সুবীর সেনের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার -

সুবীর সেনের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

আশ্চর্য অজানা না বলা কথার সঙ্গে ওনার চিরকালীন গান।

কমলেন্দু সরকার

সুবীর সেন বেঁচে থাকলে ৯০ পেরোতেন। এখনও  তিনি আছেন বাঙালির মনে, তাঁর গানে। সুবীর সেনের এই সাক্ষাৎকারটি অপ্রকাশিত ছিল। আজ থেকে বছর কুড়ি তো বটেই, আরও বেশি হতে পারে সুবীর সেনের বাড়িতে বহুদিন আড্ডা দিতে দিতে অনেক কথা বলেছিলেন শিল্পী। যার মধ্যে বহু প্রসঙ্গ সুবীর সেন লিখতে বারণ করেছিলেন, বিতর্ক এড়াতে।

আমি প্রথম শুনেছিলাম সুবীর সেনের গান, ‘সারাদিন তোমায় ভেবে হল না আমার কোনও কাজ/হল না তোমাকে পাওয়া, দিন যে বৃথাই গেল আজ…’। সময়টা সত্তরের দশক। উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ। কলকাতা এবং মফসসল-সহ গ্রামগঞ্জ। সারা রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্নরকম। অন্যরকম ভাবনাচিন্তা মানুষের মধ্যে। বিশেষ করে, যুবক-যুবতীরা অন্যরকম কিছু ভাবছেন। ঠিক এমন সময়ই সুবীর সেনের গানটি শুনি গ্রামোফোন রেকর্ডে।মুগ্ধ নয়, আপ্লুত হই। কতবার শুনেছি আর ভেবেছি এমন রোম্যান্টিক গান আগে কখনও শুনিনি!

এর তিন-চার দশক পর সুবীর সেনকে এ-কথা বলতেই উনি বললেন, “হ্যাঁ, এই গানটি অল টাইম রোম্যান্টিক গান। আমি গেয়েছিলাম ১৯৬৭। ঠিক তার আগের জিম রিভিস গেয়েছিলেন, I hear the distant drum far away. এক যোদ্ধা যুদ্ধে যাওয়ার আগে তার প্রেমিকা বলছেন, ‘তুমি একবার বলো তুমি আমার, আমাকে বিয়ে করো।’ যোদ্ধাটির বলার কারণ, সে ধরে নিয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর ফিরবে না। সব যোদ্ধাই তাই ভাবেন। জিম রিভস-এর এই গানটি থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় গানটি লেখেন এবং সুর করেন। পরে আমাকে বলেন।”একইসঙ্গে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ন্যাট কিং কোল-এর ‘মোনালিসা’র আদলে সৃষ্টি করলেন সুবীর সেনের জন্য ‘মোনালিসা’। এই গানটি গাওয়ার জন্য সুবীর সেনের কণ্ঠটিই চাইছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। এখনও গানটি শুনলে মনে হয়, ঠিক কণ্ঠটি ব্যবহার করেছিলেন গীতিকার-সুরকার।

শঙ্কর-জয়কিষণের সঙ্গে সুবীর সেন

এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, জিম রিভস-এর গাওয়া ‘My Lips Are Sealed’ গানটি শঙ্কর-জয়কিষাণ চমৎকার ব্যবহার করেছিলেন ‘আজিব দস্তাঁ হ্যায় ইয়ে’ গানটিতে। “একেবারে ঠিক। লতা মঙ্গেশকর গেয়েওছিলেন অসাধারণ। শঙ্কর-জয়কিষাণ অপূর্ব সুর করেন। আজও বারবার শুনতে ইচ্ছে করে!” বলেছিলেন সুবীর সেন।

আরও পড়ুন :

আপনাকে তো মুম্বইয়ে প্রতিষ্ঠা দেন শঙ্কর-জয়কিষাণই? “হ্যাঁ, ১৯৫৮ সাল, আমার প্রথম মুম্বই যাত্রা। আমাকে নিয়ে গেছিলেন সাংবাদিক সরোজ সেনগুপ্ত। ওঁর সঙ্গে একদিন গেলাম মহালক্ষ্মী স্টুডিওয়। সেখানে গুরু দত্তেরও অফিস ছিল। হঠাৎ সরোজদা আমাকে বললেন, ‘তুই একটু বোস। আমি শঙ্করের সঙ্গে দেখা করে আসছি। উনি ওপরেই থাকেন।’ পাঠক নিশ্চয়ই বুঝেছেন, শঙ্কর অর্থাৎ শঙ্কর-জয়কিষাণের শঙ্কর। তখন আমি বললাম, “চুপ করে বসে থেকে কী করব! আমিও যাব। উনি বললেন, ‘চল কিন্তু গান নিয়ে কোনও কথা বলবি না।’ এই কথা বলার পিছনে একটি কারণ ছিল, এর আগে কলকাতায় গুরু দত্তের সঙ্গে কথা হয়েছিল। উনি আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি আমার ছবিতে গান গাইবে। তবে একটা শর্ত, তার আগে অন্য কারওর সুরে বা ছবিতে গান গাইতে পারবে না।’ এই কারণেই বম্বে এসে গুরু দত্তের সঙ্গে দেখা করতে আসা। তাছাড়া গুরু দত্ত আমাকে বম্বে আসতে বলেছিলেন। তিনি তখন ‘পিয়াসা’ করছিলেন। অফিসে ছিলেন না গুরু দত্ত। আমি সরোজদার সঙ্গে গেলাম। সরোজদাকে দেখে উনি খুব আপ্যায়ন করলেন। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। উনি তখন ‘বসন্ত বাহার’ ছবির সুর করছিলেন। শঙ্করজি একলাই ছিলেন। একটা গানের সুর শুনে আচমকা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, এটা তো হাম্বির।

শঙ্করজি আমাকে বললেন, ‘তুমি গানবাজনা করো?’ বললাম, ওই আর কী।

উনি তখন বললেন, ‘আমার পাশে এসে বোসো। তুমি আমাকে রবীন্দ্রসংগীত শোনাও।’ গাইলাম ‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা। দেখলাম উনি একটা টেপরেকর্ডার আনলেন। বললেন, ‘আবার গাও।’রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার পর বললেন, ‘হিন্দি গান জানো?’ সুধীন দাশগুপ্তর সুরে কয়েকটি হিন্দি গান তুলেছিলাম। গজল ‘তমান্না ও হ্যায় জো না…’আর ‘হোঁটো জাম লে…’ গাইলাম।

হঠাৎই উঠে গেলেন শঙ্করজি। ওঁর সহকারীকে বললেন, ‘এখনই প্রিন্সকে ডাকো।’ প্রিন্স হলেন জয়কিষাণ। কিছুক্ষণ পর এলেন তিনি। শঙ্কর টেপ শোনাতে চাইলে জয়কিষাণজি আমার কণ্ঠে গান শুনতে চাইলেন। আবার সব গানগুলো গাইলাম।

এরপর তিনি তাঁর সহকারীকে নির্দেশ দিলেন ‘স্ক্রিন’ সিনেমা সাপ্তাহিকের ফোটোগ্রাফারকে ডাকার জন্য। তাঁকে কিছু নির্দেশ দিলে ওই ফোটোগ্রাফার আমার বেশকয়েকটি ছবি তুললেন। তারপর সহকারী এসে একটি কাগজে সই করতে বলেন, ‘তুমি এখানে সই করো।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী!

শঙ্করজি বললেন, ‘তোমাকে আমরা এক্সক্লুসিভ রাখছি। আমরাই তোমাকে হিন্দি ছবির গানে ইন্ট্রোডিউস করব। তার আগে তুমি কোথাও গাইবে না।’ তারপর ওঁদের সহকারী আমাকে নগদ একহাজার টাকা দিলেন। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! এরপর সরোজদাকে বললেন শঙ্করজি, ‘সুবীরকে নিয়ে তুমি আগামী কালই চলে যাও। আর সুবীর তুমি ভাল করে হিন্দি-উর্দু শেখো। তুমি অনেকদূর যাবে।’

আমি তো কলকাতা ফিরে ভাবলাম, এসব কথার কথা। কিছুই হবে না! হঠাৎ একদিন সকালে আমার বাড়িতে সরোজদা এসে হাজির। হাতে একটা স্ক্রিন। বললেন, ‘দ্যাখ, তোর ছবি কি লেখা হয়েছে!’ দেখি, স্ক্রিন লিখছে, ‘শঙ্কর-জয়কিষাণ এমন এক গায়ককে ইন্ট্রোডিউস করছে, যে-কণ্ঠ এর আগে বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কোনওদিন শোনেনি’।

এই খবর প্রকাশের কয়েকদিন পর একটি চিঠি এল। চিঠিতে লেখা ‘পরিচালক অমিয় চক্রবর্তীর ‘কাঠপুতলি’ ছবিতে তোমাকে গাইতে হবে’। সেইসময় মুম্বইয়ে অমিয় চক্রবর্তী বিশাল একটা নাম। তাঁর ছবিতে গাইব, ভাবতেই পারি না! বলরাজ সাহনির লিপে গাইলাম, ‘মঞ্জিল ওহি হ্যায় প্যারকে’।”

প্রথম গানেই আসমুদ্রহিমাচল জানল গায়ক সুবীর সেনের নাম। প্রথম গানই হিট। সেইসময় ‘বিনাকা গীতমালা’র রেটিংয়ে ছিল এক নম্বরে। সম্ভবত ওইসময় এমন সম্মান কেউই পাননি। এই নিয়ে খুব গর্ব ছিল সুবীর সেনের। তিনি বলতেন, “একদিন তালাত মামুদ সকালবেলা আমার বাড়িতে এলেন ওঁর ফিয়াট গাড়িতে। এসেই আমার হাত দুটো চেপে ধরে বললেন, ‘আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। তুমি আমার রেকর্ড ভেঙে দিলে। আমার দ্বিতীয় গান হিট ছিল। আমি ছাড়া দুই-তিনেও কেউ ছিলেন না।” আরও অনেককিছু বলেছিলেন সেসব আর বললাম না। অযথা তর্ক হতে পারে। তালাতদা আমাকে নানাভাবে খুব সাহায্য করেছিলেন বিপদআপদে। সেই তালাতদার সঙ্গে সম্পর্কটা ঠিক রইল না”।

গীতা দত্ত ও সুবীর সেন

কেন? “ঘটনাটিতে আমার কোনও দোষ ছিল না। মধুবালা প্রোডাকশনের ‘মহেলো কে খোয়াব’ ছবির গান রেকর্ডিং আগেই হয়ে গেছিল। রফি, তালাতদা, গীতাদি (দত্ত) গেয়েছিলেন। একদিন হঠাৎই আমাকে ডাকলেন মধুবালা। যেতেই আমাকে বললেন, ‘সুবীরদা এই গানটি আপনি গান তো। গানটি ছিল আশা ভোঁসলের সঙ্গে ‘আগর তুম বুরা না মানো’। তালাতদা কোথাও থেকে শুনেছিলেন। একদিন আমার বাড়িতে এলেন। আমাকে বললেন, ‘তুমি যে-গানটি গেয়েছ, সেই গানের রেকর্ডিং আমাকে দিয়ে আগেই করানো হয়েছে।’ আমি তো হতবাক! আমি বললাম, তালাতদা আমাকে সুরকার তো কিছু বলেননি!”

সুবীর সেনের বাবা ছিলেন অসমের চা-বাগানের ডাক্তার। সুবীর সেনের ছোট থেকেই ছিল গানবাজনার প্রতি ঝোঁক। তাই স্কুলে পড়তে পড়তেই জ্ঞানদায়িনী সংগীত মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন গান শেখার জন্য। এই স্কুলটি ছিল লখনউয়ের মরিস কলেজের একমাত্র শাখা। জ্ঞানদায়িনী থেকে যখন সুবীর তৃতীয় বর্ষ পাশ করেন, তখন তিনি ক্লাস টেনের ছাত্র। প্রতি বছর পরীক্ষা নিতে আসতেন বিখ্যাত গায়ক রতনজনকরজি। সুবীর সেনের গান শুনে মুগ্ধ রতনজনকরজি।

১৯৫১, অসম থেকে সুবীর সেন চলে এলেন কলকাতা। গুয়াহাটি ইউনিভার্সিটির ম্যাট্রিকুলেট সুবীরকে তখন পেয়ে বসেছে গানের নেশা। তিনি যোগাযোগ করলেন চিন্ময় লাহিড়ির সঙ্গে। “চিন্ময় লাহিড়িকে গান শোনালাম। আমার গান শুনে উনি অবাক! আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুই কার কাছে গান শিখেছিস? সত্যি করে বল।’ আমি প্রথমে ওঁকে বলেছিলাম, আমি কারওর কাছে গান শিখিনি। সেদিন আমাকে সত্যি কথাটা বলতে হল। তারপর অসমের গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বলতে, উনি চমকে উঠলেন! বললেন, ‘তুই গানের ভগবানের কাছে গান শিখে এসেছিস! তোকে আমি কিছু শেখাতে পারব না।  তুই এখানে আসবি। কোনও টাকাপয়সা দিতে হবে না,’ বললেন সুবীর সেন।

চিন্ময় লাহিড়ির পর আর কারওর কাছে যাননি? “গিয়েছিলাম। অনুপম ঘটকের কাছে। ভীষণ রাশভারী লোক ছিলেন। আমাকে দু’চার কথা বলে বসতে বললেন। আমি একটা জায়গা নিয়ে বসলাম। হঠাৎ চেঁচিয়ে ডাকলেন ওঁর দেখাশোনা যিনি করতেন এবং তবলাও বাজাতেন, তাঁকে। বললেন, ‘দ্যাখ, কোথায় বসেছে!’ আমি ভাবলাম, বুঝি ভুল করে অন্যকারওর জায়গায় বসে পড়েছি। লজ্জা পেয়ে, দু:খ প্রকাশ করে উঠতে তখন উনি বললেন, ‘আরে, তোমাকে উঠতে বলিনি। তুমি ওখানেই বোসো। তুমি জানো, ঠিক ওইখানেই প্রথম দিন এ-বাড়িতে এসে কে বসেছিলেন?’ আমি বললাম, সে আমি কি করে জানব! ‘তাহলে শোনো কে এল সায়গল, তারপর হেমন্ত মুখুজ্জে (মুখোপাধ্যায়), আজ তুমি। তাই তোমার গান না-শুনেই বলছি, তুমি অনেক বড় জায়গায় পৌঁছবে। তুমি আমার কাছে আসবে। কোনও টাকাকড়ি দিতে হবে না।’

অনুপম ঘটক কতবড় মাপের সংগীত পরিচালক ছিলেন তা নৌশাদের এক সাক্ষাৎকারে শুনে বুঝেছিলাম। আর ভেবে অবাক হয়েছিলাম, আমি কার কাছে গান শিখেছিলাম! একটা সময় হিন্দি ছবি হত লাহোরে। তখন বম্বেতে হত না। লাহোরে অনুপম ঘটক ছিলেন সেরা সংগীত পরিচালক। নৌশাদের মতো সংগীত পরিচালক বলছেন, ‘আমি তখন লাহোরে সহকারী সংগীত পরিচালকের কাজ করি। তখন দেখেছি, কাজ করেছি সংগীতের এক ভগবানের সঙ্গে। তাঁর নাম অনুপম ঘটক।’ ভাবো ‘সংগীতের ভগবান’ কথাটি কে বলছেন, নৌশাদ! সেই অনুপমদা আমাকে বলতেন, ‘তুই ফোনেটিক ব্যালেন্স জানিস।’

সেদিন শুনিয়েছিলাম শচীন গুপ্তের গাওয়া ‘সারা রাত জ্বলে সন্ধ্যাপ্রদীপ’। অনুপমদার সুর আর গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। উনি তো খুবই প্রশংসা করলেন। বললেন, ‘তোর কণ্ঠটি চমৎকার। যেদিন খুশি আসবি।’ কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য। ১৯৫৬-তে প্রয়াত হন। উনি আমাকে বারবার একটা কথাই বলতেন, ‘তুই ব্যারিটোন ভয়েসে প্র‍্যাকটিস চালিয়ে যাবি।’ ষাটের দশকে আমার একের পর এক গান হিট। সিনেমার গান গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা বেসিক গান গাওয়া চলল। ফলে, তৈরি হয়েছিল গানের একটা জগৎও।”

ষাটের দশক থেকে কথাটি খুব চালু ছিল, এখনও অনেকেই বলেন, সুবীর সেনের সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্ক খুব একটা ভাল ছিল না। উনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ভীষণ হিংসা করতেন? কথাটা শুনেই একটি লম্বা দিলখোলা হাসি দিলেন সুবীর সেন। বললেন তাঁর সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সখ্য এবং সম্পর্কের কথা। “দেখো, হেমন্তদার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপই থাকত বা হিংসা করতাম তাহলে কি অনুপমদার বাড়ির ঘটনাটা জাহির করে বলতাম! আসলে সেইসময় আমার সঙ্গে হেমন্তদার লড়াই লাগিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতেন। কারা এবং কেন  এসব রটিয়েছিলেন, আমি জানি কিন্তু বলব না। এসব নিয়ে আলোচনা বা প্রসঙ্গ না-তোলাই ভাল। এসব অপ্রাসঙ্গিক। বরং তার চেয়ে হেমন্তদা আমাকে, আমি হেমন্তদাকে কী চোখে বা কোন দৃষ্টিতে দেখতাম, সেসব বলাই ভাল, পাশাপাশি দুজনের মধ্যে শ্রদ্ধা, ভালবাসা কেমন ছিল তা পাওয়া যাবে। হেমন্তাদার স্ত্রী বেলা বউদিওর সঙ্গেও চমৎকার সম্পর্ক ছিল। উনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি তো তোমার গানের ভক্ত। আমাদের বাড়িতে তোমার গানই সারাক্ষণ চলে।’ আরে আমি তো কেরিয়ারের শুরুতে হেমন্তদার গানই  গাইতাম।” বলেই সুবীর সেন হারমোনিয়ামটি টেনে নিয়ে পরপর কয়েকটি গান শোনালেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের।যদিও সুবীর সেনের সেই কণ্ঠটি আর ছিল না তবুও বেশ লাগল। সন্ধ্যাটিও জমে উঠল বেশ!

“আরে বাবা, আমি তো হেমন্তদার গান গেয়ে বড় হয়েছি। হেমন্তদার ছিল ভগবানদত্ত গলা! ‘শাপমোচন’-এর গানগুলো ভাবতে পারো! কে গাইবে অমন গান! আমার তো আজও ভাল লাগে। আমি তো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে গানও গেয়েছি। হিন্দি ছবিতে সুরকার হিসেবে ওঁর শেষ ছবি ছিল ‘হাম ভি ইনসান হ্যায়’। হেমন্তদার স্মৃতিসৌধ তৈরি করার জন্য ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ ক্যাসেট প্রকাশ পায়৷ বহু শিল্পীই গেয়েছিলেন। আমিও দুটি গান গেয়েছিলাম। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে হিংসে করতেন সুবীর সেন, এসব কথা যারা রটায় তারা কোনও একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এসব করে।”

আবার পিছনে ফিরি। সুরকার-গীতিকার সুধীন দাশগুপ্তর আপনার প্রথম গানের রেকর্ড ‘এই উজ্জ্বল দিন’ আর ‘স্বর্ণঝরা সূর্যরঙে’ তো প্রকাশিত হয় ১৯৫৬-য়। এবং বেরোনোর সঙ্গেসঙ্গেই তো হিট করেছিল। তা আপনার কাছে সুযোগ কীভাবে এল? মিনিটখানেকের নীরবতা ঘর জুড়ে। হয়তো তিনি ফিরে গেছিলেন ৫০ বছর আগে। হয়তো স্মৃতির অতলে ফিরেছিলেন। হয়তো নয়, সুবীর সেনের চোখে ভেসে উঠেছিল মেট্রো সিনেমার প্রেক্ষাগৃহে। নীরবতা ভঙ্গ হল। সুবীর সেন পৌঁছে গেলেন পঞ্চাশের দশকে কোনও একদিন। বললেন, “এইসময় এইচএমভি একটা গানের প্রতিযোগিতা করে— কেরেজু। আমি নাম দিয়েছিলাম। ১৪০০ ছেলে-মেয়ে নাম দিয়েছিল। আমি তো ধরেই নিয়েছি, আমার কোনও চান্স নেই। তা দেখলাম একদিন, চূড়ান্ত নির্বাচনে আমার নামটি আছে। সঙ্গে নির্মল প্রামাণিক আর একটি মেয়ে। তার নামটি মনে নেই। মেট্রো সিনেমাহল-এ ফাইনাল৷ আমার তো হারমোনিয়াম, তবলচি কিছুই নেই। ওরা গান গেয়ে ফাটিয়ে দিয়ে গেল! আমি হারমোনিয়াম ধার করলাম। এইচএমভি-র মাইনে করা একজন তবলিয়া ছিলেন প্রেম সুখ। তাঁকে বললাম, আমার সঙ্গে একটু বাজিয়ে দেবেন? তা উনি রাজি হয়ে গেলেন। আমি গাইলাম, ‘সারা রাত জ্বলে সন্ধ্যাপ্রদীপ’৷ গান শেষ হওয়ার পর সারা হল হাততালিতে ফেটে পড়ল। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এইচএমভি-র পি কে সেন আর মেট্রোর ম্যানেজার হাফেজি। ওঁরা তো গান শুনে অবাক! আমার সঙ্গে এইচএমভি তিনবছরের চুক্তি করল। যেটা ইতিহাস ওই কোম্পানিতে! কেননা, তখন এইচএমিভি-তে নিয়ম ছিল যত বড় শিল্পী হন না কেন, তাঁর প্রথম গান হিট করলে, তবেই তাঁর সঙ্গে চুক্তি করা হত। আমার ক্ষেত্রে হল ব্যতিক্রম।”

এরপর আর ফিরে তাকালেন না বাংলা গানের স্বর্ণকণ্ঠের অধিকারী সুবীর সেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র-সহ বাংলা গানের স্বর্ণযুগের গায়কদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজের জায়গা করে নিলেন তিনি। তৈরি করলেন একেবারে নিজস্ব ঘরানা। দারুণ জনপ্রিয় উঠলেন বাংলা গানের শ্রোতাদের মধ্যে। সবাই একবাক্যে স্বীকার করলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পর এমন রোম্যান্টিক কণ্ঠ আর নেই। এমনকী, বহু গানপ্রেমী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের চেয়ে পছন্দ করতেন সুবীর সেনকে।

অসাধারণ সব গান গাইলেন তিনি। যেসব গান আজও অনেকেই গুনগুন করেন— ‘এত সুর আর এত গান’, ‘পাগল হাওয়া’, ‘সারাদিন তোমায় ভেবে’, ‘মোনালিসা, তুমি কে বলো না’, ‘রাত হল নিঝুম’, ‘দূর দিগন্তে ঢেকে আছে মেঘে’, ‘যার আলো নিভে গেছে’, ‘ধরণীর পথে পথে ধুলি হয়ে রয়ে যাব এই কামনা’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এবার তাঁকে টানল ভারতীয় সিনেমার মক্কা মুম্বই৷ “মুম্বইয়ের প্রসঙ্গে আগেই বলেছি, কীভাবে যাওয়া, যোগাযোগ এসব। আমার হিন্দি গান শুনে ভাল লেগেছিল শঙ্কর-জয়কিষাণের। গেয়েছিলাম, সুধীন দাশগুপ্তের সুরে ‘হোঁটে নে জাম লে লে’। বলে রাখি, সুধীনদার হাতে তেমন কাজ না-থাকলে উনি বসে বসে হিন্দি গানের সুর করতেন। যাইহোক, চুক্তি সই করিয়ে অ্যাডভান্সের টাকা হাতে দিয়েই শঙ্কর বললেন, ‘তুমি মুম্বই ছেড়ে কলকাতা চলে যাও।’ আমি তো সরোজদার মুখের দিকে তাকাচ্ছি। উনি বললেন, ‘গুরু দত্তের কথা ভুলে যা।’ একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমরা ফিরে, হোটেলে একটা ভাল ঘর নিলাম। কারণ, টাকা ছিল না বলে হোটেলের রান্নাঘরের পাশে যাইহোক করে থাকতাম। হাতে যখন কড়কড়ে অতগুলো টাকা তখন আর খামোখা কষ্ট করতে যাব কেন!”

এবার কলকাতা ফিরে মুম্বই চলে গেলেন সুবীর। শঙ্কর-জয়কিষাণের সুরে ‘কাঠপুতলি’ (১৯৫৭)-র ‘মঞ্জিল ওহি হ্যায় প্যার কি রাহি’। বলরাজ সাহানির লিপে সুবীর সেনের গাওয়া পুরুষ কণ্ঠে একমাত্র গান। মুকেশ-এর একটি গান ছিল লতার সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে। বাকি সব লতার। সুবীর সেনকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছিলেন সুরকার শঙ্কর-জয়কিষাণ। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে একাদিক্রমে বহুকাল বেজেছিল  গানটি ‘বিনাকা গীতমালা’য়। পরবর্তী সময়ে ‘বিনাকা হিট প্যারেড’-এ এই গানটি জায়গাও পায়। এক গানেই বলিউডের হিন্দি ছবির গানের দুনিয়া মাত করে দিয়েছিলেন সুবীর সেন।

আপনি তো কলকাতাতেও বা বাংলা গানেও বিশাল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তাহলে বাংলা বা কলকাতা ছেড়ে মুম্বই গেলেন কেন? “দ্যাখো, মুম্বই বা বলিউডের ছবিতে গান গাইলে সারা ভারত কেন, বিদেশেও লোক চেনে। শুধুমাত্র বাংলায় গান গাইলে বর্ধমানের পর আর কেউ চিনত না,” সাফ জানিয়েছিলেন সুবীর সেন।

‘ছোটি বহেন’-এ শঙ্কর-জয়কিষাণের সুরে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে ‘ম্যায় রঙ্গিলা প্যার কা রাহি’ও তো সুপারহিট গান ছিল? সুবীর সেনের কণ্ঠে একটা গর্বের রেশ ছিল, “শুধু সুপারহিট নয়, এই গানটি গেয়ে মেহমুদ নায়ক হয়ে গিয়েছিলেন। তার আগে ছোটখাটো দৃশ্যে অভিনয় করতেন তিনি। এই গানটা এতটাই জনপ্রিয় হয়ে গেল যে, মেহমুদের ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছিল হিন্দি সিনেমায়।” আচ্ছা এই ডুয়েট গান থেকেই নাকি লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে একটি ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আপনার। “আমার সঙ্গে ‘কাঠপুতলি’ ছবিতে গান গাওয়া থেকেই পরিচয়। ‘ছোটি বহেন’-এর এই গানটি হিট হওয়ার পর থেকেই লতার সঙ্গে একটা ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়।” সেটা নাকি…। আমাকে থামিয়ে দিয়ে সুবীর সেন বললেন, “এখন ওসব থাক। পরে কোনওদিন ওই প্রসঙ্গে কথা হবে।”

এইরকম আর কোনও ঘটনার কথা বা প্রসঙ্গ মনে পড়ে? “শাম্মি কাপুরের ‘বয়ফ্রেন্ড’ (১৯৬১) ছবিতে ‘দেখো না যাও এ জানে মন’ দারুণ হিট করে। সেইসময় রফির গান ছাড়া অন্য কারওর গানে লিপ দিতেন না শাম্মি কাপুর। আমি একেবারে শাম্মীর মতো করেই গেয়েছিলাম। শঙ্কর-জয়কিষাণ খুব খুশি হয়েছিলেন, শাম্মীও। ওই ছবিতে রফির একাধিক গান ছিল কিন্তু আমার গানটি পছন্দ ছিল ছবির সুরকার, নায়ক ছাড়াও শ্রোতাদেরও। এই ছবির পর থেকেই শাম্মী কাপুরের সঙ্গে প্রচণ্ড বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সেই সম্পর্ক এমন জায়গায় পৌঁছল যে, উনি রেসের মাঠে গেলেই আমাকে নিয়ে যেতেন। আমারও রেস খেলতে ভাল লাগত। যেতাম শাম্মির সঙ্গে। একবার তো আমি পঞ্চাশহাজার টাকা হেরে গেলাম রেসে, সেদিনই শাম্মী কাপুর হেরেছিলেন আশিহাজার টাকা।”

শঙ্কর-জয়কিষাণ ছাড়াও একাধিক সুরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। অভিজ্ঞতা কেমন? “মদনমোহন, লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল, কল্যাণজি-আনন্দজি, বসন্ত দেশাই, হেমন্তকুমার (মুখোপাধ্যায়)-এর মতো প্রথম সারির সুরকারদের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। পাশাপাশি দেব আনন্দ, দিলীপকুমার, রাজেন্দ্রকুমার প্রমুখ নায়কদের লিপে গান গেয়েছি৷ বলরাজ সাহনি, শাম্মি কাপুর আর মেহমুদ-এর কথা আগেই বলেছি, বললেন সুবীর সেন।

আচ্ছা আপনি যে কিছুক্ষণ আগে বললেন পঞ্চাশহাজার টাকা রেসের মাঠে হেরেছিলেন, ষাটের দশকে ওই টাকার পরিমাণ তো অনেকটাই, গায়ে লাগেনি। খুব ঠান্ডা গলায় উত্তর দেন সুবীর সেন, “আমি তো বললাম, রেস খেলতে পছন্দ করতাম। জেনে-বুঝেই তো রেসের মাঠে যেতাম। আর তাছাড়া সেইসময় দু’হাতে রোজগার করেছি। বিদেশে অনুষ্ঠান করতে যেতাম।”

তা বিদেশের অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল? “এককথায় দারুণ। আমি যখন যেতাম চার-পাঁচ মাসের জন্য যেতাম। সত্তর দশকের প্রায় শেষে বিলেতে গিয়ে তো ন’মাস ছিলাম। গানের জন্য আমার বিদেশযাত্রা শুরু ষাট দশকের প্রায় শুরুতেই। আমার আগে গিয়েছিলেন তালাত মামুদ। মহম্মদ রফি শুধু নাইরোবি গিয়ে ফিরে আসেন। আমি চার মাস ছিলাম। কেনিয়া, উগান্ডাও গেছিলাম। সর্বত্র অনুষ্ঠান করেছিলাম। দক্ষিণ আমেরিকা, কানাডা ইত্যাদি দেশেও অনুষ্ঠান করেছি। কুয়েত, মরিশাসও গেছিলাম। মরিশাস থেকে ফেরার পর কলকাতায় রাজভবনে ওই দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়। উপস্থিত সকলের সামনে উনি আমাকে বলেছিলেন, মিস্টার সেন তো আমাদের দেশে গান গেয়ে মাতিয়ে এসেছেন। সব জায়গাতেই বাঙালি শ্রোতা তো পেয়েইছি, দেখেছি যাঁরা বাংলা বোঝেন না, তাঁদেরও গান ভাল লাগেছে, অ্যাপ্রিশিয়েট করছেন। আসলে, গানের তো কোনও ভাষা নেই। গানের ভাষা গানই। এখানে একটা কথা বলে রাখি, আমার আগে কোনও ভারতীয় গায়ক কুয়েতে অনুষ্ঠান করতে যাননি।”

আপনার গানের জগতে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি হল। এবার একটু অভিনয়জীবনে প্রবেশ করতে পারি তো? সুবীর সেন বললেন, “আর বোলো না। উত্তমকুমারের জন্য সিনেমায় অভিনয় করা। তার আগে ১৯৫৮-৫৯-এ হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় একটি চিত্রনাট্য লিখেছিলেন আমাকে ভেবেই। সে কথা আমাকে বলেনও। কিন্তু আমি বলেছিলাম সিনেমায় অভিনয় করা নিয়ে মায়ের আপত্তি আছে। আমাকে দিয়ে মা বলিয়ে নিয়েছিলেন, সিনেমায় অভিনয় করা যাবে না। এর বহু পরে অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে ছবিটি করেন ‘অভিমান’৷ আমাকে সিনেমায় অভিনয় করানোর জন্য সলিল চৌধুরীও খুব বলতেন। উনি বলতেন, ‘কেন অভিনয় করবি না!’ আমি ওই একই কথা বলতাম, মায়ের কাছে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কোনওদিন সিনেমায় অভিনয় করব না। পরে অবশ্য আর বলতেন না।”

কলকাতার বিভিন্ন জলসায় আপনার অংশগ্রহণ নাকি একটা প্রেমিক প্রেমিক ভাবমূর্তি তৈরি করেছিল? বিশেষ করে আপনার সুপুরুষ চেহারা নাকি মহিলারা খুব পছন্দ করতেন। আপনার ওই প্রেমিক ইমেজ উত্তমকুমারকেও নাকি টেনেছিল? এবার সুবীর সেন কিছুটা হলেও লজ্জিত হলেন, “কিছুটা ঠিক৷ মহিলারা পছন্দ করতেন। বহু চিঠিও পেতাম। যাইহোক, আমি কলকাতায় অনুষ্ঠান করতে এলেই উত্তমকুমার তাঁর গাড়ির চালক ন্যাপাকে পাঠাতেন। যেতাম উত্তমকুমারের ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে। উনি বলতেন, ‘তোমার চেহারা, হাসি খুব সুন্দর! তুমি অভিনয় করছ না কেন! তুমি সিনেমায় অভিনয় করো।‘ এটা ‘উত্তমকুমারের শুধুমাত্র কথার কথা ছিল না। উনি আমার কথা পরিচালক সলিল দত্তকেও জানান। একদিন হঠাৎ আমার বাড়ি এসে হাজির সলিলবাবু! উনি কোনও কথা বলার সুযোগই আমাকে দিলেন না। বললেন, আমার পরের ছবি ‘মোমের আলো’-তে আপনি নায়ক এর উত্তমকুমার ডাক্তার।’ আমি বললাম, অভিনয়ের আমি ‘অ’ জানি না। দর্শক ধরে পেটাবে! এরপর তো…।”

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সুবীর সেন বললেন, “উত্তমকুমার আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি একবার সিনেমা করো, দেখবে লাইন পড়ে যাবে।’ ‘উত্তমকুমারের কথা মিলে গেছিল। লাইন পড়ে গেছিল। আমি ছবি করতে আর রাজি হইনি। ভেবেছিলাম, অভিনয়টা আমার জন্য নয়। তাই আর রাজি হইনি। বিভূতি লাহা আমার অভিনয় পছন্দ করেছিলেন। এরপর বসু ভট্টাচার্যর ‘অনুভব’ ছবিতে সঞ্জীবকুমারের গায়ক-বন্ধুর অভিনয় করেছিলাম। সঞ্জীবকুমার কারওর কাছ থেকে কোট-প্যান্টস এনে আমাকে পরিয়েছিলেন। আমি হিন্দি ছবি ‘অনুভব’-এ পুরো একটা রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছিলাম বাংলায়। গানটি ছিল, ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’। সঞ্জীবকুমার ছিল আমার গানের এক বড় ভক্ত। ওই জোর করে আমাকে  ‘অনুভব’ ছবিতে ঢুকিয়েছিলেন।”

আপনি তো রবীন্দ্রসংগীত আগেও গেয়েছিলেন? আলাদা করে শিখেছিলেন? সুবীর সেন বললেন,  “একেবারেই নয়। আমি কোনওদিন কোনও ইনস্টিটিউশন থেকে রবীন্দ্রসংগীত শিখিনি। আমি গান গাইবার যেটুকু ট্রেনিং পেয়েছি তা মূলত আধুনিক গানের। আমরা কেমন একটা ধারণা ছিল রবীন্দ্রসংগীত গাইবার আলাদা স্টাইল আছে! আমি এটা কোনওদিনই মানতে পারিনি। রবীন্দ্রসংগীত আজও আমার কাছে শেষকথা। যখনই সুযোগ এসেছে তখনই রেকর্ড করেছি রবীন্দ্রসংগীতের, গেয়েওছি। এখনও কানে বাজে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাগুলো, ‘সুবীর সবকিছু ছেড়ে রবীন্দ্রসংগীতে একটু মন দাও। তোমার মতো কণ্ঠ রবীন্দ্রসংগীতে দুর্লভ।’ এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ে জর্জদার (দেবব্রত বিশ্বাস) কথা। উনিও আমার গান পছন্দ করতেন, তাঁর ভাল লাগত। অসাধারণ এক মানুষ ছিলেন তিনি। যেমন শিক্ষাদীক্ষা, তেমনই মানসিক দৃঢ়তা! জর্জদার বিশাল এক মোটর সাইকেল ছিল। পিছনে একটা হারমোনিয়াম থাকত। খালি থাকলেই আমাকে তুলে নিতেন। মাঝেমধ্যেই ওঁর ত্রিকোণ পার্কের ছোট্ট ঘরটিতে যেতাম। গান শুনতে চাইতেন, শোনাতাম। উনিও শোনাতেন। জর্জদার একটা প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত ছিল ‘তুমি যে আমারে চাও’। ওই গানটি রেকর্ড করে জর্জদাকে দিয়ে এলাম। এর কিছুদিন পর ওঁর বাড়িতে ঢুকতেই থমকে গেলাম, দেখি গানের প্রথম লাইনটি শুনেই পিন তুলে নিচ্ছেন। আবার শুনছেন! কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে দরজায় দাঁড়াতেই বন্ধ করে দেন। ঘরে ঢুকতেই বললেন, ‘কী ভাল গেয়েছিস! আমি এই গানটি আর গামু না।”

নিজের কথা বলতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না সুবীর সেন। ধরিয়ে দিলে বলতেন। যেমন, গায়কজীবনে প্রচুর প্রেমের গান গেয়েছিলেন। কিন্তু প্রেমের কথা বললেই তিনি লজ্জা পেতেন। এড়িয়ে যেতেন। জিজ্ঞেস করলাম আপনি কিন্তু ভাল সুরকার, গীতিকার পেয়েছিলেন। যেমন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পেয়েছিলেন। বিশেষ করে, সলিল চৌধুরীর মতো একজনকে পেয়েছিলেন আপনারা দুজনই। বাংলা গানের জগতে হেমন্ত-সলিল যেমন মোড় ঘোরানো একটি জুটি, ঠিক তেমনই জুটি সুবীর-সলিল! কীসব গান হয়েছে আপনাদের জুটির! যেমন— ‘ধরণীর পথে পথে’, ‘পাগল হাওয়া’, ‘কোনও ভাল কবিতার’, ‘আমার জীবন তরণী ঢেউয়ে টলমল’…। মুখের কথা কেড়ে সুবীর সেন বললেন, “শুরু থেকেই গানের কথা আমার পছন্দ না হলে কখনওই গাইতাম না। এ-প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি, এইচএমভি-র সঙ্গে আমার চুক্তি হল। প্রথম গান রেকর্ডিং হবে। সুধীন দাশগুপ্তর বাড়ি গেলাম একদিন। উনি আমাকে একটা গান দিলেন, ‘নীল আকাশের ওই কোলে, কান্নাহাসির ঢেউ তোলে’। আমি সটান সুধীনদাকে বললাম, এই গানটিতে কিছু নেই। উনি শুনে অবাক! বললেন, ‘আর একটা গান আছে। কিন্তু তুমি কি গাইতে পারবে!’ বিস্ময় প্রকাশ করে দিলেন, ‘ওই উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্ন রঙিন’। আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। বললাম, এই গানটিই আমি গাইব। সুধীনদা বললেন, ‘ঠিক আছে তাহলে গাও দেখি।’ গাইলাম। শুনে উনি বললেন, ‘না, তুমি পারবে। তোমাকে দিয়ে হবে।’ আমার স্বভাব বলো, জেদ বলো শেষপর্যন্ত বজায় রেখে গেছি। একচুলও সরি আসিনি।”

সলিল চৌধুরীর সঙ্গে আপনার সম্পর্কের রসায়নের পিছনে কী লুকিয়ে! “না না, লুকনোটুকনোর কিছু নেই। সলিলদার সঙ্গে যখন আলাপ তখন আমার কয়েকটি গান হিট হয়ে গেছে। সলিলদার কয়্যারে আমি মাঝেমধ্যে গান গাইতাম। বা গলা মেলাতাম। সলিলদার কাছে যাতায়াতের কোনও এক ফাঁকে আমাদের দুজনের ভেতর সম্পর্কটাও জমাট বেঁধে যায়। মুম্বইয়ে ওঁর বাড়িতে সারারাত কেটে গেছে সলিলদার সঙ্গে গানের আলোচনায়। এই সময়টা আমার সংগীতজীবন অনেকটাই সমৃদ্ধ হয়। কীসব সুর করেছিলেন গানে! অন্য ডাইমেনশন! আমাকে একটা গান দিয়ে বললেন, ‘এই গানটা তুই গাইবি, তোকেই গাইতে হবে। তুই পারবি।’ গানটির প্যাটার্ন ছিল বেশ কঠিন। অসাধারণ সুর! অপূর্ব অ্যারেঞ্জমেন্ট! গানটি ছিল, ‘কোনো ভাল কবিতার দুটো পংক্তি দাও/আমি তাকে ডানা করে পাখি হয়ে শূন্যে উড়ে যাব’। গাইলাম। আমাকে বললেন, ‘বলেছিলাম না, তুই পারবি। খুব ভাল গেয়েছিস।’ একদিন একটি গান সলিলদা আমাকে দিয়ে গাওয়ালেন। তারপর বললেন, ‘ফোক গাইবি?’ বললাম, গাইতে পারি কিন্তু কোনওদিন তো গাইনি। তখন উনি বললেন, ‘এই তো গাইলি। এটাই তো ফোক। তুই কি মনে করিস গলা বিকৃত না-করলে ফোক গাওয়া যায় না। তুই তোর মতো করে গেয়েছিস, গাইবিও তাই।’ গানটি ছিল ‘আমার জীবন তরণী ঢেউয়ে টলমল করে সংশয় সাগরে’। যেমন লেখা তেমনই সুর! আমার পরম পাওয়া!” সলিল চৌধুরীর গান নিয়ে বলতে বলতে উনি হারিয়ে গেছিলেন পুরনো দিনে। সম্বিত ফিরল আমার কথায়।

সুবীর সেনকে বললাম, অনেক কথা তো হল, আবার একটু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। যেখানে আপনি অনেকটাই জায়গা জুড়ে আছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির সঙ্গেই আপনার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল নাকি? সুবীর সেন নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে সামান্য হলেও লজ্জিত হতেন। “হ্যাঁ, সম্পর্ক তৈরি মানে, হেমন্তদার মা আমার গান ভীষণই পছন্দ করতেন। উনি বলেছিলেন, ‘আমার বাড়িতে একজন বড় গায়ক থাকতেও সারাক্ষণ তোমার গানই বাজে।’ আমার এখনও মনে আছে, আমার একটি অনুষ্ঠানে মাসিমা অর্থাৎ হেমন্তদার মা এসেছিলেন। আমি সেদিন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কয়েকটি গান গেয়েওছিলাম।অনুষ্ঠানের শেষে উনি বললেন, ‘তোমার গলায় ছেলের গান শুনে মনজুড়িয়ে গেল! একদিন বাড়িতে এসো।’ আমাকে উনি আশীর্বাদ করেছিলেন। তারপর যেদিন হেমন্তদার বাড়ি গেলাম, সেদিন ভূরিভোজ করিয়ে  ছেড়েছিলেন। এসব আমার গানের জীবনে পাথেয়।”

আপনি মুম্বই ছেড়ে কলকাতা চলে এলেন কেন? সুবীর সেনের মনে হয়তো মুম্বইযাপনের দিনগুলোর স্মৃতি উসকে দিলাম কিংবা উসকে উঠল। কিছুটা সময় নিয়ে বললেন, “মুম্বইয়ে অত সাফল্যের পর হেরে গিয়ে আমি কলকাতা ফিরিনি। কলকাতা আসবার আগেও গান গেয়েছিলাম। সেসব গানও ছিল হিট। হলটা কি, জয়কিষাণ প্রয়াত হওয়ার পর একদিন শঙ্কর আমাকে ডেকে বললেন, ‘সুবীরবাবু আমি আর কোনও কাজ করব না। একসময় তুমি এত ভাল গান, হিট গান গেয়েছ, এখন কার সুরে কী গান গাইবে!’ অন্যদিকে মা অসুস্থ। সবমিলিয়ে কী করব, ভেবে হিমশিম খাচ্ছিলাম। যাইহোক, মুম্বইয়ের ফ্ল্যাট বিক্রি করে চলে আসতে হল কলকাতা।”

হয়তো রাতের খাওয়ার সময় হয়ে এসেছিল সুবীর সেনের। তাই পাততাড়ি গুটিয়ে সুবীর সেনকে শেষ কথাটি বললাম, ঈশ্বর আপনাকে সুস্থ রাখুন, আপনার কণ্ঠ সচল রাখুন, দীর্ঘজীবী হন। কিন্তু শেষদিন পর্যন্ত শ্রোতাদের আপনি কোন গানটি শোনাতে চান বা আপনি নিজে শুনতে চাইবেন? হারমোনিয়ামটি কিঞ্চিৎ নিজের দিকে টেনে নেন সুবীর সেন। ধরলেন, ‘এত সুর আর এত গান যদি কোনওদিন থেমে যায়/সেই দিন তুমিও তো ওগো জানি ভুলে যাবে যে আমায়’। না, কেউ ভোলেননি সুবীর সেনের গান। রাত্রি তখন প্রায় দশটা, সুবীর সেনের পণ্ডিতিয়া প্লেসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছি তখনও ভেসে আসছে নাকি শ্রবণেন্দ্রিয়ে লেগে রয়েছে ‘এত সুর আর এত গান’। হঠাৎই ওপর দিকে দৃষ্টি যেতেই দেখি,  আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটি জ্বলজ্বল করছে ঠিক পণ্ডিতিয়া প্লেসের ওই বাড়ির আকাশজুড়ে!

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *