এই অতিমারিতে তাৎপর্যপূর্ণ মা লক্ষীর পাঁচালির দু লাইন :
অন্নাভাবে মর্তবাসী কষ্ট পেয়ে ভোগে ।
মরিছে অনাহারে কৃশকায় রোগে ।।
পুরাণে আছে দোলপূর্ণিমার দিন রাত্রে মহর্ষি নারদ বৈকুন্ঠে মা লক্ষী ও নারায়ণের কাছে মর্ত্যের অধিবাসীদের দুঃখ দুর্দশার কথা জানালে মা লক্ষী জানান তাদের কুকর্মের ফলেই তাদের দুর্দশা। কথিত আছে অবন্তী নগরে ধনেশ্বর নামে এক ধনীর মৃত্যু হলে তার ছেলেরা বিষয়সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া করলে তাতে অতিষ্ঠ হয়ে তার বিধবা পত্নী বনে আত্মহত্যা করতে গেলে মা লক্ষী তাকে লক্ষ্মীব্রত করার উপদেশ দিয়ে ফেরত পাঠালেন এবং ধনেশ্বরের স্ত্রী তার পুত্রবধূদের দিয়ে লক্ষ্মীব্রত করার পর তাদের সংসারে দুঃখ ঘুচে গেল আর শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে এল।
সেই থেকে অবন্তী নগরে লক্ষ্মীব্রত প্রথা ছড়িয়ে পড়ল। এর মধ্যে শ্রীনগর থেকে এক যুবক এসে এই প্রথা কে ব্যঙ্গ করায় মা লক্ষী কুপিত হওয়ায় সে সব ধনসম্পত্তি হারিয়ে রাস্তায় ভিক্ষে করতে লাগল ,এর পরে সে অনুতপ্ত হয়ে মা লক্ষীর কাছে ক্ষমা চাইলে আবার তার ধনসম্পত্তি ফেরৎ পায়।
ধ্যানমন্ত্র :
ওঁ পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ-সৃণিভির্ষাম্য-সৌম্যয়োঃ।
পদ্মাসনাস্থাং ধ্যায়েচ্চ শ্রিয়ং ত্রৈলোক্যমাতরম্।।
গৌরবর্ণাং সুরুপাঞ্চ সর্বলঙ্কার-ভূষিতাম্।
রৌক্মপদ্ম-ব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।।
অর্থঃ দক্ষিণহস্তে পাশ, অক্ষমালা এবং বামহস্তে পদ্ম ও অঙ্কুশধারিণী, পদ্মাসনে উপবিষ্টা, শ্রীরূপা, ত্রিলোকমাতা, গৌরবর্ণা, সুন্দরী, সর্বালঙ্কারভূষিতা, ব্যগ্রহস্তে স্বর্ণপদ্মধারিণী এবং দক্ষিণহস্তে বরদাত্রী দেবীকে ধ্যান করি।
প্রচলিত প্রবাদ অনুযায়ী লক্ষ্মীর পাঁচালী পাঠ করলে রোগ-ব্যাধি থেকে আরোগ্য,ব্যবসায়,কর্মক্ষেত্রে উন্নতি, স্বপ্নপূরণ,খারাপ শক্তির প্রভাব থেকে রক্ষা,বিপদ থেকে মুক্তি ঘটে। একইসঙ্গে ঋণমুক্তি, বসত ভিটায় প্রাচুর্য,সমৃদ্ধির সমাহার হয়।
লক্ষীপুজো সাধারণত প্রতিমা,সরা,নবপত্রিকা আর কলার পেটোর তৈরি নৌকায় হয় যাকে সপ্ততরী নৌকা বলা হয়।নানারকম সরা হয় যেমন সুরেশ্বরী, শান্তিপুরী সরা,ঢাকাই সরা। আঞ্চলিকতা মতে লক্ষীর সরায় তিন,চার,পাঁচ পুতুল আঁকা হয়।
শাস্ত্রে অষ্টলক্ষ্মীর কথা আছে।দেবীর লক্ষ্মীর আটটি রূপ এঁনারা। ৮ জন লক্ষ্মী হলেন- আদিলক্ষ্মী, ধনলক্ষ্মী, ধান্যলক্ষ্মী, গজলক্ষ্মী, সন্তানলক্ষ্মী, বীরলক্ষ্মী, বিজয়ালক্ষ্মী ও বিদ্যালক্ষ্মী ।
লক্ষীর পাঁচালিতে মা লক্ষী স্পষ্ট করে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছেন তার পছন্দ আর অপছন্দের কথা:
