বেতিয়া মিশন হাউসের সেই রাত -

বেতিয়া মিশন হাউসের সেই রাত

একটা মেয়ের ছায়ামূর্তি….ইশারায় ডাকলো….

রঙ্গন মিত্র

শ্রাবণ মাস আসতে আরও দিন তিনেক দেরি হলেও নিম্নচাপের জেরে সকাল থেকে ঘন কালো আকাশ,কখনও ঝিরঝির,কখনও ঝমঝম।এই বৃষ্টির সন্ধ্যাবেলায় দেশবন্ধু পার্কের উল্টোদিকে রামরতন বোস লেনের কাছের উত্তরের আড্ডায় বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে মল্লিকদের বনেদি বাড়ির রকের আড্ডায় রণ,দেবা,সতু,টুবলু আর মোটা কেউ  অ্যাবসেন্ট নয় দেখে ওরা নিজেরাই বেশ পুলকিত।সবার আগে মোটা(মানে সেকেন্ড দেবাশিস,এক আড্ডায় দুটো দেবাশিস বলে একজনকে মোটা)বলল ‘আমি সিঙ্গাড়া স্পনসর করতে পারি যদি সতু ওর এক্সপেরিয়েন্স থেকে একটা জমাটি ভূতের গল্প বলে।ওরা পাঁচজন এই অঞ্চলের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় চল্লিশ বছরের অভিন্নহৃদয় বন্ধু।সময়,খ্যাতি,অখ্যাতি, রাজনীতি,সংসার কিছুই ওদের আলাদা করতে পারেনি।রণ সরকারি চাকুরে,দেবার কেমিস্ট শপ,সতু মানে সত্রাজিৎ এখন মার্কেটিং কনসালটেন্ট কিন্তু দীর্ঘদিনের সেলসের চাকরির অভিজ্ঞতায় নানা দেশের নানা শহরে ঘোরার সুবাদে দারুণ সব রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হয়েছে যেটা ওর বাকপটুতার কারণে সবার কাছে যাকে বলে সুপারহিট।যদিও অন্য দেবাশিস যে নিজে একটা সিএ ফার্মের পার্টনার,বলে ‘সতুর গল্পগুলোতে রং চড়ানো হলেও শুনতে ভালো লাগে।’ টুবলু মানে স্নেহাশিস তাদের পৈতৃক টি মেশিনারি স্পেয়ার পার্টসের ব্যবসা সামলায়।    

আজ পাশের প্রদীপ টি স্টলের সিঙ্গাড়ায় কামড় দিয়ে চায়ের অর্ডার দিয়ে রণ বলল,’আজ এই ওয়েদারে ভূতের গল্প খুব জমতো কিন্তু সতুর কি আর কোনও ভৌতিক এক্সপেরিয়েন্স আছে ?মনে তো হয় না।’গোল্ড ফ্লেক লাইটসে একটা টান দিয়ে সতু বলল হ্যাঁ আছে কিন্তু মোটা বিশ্বাস করবে না,আওয়াজ দেবে ঢপ দিচ্ছিস বলে তাই কখনও বলিনি।’

বাকি সবাই রে রে করে বলে উঠলো ,’না না মোটা কিচ্ছু বলবে না তুই বল।’ আর স্বয়ং মোটা বলল ,’আরে আমি তো বলেইছি রং চড়ানো হলেও শুনতে হেব্বি লাগে।তুই শুরু কর প্লিজ,এই বৃষ্টি বাড়লে বাড়ি ফিরতে কেস খাব,আজ আবার নুপুর খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা করবে শুনেছি।’এই শুনে খাদ্যপ্রেমী সবাই চেঁচিয়ে বলল.’লজ্জা করেনা উল্লুক আমাদের এই ওয়েদারে খিচুড়ি আর ইলিশের লোভ দিয়ে একা খাবি?’শুনে সতু বলল,’আজ ওয়েদার রিপোর্টে বলেছে এই বৃষ্টি আগামী তিনদিন চলবে,তাই যদি মোটা কাল আমাদের খিচুড়ি ইলিশ ডিনার আর সঙ্গে টুকসের  ইনভাইট না করে আমি গল্প বলবো না আর এখন বৃষ্টি হলেও বাড়িতে ফোন করে খিচুড়ি চাপাতে বলে মানিকতলা বাজারে গিয়ে ইলিশ কিনে বাড়ি যাব।বাকি তোদের ইচ্ছে’।বেঁফাস বলে ফেঁসে যাওয়া মোটাকে সবাই এক মিনিটের মধ্যে রাজি করার পর সতু তার কাহিনী শুরু করল। 

 ‘আমি তখন ম্যারিনা ইন্ডাস্ট্রি যাদের কোকোম্যাট নারকেল তেল তাদের এরিয়া সেলস এক্সেকিউটিভ।পাটনা হেডকোয়ার্টার আর পুরো নর্থ বিহার টেরিটরি।তখন ১৯৮৮/৮৯ র বিহার ,যখন ঝাড়খন্ড হয়নি।আমায় মাসে ৫/৬ দিন পাটনায় থেকে বাকি দিনগুলো পুরো নর্থ বিহার ট্যুরে কাজ করতে হত সে কথা তো আগেই বলেছি।যারা এফএমসিজি সেলসে যারা কাজ করে তারা জানে যে কম্প অফ বলে একটা ব্যাপার আছে মানে কম্পেন্সেটরি অফ,অর্থাৎ সানডে গুলো টানা কাজ করলে মাসের শেষে ওই তিনটে সানডের সঙ্গে শেষ সানডে যোগ করে চারদিন কলকাতায় ছুটিতে আসার সুযোগ যেটা কোনও এক্সিকিউটিভ আর রিপ্রেসেন্টেটিভরা মিস করত না।মানে একবার বেরোলে টানা ট্যুর।নিয়মিত যেতে যেতে সব শহরের,আধা শহরের থাকার আর খাবার জায়গা চিনে নেওয়া হল প্রাইমারি কর্তব্য।যেমন মজফ্ফরপুরে নর্থ বিহার চেম্বার অফ কমার্সের গেস্ট হাউস আর ভগবান ভোজনালয়ের ডিনার আর ভারত জলপানের পুরি সবজি লস্যি ব্রেকফাস্ট,দ্বারভাঙার টাওয়ার চকের কাজু শরবত আর ডিম ভুজিয়া।

আমাদের ট্যুরের অনেক রুটের একটা ছিল মজফ্ফরপুর,মোতিহারি,বেতিয়া। মজফ্ফরপুর থেকে দেড় ঘণ্টা বাসে মোতিহারি আবার কাজ সেরে ওখান থেকে এক ঘণ্টার বাসে বেতিয়া কারণ মোতিহারিতে কেউ রাতে থাকতনা সেরকম ভাল ব্যবস্থা নেই বলে আর বেতিয়ায় রাতে থাকার কারণ ওখান থেকে মাত্র এক ঘণ্টা দূরে রকসৌল আর রকসৌল থেকে ১০ টাকার রিকশা ভাড়ায় নেপালের বীরগঞ্জ,যেখানে প্রচুর সস্তায় লিভাইস জিন্স, ডেনিম আফটার শেভ লোশন আরও আশ্চর্য লোভনীয় জিনিসপত্র কেনার সুযোগ।তাই সবাই বেতিয়াতে রাতে থাকা প্রেফার করত।

এখানে ৮৮/৮৯ সালের বেতিয়ার একটু বর্ণনা দেওয়া প্রয়োজন।তখনকার দিনে বেতিয়া নর্থ বিহারের একটা আধা শহর হলেও প্রাচীন আর ঐতিহ্যশালী। ১৬৬০ সাল থেকে শাহজাহানের আমলে বেতিয়ায় অগ্রসেন বলে রাজা থাকতেন আর সেই সময় ঐ অঞ্চলকে বেতিয়া রাজ বলা হত।১৮৫৪ সালে মহারাজা হরেন্দ্র কিশোর সিংহ শেষ রাজা ছিলেন।উনি খুব শিক্ষিত আর গুণী,কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির মেম্বার ছিলেন।এছাড়া ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পশ্চিম চম্পারণ জেলার এই বেতিয়া ঘরানার উল্লেখ আছে।ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে মহাত্মা গান্ধীর চম্পারণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ধাত্রীগৃহ বেতিয়া। ৮০/৯০ এর দশকে একটা মামুলি আধা শহর ছাড়া কিছু ছিলনা যদিও মেডিকেল কলেজ স্কুল সবই ছিল।   

সেবারে কি কারণে সাধারনত যেখানে উঠি সেই দুবেজির লজ পুরো ভর্তি।কি আর করা তাই শর্মাজি মানে আমাদের ডিস্ট্রিবিউটরকে জিজ্ঞেস করায় বলল,’আপ মিশন ক্রস সোসাইটি কে গেস্ট হাউস মে রুকিয়ে,বাজার কি ভিড়ভাড় সে থোড়া দূর লেকিন আপকো কাম চল জায়গা,ঔর এক হি রাত কি তো বাত হ্যায়।আপ কে লিয়ে ঔর আচ্ছি চিজ হ্যায় উওহ গেস্ট হাউস কে সামনে এক সর্দারজিকি দুকান মে মস্ত মাটন ঔর তড়কা মিলতা হ্যায়।’                                                                        

শুনেই মনটা খুব হ্যাপি হয়ে গেল।যাইহোক মার্কেটের কাজ সেরে বিকেলে ডিস্ট্রিবিউটরের খুশি টোলার অফিসে সেই মাসের সেলস,পরের মাসের অর্ডার এই সব কাজের মধ্যে সন্ধ্যে হওয়ার পরে শর্মাজির অনুরোধে একটু টুকস আর স্ন্যাক্স,কারণ মাসের এই একদিনে আমি আসার জন্য শর্মাজির বাড়িতে ছাড় আছে।

মতিহারি থেকে দু ঘন্টার বাস জার্নি আর ঐ রাস্তার ঝাঁকুনি,তারপরে স্ট্রেট ছাওনি চক মার্কেটে কাজ করে আবার টুকস বলে খুব টায়ার্ড ছিলাম।শর্মাজীর স্কুটারে কমল নাথ নগর রোডে মিশন ক্রস সোসাইটিতে নামিয়ে দিয়ে ওখানকার কেয়ারটেকার শিবলালকে জিজ্ঞেস করলেন,’ নিচে কা খিড়কি ওয়ালা কামরা দিয়া তো সাহাব কো?’ উত্তরে কাঁচুমাচু মুখে শিবলাল বলল,’নহি মালিক,নিচে পুরা ফুল বা।উপর কা কামরা দিয়া।’ আমি শুনে খুশিই হলাম কারণ সাধারণত নিচের থেকে ওপরের কামরাই হোটেল,গেস্ট হাউসে ভাল হয় কিন্তু শর্মাজী কেন রাগারাগি করলেন শিবলালের ওপর বুঝলাম না।শেষে খালি বলে গেলেন,’কুছ হোনেসে তুমহারা খ্যায়রিয়ত নহি ইয়ে সমঝ লো।’শিবলাল মাথা নেড়ে ,ঠিক ঠিক মালিক,হম খয়াল রাখিল বানু,’ বলায় শর্মাজী একটু শান্ত হতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম এত গোলমালের কারণ কী?ওপরের ঘর তো নিচের থেকে ভালো,আপনি রাগছেন কেন?’তখন বুঝিনি কেন আমার প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে কথা ঘুরিয়ে আমায় উল্টোদিকের সর্দারজির ধাবা চিনিয়ে চলে গেলেন।

মিশন ক্রস গেস্ট হাউসটি অন্তত ১০০ বছরের পুরোনো,ভিক্টরিয়ান গথিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত,আভরণ এবং চাকচিক্যবিহীন।নিচে ওপরে মিলিয়ে বোধয় ৮টি ঘর এছাড়া কমন টয়লেট ডাইনিং রুম আর একটা ছোট রিসেপশন আর অফিস ঘর মিশনের কাজ কর্মের জন্য।শিবলাল প্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দুটো ঘরের পর একটা ঘর খুলে বলল,’ইয়হি ডাবল বেড বা,আপ ইসি মে সিঙ্গল রহিয়ে।ঔর বাথরুম সিধে করিডোর কা ডাইনে।’এত শহরে ঘুরে সব হোটেলে আর গেস্ট হাউসে অ্যাটাচ্ড বাথ পাওয়া যায়না বলে আমরা মানে তখনকার বিহারে কাজ করা সেলসের ছেলেরা সবেতেই স্বচ্ছন্দ থাকতে অভ্যস্ত ছিলাম তাই ব্যাগপত্তর রেখে করিডোরের শেষে বাথরুমে গিয়ে  চান করে জামাকাপড় চেঞ্জ করে পাজামা আর টি শার্ট পরে গেস্ট হাউসের উল্টো দিকে সর্দারজির দোকানে  সত্যি দারুণ টেস্টি রুটি মাংস খাওয়ার পর মনে হচ্ছিল কখন শুতে যাব।

গেস্ট হাউসে ফিরেই লক্ষ্য করলাম রাতের  আকাশে ছাই মেঘ করে ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।এই বৃষ্টির রাতে ঠাণ্ডা হাওয়ায় ভালো ঘুম হবে বলে মনটা যাকে বলে বেশ প্রসন্ন হয়ে গেল।এসে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে শোয়ার পরেই ঘুমে চোখ বুজে এল।

ঘুমটা ভাঙল একটা অস্বস্তিতে না একটা আওয়াজে এতদিন পরে সেটা মনে নেই।প্রথমেই বেশ শীত করতে লাগল।জুন মাসে বেতিয়ায় শীত পড়েনা কিন্তু নেপালের কাছে বলে মনোরম আবহাওয়া কিন্তু এই শিরশিরে শীত অনুভব এই প্রথম।তার সঙ্গে করিডোরে একটা ঘষে চলার শব্দ।অচেনা অজানা জায়গায় রাতে শুধু করিডোরে আওয়াজের জন্য দরজা খুলব কিনা ভাবছি এমন সময়ে দরজায় টোকা পড়ল।

এমনিতে ডেয়ারিং আর ডাকাবুকো বলে আমার সুনাম থাকলেও ঐ বৃষ্টির রাতে একা দোতলায় দরজা খুলব কিনা ভাবছি এমন সময়ে আবার টোকা।দু বার কৌন হ্যায় বলে জিজ্ঞাসায় কেউ সাড়া দিলো না বলে দরজা খুললাম।আর খুলতেই একটা দমকা ঠান্ডা হাওয়ায় ঠান্ডা আরও বেড়ে গেল আর বাইরে বেরিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে বেশ ভয় পেলাম।ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার সময় আবার ওই ঘষটানোর শব্দে বেরিয়ে দেখি করিডোরের একটু দূরে একটা মেয়ের ছায়ামূর্তি,আর সে আমায় ইশারায় ডাকছে।এবারে সত্যিকারের ভীষণ ভয় পেয়ে আবিষ্কার করলাম গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছেনা।

ঐ মেয়েটি এবার ঘুরে তাকাল।এমন সম্মোহনী দৃষ্টিতে আমার শরীরের ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক চলাচল যেন কেমন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল।অথচ আমি সজ্ঞানে।মেয়েটি ইশারায় ডাকলো আর আমি তাকে অনুসরণ করে হাঁটতে লাগলাম।হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা যাওয়ার পরে খেয়াল হল কত বড় করিডোর যে এতক্ষণ হেঁটে চলেছি,শেষই হচ্ছে না।এতক্ষণে চারপাশ চেয়ে দেখে আতঙ্কে শরীরের রক্ত জল হয়ে গেল।কোথায় করিডোর?আমি একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি একটা অমোঘ আকর্ষণে।

চারিদিকে গাছ আর ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে।প্রাণপণ চেষ্টা করছি ফিরে যাওয়ার কিন্ত পারছি না আর কোন পথে গেস্ট হাউসে ফিরব,এই গভীর জঙ্গলে কি করে এলাম আর মেয়েটিকে ফলো করার টানে আমি কোথায় যাচ্ছি ?

আরও বেশ কিছুক্ষণ চলার পর জঙ্গল একটু ফাঁকা হতে দেখলাম সামনে একটা দীঘির মত বড় জলাশয়।আর ঠিক সেই সময়ে অন্ধকারে একটা গাছের ফাঁক থেকে বেরিয়ে এল প্রবীরদা।

প্রবীরদা।প্রবীর দাস।কাটিহার হেডকোয়ার্টারের সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ ,মাস ছয়েক আগে চাকরি চলে যাওয়া প্রবীরদা।বয়েসে বেশ সিনিয়র কিন্তু নিজের ফাঁকিবাজির জন্য মাসের পর মাস বিলো আ্যভারেজ পারফরম্যান্স আর টার্গেট শর্টফলের জন্য স্যাকড।আমি অন্তত তিনবার চাকরি যাওয়া থেকে বাঁচালেও শেষে আর পারিনি।পুরো ইস্টার্ণ রিজিয়নে আমি তিন বছর হায়েস্ট পারফর্মার বলে আমার কথার গুরুত্ব পেত রিজিওনাল সেলস ম্যানেজার এমনকি অল ইন্ডিয়া জেনারেল সেলস ম্যানেজারের কাছেও,তাই আমি প্রবীরদার শর্টফল মিট আপ করে দিলে সেবারের মতন চাকরি বাঁচত কিন্তু গুবলু ধরা পড়ায় আমি অনেক চেষ্টা করেও প্রবীরদার চাকরিটা বাঁচাতে পারলাম না।সেলসের পরিভাষায় গুবলু মানে মার্কেটে কাজ না করে ফলস রিপোর্ট দিয়ে কলকাতায় চলে আসা।বয়েসে সিনিয়র,জমাটি আড্ডা ,রোজ সন্ধ্যায় নিয়মিত মদ্যপানে অসংযমী যাপন স্বত্বেও প্রাণখোলা মাই ডিয়ার আড্ডাবাজ প্রবীরদাকে আমরা সবাই খুব ভালোবাসতাম।আমার হাতিবাগানের বাড়ির কাছে বিডন স্ট্রিটে থাকার জন্য আমাদের বাড়িতেও  আসা যাওয়া ছিল।

