অনিন্দিতা পাত্র
৮ই মার্চ একটি বিশেষ দিন। বিশ্বজুড়ে এই দিনটি প্রতি বছর নারী দিবস হিসাবে পালিত হয়। নারী স্বাধীনতা এই মুহূর্তে পৃথিবীর একটি বহুল চর্চিত বিষয়। শুধু আমাদের দেশ নয়, সারা পৃথিবীতেই নারীর স্বাধীনতা, নারীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার হচ্ছে মানুষ। তাই এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বিশ্ব জুড়ে নারী দিবসের উদযাপন যে ধুমধাম করেই হবে, এ তো বলাই বাহুল্য। এই দিনটি পালনের মূল বিষয় যদিও নারী, কিন্তু দেখা গেছে দেশ-অঞ্চলের ভিত্তিতে দিবসটি পালনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন। কোথাও নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তো কোথাও নারীর প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা প্রদর্শনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আবার কোথাও নারীর মর্যাদা, নিরাপত্তা রক্ষাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে, উদযাপন করা হয়েছে এই দিনটিকে।
এখন কথা হল, পৃথিবীর আদি যুগ থেকে তো এই দিনটি নারী দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসেনি। পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে নারীর মর্যাদা সম্পর্কিত ধারনাটিও জনমানস ও বৃহত্তর সমাজে ক্রমবিবর্তিত হয়েছে। আমরা দেখেছি যুগে যুগে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে নানান অগ্নি পরীক্ষা দিতে হয়েছে! তাই নারীর জন্যে একটি বিশেষ দিনের উদযাপন শুরু হল কবে থেকে বা নারী দিবসের উৎপত্তি হল কিভাবে, সেটা দেখে নেওয়া যাক। জেনে নেওয়া যাক নারী দিবসের ইতিহাস।
১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের এক সূঁচ কারখানায়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, কম বেতনে বেশি সময় কাজ করার অভিযোগ এনে, মহিলা শ্রমিকরা প্রতিবাদ মিছিল বের করে। শান্তিপূর্ণ সেই মিছিলে পুলিশ ওই মহিলাদের ওপর নির্যাতন চালায় এবং বহু মহিলাকে আটক করে। পরবর্তীতে এই ঘটনাকে স্মরণে রেখে ১৮৬০ সালের ৮মার্চ, নিউ ইয়র্কের সূঁচ শ্রমিকেরা, মহিলা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করে।
এইভাবে সংঘবদ্ধ হতে থাকে মহিলা শ্রমিকদের আন্দোলন। এরপর ১৯০৮ সালে জার্মান সমাজ নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে, জার্মানিতে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন! নারীদের ভোটাধিকার, কর্মঘন্টা, ন্যায্য মজুরি নিয়ে আলোচনা হয় এই সম্মেলনে। এর দু’বছর পর ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ১৯১০ সালে, দ্বিতীয় নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৭টি দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিল এই সম্মেলনে এবং সেখানেই প্রথম ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯১১ সালের ৮ মার্চ, প্রথম বার দিবসটি পালিত হয়। তবে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে দিবসটি গুরুত্বের সাথে পালিত হওয়া শুরু করে ১৯১৪ সাল থেকে। আর জাতিসংঘ দিবসটি পালন করতে শুরু করে ১৯৭৫ সাল থেকে। তবে ১৯৭৭ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দিবসটি পালনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এবং দিবসটির গুরুত্ব উপলব্ধি করে জাতিসংঘ, সকল সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে দিবসটি পালনের আহ্বান জানায়। এর ফলে অধিকার বঞ্চিত নারী সমাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির পথ সুগম হয়। নারীর অধিকার রক্ষা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এটি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
আমরা আজকে নারী দিবস পালন করছি। নারী আন্দোলনের কথা বলছি। মেয়েদের আন্দোলন করার অধিকার কিন্তু অত সহজে আসেনি। সমাজের নানা বাধা এবং পুরুষের ক্রুদ্ধ ভ্রুকুটি, দারিদ্র্য, জীবনের সর্বস্তরের অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াই করে তবেই নারী এই অধিকার অর্জন করেছে। অনেক নিষ্ঠুর ইতিহাস বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে এই নারী দিবস। বিশ্ব আজ একবিংশ শতাব্দীতে পা রেখেছে, পা রেখেছে নতুন সহস্রাব্দে।
আমরা যখন নতুন শতাব্দীর প্রথম নারী দিবস পালন করছি তখনও বিশ্ব নারী সমাজের অবস্থা কিন্তু কন্টকমুক্ত নয়। গত তিন দশকে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, পশ্চিম এবং দক্ষিণ এশিয়ার নারী সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটলেও, পুরুষের সাথে ঘটা অগ্রগতির তুলনায় তা কিছুই নয়। আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারীসমাজের অবস্থা তো এখনো রীতিমতো আশঙ্কাজনক! উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আজও দারিদ্রসীমার নিচে রয়ে গেছে প্রায় ৬০ কোটি নারী। অপরদিকে উন্নত দেশগুলোতে দারিদ্রসীমার নিচে বাস করা নারীর সংখ্যাও কিছু কম নয়। ফ্রান্স, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ের মত উন্নত দেশেও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নারী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের প্রেক্ষাপটে অশিক্ষিত জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ নারী এবং দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী ৭০ শতাংশই নারী।
আজকে এই সমতার যুগে, নারী পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে আসছে। শিক্ষায়, রাজনীতিতে, সমাজের আরো নানা ক্ষেত্রে নারী নিজের যোগ্যতায় এগিয়ে এসেছে সামনে। জায়গা করে নিয়েছে পুরুষের মাঝে। নারী এখন শুধু চার দেওয়ালে আটকে নেই। বিশ্বের দরবারে জ্ঞান-বিজ্ঞান-গবেষণা, তথ্য প্রযুক্তি, শিল্প সাহিত্য, সবেতেই নারীর অবদান লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তার পরেও নারী, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। দেশ বিদেশ জুড়ে আজও নারীকে সমাজ, দ্বিতীয় শ্রেনীর বাসিন্দা বানিয়ে রাখতে চায়। বর্তমানের গালভরা গণতান্ত্রিক-সমতার যুগে, পথেঘাটে কর্মস্থলে নারীকে যৌন হয়রানি, লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় হামেশাই। এমনকি যেসব পরিবারে শিক্ষার আলো তেমনভাবে পৌঁছায়নি, পরিবারেরই আপনজন কর্তৃক নির্যাতন ঠেকানো আজও সম্ভব হয়নি। এছাড়া আমাদের দেশে নারী ভ্রূণহত্যা বা পণ প্রথার মতো নারী অবমাননার জ্বলন্ত উদাহরণ তো আছেই! নারী দিবস উদযাপনের মধ্যে দিয়েও এসব অবাঞ্ছিত অবস্থাকে মূল থেকে উৎপাটন করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নারী নির্যাতনের পরিমান আগের থেকে অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্যে সুস্থ পরিবেশ, মজুরি, কর্মঘন্টা, প্রয়োজন মত ছুটির আবেদন অনেকাংশে নিশ্চিত করা গেছে। তবে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখনো বহ বাধা থেকে গেছে। দেশ কাল নির্বিশেষে সেই বাধাগুলি মোটামুটি এরকম-
▪কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ কখনোই নারীর অগ্রগতিকে মেনে নিতে পারে না। তারা প্রতি পদে নারীর স্বাধীনতার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
▪নারীর ক্ষমতায়ন না হওয়া।নারী তার কাজে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পেলে, কখনোই নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারে না।
▪নারী যদি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়, তবে সে কোনদিন তার অধিকার নিয়ে সচেতন হতে পারে না। সমাজ তাকে ঠকিয়ে নেয়। তার আয়বৃদ্ধি হয় না। ফলে তাকে অর্থের ব্যাপারে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়।
▪সবশেষে বলব নারীর উন্নয়নের প্রধান বাধার কথা- যা হলো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি! পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই পুরুষতান্ত্রিকতায় বিশ্বাসী মানুষ নারীকে পুরুষের অধীন এবং ছোট করে দেখতে ভালবাসে।
নানান বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও সারাবিশ্বে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীতে অল্প হলেও যেটুকু পরিবর্তন এসেছে, তাতে এই দিবসটি পালনের যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে, তা অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই। নির্যাতন প্রতিরোধ এবং ক্ষমতায়নের মাধ্যমে যে নারীর উন্নয়ন সম্ভব, একথা আজ সমগ্র পৃথিবীতে স্বীকৃত। নারীর উন্নয়ন বলতে- নারীর ক্ষমতায়ন, অধিকার এবং তার কাজের যথাযথ মূল্যায়নকে বোঝাচ্ছে। আর সমাজ এবং রাষ্ট্র যদি এক হয়ে কাজ করে তবেই নারীর উন্নয়ন সম্ভব। এক্ষেত্রে সবার আগে দরকার নারী শিক্ষার। নারীমুক্তির প্রধান শক্তিই হলো শিক্ষা। শিক্ষাই পারে নারীকে আলো দেখাতে। শিক্ষা নারীর আত্মবিশ্বাস, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে মজবুত করবে। তাই নারীর উন্নয়নের প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত নারী শিক্ষার বিস্তার। এছাড়াও দরকার নারী পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করা। যুগ যুগ ধরে যে বৈষম্য চলে আসছে, আজ নারী নিজ যোগ্যতায় সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তাই আজ তার স্বীকৃতি আদায় করে নেওয়ার সময় এসেছে। নারীর নিরাপদ কর্মসংস্থানেরও সুযোগ করে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকে। তবেই এগিয়ে যাবে নারী। এছাড়া নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিকেও রাষ্ট্রের নজর রাখা উচিত। যে সুযোগ সুবিধা এতদিন শুধু পুরুষ ভোগ করে এসেছে, এখন তাতে নারীরও যাতে অধিকার কায়েম হয়, সে আশ্বাস রাষ্ট্রকেই দিতে হবে। অর্থাৎ নারীর উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সহায়ক সেবা ও আইনি সহযোগিতার মাধ্যমে, সমাজ তথা রাষ্ট্রের উচিত নারীর পাশে থাকা।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের ফলস্বরূপ বিশ্ব সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, একথা মাথায় রেখেও বলবো- আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস এখনো পর্যন্ত অনেকাংশে সভা, সমিতি, সিম্পোজিয়ামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। বাস্তবে নারীর অবস্থানে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি। বস্তুত উন্নত, অনুন্নত, উন্নয়নশীল নির্বিশেষে সকল দেশেই নারীরা কমবেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে আজও। বস্তুত নারীর মর্যাদা ও অবস্থান দেখেই বোঝা যায় একটি দেশ কতখানি সভ্য ও উন্নত। তাই নারীকে পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা দেওয়ার জন্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, পেশা-শ্রেণি নির্বিশেষে সকলের গণতান্ত্রিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নারীকে দিতে হবে তার ন্যায্য পারিশ্রমিক ও যথাযথ মর্যাদা। তবেই নারী দিবস পালন সার্থক হবে।
লেখক পরিচিতি – অনিন্দিতা পাত্র সমাজমাধ্যমে দাপুটে সোজা সাপটা ব্লগার এবং সম্প্রতি প্রকাশিত নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে জনপ্রিয় দুটি গল্পগুচ্ছ ‘ উত্তরণ’ আর ‘৩ এক্কে ৩’।
শেয়ার করুন :