উত্তম কেন সর্বোত্তম -

উত্তম কেন সর্বোত্তম

‘উত্তমের মতো কেউ নেই, উত্তমের মতো কেউ হবেও না।; – সত্যজিৎ রায়

কমলেন্দু সরকার

দেখার সুযোগ পেলেই উত্তমকুমারের কয়েকটি ছবি কখনওই ছাড়ি না। যেমন, ‘অমানুষ’, ‘সপ্তপদী’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘নায়ক’, ‘বনপলাশীর পদাবলি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছুদিন আগেই দেখছিলাম পরিচালক শক্তি সামন্ত-এর ‘অমানুষ’ (১৯৭৪)। ছবিটি দেখছি আর অবাক হচ্ছিলাম! ছবিটি  আউট অ্যান্ড আউট কমার্শিয়াল ফিল্ম, কিন্তু উত্তমকুমারের অভিনয়!  জাস্ট  ভাবা যায় না! বিশেষ করে কয়েকটি জায়গায়।

বাজারে অমর সিং পিছনে পড়ে লেখার। লেখা হলেন মধুসূদন চৌধুরীর প্রেমিকা। ওঁদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণে সেই সম্পর্কে আপাতত স্থগিত। অমর সিংকে উপযুক্ত শিক্ষা দেন মধু। প্রচণ্ড মারামারি পর নৌকায় এসে দাঁড়ান। আঙুলে থাকা আংটির দিকে তাকান মধু। মুখে তাঁর স্মিত হাসি। সেই হাসি ভাললাগার ইঙ্গিত করে। এই হাসির ইঙ্গিত কিন্তু দর্শককে বুঝতে দেন না মধু অর্থাৎ উত্তমকুমার। হাসি লেগেই থাকে ঈষৎ খোলা মুখের ঠোঁটের ডগায়। এই হাসির কারণটি পাওয়া যায় পরে।

একদিন একটি আংটি লেখা অর্থাৎ শর্মিলা ঠাকুর পরিয়ে দেন মধুকে। সেইসময় মধুসূদন চৌধুরী আর লেখার সম্পর্ক প্রেমের৷ তারপর লেখা বলেন, “আমি যখন থাকব না তখন আমাকে মনে করিয়ে দেবে।”

সত্যিই তো, বেঁচে থেকেও লেখা নেই মধুর বর্তমান যাপনচিত্রে। উত্তমকুমারের মুখে সেই হাসি, যে-হাসি দর্শক দেখেন অমর সিংয়ের সঙ্গে মারপিটের পর ফাঁকা নৌকায়৷ নৌকার সেই হাসি, যখন তিনি মধু, পরিচিতি গুন্ডা। আর লেখার আংটি পরিয়ে দেওয়ার সময় সেই হাসি, যখন তিনি জমিদার ভাইপো মধুসূদন চৌধুরী। দু’টি হাসিই সুন্দর এবং অদ্ভুতভাবে মিল আছে। গুন্ডা হোক বা জমিদার ভাইপো, দুই ঘটনার মূলে আছেন লেখা, যিনি মধুর প্রেমিকা৷ ওই জায়গাটা কলুষিত করতে চান না মধু। তাই দু’টি ঘটনার দু’টি হাসির ভিতর চমৎকার মিল থাকে। দু’টি দৃশ্যর ভিন্ন ভিন্ন সময় শুটিং  হয়েছে। কিন্তু উত্তমকুমার অপূর্ব  সিনক্রোনাইজড  করেছেন৷ খুব ভালভাবে লক্ষ করলে হাসির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। খুব বড় মাপের অভিনেতা না হলে এটা হয় না।

দারোগাবাবুর কাছে চাবুক খাওয়ার পর যখন ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে যান মধুর দুই শাগরেদ তখন মধু আপত্তি করেন৷ এই ডাক্তারবাবু লেখার দাদা। মধুর কোনও আপত্তি শোনেন না ডাক্তারবাবু। বলেন, “মধু, তোমাকে সবাই ভুল বুঝলেও, আমি কিন্তু ভুল বুঝি না তোমাকে।” এই সময় উত্তমকুমার মুখটি সামান্য ঘুরিয়ে বলছেন, “সত্যি বলছেন!” ডাক্তারবাবুর প্রতি মধুর বিস্ময়, অবিশ্বাস থেকে বিশ্বাসে উত্তরণ, সবটাই উত্তমকুমার ধরেন তাঁর মুখের ভাবপ্রকাশে এবং দৃষ্টিতে। এবং সেই এক্সপ্রেশন তিনি  হোল্ড করেন বেশ কয়েক সেকেন্ড! ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এই শটটি যাঁরা অভিনয় করেন তাঁদের কাছে শিক্ষণীয়। এরপর ডাক্তারবাবু চিকিৎসা শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর লেখা এসে দরজায় দাঁড়ান। উত্তমকুমার লেখার দিকে পিছন ফিরে৷ তিনি লেখা অর্থাৎ শর্মিলার মুখের ভাবপ্রকাশ দেখতে পান না৷ কিন্তু লেখা যখন  বলেন, “দোষ করলেই শাস্তি পেতে হবে। তাই শাস্তি পেয়েছে।” তৎক্ষণাৎ উত্তমকুমার ডাক্তারবাবুর চিকিৎসা না-নিয়ে জামাটি পরে বেরিয়ে যান ডাক্তারখানা থেকে৷ এই যে লেখা তাকে প্রথম থেকেই ভুল বুঝছে, তার বিরুদ্ধাচারণ করেন মধু। এবং বলেন, “সুন্দরবনের জন্তুজানোয়ারেরা এইভাবেই বেঁচে থাকে৷ তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে।” এই সংলাপ ডাক্তারবাবুর উদ্দেশে নয়, লেখার বিরুদ্ধে। সেটা কিন্তু বোঝা যায় উত্তমকুমারের অভিনয়ে। এই মুহূর্তে উত্তমকুমারের মুখের ভাবপ্রকাশ একেবারে অনবদ্য! আসলে মহিম হালদারের ষড়যন্ত্রের কারণে সর্বস্ব হারিয়ে সর্বহারা মধু। গুন্ডামি তাঁর পেশা নয়, অন্যায় করতেও নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর গুন্ডামি৷ একজন জাত গুন্ডা, পাকেচক্রে পড়ে আর একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক গুন্ডা, দুটোর বিস্তর ফারাক। একজন নৃশংস, অন্যজনের মধ্যে ভদ্রতা, ভালবাসা ইত্যাদি সব থাকে। তার গুন্ডামি অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এই ধরনের গুন্ডা চরিত্রে অভিনয় করার সময় ভীষণভাবে সচেতন থাকতে হয় অভিনেতাকে। তাই ‘অমানুষ’ ছবিতে উত্তমকুমার অভিনীত মধু চরিত্রটি তিনি মেপে নিয়েছিলেন তাঁর মতো করে। সম্ভবত পরিচালক শক্তি সামন্ত অভিনয়ের ব্যাপারে কোনওরকম মাথা গলাননি। উত্তমকুমার অভিনয়ে এতটুকু এদিক ওদিক করেননি।

‘অমানুষ’ কে? মধু না মহিম? মধু বিপিনবাবুর কারণসুধা পান করুক বা মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে সময় কাটাক, এই জীবনটা তাঁর আরোপিত। তাঁর সামাজিক পরিচিতিটা ভিন্ন। এটা মধু বিলক্ষণ জানেন। তাই তো মন্দিরে পুজোর দিন পুরোহিতের সঙ্গে বিবাদ করেন, প্রতিবাদ করেন। তাই মাঝেমধ্যেই প্রকাশ হয়ে পড়ে জমিদার মধুসূদন চৌধুরী। মধুর চরিত্রের ভিতরের নির্যাসটুকু টেনে নিয়েছিলেন উত্তম। তাই তাঁর অভিনয়ে নানারকম  শেডস পাওয়া যায় পুরো ছবিতে। এ-প্রসঙ্গে মধু-মাতন (প্রেমা নারায়ণ) মুখোমুখি মাতনের ঘরে। মাতন খবরদারি করার চেষ্টা করে। তারপর মাতন গান ধরে ‘না, না, অমন করে দাগা দিয়ে চলে যেয়ো না’ সঙ্গে হিল্লোলিত নৃত্য! দর্শক দৃশ্যটি দেখতে দেখতে হয়তো অন্যকিছু আশা করেন। কিন্তু মধু কিন্তু বেশি এগোন না। কারণ, তাঁর আসল শ্রেণি চরিত্র সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল মধুসূদন চৌধুরী অর্থাৎ মধু। তিনি জানেন মাতন তাঁর প্রজা।

আরও একটি দৃশ্যে উত্তমকুমার লা-জবাব। যখন থানার দারোগাবাবু পুলিশ পাঠিয়ে মধুকে ডেকে নিয়ে যান। থানায় ঢুকে দারোগাবাবুর হাতে চাবুক তুলে  দিয়ে মধু বলেন, “মারুন।” তারপর দারোগাবাবুর কথার পিঠে মধু যখন বলছেন, “নাটক করছেন,  নাকি বিবেকের দংশন?” অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতাকে গুনে দশ-দশটা গোল দিলেন উত্তমকুমার! এরপর ফ্ল্যাশব্যাক। মধুর অতীত জীবন। এই পর্যায়ে একাধিকবার উত্তমকুমার-উৎপল দত্ত মুখোমুখি৷ সেইসব দৃশ্যে উত্তমকুমারের বেশি সংলাপ নেই। শুধুমাত্র চোখের অভিনয় করে গেছেন তিনি। উৎপল দত্তের মতো বাঘা অভিনেতাও সমীহ করেছেন উত্তমের অভিনয়!

‘অমানুষ’ ছবিতে উত্তমকুমার তাঁর অভিনয়জীবনের শেষপ্রান্তে এসে যে-অভিনয় করে গেলেন তা শিক্ষণীয়। তার কারণ একেবারে অন্যধারার অভিনয়। শক্তি সামন্ত যেহেতু বলিউডে হিন্দি ছবিই  করেছেন কেবলমাত্র। তাই হয়তো তিনি চাইতেই পারেন ছবির প্রধান চরিত্র মধুর ভিতর বলিউডের ঘরানার অভিনয়। মধুর চরিত্রটিও একেবারে বলিউডি ঘরানার। পরিচালক মধুর অর্থাৎ উত্তমকুমারের কাছে কেমন অভিনয় চেয়েছিলেন জানি না, জানার কথাও নয়। কিন্তু উত্তমকুমার করলেন কি, না-বলিউড, না-টলিউড, কোনও ঘরানার অভিনয় করলেন না, তাঁর অভিনয়ে সৃষ্টি করলেন অন্য ঘরানা। সেটি একবারেই উত্তমকুমারের নিজস্ব। উত্তমকুমার যে মধুর চরিত্রের কাছাকাছি বা আদলে বা কাছাকাছি কোনও চরিত্র করেননি, তা নয়, করেছেন। ঠিক এর আগের বছর করছেন ‘বনপলাশীর পদাবলী'(১৯৭৩) ছবিতে উত্তমকুমার উদাস-এর চরিত্র।

যাইহোক, সেইসময় পরিচালক শক্তি সামন্তের সহকারী ছিলেন প্রভাত রায়। ‘অমানুষ’ ছবির সংলাপও লিখেছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে প্রভাত রায় বাংলা সিনেমার প্রথম সারির পরিচালক। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘অমানুষ’ করার সময় উত্তমকুমারকে পরিচালক বলে দিয়েছিলেন কীভাবে, কেমনভাবে অভিনয় করতে হবে? প্রভাত রায় জানালেন, “একেবারেই নয়। প্রয়োজনই হয়নি উত্তমকুমারকে কীভাবে অভিনয় করতে হবে এসব নির্দেশের। পরিচালক শক্তি সামন্ত শুধুমাত্র মুভমেন্ট গুলো বলে দিতেন। আর কিচ্ছু নয়। উত্তমকুমার তাঁর নিজের মতো অভিনয় করতেন।”

‘বনপলাশীর পদাবলী’র উদাস উত্তম অভিনীত আর একটি ব্যতিক্রমী চরিত্র। এই ছবির তিনি পরিচালকও বটে। উদাস চরিত্রে উত্তমকুমারের অভিনয় বিশ্লেষণের আগে অন্য একটি কথা বলে নিই। ‘বনপলাশীর পদাবলী’ উপন্যাসের লেখক রমাপদ চৌধুরী। তাঁর কাছেই শোনা। রমাপদ চৌধুরী একদিন চা-সিগারেট খেতে খেতে বলছিলেন, “একদিন উত্তমকুমার এলেন। বললেন, ‘আপনার ‘বনপলাশীর পদাবলী’ উপন্যাসটি নিয়ে ছবি করতে চাই। ছবির জন্য গল্পের স্বত্ব কিনতে চাই।’ আমি তো অবাক! বলে কী! বললাম, এত টাকা লাগবে। এককথায় রাজি। ছবির জন্য উপন্যাসের স্বত্ব কিনলেন। টাকাও দিলেন। তারপর বহুদিন পর আবার এলেন উত্তমকুমার। বললেন, ‘ছবি শেষ। এবার রিলিজ করব। আপনাকে আসতেই হবে।’ ‘বনপলাশীর পদাবলী’ দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেলেন। আমি এই ভেবে ছবি দেখতে গেলাম, ও আবার কেমন করবে! কিন্তু ছবি দেখার পর আমার ধারণা একেবারেই বদলে গেল। ভাবলাম, কোনটা বেশি ভাল? আমার লেখা ‘বনপলাশীর পদাবলী’ নাকি উত্তমকুমারের ‘বনপলাশীর পদাবলী’!”

এই হলেন উত্তমকুমার। আমারও সামান্য অভিজ্ঞতা আছে ‘বনপলাশীর পদাবলী’ নিয়ে৷ এই ছবির আউটডোর শুটিং হয়েছিল হাওড়ার জগৎবল্লভপুরে। ওখানে থাকতেন চণ্ডীমাতা ফিল্মসের মালিক সত্যরঞ্জন সাধুখাঁ। ওইসময় আমি যুবক। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে গেছিলাম জগৎবল্লভপুর। দু’চার দিন ছিলাম। ওই গ্রামের একজন এসে বললেন, “কাছেই ‘বনপলাশীর পদাবলী’র শুটিং চলছে। উত্তম, সুপ্রিয়া ছাড়াও অনেকেই এসেছেন।” আমরা সবাই বললাম, তাহলে যাওয়া যাক। আমরা যেদিন গেছিলাম সেদিন শুটিং চলছিল, ‘দেখুক পাড়াপড়শিতে কেমন মাছ গেঁথেছ বড়শিতে’। সুপ্রিয়া দেবী ছোট একটা পুকুরে সাঁতরাচ্ছেন আর উত্তমকুমারের হাতেধরা ছিপের বঁড়শি সুপ্রিয়ার ব্লাউজে আঁটকে আছে। আর উত্তমকুমার গাইছেন, ‘দেখুক পাড়াপড়শিতে…’। শুটিং শুরু হওয়ার আগে উত্তমকুমার ক্যামেরায় চোখ রাখলেন, দেখলেন। তারপর যাঁকে যা দায়িত্ব দেওয়ার তা দিলেন। উনি শট দেওয়ার জন্য তৈরি। হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠলেন। দূরে যাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল শুটিং এলাকার ভিতর কেউ যেন প্রবেশ করেন। উত্তমকুমার শট দেবেন বলে মুড নিয়ে তৈরি। ঠিক সেইসময় তাঁর চোখে পড়ে এক গ্রামবাসী প্রায় ঢুকে পড়েছেন। সঙ্গেসঙ্গে “কাট” বলে ধমকে ওঠেন ওদিকে দায়িত্বে থাকা লোকটির ওপর। বুঝলাম, কী সাংঘাতিক দৃষ্টি উত্তমকুমারের! চেঁচামেচি করার পরমুহূর্তেই আবার তৎক্ষণাৎ তৈরি শট দেবেন বলে। সেই এক মুড , এক ভাবপ্রকাশ। এখন ভাবি, এ মস্ত অভিনেতা না হলে সম্ভব নয়।

বনপলাশীর উদাস কৃষক পরিবারের একজন। তিনি নিজেকে চাষি বললে সম্মানিত বোধ করেন। সেটা জানা যায়, বাস ড্রাইভার দশরথের সঙ্গে কথোপকথনে। দশরথ তাঁকে বলেন, “আরে জমি তো বছরে দু’বার বাচ্চা দেয়। আর এই গাড়ি ঘণ্টায় ঘণ্টায় পয়সা দেয়।” উদাসের বহুদিনের মনের ইচ্ছেকে নাড়া দেন বাস ড্রাইভার দশরথ। আমতা আমতা করে উদাস বলেন, “আমার বহুদিনের মনের ইচ্ছে ড্রাইভারি শিখব।” উদাসের ইচ্ছা পূরণ করবেন দশরথ। কিন্তু তার মধ্যে একটা শর্ত থাকে দশরথের মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। উদাস শ্রেণিচ্যুত হলেন। চাষি থেকে বাস ড্রাইভার। পুরো ব্যাপারটায় উত্তমকুমারের অভিনয়, শরীরী অভিনয় এবং তার প্রকাশ অসাধারণ।

যখন দশরথ হঠাৎই বলে ওঠেন, “হবেক।” উদাস খুশিতে ডগমগ! ভাবেন ড্রাইভারি হবে। উদাস বলেন, “কী হবেক!” দশরথ বলেন, “বিয়ে হবেক।” উদাস অর্থাৎ উত্তমকুমার totally fused. খুশি খুশি ভাব থেকে হঠাৎই নিভে যাওয়া, অভাবনীয় অভিনয় উত্তমের। তারপর দশরথ যখন বলেন, “লক্ষমণিকে বিয়ে করো। হবেক।” আবার খুশিতে ফিরে আসা, এমন অভিনয় বোধহয় খুব বড় মাপের অভিনেতাদের দ্বারাই সম্ভব।

চাষি থেকে বাস ড্রাইভার, উদাসের এই পুরো ঘটনাটাতে ভালমানুষি ভাব, দশরথের কাছে আত্মসমর্পণ, সবমিলিয়ে অসাধারণ অভিনয় উত্তমকুমারের। যেহেতু উত্তমকুমার ‘বনপলাশীর পদাবলী’র পরিচালক তাই কখনও তিনি অহেতুক উদাসকে প্রাধান্য দেননি ছবিতে। কিন্তু ছবির শেষমুহূর্ত উদাস, পদ্ম আর ডাক্তারের ওপর নির্ভর করে। লক্ষ্মী আত্মহত্যা করার পর থেকেই পদ্মর প্রতি বেশি অনুরক্ত হয়ে পড়েন উদাস। কিন্তু পদ্ম দূরে সরে থাকতে চান উদাসের থেকে। একটি রাতের অন্ধকারের দৃশ্য রয়েছে যেখানে বোঝা যায় উদাস শারীরিকভাবে চাইছেন পদ্মকে। পদ্ম নারাজ। শুধুমাত্র সংলাপের ওপর অভিনয়। এই দৃশ্যে উত্তমকুমারের কণ্ঠ অভিনয় অত্যন্ত প্রশংসনীয়। পাশাপাশি পদ্মের ভূমিকায় সুপ্রিয়া দেবীও ভীষণ ভাল। উত্তমের অভিনয়কে সাপোর্ট  দিয়ে গেলেন পুরো দৃশ্যটিতে৷ যার জন্য উত্তমকুমার তাঁর অভিনয় অমন উচ্চতায় নিয়ে যান!

পদ্মর কাছে প্রত্যাখ্যাত উদাস হয়ে ওঠেন ভয়ংকর৷ এই উত্তমকুমারের অভিনয়ে বেশ রকমফের দেখা যায়। পদ্মকে খুন করার পর তাঁকে পাঁজাকোলা করে উদাস ছোটেন গ্রামের পথে। হঠাৎ দেখা ডাক্তারবাবুর সঙ্গে৷ উদাস বলেন, “আপনি তো ডাক্তার। কত মানুষকে বাঁচিয়েছেন। আমার পদ্মকে বাঁচিয়ে দিন না ডাক্তারবাবু।” উদাসের ভিতর এই গভীর আকুতি, ভুল করে পদ্মকে খুন করা ইত্যাদি সংলাপের ভিতর দিয়ে নানারকমফের পাওয়া যায়। তার কারণ দৃশ্যটি অন্ধকারে৷ এখানে অভিনীত চরিত্রগুলোকে হয়তো  দর্শক সেইভাবে দেখতে পাবেন না। তাই সংলাপের মধ্যে দিয়ে দর্শকদের বুঝিয়ে দিতে হবে। দৃশ্যটি কেন এবং কিসের জন্য। এখানেও উত্তমকুমারের কণ্ঠাভিনয় এবং শরীরী ভাবপ্রকাশ অসাধারণ।

এই পর্যায়ে উত্তমকুমার লাখো অভিনয়ের একটি করে মেরে বেরিয়ে গেলেন। সেটি আদালত-দৃশ্যে। কোর্ট রুমে উদাসের বিচার চলছে। তাঁর ফাঁসির আদেশ শুনিয়ে দিয়েছেন বিচারক। উদাসের বিচারে মন নেই। উত্তমকুমার জাস্ট  একটা লুক দিলেন। তাঁর চাউনিতে মনে হল পদ্মকে খুঁজছেন উদাস। কিংবা তাঁর ফাঁসিতে মৃত্যু হলে পদ্মের কাছে পৌঁছতে পারবেন হয়তো। তারপর উদাসের বাবা যখন কান্নায় ভেঙে পড়ছেন উদাসের ফাঁসির আদেশ শুনে। সেইসময় উদাস বা উত্তমকুমারের ফিরে আসেন আদালতের বিচারকক্ষে। সেইসময় লুকটি  অদ্ভুতভাবে চেঞ্জ করেন। অভিনেতা উত্তমকুমার তাঁর জাত চিনিয়েছিলেন ‘বনপলাশীর পদাবলী’র শেষ দৃশ্যে  জাস্ট ছোট্ট একটি মোচড়ে!

এই দু’টি ছবির চরিত্রের সঙ্গে বিন্দুমাত্র মিল নেই পরিচালক অজয় কর-এর ‘সপ্তপদী’র কৃষ্ণেন্দুর। পঞ্চাশের দশকের পর উত্তমকুমার তাঁর অভিনয় স্টাইলের অনেকটাই পরিবর্তন করেছিলেন। বিশেষ করে, সুচিত্রা সেনের বিপরীতে তিনি থাকলে। যদিও ষাটের দশকে মাত্র চারটি ছবি করেছেন  উত্তম-সুচিত্রার জুটি। সপ্তপদী ছাড়া বিপাশা, গৃহদাহ আর কমললতা। পঞ্চাশের দশকে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ছবিতে উত্তমকুমার অনেকটাই ছেড়ে খেলতেন। সেই খেলা তাঁর সহ অভিনেত্রীকে সুবিধা করে দেওয়ার জন্যই হয়তো হবে। ষাটের দশকে ‘সপ্তপদী’ করার সময় ওঁদের দু’জনের ভিতর কিছু-একটা কারণে সাময়িক বিরোধের কথা শোনা যায়। যে-কারণে কিছুদিন ‘সপ্তপদী’র শুটিং বন্ধ থাকে। এই ছবিটি ছিল উত্তমকুমারের নিজস্ব প্রযোজনা। তারপর থেকেই এই জুটির উত্তম তাঁর অভিনয়ের স্টাইল এবং প্যাটার্ন এর পরিবর্তন করেছিলেন! ‘সপ্তপদী’ ছবিতে সুচিত্রা সেন যেমন এক ইঞ্চি জমি ছাড়েননি, উত্তমও তেমনই। সেয়ানে সেয়ানে লড়াই। ফলে হয়েছিল কি, সবমিলিয়ে একটা ভাল বাংলা ছবি পেলেন বাংলা সিনেমার দর্শকেরা।

‘সপ্তপদী’ ছবিতে উত্তমকুমারের রকমারি অভিনয় দেখতে পান দর্শকেরা। এবং প্রতিটিই বেশ কুশলী অভিনয়। যেমন, ‘এবার কালী তোমায় খাব, মুণ্ডমালা চিবিয়ে খাব’। এক্কেবারে হস্টেল জীবনে যেমন হয় ঠিক তেমনই। ঢোল কাঁধে উত্তমের গায়নভঙ্গি এবং শরীরী অভিনয়ের সঙ্গে চোখমুখের ভাবপ্রকাশ অসাধারণ। বিশেষ করে, রিনা ব্রাউনকে দেখিয়ে কৃষ্ণেন্দুর নিজের মাথায় নারকেল ভাঙা, পুরো দৃশ্যটি tease করার সঙ্গে কৌতুকাভিনয়ের মিশেল, বাংলা সিনেমার অভিনয়ে ব্যতিক্রমী দৃশ্য তৈরি করলেন উত্তমকুমার।

‘সপ্তপদী’ ছবিতে কয়েকটি দৃশ্যে রয়েছে উত্তমকুমারের দৃষ্টান্তমূলক অভিনয়! ছবির যেখান থেকে ফ্ল্যাশব্যাক শুরু। ছবির শুরুতেই পরিচালক অজয় কর বলে দিলেন ছবির ঘটনা ১৯৪৩-এর। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। একদিন রাতের ঘটনা। একটি মিলিটারি জিপ হাসপাতালে নিয়ে আসে মদ খেয়ে বেহুঁশ এক মহিলাকে। সেই মহিলাকে দেখতে যান কৃষ্ণেন্দু। তিনি তখন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে ক্রিশ্চান। সবাই তাঁকে বলেন, “বাবা সাহেব।” হাসপাতালে উপস্থিত মহিলাকে দেখতে এসে জলের ঝাপটা দেন। দু’চারবার  ঝাপটা মারার পর মেয়েটিকে বাঁহাতে তুলে ধরেন। বোঝা যায় ডাক্তারের পূর্বপরিচিত। দর্শক একাধিকবার দেখার বা গল্প শোনা-পড়ার কারণে জানেন মহিলাটি রিনা ব্রাউন। কৃষ্ণেন্দুর পূর্বপরিচিত। যাইহোক, প্রেমিকা রিনা ব্রাউনকে দেখে হতচকিত কৃষ্ণেন্দু। ডানহাতে জল থেকেই যায়। হাতের বিগ ক্লোজআপে বোঝা যায়, কিংকর্তব্যবিমূঢ় কৃষ্ণেন্দুর বা ডাক্তারবাবার জল সমেত হাত থমকে যায়। এই দৃশ্যে উত্তমকুমারের মুখের ভাবপ্রকাশ আর হাতের থমকে যাওয়া একইভাবে, একই স্কেলে অভিনয় করে! বিস্মিত হতে হয় অভিনেতার অভিনয় ক্ষমতায়!

এরপরই শুরু হয় ফ্ল্যাশব্যাক। কৃষ্ণেন্দু বা উত্তমকুমার আর রিনা ব্রাউন বা সুচিত্রা সেনের টক্কর। সেই খেলার মাঠ। যেখান থেকে উত্তম-সুচিত্রার লড়ালড়ি।

রিনা যখন সুস্থ হয়ে ডাক্তারের কাছে কাছে এসে বলেন, “হসপিটালকে টাকা দিতে গেলাম নিল না। ডক্টর আপনাকে কিন্তু নিতে হবে। ডক্টর…। আমার কাছে মাত্র চল্লিশ টাকা আছে।” কৃষ্ণেন্দু বসেছিলেন। উঠলেন। ঘরে রাখা আয়নায় রিনা দেখতে পান কৃষ্ণেন্দুকে। তারপর সুচিত্রা-উত্তমের ক্লোজআপ শট। নির্লিপ্ত কৃষ্ণেন্দু। মুখোমুখি রিনা-কৃষ্ণেন্দু। উত্তমকুমারের অভিব্যক্তি সবকিছু হারিয়ে ফিরে পাওয়া। just হালকা হাসি বা হাসবার ক্ষীণ চেষ্টা। রিনা বেরিয়ে যান। কৃষ্ণেন্দু আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসেন বাইরে। লক্ষ করেন রিনার নির্গমন। আলো-আঁধারিতে কৃষ্ণেন্দু দাঁড়িয়ে। মুখে আবার হারিয়ে ফেলার ভাবপ্রকাশ। পুরো সিকোয়েন্সটি অনবদ্য।

‘সপ্তপদী’র সেরা দৃশ্য ‘ওথেলো’র অংশবিশেষ। উত্তমকুমার অভিনয়ের ব্যাপারে ছিলেন ভীষণই খুঁতখুঁতে। ‘ওথেলো’র এই পুরো সিকোয়েন্সটি নিয়ে তিনি কোনওরকম আপোস করতে চাননি। তিনি পরামর্শ নিয়েছিলেন উৎপল দত্তের। শোনা যায়, উত্তমকুমার রাত জেগে নাকি নিজে নিজেই রিহার্সাল করতেন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার উৎপল দত্ত সংলাপ বলছেন আর ঠোঁট নাড়ছেন উত্তমকুমার। অন্যের সংলাপের সঙ্গে ঠোঁট নাড়িয়ে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা কম কথা নয়! খুব কঠিন কাজ। উত্তমকুমার অত্যন্ত সুচারুভাবে করেছিলেন কাজটি। কখনওই মনে হয় না সংলাপ অন্যের আর অভিনয় উত্তমের। গানে ঠোঁট নাড়ানো আর সংলাপে ঠোঁট নাড়ানোর মধ্যে বিস্তর ফারাক। সংলাপের সঙ্গে শুধু ঠোঁট নাড়ানো নয়, সংলাপের ভাবপ্রকাশ অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে এই কঠিন কাজটি অনায়াসেই করে গেছেন উত্তমকুমার। সুচিত্রা সেনও সমানভাবে  সাপোর্ট  দেন তাঁর সহ আভিনেতাকে।

পঞ্চাশের দশকে উত্তম-সুচিত্রা জুটির ২২টি ছবির বাইরে অন্যরকম সিনেমা উত্তম-সুচিত্রার ‘সপ্তপদী’। তবে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায় দু’বছর আগে যাত্রিক-এর তৈরি ‘চাওয়া পাওয়া’ ছবিতে।

‘আমি যখন ‘নায়ক’ করতে যাই তখন সত্যজিৎবাবু বলেছিলেন— ওহে উত্তমকুমার? আমি বললাম, হ্যাঁ, বলুন স্যার। —না প্রথম সিনটা একটু ছবিবিক ঢঙে অভিনয় করতে হবে।

ছবিবিক ঢঙে আমি কি অভিনয় করব? ছবিদা ছবিদার মতো অভিনয় করতেন, আমি আমার মতো করব।

না, ওই যে টাইম অ্যান্ড পজ-এর ব্যাপারটা আছে না, ওইটে একটু করতে হবে…’।

‘নায়ক’-এর প্রথম দৃশ্যটি টাইটেল কার্ড শেষ ক্লোজআপে বিখ্যাত সেই ‘ইউ’ ছাঁট, মাথায় চিরুনি চালাচ্ছেন উত্তমকুমার। পরিচালক উত্তমকুমাররের মুখ দেখালেন বেশ কিছুটা পর। ‘ইউ’ ছাঁটের অর্থ মানুষটি উত্তম ছাড়া অন্য কেউ নন। দিল্লিতে পুরস্কার নিতে যাওয়ার প্রস্তুতি চলেছে বাংলা ছবির মহানায়ক অরিন্দম মুখার্জির। এমন সময় প্রবেশ বন্ধু কাম সেক্রেটারি জ্যোতির। এক প্রযোজকও আসেন নতুন ছবির চুক্তিপত্রে সই করাতে৷ ওঁদের দু’জনের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে অরিন্দম কথাবার্তা চালিয়ে যান। এবং ব্রেকফাস্ট  সারেন। টেবিলে বসে থাকা প্রযোজককেও এক পেয়ালা চা দিতেও ভোলেন না। বেরোবার জন্য তৈরি এমন সময় ফোন এলে জ্যোতি ধরেন, বলেন “নায়িকা।” ফোনের ওপ্রান্তে থাকা নায়িকার সঙ্গে কথা বলেন অরিন্দম। সত্যজিৎ রায় উত্তমকুমারকে ধরেন বিগ ক্লোজআপে। রোদচশমা পরা অরিন্দমের মুখ। ঠোঁটে কিং সাইজ সিগারেট। এই সিগারেটই তফাত করে দেয় সাধারণের সঙ্গে অরিন্দমের। এইসময় অরিন্দম অত্যন্ত  পার্সোনাল। কাটা কাটা কথা বলেন তাঁর নায়িকার সঙ্গে। অরিন্দম এবং নায়িকার সম্পর্ক এতটাই ব্যক্তিগত যে, নায়িকা স্টেশনে আসতে চাইলে বারণ করেন অরিন্দম।

পুরো সিকোয়েন্সটিতে উত্তমকুমারের অসাধারণ সাবলীল সহজ অভিনয়। তাঁর জ্যোতির সঙ্গে কথা চালানো এবং একইসঙ্গে প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলার মধ্যে দু’রকম উত্তমকুমারকে তুলে ধরেন পরিচালক। একটি উত্তমকুমারের মধ্যে মধ্যবিত্তসুলভ ব্যাপার লক্ষ করা যায়, যে-শ্রেণি থেকে তিনি উঠে এসেছেন। আর একটি উত্তমকুমারের ভিতর পুরোপুরি এক প্রোফেশনাল ম্যাটনি আইডল ফুটে ওঠে। দুটো প্রোফাইলে তিনি অত্যন্ত সফল। পরে যোগ হয় নায়িকার সঙ্গে ফোনে কথা বলা personal উত্তমকুমার ওরফে অরিন্দম। উত্তমকুমার ‘আমার অভিনয়ের মুক্তি’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘… অরিন্দম আর উত্তমকুমার সম্পর্কে দুস্তর ব্যবধান কখনই থাকত না। অরিন্দমের মানসিকতার সঙ্গে নিজেকে ভাবতে গিয়ে বিসদৃশ মনে হয়নি। মনে হয়নি আমরা ভিন্ন ভিন্ন আনন্দ আর ব্যর্থতার গ্লানি জড়িয়ে রেখেছি শরীরে। মনে হয়েছে অরিন্দমের সুখ আমার সুখ, অরিন্দমের দুঃখ আমার দুঃখ। অরিন্দমের জটিলতায় আমিও ভাবিত। অরিন্দমের সরলতায় কখন আমিও মুগ্ধ’ (নায়কের কলমে, সপ্তর্ষি)।

গোটা ছবিতেই উত্তমকুমার অতুলনীয়, পার্টিকুলার কোনও দৃশ্যে নয়। তবে একটি দৃশ্যের অবতারণা না-করলে অসমাপ্ত থেকে যায়। সেটি হল, অরিন্দমের  নাটকের গুরু প্রয়াত শঙ্করদার দাহ করার দৃশ্যে। অরিন্দম আর জ্যোতি বসে। ওদিকে চিতার আগুনের লেলিহান শিখায় আলো-আঁধারি শ্মশান। অরিন্দম কনফেস  করছেন। সবশেষে অরিন্দম যখন জ্যোতিকে বলেন, “তুই পরজন্মে বিশ্বাস করিস?” জ্যোতি উত্তর দেন, “কার?” অরিন্দম, “মানুষের।” জ্যোতি, “জ্যোতি বাড়ুজ্যে তো আর জ্যোতি বাড়ুজ্যে হয়ে জন্মাচ্ছে না। বুঝব কী করে! সকলেই তো আর জাতিস্মর হয় না।” অরিন্দম, “শঙ্করদা মাস্ট বি রং, মাস্ট বি রং.” তারপর বলেন, “সত্যযুগ হলে ভয় পেতাম।” জ্যোতি, “কার।” অরিন্দম, “শঙ্করদার অভিশাপের।” আধপোড়া সিগারেট ছুড়ে দেন চিতার দিকে। তার আগেই জ্যোতি বলেছেন, নায়ক হলে কমপক্ষে ছবিপিছু কত টাকা পারিশ্রমিক হতে পারে। বোঝা যায়, শঙ্করদা অতীত হয়ে যান  অরিন্দমের কাছে। জ্যোতির কথামতো সিনেমার নায়কের হওয়ার জন্য পরীক্ষা দিতে রাজি। আধপোড়া সিগারেট ছোড়া এবং মুখের অভিব্যক্তিতে বুঝিয়ে দেন উত্তমকুমার। শ্মশানযাত্রী অরিন্দমের মুখ থেকে ক্যামেরা চলে যায় দিল্লিতে পুরস্কার নিতে যাওয়া ম্যাটনি আইডল অরিন্দম মুখার্জির মুখে। যেখানে তিনি ট্রেনে বসে নিজের নায়ক হয়ে ওঠার কাহিনি শোনাচ্ছেন সাংবাদিক অদিতি সেনগুপ্তকে। শ্মশানে শঙ্করদারকে নিজের জীবনে অতীত করে দেওয়ার দৃষ্টির সঙ্গে অদিতিকে জীবনকাহিনির শোনানোর অভিব্যক্তি একচুল এদিক ওদিক হয় না উত্তমকুমারের!

সত্যজিৎ রায় উত্তমকুমার সম্পর্কে স্মৃতিচারণায়  বলেছিলেন, ‘… অনেকের সঙ্গে আমি কাজ করেছি, কাজ করে আনন্দও পেয়েছি কিন্তু উত্তমের মতো কেউ নেই, উত্তমের মতো কেউ হবেও না।’ ‘নায়ক’ সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় বলছেন, ‘নায়ক’ আমি লিখলাম উত্তমকুমারের কথা ভেবেই, কারণ সেখানে এমন একজন অভিনেতার কথা বলা হয়েছে যে স্টার হিসাবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে গেছে। (উত্তমকে নেওয়ার কারণ হল আমি যদি উত্তমকে ছাড়া অন্য কাউকে নিই তখন লোকের মধ্যে ধারণা হবে যে এই অভিনেতা এতদিন ধরে অভিনয় করছেন কিন্তু তিনি তো স্টার হিসেবে ব্যক্তিগত জীবনে সফল হতে পারেননি।) এক্ষেত্রে উত্তম ছাড়া আর কাউকে এই ভূমিকায় জনগণ গ্রহণ করবে না ফলে উত্তমের কথাটা প্রথমে মনে হয় এবং তারপর তার সঙ্গে কাজ করে আমার সেই উপলব্ধি হল। তাঁকে চিত্রনাট্য পড়ালাম, তাঁকে বললাম, সে পার্ট-টা পছন্দ করল। (উত্তমকুমার, সত্যজিৎ রায়, প্রবন্ধ সংগ্রহ, আনন্দ)।

‘নায়ক’ করার পর ৪০ নম্বর ছবি ‘যদুবংশ’। অর্থাৎ মাঝে ৩৯টি ছবি করে ফেলেছেন উত্তমকুমার। ‘নায়ক’-এর পরিচালক সত্যজিৎ রায় আর ‘যদুবংশ’-এর পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরী৷ এতগুলো ছবির মাঝে অন্যরকম অভিনয় করার সুযোগ পান উত্তমকুমার মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি সিনেমায়। সেইসব ছবিতে উত্তমকুমার তাঁর মতো করে অভিনয় করার সুযোগ পান। আসলে হয়েছিলটা কি, ‘নায়ক’ করার পর থেকেই উত্তমকুমার তাঁর অভিনয়ের খোলনলচে বদলে ফেলেন। তিনি ‘নায়ক’ করার সুবাদে সত্যজিৎ রায়ের অনেক কাছাকাছি আসেন। সম্ভবত তিনি সত্যজিৎ রায়ের কথা বলা, চলাফেরা,  সবকিছুই লক্ষ করেন। পাশাপাশি ভাল ছবি, ভাল অভিনয় করার খিদেটাও বাড়ে তাঁর। যদিও উত্তম লিখছেন, ‘জতুগৃহ’ সর্বসম্মত ভালো ছবি। আকাঙ্ক্ষা আরও এক ধাপ উঁচুতে উঠল। মনে হল এমন ভালো ছবি আরও করি। সবাই বলে, আমি গতানুগতিক ছবি করি। কিন্তু ‘জতুগৃহ’ এক্সপেরিমেন্টাল’ (জবানবন্দি, উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়, নায়কের কলমে, সপ্তর্ষি)। ‘নায়ক’-এর দু’বছর আগে ১৯৬৪-তে পরিচালক তপন সিংহের ছবি ‘জতুগৃহ’। ঠিক এর মাসখানেক আগে পরিচালক বিনু বর্ধন-এর ‘বিভাস’ করেছেন উত্তমকুমার। এটিও ছিল একেবারে অন্যধরনের ছবি। যে-ছবি একেবারে বাণিজ্যিক বাংলা ছবি নয়।

‘যদুবংশ’ করার সময় পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরী চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছিলেন ম্যাটনি আইডল উত্তমকুমারকে। অথবা একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলেন তাঁকে। হয়তো সেইকারণেই  উত্তমকুমারকে বহু ক্লোজআপে রাখেন পরিচালক৷ কখনও ক্লোজআপ, কখনও বিগ ক্লোজআপ।

ছবির মূলকেন্দ্রে চার ভবঘুরে যুবক। তারাই মূলত ছবির মূল চরিত্র। চার যুবক কোনও গুণের অধিকারী নন। তারা পরিবার, সমাজের চোখে অবহেলিত, বখাটে। চার বখাটে, উচ্ছনে যাওয়া যুবক– অভয়, সূর্য, কৃপাময় আর বুললি। এঁরা নেশা করেন, সবকিছুর ওপর বিরক্তি প্রকাশ করেন আর কারণে-অকারণে রেগে যান। চার যুবকের সঙ্গে রয়েছেন গণাদা। গণপতি বা গণনাথ।

এই গণাদা যতটুকু জানা যায়– তিনি রেলের চাকরি ছেড়ে নিজের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু তাঁর ব্যবসার অবস্থা ভাল নয়। ইতিমধ্যে তিনি সূর্যের কাছ থেকে একটি সোনার পঞ্চপ্রদীপ কেনেন। সূর্য অনেকগুলো টাকা পাবেন গণাদার কাছ থেকে। এই নিয়ে চার যুবক আর গণাদার ভিতর ঝামেলা। এমনকী, গণাদার বাড়ি গিয়ে তাঁকে মারতে ছাড়ে না চার যুবক। এর আগে গণাদার অফিসেও একপ্রস্ত ঝামেলা ইত্যাদি হয়ে গেছে সূর্য, অভয়, কৃপাময় আর বুললির। আলটিমেটলি  ছবিতে দেখা যাচ্ছে ওই চার যুবক নয়, গণাদাই ছবির কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে। উত্তমকুমারের অভিনয়ই তাঁকে নিয়ে যায় ছবির প্রধান চরিত্রে। এবং এর অন্য একটি কারণও আছে। সেই কারণ, গণাদার সঙ্গে চার যুবকের ঝামেলার দু’টি দীর্ঘ সিকোয়েন্স আছে। একটি, গণাদার অফিসে, অন্যটি তাঁর বাড়িতে। দ্বিতীয় সিকোয়েন্স অনেকটাই দীর্ঘ। ওই দৃশ্যেই গণাদা চার যুবক দ্বারা অত্যাচারিত হন। তাঁকে মারধরও করেন যুবকেরা। এই দুই দীর্ঘ সিকোয়েন্সে কেবলমাত্র উত্তমকুমারে ক্লোজআপ আর বিগ ক্লোজআপ ব্যবহার করেন পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরী। বিশেষ করে, গণাদার বাড়িতে যখন তাঁকে মারধর করছেন চার যুবক, তখন উত্তমকুমারকে ক্লোজআপেই দেখান পরিচালক। উত্তমকুমারের অভিনয় অতুলনীয়। উত্তমকুমার তাঁর অভিনয়ে জাদু দেখিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেন। বিশেষ করে, নয়নার সঙ্গে কথা শেষ। উত্তমকুমারের মুখের বিগ ক্লোজআপ। আলো-আঁধারিতে পর্দাজোড়া উত্তমের মুখ। সেই মুখ মূক নয়, অবশ্যই অভিব্যক্তিতে। কোনও সংলাপ নেই, মিউজিক নেই। কিন্তু কিছু বলতে চাইছেন গণাদা, আসলে উত্তমকুমার। দর্শককে বুঝতে দেন না গণাদা। ধারণা করা যায়, একজন বয়স্ক মানুষের প্রতি যুব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি চার যুবকের কোনও সমবেদনা নেই, ভদ্রতাবোধ নেই। তাহলে গণাদা কী ভাবছিলেন এই পৃথিবী তাঁর মতো মানুষের কাছে আর বাসযোগ্য নেই! হতে পারে। তাই চার যুবকের একজনের কাছে শোনা যায় গণাদার মৃত্যুসংবাদ। তিনি আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

উত্তমকুমারের ক্লোজআপ অভিনয় বারবার চমকে দেয় ‘যদুবংশ’-এ। বিশেষ করে, বিড়ি মুখে যখন তিনি ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেন চার যুবককে। তাঁর মুখের অভিব্যক্তি যেন বলে, এরা কোন প্রজন্মকে প্রতিনিধিত্ব করছে! এদের মধ্যে কী সামান্যতম ভদ্রতাবোধ নেই। এরা কী শালীনতার ধার ধারে না! উত্তমের সংলাপহীন মুখের ভাবপ্রকাশ, শরীরী অভিনয় লা-জবাব। ‘যদুবংশ’ দেখলে বোঝা যায়, উত্তমকুমার এমন একজন অভিনেতা যাঁর মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল অভিনয় করে। তাঁর মাথা এবং সহজাত প্রবৃত্তি একসঙ্গে অভিনয় করে। নিশ্চয়ই করে নইলে এমন সম্ভব নয়! ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মেক-আপহীন, অগ্ল্যামারীয় উত্তমকুমারের দুর্দান্ত অভিনয় উত্তমের অভিনয়জীবনের সেরা অভিনয়। সেই কারণে মনে করি, ‘যদুবংশ’ উত্তম অভিনীত সেরা ছবির একটি।

যদুবংশ’-এ গণাদার চরিত্রটি যদি না থাকত, তাহলে কি হতে পারত? সত্তরের চারটি বেকার ভবঘুরে যুবকের ছবি হতে পারত। কিন্তু উত্তমকুমার অভিনীত ‘যদুবংশ’ হয়ে গেল তাঁরই ছবি। গণাদাই মুখ্য চরিত্রে দাঁড়িয়ে যান। বাকি চার যুবক গণাদার চারপাশে উপগ্রহ হয়ে ঘোরেন। ক্লান্ত, অবসন্ন, অপমানিত গণনাথকে বাস্তব এবং মুখ্য করে তোলেন উত্তমকুমার তাঁর অসামান্য অভিনয়ে। এর আগে উত্তমকুমারকে কখনওই দেখা যায়নি গণনাথের মতো চরিত্রে। গণনাথের চরিত্রে মহানায়কোচিত মুদ্রাদোষ খুঁজে পাওয়া যায়নি, যায়ও না। ভীষণভাবে সাবলীল, স্বাভাবিক উত্তমকুমার। চার যুবক গণাদার খুবই স্নেহের। কিন্তু তাঁদের হাতেই অপমানিত, ভর্ৎসিত গণাদা। তাঁর বিহ্বল দৃষ্টিতে অসহায়তা, অপমানের যন্ত্রণা। এই দৃশ্যে উত্তমকুমারের চোখের দৃষ্টি আর শরীরী অভিনয় চমৎকার synchronised করে অভিনয়ের চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে দেন নিজেকে। উত্তমকুমারের অভিনয় শুধু বাক মুগ্ধ করে না, স্তব্ধ করে দেয় দর্শকদের!

উত্তমকুমারের অভিনয়জীবনে আরও একটি ব্যতিক্রমী ছবি ‘চিড়িয়াখানা’। সত্যজিৎ রায় লিখছেন, ‘নায়ক’-এর পর ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে উত্তমের সঙ্গে কাজ করেও একই তৃপ্তি পেয়েছি৷ ‘চিড়িয়াখানা’ ছিল নায়িকা-বর্জিত ছবি, ফলে বলা যেতে পারে উত্তমের পক্ষে আরও বড় ব্যতিক্রম’। (অস্তমিত নক্ষত্র, সত্যজিৎ রায়, প্রবন্ধ সংগ্রহ, আনন্দ)।

‘চিড়িয়াখানা’য় ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায় উত্তমকুমার। ধুতি বা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত গোয়েন্দা। যদিও লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও ‘গোয়েন্দা’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। লেখক বলতেন ব্যোমকেশ বক্সী হল একজন সত্যান্বেষী, অর্থাৎ যিনি সত্যের সন্ধান করেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী একজন নিপাট বাঙালি ভদ্রলোক। ধুতি-পাঞ্জাবি, পাজামা-পাঞ্জাবি পরতেন, কখনওসখনও শার্ট-প্যান্ট। তাঁর মগজাস্ত্র ব্যবহার করতেন বেশি। ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে ব্যোমকেশ বক্সীর চরিত্রে বাঙালিয়ানা থেকে বিন্দুমাত্র সরে আসেননি উত্তমকুমার। ছবির শুরু থেকে শেষ উত্তমকুমারকে ব্যোমকেশ বক্সী ছাড়া কিছুই মনে হয় না। এবং একভাবে অভিনয় করে যান। খুনিকে ধরার জন্য গোলাপ কলোনির সকলকে ডেকে যখন কথাবার্তা বলছেন তখন উত্তেজিত ব্যোমকেশ বক্সীর উত্তেজনাকে প্রকাশ করছেন উত্তমকুমার শুধুমাত্র কপালের ভাঁজে আর কথার ভঙ্গিতে। অমন একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে উত্তমকুমারের অভিনয় অত্যন্ত প্রশংসনীয়। গোটা ছবিতেই একইভাবে সংযত অভিনয় করে গেছেন তিনি।

সত্যজিৎ রায় ‘অস্তমিত নক্ষত্র’-এ লিখছেন, ‘এটা  বলতে পারি যে— উত্তমের সঙ্গে কাজ করে যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম, তেমন তৃপ্তি আমার এই পঁচিশ বছরের ফিল্ম জীবনে খুব বেশি পাইনি। উত্তম ছিল যাকে বলে খাঁটি প্রোফেশনাল। রোজকার সংলাপ সে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করে কাজে নামত। তার অভিনয় ক্ষমতা ছিল সহজাত। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপর দখল ছিল ষোলো আনা। ফলে স্বভাবতই তার অভিনয়ে একটা লালিত্য এসে পড়ত। রোজই দিনের শুরুতে সেদিনকার বিশেষ কাজগুলি সম্পর্কে একটা প্রাথমিক আলোচনার পর আমাকে নির্দেশ দিতে হত সামান্যই। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, নিছক নির্দেশের বাইরেও সে মাঝে মাঝে কিছু সূক্ষ্ম ডিটেল তার অভিনয়ে যোগ করত যেগুলি সম্পূর্ণ তার নিজস্ব অবদান। এই অলংকরণ কখনই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ত না; এটা সব সময়ই হত আমার পক্ষে একটা অপ্রত্যাশিত উপরি প্রাপ্তি৷ বড় অভিনেতার একটা বড় পরিচয় এইখানেই’। (প্রবন্ধ সংগ্রহ, সত্যজিৎ রায়, আনন্দ)

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *