কমলেন্দু সরকার
রাধা মিত্র, রিনা ব্রাউন, দেবযানী পরে পান্নাবাঈ এবং সুপর্ণা, অর্চনা, আরতি দেবী- সুচিত্রা সেন অভিনীত পাঁচটি চরিত্র। রাধা মিত্র পরিচালক অসিত সেনের ‘দীপ জ্বেলে যাই’ (১৯৫৯) ছবির নায়িকা এবং ‘উত্তর ফাল্গুনী’ (১৯৬৩)র দেবযানী/পান্নাবাঈ, সুপর্ণা, রিনা ব্রাউন হলেন অজয় কর পরিচালিত ‘সপ্তপদী’ (১৯৬১) এবং ‘সাত পাকে বাঁধা’ (১৯৬৩)র অর্চনা, পরিচালক গুলজারের ‘আঁধি’ (১৯৭৫)-র আরতি দেবী।
এই পাঁচটি চরিত্র ভিন্নধর্মী হলেও, চরিত্রগুলোর কোথাও একটা মিল থেকে যায়। সেটা হল প্রতিটি চরিত্রের আত্মমর্যাদাবোধ,অধিকার রক্ষার লড়াই। সুচিত্রা সেন ব্যক্তিগত জীবনেও তেমনই ছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর এই ঘটনাটি বলেছিলেন, আমার এক বন্ধুর মামা৷ শিশিরকুমার ভাদুড়ি ছিলেন এঁর নাট্যগুরু। তিনি বলেছিলেন, “সুচিত্রা সেনের প্রথম ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদি’ (১৯৫৩)-র শুটিং চলছিল। পরিচালক ছিলেন সুকুমার দাশগুপ্ত। ওই ছবিতে আমার এক বন্ধু অভিনয় করছিল। আমি বাইরে বসে হঠাৎই কানে এল কথাকাটি চলছে ফ্লোরের ভিতর। দেখি, ছবির নায়িকা গটগট করে বেরিয়ে আসছেন ফ্লোরের ভিতর থেকে। পিছনে পরিচালক-সহ আরও অনেকে। তাঁকে বোঝাচ্ছেন সবাই। তিনি গোঁ-ধরে আছেন শুটিং করবেন না। তারপর আরও কেউ কেউ বোঝানোর পর তিনি আবার ফ্লোরে ঢুকলেন। পরে জেনেছিলাম, কোনও এক সিনিয়র অভিনেতা মেক-আপ রুমে ঢুকে তাঁর গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ছবির ইউনিটের কাছে তাঁর নিজস্ব মেক-আপ রুম আদায় করে ছেড়েছিলেন। সেইসময় সকলের জন্য যৌথ মেক-আপ রুম থাকত। সুচিত্রা সেন প্রথম থেকেই নিজের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট। ছিলেন প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলা।”
কাননদেবীর কথায়, যে অত্যাচার-অবিচার আমাদের মতো নায়িকাদের একসময় মুখ বুজে সহ্য করে যেতে হয়েছে সুচিত্রা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।এককথায় একটা যুগের বিদ্রোহ ওঁর মধ্যে দিয়ে কথা বলে উঠেছে।
এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, ‘সপ্তপদী’র রিনা ব্রাউনের মুখে সেই বিখ্যাত সংলাপ, “আমাকে টাচ করবে না।” মনে হয়, প্রতিটি নারীর প্রতিনিধি হয়ে পুরুষদের প্রতি সতেজ উচ্চারণ রিনা ব্রাউন অর্থাৎ সুচিত্রার।
এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি, “রমা, আমি সমরেশ বসুর ‘নাটের গুরু’র রাইট কিনেছি। ছবি করব। চিত্রনাট্যও প্রায় শেষ। তুমি থাকবে।” উত্তমকুমারের কথায় সায় দিয়েছিলেন রমা সেন। বলেছিলেন, “উতু তুই কর আমি করব। এটাই হবে আমার শেষ ছবি।”
না, ছবিটি হয়নি। অনেকদূর এগিয়েও শেষপর্যন্ত রমা সেন করেননি ‘নাটের গুরু’। এমনকী মহরতের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে কার্ড ছাপাও হয়েছিল। মহরতের আগের দিন রাতে উত্তমকুমারকে ফোন করে জানান ছবিটি তিনি করবেন না। এই গল্পটি আমাকে বলেছিলেন প্রযোজক রত্না চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন দু’জনের সঙ্গেই ছিল ভাল সম্পর্ক। কেন করেননি সুচিত্রা সেন? এ-প্রশ্নের জবাব রমা সেনই দিতে পারতেন। উত্তমকুমার নিজেও হতভম্ব হয়েছিলেন!
আসলে সুচিত্রা সেন কেন অন্তরালে কেন চলে গেছিলেন এ তো রীতিমতো রহস্যময়! অনেকটা ‘সপ্তপদী’র রিনা ব্রাউনের মতো। রিনা ব্রাউন কেন কৃষ্ণেন্দুর জীবন থেকে সরে গেলেন সে-কথা যেমন তিনি ছাড়া কাউকেই জানতে দেননি, তেমনই তিনি কেন সিনেমাজগৎ ছেড়ে স্বেচ্ছা গৃহবন্দি হয়েছিলেন রিনা ব্রাউন-ই জানতেন অর্থাৎ সুচিত্রা সেন। রিনা ব্রাউনের সঙ্গে অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের বহু মিল ছিল। যেমন ‘উত্তর ফাল্গুনী’র পান্নাবাঈ/দেবযানী আড়াল থেকে অনেককিছু করতেন যা প্রকাশ্যে আনতেন না। তিনি ব্যক্তিগত জীবনেও নাকি তেমনটাই ছিলেন বলে জানা যায়। পর্দার অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন আর পর্দার বাইরেও অনেকটা একইরকম ছিলেন।
এ-প্রসঙ্গে আরও একটি ছবির কথা মনে পড়ে। পরিচালক অজয় করের ‘সাত পাকে বাঁধা’ (১৯৬৩)। লেখক-সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরীকে গল্পটা করেছিলেন সুচিত্রা সেন নিজেই, “… এই যে ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিটা তোমরা দেখ, তার সঙ্গে আমার বাস্তব জীবনের অনেক মিল আছে। তখন প্রায় প্রতিদিন সকাল থেকেই স্বামীর সঙ্গে ঝগড়াঝাটি, কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে যেত। একদিন তো ওর সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়ে গেল। রেগেমেগে ওর শার্টটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিলাম। সেদিন ‘সাত পাকে বাঁধা’য় ওই ধরনের একটা শট ছিল। বিপরীতে ছিল সৌমিত্র। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
স্টুডিওয় গিয়ে পরিচালক অজয় করকে বললাম, আমি যদি ওই সিনে নায়ক সৌমিত্রের জামাটা ছিঁড়ে ফেলি তাহলে কেমন হয়? রাজি হয়ে গেলেন অজয়বাবু। বললেন, বেশ তো… তাই করুন। দর্শকেরা অনেকেই তো ওই শটের জন্য যথেষ্ট তারিফও করেছিলেন। আর এই ছবিতে অভিনয়ের সুত্রেই মস্কোয় আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছিলাম।
একসময় আমাদের দু’জনের ঝগড়া এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে, রেগেমেগে চলে গিয়েছিলাম দক্ষিণ শহরতলির রিজেন্ট গ্রোভে কাননদেবীর বাড়ি। বুঝতেই পারছিলাম আর ঘর করা সম্ভব নয়।” (টলিউডের গ্রেটা গার্বো সুচিত্রা সেন, হিমাংশু চট্টোপাধ্যায়, উর্বি)।
এখানেও অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন আর ‘সাত পাকে বাঁধা’র অর্চনা এক হয়ে যায়। আসলে সুচিত্রা সেনকে মাথায় রেখে পরিচালকেরা কাহিনি বাছতেন, চিত্রনাট্য লিখতেন।
সুচিত্রা সেন সেইসময় অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকে বাংলা ছবিতে অভিনয়জীবনের তুঙ্গে। সুপারহিট জুটি উত্তম-সুচিত্রা। পরিচালক অসিত সেন এলেন ‘দীপ জ্বেলে যাই’ (১৯৫৯) এবং ‘উত্তর ফাল্গুনী’ (১৯৬৩) ছবির অফার নিয়ে। দু’টি ছবিতেই নায়ক কিন্তু উত্তমকুমার নন। তার মধ্যে একটি ছবির প্রযোজক উত্তমকুমার নিজেই। ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবির নায়ক বসন্ত চৌধুরী এবং ‘উত্তর ফাল্গুনী’-র নায়ক দিলীপ মুখোপাধ্যায়। এর আগে অবশ্য বসন্ত চৌধুরীর বিপরীতে নায়িকা হিসেবে কাজ করেছিলেন সুচিত্রা সেন। একটি পরিচালক দেবকীকুমার বসুর ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ (১৯৫৩)। তখন অবশ্য সুচিত্রা সেন বাংলা ছবিতে প্রায় নবাগতা। মোটে তিনটি ছবি করেছিলেন। ঠিক তার তিনবছর পর করেছিলেন পরিচালক সুশীল মজুমদারের ‘শুভরাত্রি’ (১৯৫৬)। এর তিনবছর পর পরিচালক অসিত সেনের ‘দীপ জ্বেলে যাই’ (১৯৫৯)। পরবর্তী সময়ে আর একটি মাত্র ছবি করেন পরিচালক সুশীল মুখোপাধ্যায়ের ‘মেঘ কালো’ (১৯৭০)। এ-বছর এই একটি ছবিই করেন সুচিত্রা সেন। যাইহোক, ‘উত্তর ফাল্গুনী’ (১৯৬৩) ছবিতে সুচিত্রা সেনের দ্বৈত ভূমিকা। মা ও মেয়ের। মা সুচিত্রা অর্থাৎ দেবযানী/পান্নাবাঈয়ের বিপরীতে কালীপদ চক্রবর্তী এবং কন্যা সুপর্ণা অর্থাৎ সুচিত্রার বিপরীতে দিলীপ মুখোপাধ্যায়। সিনেমাজগতে দিলীপ মুখোপাধ্যায় পুরনো হলেও অভিনয়ে ছিলেন একেবারেই আনকোরা। কালীপদ চক্রবর্তী যাত্রা-থিয়েটারে অভিনয় করলেও এটাই ছিল তাঁর প্রথম ছবি। অথচ এই দুই অভিনেতাকে নিয়ে স্মরণীয় অভিনয় করে গেলেন ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবিতে। পাশাপাশি বসন্ত চৌধুরীর সঙ্গে ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবিতে। সুচিত্রা সেন প্রমাণ করে দিয়েছিলেন নায়িকাপ্রধান ছবিতে সুচিত্রা সেন অনন্যা, অসাধারণ। তাঁর বিপরীতে উত্তমকুমার না-থাকলেও ছবি হিট দিতে পারেন তিনি। তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ম্যাডাম। তাঁকে সমীহ করতেন বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সকলেই। সুচিত্রা-প্রসঙ্গে কাননদেবী একবার বলেছিলেন, “নিজেকে দুর্লভ রাখতে জানে বলেই আজও ফুরিয়ে যায়নি।” সুচিত্রা সেন গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব জগৎ। যে-জগতে তিনি ছিলেন একা। একাই কাটিয়ে গেলেন ছবির দুনিয়া ছেড়ে নিজের জগতে।
গুলজারের লেখা থেকেই জানা যায়, সুচিত্রা সেনকে তিনি দেখেছিলেন সেই নিউ থিয়েটার্সের সময় থেকেই। বলতে গেলে সেইসময় থেকেই তাঁকে নিয়ে ছবি করার ইচ্ছা পোষণ করতেন মনে মনে। গুলজার লিখছেন, অমন আলো করা স্ক্রিন প্রেজেন্স, ওঁরই ছিল। ‘দীপ জ্বেলে যাই’ দেখে তো সিনেমা-হলেই বোধবুদ্ধিহীন হয়ে পড়েছিলাম মনে হয়, আর ‘সাত পাকে বাঁধা’র মতো অত ম্যাচিয়োর অভিনয় সুচিত্রা সেনের আমি দেখিনি। হ্যাঁ, পরে অবশ্য ‘আঁধি’তে ওঁর অভিনয়ের একটা অন্য ডায়মেনশন পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ‘দীপ জ্বেলে যাই’ আর ‘সাত পাকে বাঁধা’, এই সিনেমা দুটোতেই গ্ল্যামার-সমৃদ্ধ নায়িকার ডি-গ্ল্যাম অভিনয়, তাঁর সাদামাটা প্রেজেন্স, তাঁর অপূর্ব অভিনয় তাঁকে একেবারে আলাদা চোখে চিনিয়েছিল। (পান্তাভাতে, ওঁর জন্য আলাদা চিত্রনাট্য, গুলজার, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, আনন্দবাজার পত্রিকা)।
‘আঁধি’র শুটিংয়ের প্রথমদিন থেকেই গুলজারকে স্যর বলে সম্বোধন করতেন সুচিত্রা সেন। পরিচালক গুলজার বলেছিলেন, আপনি আমার থেকে বড় আমাকে স্যর কেন বলছেন। তার উত্তরে সুচিত্রা বলেছিলেন আপনি আমার পরিচালক, তাই স্যর। তখন গুলজার বলেন, আপনি আমায় স্যর বললে আমিও আপনাকে স্যর বলেই ডাকব।
‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবিটি চারবার দেখেছিলেন মালা সিনহা। বাংলা এবং হিন্দি ছবির একদা প্রথম সারির নায়িকা মালা সিনহা বলছেন, “… ‘দীপ জ্বেলে যাই’-এর রাধা মিত্রকে আজও আমি ভুলিনি, ভোলা যায় কি রাধার জীবনের শেষ দৃশ্য!… ছবিটা আমি ওঁর জন্য চারবার দেখেছি। কোন হলে দেখেছি সেটাও মনে আছে, ভবানীপুর থানার পাশে বিজলীতে! তারপর অবাক বিস্ময়ে দেখেছি সপ্তপদী, সাত পাকে বাঁধা, উত্তর ফাল্গুনী— প্রত্যেকটা প্রত্যেকটার থেকে স্বতন্ত্র, রীনা ব্রাউন থেকে দেবযানী ও সুপর্ণা– একই শিল্পীর এ কি বিচিত্র রূপ, কি বিচিত্র চরিত্রচিত্রণ! সাফ কথায় ভদ্রমহিলা ওয়ার্ল্ডক্লাস আর্টিস্ট, ভারতবর্ষে না জন্মে ওদেশে জন্মালে উনি অমরত্ব পেতেন, শিল্পী হিসাবে স্ট্যাচু রাখা হত ওঁর জনপথে— এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।” (ম্যাডাম, সুচিত্রা সেনের জীবন কথা, সাহিত্য তীর্থ)।
‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবির শেষ দৃশ্যে রোম্যান্টিক নায়িকা সুচিত্রা সেন হয়ে উঠলেন ক্রমশ অভিনেত্রী, ছবির চরিত্র। সুচিত্রা সেন থেকে রাধা মিত্র। কোনও সংলাপ নেই। আছে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া। নির্বাক অভিনয়। অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। পুরোপুরি শরীরী অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে দর্শককে বুঝিয়ে দেওয়া তাঁর মনের অবস্থা। সুচিত্রা সেনের এই নির্বাক অভিনয় নাকি একটা টেকই হয়েছিল। সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী ‘দীপ জ্বেলে যাই’ দেখে বলেছিলেন, “অদ্ভুত… জলে ভেজা একখানা যুঁই ফুলের মতোই স্নিগ্ধ অথচ করুণ আপনার এই নার্স মিত্র… মানে সুচিত্রা সেন, বাংলা ছবিতে এমন অভিনয় আর দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না।” (ম্যাডাম, সুচিত্রা সেনের জীবন কথা, সাহিত্য তীর্থ)।
সুচিত্রা সেন চলে গেছেন আটবছর অতিক্রান্ত। তিনি প্রয়াত হন ২০১৪, ১৭ জানুয়ারি৷ তারও ৩৬ বছর আগে চলে গেছিলেন অন্তরালে। তবু্ও সিনেমাপ্রেমী বাঙালির কাছে তাঁকে নিয়ে ছিল অদম্য কৌতূহল। সুচিত্রা-বিস্ময়! স্বেচ্ছাবন্দি সুচিত্রা সেনকে ঘিরে ছিল নানাবিধ গুজব, ভ্রান্ত ধারণা, গল্প ইত্যাদি। হয়তো এখনও আছে। সাদা-কালো সুচিত্রা সেন আজও বাঙালির কাছে চিরকালীন। নস্ট্যালজিক করে তোলে বাঙালিকে।
শেয়ার করুন :