দন্তশূল -

ছবি- শুভেন্দু সরকার

দন্তশূল

ডেন্টিস্টের কাছে দাঁত তুলতে, পেছনে চললো একটি ছোটখাট ব্যাটেলিয়ন…

কেকা বসুদেব

জানেন, আমার মত অগোছালো মানুষের বেহ্ম মার্কা- বেজায় ডিসিপ্লিন্ড শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ঝামেলার অন্ত ছিলনা। অন্য অনেক কিছুর মত, তার মধ্যে দাঁতের যত্নও ছিল। শাউড়ির গোটা পরিবার, মায় তিন বছরের নাতনী পর্যন্ত- দিনে দুবার নন ফ্লোরাইড মাজন আর বৈজ্ঞানিক ব্রাশ দিয়ে- ডেন্টিস্ট নির্ধারিত পদ্ধতিতে দাঁতের সেবা করে। 

আর আমি ? মায়ের পেয়ারার ডালের ভয়ে দিনে – ওই একবার ! তাও স্যাটাস্যাট চোখের নিমেষে ব্রাশ শেষ ! 

আমার বত্রিশ পাটি আজও আছে কি করে, সেটাই তখন শ্বশুরবাড়িতে মহা গবেষণার ব্যাপার। রূপ নয়,গুণ নয়, প্রধান আলোচ্য বিষয়- আমার দাঁত।

কিন্তু যা দেখা যায়, সেটাই সব নয়।  অচিরেই শ্বশুরবাড়ির লোহার বাসরেও ছিদ্র মেলে; যেমন- শাশুড়ি দাঁতের গোলমালের ঠ্যালায় ঢাকি সমেত বিসর্জন দিয়েছেন বহুকাল, অর্থাৎ কিনা – সব দাঁত তুলে বাঁধিয়ে ফেলেছেন। আর প্রিয় হবি হল- সেই বাঁধানো দাঁত হারানো, তাই বেশ কয়েক সেট নকল দাঁত আছে। কোথাও গেলে কোনো মতে ছেলেদের জুলুমে দাঁত পরে যাবেন, আর অস্থানে কুস্থানে ফেলে আসবেন। খাওয়ার সময় ওটা অবশ্য খুলে রাখেন, নইলে নাকি স্বাদ পাওয়া যায় না। তবে মাড়ি বেজায় শক্ত, মাছের মাথা চিবিয়ে খান।

জায়ের দাঁত- দেখলে মুগ্ধ হয়ে যাবেন, আহা ! কি সুন্দর মুক্তোমালার মত সেটিং ! ওই সামনের টুকুই, দুপাশের মাড়ির সব দাঁত তুলে তুলে প্রায় খতম ! যে কটা আছে- রুট ক্যানাল ট্রিটমেন্ট না কী বলে – তাই করাচ্ছে।

দুই কর্তারও দাঁতে সিল করানো আছে, টুকটাক দাঁতের ব্যথা, বলে- আক্কেল দাঁত বা জিভে কামড় লেগেছে।

যদি মিনমিন করে বলি- ‘এত যত্ন করে শেষে এই ?’

ওমনি চোখ পাকায়- ‘চুক্করো ! তোমার মত তো পাথর দিয়ে প্লাস্টার করা নয় !’

আমার দাঁত নিয়ে সবাই কতটা চিন্তিত বোঝা গেল, যখন বিয়ের দু মাসের মধ্যে ডাক্তার ভাসুর তাঁর বাড়িতে ডেন্টিস্ট বন্ধুকে ডেকে আনলেন যন্ত্রপাতি সমেত, কি এক আধুনিক পদ্ধতিতে নাকি পাথর পরিষ্কার হবে। আপিস থেকে ফোন করে ধরে আনা হল, কর্তারা দুই ভাইও উপস্থিত হলেন… 

দাঁত পরিষ্কার শুরু হল…

আমি কিচ্ছুটি মালুম পাচ্ছিনা, হঠাৎ কর্তা- চোখে অন্ধকার দেখে দুম করে পড়ে গেলেন !

– ‘এ কী ! এ কী !’ লাফিয়ে উঠি।

বাকি সবাই দেখি নির্বিকার ! ঘটনা হল – অপারেশনটি চালাতে আমার মাড়ি দিয়ে নাকি রক্ত বেরোচ্ছে, আর রক্ত দেখলে শুনলাম- কর্তামশাই চোখে অন্ধকার দেখেন, অতএব…

ওটা ছিল ট্রেলার, পরবর্তী কালে দেখেছি – কর্তাটি ব্রেন অপারেশন থেকে ওপেন হার্ট সার্জারী – সব কিছুতে,’ওটা কোনো ব্যাপার না !’ বলে সব্বাইকে সাহস দেন, আর নিজে- একটা টেটানাস ইঞ্জেকশন নিতে হলে – ও মা ! ও দাদা ! ও চুমকি ! বলে কাঁপাকাঁপি জুড়ে দেন, অর্থাৎ কি না- আদর্শ বাঙালি !

সেই মানুষের দু হাজার উনিশে হল দাঁতের ব্যথা; পাছে দাঁত তুলতে হয় – সেই ভয়ে বেমালুম চেপে ছিলেন বহুদিন। নিজে নিজে টোটকা টুটকিও চালাচ্ছিলেন। ধরা পড়লো বেশ নাটকীয় ভাবে, ট্রেনের মধ্যে। সেবার হিমালয়ে চলেছি, ট্রেনে এক বছর নব্বইয়ের বৃদ্ধা- কর্তার সঙ্গে নাতি-ঠাকুমা পাতিয়েছেন, দিব্যি সময় কাটছে গল্প গুজবে… 

রাতে কর্তা শুয়েছেন সাইড আপারে, হঠাৎ শুনি ঠাকুমার উত্তেজিত গলা- ‘নাতি, ইঞ্জেকশন দাও কেন ?’

-‘অ্যা !’ সাইড লোয়ার থেকে লাফ মেরে উঠে দাঁড়াই।

দেখি- কর্তা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে, এক হাতে লবঙ্গ তেলের শিশি, আর এক হাতে সিরিঞ্জ !

ওঃ ! এই সিরিঞ্জ দিয়ে দাঁতের গোড়ায় তেল দেওয়া চলে ! এই জন্যই আজকাল ঘরে লবঙ্গের গন্ধ পাই, আর আমায় বোঝানো হয়- গলা খুশখুশ করে বলে জিভে লবঙ্গ রাখা হয় ! মিথ্যুক কোথাকার !

ভালোয় ভালোয় ঘুরে এসে ডাক্তার দেখানো শুরু হল; বিশ্বাস করবেন না, যত রকম ডাক্তার সম্ভব দেখিয়ে বেড়ালো – যাতে কেউ অন্তত বলে, দাঁত তুলতে হবে না। কিন্তু বিধি বাম, সবার সাজেশন – সমূলে উৎপাটন ! 

শাশুড়ি পাঁজি পুঁথি দেখে দিন স্থির করে দিলেন। ওদিকে কর্তার রাতের ঘুম উড়ে গেছে। কয় পোয়া রক্তপাত হবে জানতে গুগল ঘেঁটে ফেললেন; আমায় দিবারাত্র উপদেশ দিয়ে চললেন- তাঁর অবর্তমানে এই জীবন লইয়া আমি কি করিব। কোথায় কি লুকোনো আছে তার সুলুক সন্ধান, খান কতক আপিসের চেক সই করে রাখা… 

এমন কি ভালোমন্দ হয়ে গেলে সুপাত্র দেখে আবার বিয়েতে বসারও পরামর্শ দিলেন। 

আমি পুলকিত হয়ে বলি- ‘আইডিয়া মন্দ নয়, তবে এবার দেখে নিতে হবে- পাত্রের দাঁতের ব্যমো যেন না থাকে !’

কর্তা কটমটিয়ে চান…

নির্দিষ্ট দিনে মায়ের পায়ে প্রণাম করে পুত্র চললেন- পাড়ার সমবয়সী ডেন্টিস্টের কাছে দাঁত তুলতে, পেছনে চললো একটি ছোটখাট ব্যাটেলিয়ন – বউ, দাদা, বৌদি, ভাইঝি, আপিসের ম্যানেজারবাবু, দুই বন্ধু… আরো কেউ কেউ ছিল, এখন মনে পড়ছে না। 

ওয়েটিং রুমে বসা মানুষটাকে দেখে একটাই উপমা মনে আসে- বলি দেবার আগে ছাগল ছানা… 

এট্টু এট্টু যে মায়া হয় না, তা বলবো না… 

পালা আসার আগে দেখি ঊষাদি হন্তদন্ত হয়ে চেম্বারে ঢুকলো- ‘কি ছোড়দা হইলো ?’

– ‘তুমি এখানে কেন ?’ ভাসুর আকাশ থেকে পড়েন।

জানা গেল – বাড়ির বহু পুরনো কাজের লোক ঊষাদিকে তাঁর ছোড়দা রিকোয়েস্ট করেছে – দাঁত তোলার সময় উপস্থিত থেকে মরাল সাপোর্ট দিতে, তাই বেচারী ঠিকে কাজ ফাঁকি দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এসেছে।

– ‘ভয় পায় না, আমার চার খান দাঁত তোলা হইসে, এট্টুও লাগে নাই !’ ঢাকাইয়া ঊষাদি তার ছোড়দাকে প্রবোধ দেয়…

খানিক পরেই ভেতরে ডাক পড়ে… 

কর্তার ইচ্ছে- অন্তত দাদা যেন পাশে থাকে, কিন্তু বন্ধু ডাক্তার রাজি নয়, ‘আমি তো আছি, চিন্তা কি ?’

খানিক বাদেই থেকে থেকে প্রাণান্তকর আর্তনাদ- ‘আঁ! আঁ! আঁ! আঁ!!!’

কেসটা কি ? অন্তত সাত জন লোক আমাদের সামনে দিয়ে দাঁত তুলে বেরিয়ে গেল বিনা চিৎকারে, আমাদের পেশেন্ট চ্যাঁচ্যায় ক্যান ?

অ্যাসিস্টেন্টকে এক ঝটকায় সরিয়ে ঊষাদি চেম্বারে ঢোকে, পেছনে ভাসুর।

কেস গুবলেট! দাঁতের রুট নাকি গন্ডগুলে, তুলতে গিয়ে টানাটানিতে স্রেফ ভেঙে গেছে ! অর্ধেক রয়ে গেছে ভেতরে। জানতে চাওয়া হল- ‘আপনি এক্স রে করালেন না কেন আগে ?’ 

ডাক্তার নিরুত্তর…

ছবি তুলে যা বোঝা গেল- অপারেশন করে গোড়া বের করতে হবে। 

কর্তার ঘোষণা, ‘আর তুলবো না, সারা জীবন পেন কিলার খাব !’

দিন কতক চুপচাপ থেকে, অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স করিয়ে, ভ্রাতৃপ্রতীম এক তরুণ ডাক্তারবাবু কর্তাকে নিমন্ত্রণ করলেন- দাঁতের গোড়াটা পরীক্ষার জন্য। 

আমায় চুপি চুপি বলে দিলেন- কিছু কাজকম্ম কর্তার অগোচরে সেরে দিতে।

আবার ঊষাদি বাদে সেই পুরনো দল মিছিল করে চললাম…

আমাদের দলবল দেখে ডাক্তারবাবু আর তাঁর সহকর্মীরা হাসি চাপেন…

শুধু চেকআপ হবে, তাই কর্তাও বেশ স্মার্টলি হাসি ঠাট্টা করতে করতে ভেতরে ঢোকেন… 

মিনিট কুড়ি পরে ভাসুরের ডাক আসে, খানিক পর তিনি ভাইকে নিয়ে বের হন – দাঁত তোলা হয়ে গেছে !

কর্তা আকারে ইঙ্গিতে বোঝান – তিনি নাকি টেরটিও পান নি ! 

পর পর চার খানা আইস্ক্রিম খেয়ে খোশ মেজাজে বাড়ি ফেরেন… 

যদিও পরে ফোনে বন্ধুকে অনুযোগ জানিয়েছিলেন- কাজটা ঠিক হয়নি, তাঁকে একটু প্রস্তুতির টাইম দেওয়া উচিত ছিল।

– ‘কি ভাবে প্রস্তুতি নিতে গো দাদা ? উইল বানাতে ?’ ওপার থেকে মোক্ষম রসিকতা ভেসে আসে…

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *