প্রান্তিক চ্যাটার্জী
চন্দ্রপুর এক অসাধারণ, ব্যতিক্রমী ল্যান্ডস্কেপ।
মাইলের পর মাইল জুড়ে জঙ্গল। তবে আজকাল মাঝে মাঝেই জুড়েছে কিছু সভ্যতার চিহ্ন আর সঙ্গে বহু মানুষের বসবাস। এই চন্দ্রপুরের ঠিক মাঝখানে অথবা বলা যেতে পারে হৃদয় জুড়ে রয়েছে “তাডোবা আন্ধারি টাইগার রিজার্ভ”। বছরের পর বছর ধরে এই অঞ্চলে মানুষ আর বাঘ এক সঙ্গে বসবাস করছে। যাকে ইংরেজিতে আমরা বলে থাকি “Co-existence”। বাঘকে এখানে দেবতা রূপে পুজো করা হয়।
মানুষ বলতে মূলত গোন্দ আদিবাসী, গোন্দ রাজাদের শিকার ভূমি ছিল এই তাডোবা । আজও তাডোবার কোর এ গোন্দ রাজাদের স্থাপত্যের কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। তাডোবা কোর ও বাফার সংলগ্ন এলাকায় প্রায় সত্তর থেকে আশিটি গ্রাম আছে। কথিত আছে যে “তারু” নামে এক গ্রাম প্রধান একটি বাঘের সাথে এক ঐতিহাসিক যুদ্ধে মারা যায়, তারপর থেকে “তারু”কেও ভগবান রূপে পুজো করা হয় এবং “তারু”কে সম্মানিত করতে একটি ছোট্ট মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। যেটা এখনও “তাডোবা” লেকের ধারে এক বিশাল শাল গাছের তলায় দেখা যায় । এই “তারু” নাম থেকেই নাম হয় “তারোবা” কিন্তু ব্রিটিশরা এই নাম উচ্চারণ করতে পারত না, তাই তারা নাম বদলে রাখল “তাডোবা”। হারিয়ে গেল সেই অসীম সাহসী “তারু”র নাম ইতিহাসের পাতা থেকে। তবু আজও কিছু পুরোনো গাইড “তারু”র গল্প করে শুনে এখনও গায়ে কাঁটা দেয় আমার।
তাডোবা নিয়ে লিখতে বসলে বাঘ আসা অবশ্যম্ভাবী।
শুধু বাঘের উপস্থিতি একটা অঞ্চলের মানুষের রুচি, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক অবস্থার যে কতটা পরিবর্তন ঘটাতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। এইবারের জঙ্গল ছিল একেবারে সবুজ, বর্ষার পর জঙ্গলের সৌন্দর্য একেবারে স্বগীর্য়। জঙ্গলে ঢুকেই যে বাঘ খুঁজতে হবে এমন মানসিকতা আমার কোনওদিনই ছিল না। কিন্তু এইবার কোনও ভাবে “সোনাম” (T-30) আর ওর বাচ্চাদের দেখার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। পথম দুটো সাফারিতে “সোনাম”কে স্পট করা সম্ভব হল না। তবে বার তিনেক গর্জন শুনলাম। আর লম্বা ঘাসের ফাঁক দিয়ে একবার গেরুয়া রঙের ওপর বিখ্যাত কালো ডোরাকাটা চোখ ঝলসে দিল।
তৃতীয় সাফারিতে সোনামের বর্তমান টেরিটোরি তেলিয়া লেকের ধারে যখন পৌঁছলাম তখন বেলা প্রায় তিনটে আকাশে হালকা মেঘ, নাহে সোনামের কোনো চিহ্ন নেই। অতএব নিরলস অপেক্ষা, হঠাৎ ই শম্বর হরিণের সতর্ক ডাক, নড়তে দেখলাম লম্বা ঘাসের কিছু অংশ হালকা রোদ পড়ল ওর শরীরে, হৃদস্পন্দন বলে আর কিছু অনুভব করলাম না নিজের শরীরে, প্রতিবার বাঘ দেখলে এমনই অবস্থা হয় আমার। তারপর আসলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ “সোনাম” এর চারটি সাবক ধীরে ধীরে বসল মায়ের গা ঘেঁষে। নিজেকে চিমটি কেটে দেখলাম একবার। হ্যাঁ, যা দেখছি তা সত্যি । কত মুহূর্ত কেটে গিয়েছে খেয়াল নেই আমার, হঠাৎই বাধ ভাঙলো আকাশের ঝমঝমিয়ে নামল বৃষ্টি। ভিজলাম আমি, ভিজল “সোনাম” আর ওর তুলোর বল গুলো। লম্বা ঘাসগুলো হল আরও সবুজ, জঙ্গলের বুক চিরে ওঠা মোহময়ী গন্ধটা পাগল করে দিচ্ছিল আমায়।
সোনাম উঠে আসলো রাস্তার ওপর, অঝর বৃষ্টিতে ঠিকরে বেরোচ্ছিল ওর গায়ের গেরুয়া রঙ শান্ত চোখে একবার ঘুরে তাকাল আমার দিকে একটা ছবি তুললাম আমি তারপর ক্যামেরা নামিয়ে রাখলাম। একবার বুঝি ওর চোখে চোখ পড়লো, ওর জন্যই বুঝি অপেক্ষায় ছিলাম এতদিন, আমার তেলিয়া লেকের রানি “সোনাম”।
শেয়ার করুন :