অপছন্দ
যে বাড়িতে ঈশ্বর,গুরু,পিতা মাতা রুষ্ট থাকেন,যে বাড়িতে সবসময় ‘নেই,নেই’ করে,মিথ্যাবাদী ও দুঃশীল, যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়,বিশ্বাসঘাতক,দুশ্চিন্তাগ্রস্ত,সর্বদা কলহপরায়ণ,দুর্বাক সেই সব বাড়ি পরিত্যাজ্য।
পছন্দ
যে বাড়িতে শান্তি শৃঙ্খলা আছে ,ঈশ্বর ,গুরুজনদের পুজো ও শ্রদ্ধা করা হয়,যেখানে ঝগড়া, চেঁচামেচি নেই,সোনার মত ধান,রজতপম তন্ডুল বা চুলা,আর তুষহীন অন্ন আছে।যে গৃহস্থ স্পষ্টভাষী,বৃদ্ধদের সেবা করেন,ধন ,ভোগ্যবস্তু পরিজনের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করেন,আর্তের সাহায্য করেন, ধার্মিক,বিদ্যা বিনয়ী,জনানুরাগী ব্যক্তিদের বাড়িতেই তাঁর বসবাস।
লক্ষ্মী দেবী হলেন বিষ্ণুপত্নী। তৈত্তিরীয় সংহিতায় শ্রী ও লক্ষ্মী দেবী হলেন আদিত্যের স্ত্রী। যেহেতু আদিত্য বা সূর্য ও বিষ্ণু একই দেবতা সেহেতেু লক্ষ্মীকে বিষ্ণু-শক্তি বলা যায়।
পড়ুন: গ্রামের বাড়ির দুর্গাপুজো
লক্ষ্মী ও শ্রী শব্দের অর্থ জানা আছে ? যাঁর দ্বারা লক্ষত হয় অর্থাৎ সকলে যাকে লক্ষ্য করেন বা দর্শন করেন, তিনিই লক্ষ্মী। অর্থাৎ লক্ষ্মী শব্দের অর্থ সৌন্দর্য। আবার যার দ্বারা সকলে আশ্রিত হয় তিনিই শ্রী। সেহেতু ধন দ্বারা সকলে আশ্রিত হন বা ধনকে আশ্রয় করে সকলে জীবন ধারণ করেন সেহেতু শ্রী অর্থ ধন। অহির্বুধণ্য-সংহিতায় আছে জগৎ রূপে লক্ষ্যমানা বলে তিনি লক্ষ্মী।
প্রপঞ্চসার তন্ত্রে লক্ষ্মী দেবীর যে নয়টি শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়, তা হল- বিভূতি, উন্নতি, কামিত্ম, হৃষ্টি, কীর্তি, সন্নতি, ব্যুষ্টি, উৎকৃষ্টি ও ঋদ্ধি।
লক্ষ্মী দেবীর বাহন পেঁচা কেন?
পুরাণ আর শাস্ত্রে এই নিয়ে দুই মত আছে। একটি হল মা লক্ষীর গুণ আর পবিত্রতা অর্জন করতে হলে পেঁচার ধর্ম পালন করতে হবে অর্থাৎ জগতের মায়া মোহ উপেক্ষা করে নিরালা নিভৃতে নির্জনে সেবার আর ধ্যান করতে হবে লোকচক্ষুর আড়ালে।ঋগ্বেদে আছে পেঁচা যমের দূত। যমের আর এক অর্থ সংযম, মানে ধন উপার্জনের ক্ষেত্রেও সংযম দেখাতে হবে।আর একটি কারণ হলো মানুষের প্রধান খাদ্যবস্তু ধানের প্রধান শত্রু ইঁদুর কে বধ করে ধনরক্ষার ব্রত পালন করে প্যাঁচা।
অন্য মতে পেঁচা লক্ষ্মী দেবীর সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্ম ধারণ করে। পেঁচা কুৎসিত ও দিবান্ধ। যারা সারা জীবন শুধু ধনলাভের চিন্তায় মগ্ন থাকে, তারা ঐ পেঁচার মতই অন্ধ হয়ে যায়। তাই জ্ঞানের আলো তাদের অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। পেঁচা যেমন কালো অন্ধকারে পথ চলে, ধনলোভীরাও তেমনি কালো পথে অর্থাৎ অসৎ পথে ধাবিত হয়। ধনের দেবী তাঁর সঙ্গে পেঁচা রেখে সকলকে জানিয়ে দেন, যিনি ভক্তিধন অন্বেষণ করবে, তিনি আমাকে পাবে আর যিনি পার্থিব-ধন অন্বেষণ করবে তিনি আমাকে নয় আমার পেচাঁকে লাভ করবে।
খালনার সার্বজনীন লক্ষী পুজো
কলকাতা,প্রবাসে,বিদেশে দুর্গা পুজো, আমহার্স্ট স্ট্রিট,কলেজ স্ট্রিট,বারাসতের কালীপুজো,চুঁচড়োর কার্তিক পুজোর কথা সবাই জানে কিন্তু এই পশ্চিমবাংলায় এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে বিশাল কলেবরে সার্বজনীন লক্ষীপূজোর কথা অনেকেরই অজানা।
হাওড়া জেলার বাগনান থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে খালনা গ্রাম। ২০ হাজার লোকের বসবাস।
১৫০ বছর আগে এখানে প্রথম লক্ষী পুজো হয়। ১৯৭৮ সালের ভয়ঙ্কর বন্যার ফলে এই অঞ্চলে মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার ফলে সেই বছর সার্বজনীন ভাবে লক্ষী পুজো করা হয় যার কয়েক বছরের মধ্যেই আর্থিক ভাবে ঘুরে দাঁড়ায় এই গ্রাম। শুরু হয় দুর্গাপুজোর মতো বড় করে তিনদিন ধরে লক্ষীপূজোর আয়োজন।দুর্গাপুজোর মতো লক্ষীপুজোতে এখানে সাবেকি আর থিমের লড়াই।
৪০ ফুটের লক্ষীপ্রতিমা,মাটির নিচে কুবেরলক্ষী,অযোধ্যা পাহাড়ে লক্ষী এমন অনেক বর্ণাঢ্য বৈচিত্র। পুজোর বাজেট ৩ থেকে ১০ লক্ষের মধ্যে থাকে যা অবিশ্বাস্য আর অভাবনীয়। এলাকার প্রাচীনতম বনেদি পুজো হল ক্ষুদিরায়তলা সার্বজনীন লক্ষীপুজো।বিখ্যাত পুজো গুলোর মধ্যে ৯৬ বছরের কালীমাতা তরুণ সংঘের পুজো,মিতালি সংঘ,আমরা সবাই, রাজবংশীপাড়া বারোয়ারি,মালঞ্চ লক্ষীমাতা ক্লাব।
গ্রামের সিংহভাগ মানুষই স্বর্ণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। মন্দার বাজারে সোনার ব্যবসা বেহাল। তারই প্রভাব পড়েছে এবারের পুজোয়। এক দিনের পুজো। তিন দিনের উৎসব। কয়েক লক্ষ মানুষের সমাগম। সারাবছরের অপেক্ষা শেষে লক্ষ্মী আরাধনায় সেজে উঠেছে খালনা গ্রাম।
এখানে এই উপলক্ষে বিশাল মেলা বসে আর লক্ষীপুজো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির সৃষ্টি করে।পীর সাহেব ফতে আলী শাহর মাজারে লক্ষীপূজোর আগে সিন্নি চড়ানো হয়। গোটা খালনা গ্রাম আলোর মালায় সেজে ওঠে।গ্রামের বাইরের মানুষ এই পুজো উপলক্ষে গ্রামে ফেরে আর আশে পাশের জেলা থেকে প্রচুর মানুষ আসেন সার্বজনীন লক্ষীপুজো দেখতে।এই জন্যেই এই খালনা গ্রামের আরেক নাম ‘লক্ষীগ্রাম’।গত বহু বছর ধরে এই তিনদিনে প্রায় ১০ /১২ লক্ষ লোকসমাগম হয়।
জয় জয় ব্রহ্মময়ী, মা নারায়নী ।
তোমার কৃপায় শেষ করিনু পাঁচালী খানি ।।
ঋণ :লক্ষীপুজো :সত্যানন্দ সরস্বতী,বেঙ্গলি ওয়ান ইন্ডিয়া,শ্রী লক্ষীসহশ্রম, দ্য ওয়াল,খালনা লক্ষী পুজো ফেসবুক,নিউজ 18 বাংলা
শেয়ার করুন :