চাকরি যাওয়ার পর মাস ছয়েক অন্য চাকরির চেষ্টা করে কিছু না পাওয়ায়,আসলে সেলস ট্রেডে এসব কথা খুব চাউর হয়ে যায় তাই কোনও কোম্পানি প্রবীরদাকে নিতে ইচ্ছুক ছিল না,তাই একদিন বাড়ির কাছে গঙ্গায় সাঁতার কাটতে গিয়ে ডুবে মারা গেল প্রবীরদা,যাকে ওর কাছের লোকেরা আত্মহত্যা বলেছিল।

সেই প্রবীরদা।সেই এক সাদা শার্ট কালো প্যান্ট,হাই পাওয়ার চশমা,দাঁতে পানের ছোপ প্রবীরদা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আমায় বলল,’কি রে ,তোকে এত রিকোয়েস্ট করলাম তাও আমার চাকরিটা বাঁচাতে পারলি না। যাক এখন খুব শান্তি।আয় জলে নেমে দেখ, কি আরাম আর শান্তি।

তাকিয়ে দেখি মেয়েটি আর নেই,আর প্রবীরদা ধীরে ধীরে জলের দিকে চলে যাচ্ছে আর তার টানে আমিও।এর পরে আর আমার কিচ্ছু মনে নেই।

জ্ঞান ফিরে দেখলাম ভোর হয়ে গেছে, আমি করিডরে শুয়ে আর শিবলাল ব্যাকুল হয়ে আমায় ডাকছে,  আমার শরীর খুব খারাপ,মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা আর জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।সকালেই শর্মাজী এসে আমায় দুবেজির হোটেলে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার এনে চিকিৎসার পর সন্ধ্যেবেলায় যখন একটু ভালো হয়ে উঠছি তখন শুনলাম মিশন ক্রসের দোতলার ঘর যাকে বলে হন্টেড এমন দুর্নাম আছে।এর আগেও নাকি দু একজনের এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছে তাই পারতপক্ষে দোতলার ঘরে কাউকে থাকতে দেওয়া হয়না।মেয়েটি নাকি বহুবছর আগে ঐ গেস্ট হাউসে কাজ করত আর একদিন রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়ে যায় আর তার পর থেকেই মাঝে মাঝে রাতে তাকে দোতলার করিডরে দেখা যায়।কি করে নিখোঁজ হল সেই রহস্য শর্মাজি আমায় বলেন নি,অনেক বার জিজ্ঞাসা করায় বলেছিলেন ‘মালুম নহি’। 

শুধু গল্প উপন্যাসে নয় বাস্তবেও অনেক ভূতের বাড়ি,ভুতুড়ে অভিজ্ঞতার কথা পড়া জানা থাকলেও ঐ মেয়েটির কি উদ্দেশ্য ছিল আর সবচেয়ে আশ্চর্যের,প্রবীরদাকে কি করে ওখানে দেখলাম আর আমায় কি প্রবীরদা মেরে ফেলতে চেয়েছিল এটা আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি।’

সতুর গল্প শেষ হওয়ার পরেও বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ।বৃষ্টি ধরে এসেছে।নিঃশব্দতা ভেঙে রণ বলল,ঐ মেয়েটি আর প্রবীরদাকে দেখা আর সত্যিই তোকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল কি না, এমন অনেক প্রশ্ন অজানাই থেকে যাবে।’টুবলু বলল,’সে তো বটেই কিন্তু আরও আছে।যদি দুঃস্বপ্নই হবে তো সতুকে সকালে করিডোরে পাওয়া গেল কেন? ও তো তাহলে নিজের বিছানাতেই থাকত।’ দেবা বলল,’ দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ হোরেশিও..।চল যাওয়া যাক।’

গ্র্যাফিক্স-সৌরভ হাজারী

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *