অ্যাপোলোর মর্মস্পর্শী ভ্যালেনটাইন্স ডে উদযাপন -

অ্যাপোলোর মর্মস্পর্শী ভ্যালেনটাইন্স ডে উদযাপন

এই বসন্তে ভ্যালেন্টাইন্স উৎসবে যখন আপামর বিশ্ব প্রেমের উৎসবে মেতে উঠেছে তখন পূর্ব ভারতের একমাত্র আন্তর্জাতিক JCI অ্যাক্রেডিটেড স্বনামধন্য অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশালিটি হসপিটালস একটি অনন্য হৃদয় কাড়া ‘আল্টিমেট গিফ্ট অফ লাভ’ অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল  ।

দৃষ্টান্তমূলক অনন্য এই অনুষ্ঠান আলো করে উপস্থিত ছিলেন সেই দ্বিগ্বিজয়ী অনন্য মানুষরা যাঁরা তাদের প্রিয়জনকে লিভার ও কিডনি দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছেন এবং এই অসাধারণ কাজের কান্ডারি দেবদূত সোম ডাক্তারেরা।ডি এম এস ডঃ সুরিন্দর সিং ভাটিয়া, সিনিয়র কনসালটেন্ট নেফ্রোলজিস্ট ও ট্রান্সপ্লান্ট ফিজিশিয়ান ডঃ সন্দীপ কুমার ভট্টাচার্য্য,হেড অফ লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি ডঃ রামদীপ রে, সিনিয়র কনসালটেন্ট ও লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন ডঃ সুমিত গুলাটি ,প্যাথলজি কনসালটেন্ট ডঃ অতসী বসু,কনসালটেন্ট এ এইচ সি ডঃ শুচিস্মিতা ভৌমিক ও সিনিয়র কনসালটেন্ট মেডিসিন ডঃ জয়ন্ত শর্মা।

ডি এম এস ডঃ ডঃ সুরিন্দর সিং ভাটিয়া বলেন,’এই ডোনার অর্গান দেওয়ার  ভাবনা স্বতন্ত্র কারণ স্বাভাবিক প্রথা অর্গান কিনে নেওয়া।এখানে উপস্থিত জামশেদপুর ,ঝাড়খন্ড থেকে আসা শ্রীমতি  কাঞ্চনমালা তার স্বামী শ্রী হেমন্ত ঠাকুরকে নিজের কিডনি ডোনেট করেছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার শ্রী পান্নালাল দাসকে তাঁর স্ত্রী শ্রীমতি রিংকু দাস কিডনি ডোনেট করেছেন,যোধপুর পার্কের শ্রীমতি পিউ গুহ তাঁর স্বামী শ্রী সম্বিৎ গুহকে কিডনি ডোনেট করেছেন,আর শ্রীমতি নুপুর মুখার্জি তাঁর ভাই শ্রী সৌভিক আচার্য্যকে লিভার ডোনেট করেছেন। আপনারা এই মহামানবরা আজকের পৃথিবীতে স্পেশাল আর এনারা প্রমাণ করলেন যে পৃথিবীতে নিজের শরীরের অঙ্গদান করার চেয়ে মহৎ আর কিছুই নয়।  এই অত্যাধুনিক সায়েন্টিফিক  প্রোগ্রাম সার্থক করে তুলেছেন কনসালটেন্ট ডক্টর সন্দীপ ভট্টাচার্য্য ,ডক্টর জয়ন্ত শর্মা , নেফ্রোলজিস্ট ডক্টর মনীশ  জৈন,এবং লিভার ট্রান্সপ্লান্টের মতন অত্যন্ত কঠিন চিকিৎসায় ডঃ রামদীপ রে, ডঃ সুমিত গুলাটি,ডঃ সুপ্রিয়  ঘটক দুর্দান্ত কাজ করে চলেছেন।এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য  ট্রান্সপ্ল্যান্ট কো অর্ডিনেশন  কমিটির শ্রীমতি তানিয়া মাইতি,শ্রীমতি দেবস্মিতা দে,যারা এই ট্রান্সপ্লান্টের কাজের শুরুর দিন থেকে অর্গান ডোনেশনের কঠিন সরকারি প্রটোকল আর গাইডলাইন আর প্রক্রিয়া মেনে কাজ করে চলেছেন,কাউন্সিলিং ডঃ অতসী বসু,ডক্টর শুচিস্মিতা ভৌমিককে অজস্র ধন্যবাদ জানাই।‘

সিনিয়র কনসালটেন্ট নেফ্রোলজিস্ট ,ট্রান্সপ্লান্ট ফিজিশিয়ান ডঃ সন্দীপ ভট্টাচার্য্য বলেন, ডি, এম এস ডঃ ভাটিয়া ডোনেশনের সুবিধা আর সুবিধার কথা বলছিলেন ,একটা রিসার্চ পেপারে প্রমাণিত যে যিনি ডোনেট করছেন তিনি যে তার প্রিয়জনের  জন্য কিছু করতে পারলেন এই ভাবনা পরবর্তীকালে তাঁর নিজস্ব জীবন উন্নত করে দিয়েছে।ট্রান্সপ্লান্ট করার সময় এঁদের সঙ্গে অনেকদিন থাকতে হয় ফলে অনেক অজানা অবিস্মরণীয় ঘটনার কথা জানা যায়। পান্নার ফলের বাগান আছে।এই ফলের বাগান থেকে উপার্জন আর তাই দিয়েই ট্রান্সপ্লান্ট।কিন্তু বেশিরভাগ কাজই করত রিংকু।যেহেতু পান্না র অসুখ তখন রিংকু সেই কাজ করতে গিয়ে হেমারেজ হয়ে ইন্সিশনাল হার্নিয়া হয়। এর পরে এই কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট।এই বিষয়টা এমন নয় যে শুধু একটা কিডনি দিলাম।মালদার পাপড়ি তার সে অর্থে সম্পূর্ণ উদাসীন আবেগবর্জিত স্বামীর জন্য কিডনি দিয়েছে আর এর পর থেকে তাকে মায়ের মতন যত্নে রাখে। যেদিন ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে ,পাপড়ি প্রশান্ত কে কিডনি দিচ্ছে আর যেহেতু দুটো বেড কাছাকাছি  ছিল পাপড়ি ট্রান্সপ্লান্টের সময় উঠে দেখছে যে ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে আর পরের দিন পাপড়ি নিজে এসেছে স্বামীকে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করতে,কারণ ওদের একটি মেয়ে যে পেশায় হাউস স্টাফ সে সেদিন ছুটি পায়নি।ইংরেজিতে আলট্রুইজম বলে একটা কথা আছে যার মানে যে নিজের ভালোমন্দের সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে অন্যের উপকার করে।এটা পরার্থপরতা নয় কারণ এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে প্রচলিত দর্শন স্ত্রী স্বামীকে অঙ্গদান করছেন কারণ স্বামী অর্থ উপার্জন করেন তাহলে পিউকে কি বলবেন? পিউ স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ অফিসার।পিউ তার স্বামীকে কিডনি দিয়েছে।একথা সত্যি যে এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে  সোসাইটিতে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বেশিরভাগ  স্ত্রী স্বামীকে কিডনি দান করেছেন তার প্রধান কারণ হল নারী পুরুষের মধ্যে নারী পুরুষকে বেশি ভালোবাসে।  অনেক ইমোশনালি স্ট্রঙ্গার হয়  ছেলেদের থেকে এটাই প্রমাণ করে।‘

লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জারি হেড ডঃ রামদীপ রে বলেন,’ এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ টার্ন্সপ্লান্ট প্রসিজিওরে আমরা অর্থাৎ ডাক্তারদের সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়া হলেও বিশেষভাবে মনে রাখতে  কোঅর্ডিনেটর দের অবদানের কথা।এই ট্রান্সপ্লান্টের ক্ষেত্রে একটি প্রধান বিষয় হল বিধিসম্মত প্রয়োজনীয় ফাইলপত্রের সময়মতো এক ডিপার্টমেন্ট থেকে অন্য ডিপার্টমেন্টে সবরকম পদ্ধতি মেনে সময়ে পৌঁছনো।এখানে একটি সই এর মূল্য অপরিসীম,আর যে ফাইল বিকেল ৩টের সময় সই হয়ে অন্য দপ্তরে পৌঁছনো আর শুক্রবার সকাল ১০টায় সই হয়ে ফাইল সোমবার সকালে পৌঁছনোর মধ্যে একটি মূল্যবান জীবন চলে যেতে পারে তাই এই তানিয়া,দেবস্মিতাদের মতন কো অর্ডিনেটরদের কর্মতৎপরতা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এই প্রসঙ্গে আরো মনে রাখতে হবে যে এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ,একটি ট্রান্সপ্লান্ট সার্থকভাবে সম্পন্ন  করতে দীর্ঘসূত্রতার জন্য অনেক সময় লাগে,যেমন ট্রান্সপ্লান্ট অ্যাডভাইস করা হলেও সময়মতো অর্গান না পাওয়ার  জন্য তাদের বাঁচানো যায় না।আমি মনে করিনা এখানে আলট্রুইজম অর্থাৎ স্বার্থহীন পরার্থপরতার দর্শন আছে।এটি সে অর্থে অপরিসীম ভালোবাসা যে আমি আমার শরীরের অঙ্গ দান করছি তাকে যাকে আমি  ভালোবাসি।নিজের থেকেও যার ভালো চাই ,এটি অসাধারণ ভাবনা।ভ্যালেন্টাইন মানে তো শুধু স্বামী স্ত্রী নয়,ভাই বোনের ভালোবাসাও আছে।যিনি দাতা তিনি তো মহান,সব আলো তার ওপরে কিন্তু এখানে আমি গ্রহীতার কথা বলব কারণ কথাও বলব কারণ গিফট দেওয়া সহজ ,নেওয়া খুব ডিফিকাল্ট ,এটা একটা লাইফটাইম অফ ইমোশনাল অব্লিগেশন ,তার আত্মীয়রা কি ভাবছে,পরিচিতরা কি ভাবছে। কারণ ডোনার তো পরের দিন থেকেই হিরো।কিন্তু গ্রহীতা যে নিল তার দ্বিধা, কৃতজ্ঞতা।এখানে একটি অসাধারণ বিষয় প্রত্যক্ষ্য করেছি যে গ্রহীতা বলছে নেব কিন্তু ছেলেমেয়ের কাছ থেকে নেব না ,কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করছি বাবা ,মার্ হলে দিতেন ,বলছে হ্যাঁ,নিশ্চয়ই দিতাম। লিভিং ডোনার লিভার ট্রান্সপ্লান্ট একটি  অত্যন্ত জটিল আর দুরূহ অপারেশন যার পেছনে একটি বিশাল টিম কাজ করে যাদের প্রত্যেকের অপরিসীম গুরুত্ব আর অবদান আছে।‘

এদিনের অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকলেও সম্বর্ধনা দেওয়া হয় শ্রী শৌভিক আচার্য্য ও তাঁর বোন শ্রীমতি নুপুর মুখার্জিকে যিনি ভাইকে  লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করেছেন। 

ওঁদের কথায়

শ্রী হেমন্ত ঠাকুর আর শ্রীমতি কাঞ্চনমালা,জামশেদপুর ,ঝাড়খন্ড

হেমন্তের কথা -‘২০১৭  ব্লাড প্রেশার বেড়ে গিয়ে পরে কিডনি খারাপ হয়ে গেছে।যখন ট্রান্সপ্লান্টের প্রশ্ন এল তখন আমার বাবা রাজি ছিলেন কিন্তু ওনার বয়স একটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়।যখন কাঞ্চন বলল তখন আমার মনে দ্বিধা ছিল যে পরিবারে একজন এতটা অসুস্থ এর পর আবার ওঁর জীবনের ঝুঁকি তাই প্রথমে রাজি হই নি কিন্তু পরে ও জোর করতে রাজি হলাম।এখন কাঞ্চন আমার শরীরের বিষয়ে খুব স্ট্রিক্ট আর ভীষণ যত্নশীল।এর পরে ওর জন্য আমার জীবন সম্পূর্ণ বদলে গেছে এবং তা ভালোর দিকে।’  

কাঞ্চনমালার কথা-আমি যখনই শুনি তখনই সিদ্ধান্ত নিই।এই নিয়ে আমার মনে কখনও কোনো দুশ্চিন্তা,দ্বিধা আসেনি আর এখন যখন ও সম্পূর্ণ সুস্থ এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে।’

পান্না দাস, রিংকু দাস

হঠাৎ ক্রমাগত হাই ব্লাড প্রেশার তারপর সেই সময়ে চেন্নাই অ্যাপোলোতে জানতে পারি   কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে।শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে কারণ পরিবারে আমি আর ও দুজনেই একা।বাড়ির পাশেই ভাইয়ের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট ডঃ সন্দীপ ভট্টাচার্য্য করেছিলেন তাই ওনার কাছে আসি।আশ্চর্যের বিষয় ওর অসাধারণ,অকল্পনীয় মনের জোর,ওর শরীরের জন্য আমার ভয় করলেও ও সম্পূর্ণ নির্বিকার ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল।এটা নারীশক্তির জয়। এখন দৈনন্দিন ওর কঠোর শাসন মেনে চলি। ওর জন্যই আবার জীবন ফেরত পেলাম।‘

সম্বিৎ গুহ, পিউ গুহ 

 ২০১৭ সালে ক্যান্সার হয়েছিল।কেমোথেরাপি থেকে ব্লাড সুগার ডেভেলপ করে।একটা কিডনি খারাপ ছিল এবার দ্বিতীয় কিডনি খারাপ হল।২০১৭ সেপ্টেম্বর মাস থেকে ডায়ালিসিস শুরু হয়।আমি সরকারি জয়েন্ট সেক্রেটারি ছাড়াও হাওড়া ব্রাত্যজনে গ্রূপ থিয়েটার করতাম।যাইহোক ডোনার চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম কিন্তু বড্ড ঘোরাচ্ছিল ,তখন পিউ বলল ও দেবে।আমি চাইনি কিন্তু ও জোর করল আর ওর ভাই ও বলল।এই লাস্ট জুন ট্রান্সপ্লান্ট করে ৩১ ডিসেম্বর নিউ ইয়ার পার্টিতে একটু নেচেছি।বিদেশে ঘুরতেও গেছি।আর দাম্পত্য ঝগড়া কি ,আমাদের কলেজ জীবন থেকে প্রেম আর তখন থেকেই ঝগড়া করছি ,অবশ্য এখন ঝগড়া হয় ওর কঠোর শাসনের জন্য যা আমি মাথা নিচু করে মেনে নিই।’      

এদিনের অনুষ্ঠানে সম্বর্ধনা দেওয়া হয় শ্রী শৌভিক আচার্য্য ও তাঁর বোন শ্রীমতি নুপুর মুখার্জিকে যিনি ভাইকে  লিভার ট্রান্সপ্লান্ট অঙ্গদান করেছেন। 

হেমন্ত ঠাকুর,কাঞ্চনমালা,পান্না দাস, রিংকু দাস,সম্বিৎ গুহ, পিউ গুহ,শৌভিক আচার্য্য, নুপুর মুখার্জি,এঁদের কে চিনে রাখুন।কালজয়ী প্রেমের গল্প উপন্যাসের নায়ক নায়িকাদের চেয়ে অনেক ওপরে এঁদের স্থান।আর এঁদেরকে যাঁরা জীবন দিলেন সেই ডানা লোকানো দেবদূত ডাক্তার আর তাঁদের টিমকে। অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশালিটি হসপিটালসের এই গিফ্ট অফ লাভ  ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপনের রেশ সবার হৃদয়ে থেকে যাবে।এদিনের অনুষ্ঠানের সার্থক নাম ‘লাভ হিলস’ আক্ষরিক অর্থে সত্যি ,কারণ ভালোবাসাই সব ক্ষতের আরোগ্য এদিন যেন তা সশরীরে প্রমানিত হল।          

ছবি- কৃশানু রায়         

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *