কমলেন্দু সরকার
ক্যাসুরিনা অ্যাভিনিউ ধরে কখনও কোনওদিন গ্রীষ্মের দুপুরে বা বিকেলে হেঁটেছেন? কখনও একাকী কখনও-বা প্রেমিকার হাত ধরে আবার কখনও-বা শখের পুরুষ বা নারীর সঙ্গী হয়ে? উত্তর আসবে ‘না’, হয়তো ‘হ্যাঁ’। যাঁরা কোনওদিন হাঁটেননি, তাঁদের উদ্দেশে বলি, আপনারা গ্রীষ্মের কলকাতার রূপমাধুরী দেখেননি। আবার অনেকেই বলবেন, “হেঁটেছি তো।” এবার প্রশ্ন, কেমন দেখলেন? প্রশ্নটি শুনে ঘাবড়ে গেলেন! না, আপনি দেখননি শুধুই হেঁটে গেছেন।
এবার ফিরে যাই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি লেখার কাছে৷ লিখেছেন নাদিমা জাহান। তিনি লিখছেন: ইট-কাঠের এই নগরীতে থোকায় থোকায় ফুটেছে অজস্র কৃষ্ণচূড়া ফুল। কংক্রিট-জঙ্গলের ল্যান্ডমার্ক পেরিয়ে দৃষ্টিসীমার একটু ওপরে কৃষ্ণচূড়ার ছলকে ওঠা কমলা-লালের খেয়ালি বিমূর্ত চিত্র থেকে সত্যি চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। রোদের ঝলকে তার এক রূপ তো ঝমঝমিয়ে একপশলা বৃষ্টি শেষে তার আরেক সৌন্দর্য। আবার রাত নামলে সড়কবাতির আলো–আঁধারিতে কৃষ্ণচূড়া তার অদ্ভুত সুন্দর রূপ মেলে ধরে।
আবার ‘অর্থহীন’ ব্যান্ডের ‘এফিটাফ’ গানটি বারবার ফিরে আসছে এইক’টি লাইনের কাছে: তুমি তো দিয়েছিলে মোরে কৃষ্ণচূড়া ফুল/আমি তো বসেছিলাম নিয়ে সেই গানের সুর/তুমি তো দিয়েছিলে মোরে কৃষ্ণচূড়া ফুল/চলে গেছো কোথায় আমায় ফেলে বহু দূর’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বসন্তের গানে বলছেন: গন্ধে উদাস হাওয়ার মতো উড়ে তোমার উত্তরী,/ কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী।/তরুণ হাসির আড়ালে কোন্ আগুন ঢাকা রয়–/এ কী গো বিস্ময়।
কাজি নজরুল ইসলাম তাঁর গানে বলছেন: কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জরি-কর্ণে।/আমি ভুবন ভুলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে।/মোরে চেন কি?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলামের গান থেকে শুরু করে সকলেই মনোমুগ্ধকর কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্যের কথা বলে। বৈশাখের আকাশে আগুনের গোলার মতো সূর্য, দখিনা বাতাসও গরম হয়ে থাকে রোদ্দুরে। প্রকৃতি প্রখর তপন তাপে যখন পোড়ে, কাঠফাটা রৌদ্রের তেজে রাস্তাঘাট নদীনালা খালবিল শুকিয়ে যায় ঠিক তখনই আকাশছোঁয়া গাছে কৃষ্ণচূড়া ফুল বার্তা অনন্ত রূপ-মাধুর্যের! বৈশাখের বা গ্রীষ্মের রুক্ষতা সরিয়ে প্রকৃতিকে সাজিয়ে তোলে কৃষ্ণচূড়া তার আপন মহিমায়। প্রকৃতি সেজে ওঠে কৃষ্ণচূড়ার রূপকথার রূপে! দূর থেকে মনে হয় গ্রীষ্মের আকাশজুড়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে! ঠিক তার পাশে হলুদ রঙের কৃষ্ণচূড়া, যাকে বলি রাধাচূড়া। অসাধারণ বৈপরীত্য প্রকৃতির! লাল আর হলুদ, চোখের আরাম!
এমনই চোখের আরাম দীর্ঘ ছায়া ফেলা পথ ক্যাসুরিনা অ্যাভিনিউ। এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুর ট্রাম রাস্তার পথটিই ক্যাসুরিনা অ্যাভিনিউ। দুপাশে বিশাল বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছ। এই গ্রীষ্মে সমস্ত ফুলে ফুলে ভরা থাকে। কালবৈশাখীর ঝোড়ো হাওয়ায় টুপটাপ ঝরে পড়া ফুল যখন পড়ে রাস্তায়, মনে হয় প্রকৃতি লাল গালিচা পেতে রেখেছে শহরবাসীর জন্য!

এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝেছেন প্রথমেই কেন ভরা গ্রীষ্মে হেঁটেছেন কখনও ক্যাসুরিনা অ্যাভিনিউ! কলকাতার ফুসফুসে এত গাছগাছালি সম্ভবত কোথাও নেই। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কলকাতার অন্যতম সুন্দর রাস্তা এটি। আর যখন তীব্র বেগে ট্রাম ছুটে যায় তখন রাস্তার রূপমাধুর্য বেড়ে যায় শতগুণ!
গ্রীষ্মের রুক্ষ মেজাজে, রৌদ্রের রুদ্রতেজে প্রকৃতির কাছে মানুষের কালবৈশাখীর বন্দনা। ফুটিফাটা মাঠের মাঝে চাতকের মতো দু’চার ফোঁটা বৃষ্টির মাঝে কৃষকের চোখে আনন্দের ঝিলিক, আর নগরজীবনে উন্মুক্ত আকাশের নীচে চলে বৃষ্টিবিলাস। কালবৈশাখীর কালোমেঘের ফাঁকে চলে অঝোর বর্ষণ!
আচ্ছা, বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যের গরমে কাতর বাঙালি কী ভেবে দেখেছেন একবার প্রকৃতি তার কতরকমের পুষ্পবন্দনায় মেতে ওঠে! সবুজের মাঝে লাল, হলুদ, সাদা, গোলাপি, রানি কালারের নান্দনিকতায় মানুষের চোখের আরাম দেয়! গরমের হাঁসফাঁস আর ঘামাচির চিড়বিড়ানিতে বাঙালির আর সেদিকে মন থাকে না, দৃষ্টি পড়ে না। অথচ প্রকৃতি নজরকাড়া, মনজুড়ানো ফুল ফোটান এসময়!
একবার চোখ বুলিয়ে নিই সেইসব গ্রীষ্মের ফুলে। লাল কৃষ্ণচূড়া আর হলুদ রাধাচূড়া বা কনকচূড়া তো স্বমহিমায় বিরাজমান থাকে গ্রীষ্মের প্রখর দহনে। তারই মাঝে অমলতাস যাকে চিনি বাঁদরলাঠি হিসেবে। এত সুন্দর ফুল তার নাম লাঠি, হয়তো সেজন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাম দিয়েছিলেন অমলতাস। নীলমণিলতা কবিগুরুরই দেওয়া। এইসব গাছের ছায়াও দু’দণ্ড শান্তি দেয় নাটোরের বনলতার মতো! আর আছে– জারুল, স্বর্ণচাঁপা, শ্বেতচাঁপা, কুরচি, মেঘশিরীষ, ঝুমকোলতা-সহ আরও কত কী! শুধু কী রং, ফুলের গন্ধও মাতিয়ে দেয় গ্রীষ্মের সন্ধ্যা! ছয় ঋতুর ভিতর গ্রীষ্মের সন্ধ্যাবেলায় সম্ভবত সেরা!
গ্রীষ্মে শুধু কি ফুল, ফলও তাদের রূপসৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয় গাছে গাছে ডালে ডালে। সুঘ্রাণের পরিবেশন চারিদিকে। গ্রীষ্ম মানেই তো আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, আনারসের মিষ্টি উঁকিঝুঁকি গাছগাছালির ফাঁকফোকরে! গ্রীষ্মের আম, কাঁঠাল খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তরমুজ তো তৃষ্ণা মিটিয়ে একটুকরো শীতলতার পরশ ছড়িয়ে দেয় সারা শরীর জুড়ে! কাঁচামিঠে, হিমসাগর-সহ আমের স্বাদ গ্রীষ্ম ছাড়া আর কোন ঋতুতে মেলে! কিংবা বারুইপুর বা মুজফফরের লাল লিচুর স্বাদ। শুধু গ্রীষ্মতেই পাওয়া যায়। এছাড়াও আছে গ্রীষ্মের আরও ফল। একসময় ছিল বাঙালিবাড়িতে গ্রীষ্মের ফল নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আসা-যাওয়া। এটা ছিল সেকালের বাংলার সেকালের। আজও হয়তো আছে। গ্রামবাংলায় দেখা যায় এখনও। বিশাল এক কাঁঠাল কাঁধে নিয়ে চলেছে কুটুমবাড়ি। ব্যাগভর্তি আম, জাম, লিচু ইত্যাদি।
কলকাতা শহরে হয়তো এ-দৃশ্য অমিল। কিন্তু গ্রীষ্মের ফুলের রঙে মেতে ওঠে শহর। এসপ্ল্যানেড থেকে ক্যাসুরিনা অ্যাভিনিউ দিয়ে হেঁটে রবীন্দ্রসদন বা চিড়িয়াখানা হয়ে খিদিরপুরের দিকে পায়ে-পায়ে রওনা দিলেই বুঝবেন কলকাতা আছে কলকাতাতেই!
শেয়ার করুন :