যে ওরাই এবার আমাদের ছেড়ে যাবে! বড়দিদার কথায় শেষে হাল ছেড়েছিলেন বড়দাদু। বারান্দা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন নিজের ঘরে। আর সেটা সবার প্রথম বুঝতে পেরে বড়দাদুর বড় ছেলে, মানে ছোট পিসিদিদার বড় ভাইপো আনন্দে চেঁচিয়ে উঠেছিল —ওরে সুরথ, জোরসে ঢাক বাজা! ব্যস আনন্দ আর যায় কোথায়। মুখার্জি বাড়ির পুজো শুরু হল দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে। এতক্ষণ সুহাসকে জড়িয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মিঠাই এবার বাড়ির অন্যদের হাতে তাকে সঁপে দিয়ে সরে আসে একপাশে। ফোনের হোয়াটসঅ্যাপটা অন করে মেসেজ করে তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করে থাকা প্রতীককে, “মিশন ছোট পিসিদিদা, সাকসেসফুল”!  

.

.

লেখক পরিচিতি- অনিন্দিতা পাত্র এই সময়ের একজন উদীয়মান লেখিকা। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রথম ছোটগল্পের সংকলন ‘উত্তরণ’ ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়। অনিন্দিতার জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা দক্ষিণ ২৪ পরগনার শিরাকোলে।লেখালেখি ছাত্রজীবন থেকেই।বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আর ফেসবুকে অ_ নিন্দিতা শিরোনামে তার স্বাদু ঝরঝরে লেখার পাঠক সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

শেয়ার করুন :

1 thought on “সুহাসিনী 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *