সাবর্ণী দাস
পয়লা বৈশাখে ফ্যাশন নিয়ে লেখা অথচ শাড়ি নিয়ে লেখা হবে না, তেমনটা হতেই পারেনা। বাঙালির বাছাই করা কয়েকটা দিন আছে যে দিনগুলোতে শাড়ি না পরলে ঠাকুর পাপ দেন। বাঙালির বছর শুরুর দিনটিতেই এই হাতেগোনা কয়েকটি দিনের শাড়ি পরার বিসমিল্লা। তবে এই লেখা শাড়ি বিষয়ক হলেও বোধকরি একটু অন্যরকম হবে।
পোশাক পরার বা স্টাইলিং করার দু’ ধরনের পন্থা আছে – ট্র্যাডিশনাল আর ট্রেন্ডি । ঐতিহ্যবাহী এবং চলতি। এটা অবিশ্যি একটা মোটা দাগের সীমারেখার কথা বলা হল। এগুলিরও নানা ভাগ বা প্রকোষ্ঠ আছে। শাড়ির উদাহরণ দিয়েই ব্যাখ্যা করা যাক। ঐতিহ্যবাহী শাড়ির ধরন নিয়ে বোধহয় বেশি বোঝাতে হবেনা। তাঁতের শাড়ি তা সে সুতি বা সিল্ক, ছাপা অথবা একরঙা হতে পারে সঙ্গে মানানসই বা বিপরীত রঙের ব্লাউজ। হাতা কনুই পর্যন্ত বা থ্রি কোয়ার্টার বা ফুল স্লিভ বা স্লিভলেসও হতে পারে। হ্যাঁ, স্লিভলেসও ঐতিহ্যের মধ্যে পড়বে কারণ বাঙালির অন্দরমহলে তার প্রবেশ বহুদিনের। কিন্তু শাড়ির সঙ্গে নুডুল স্ট্র্যাপ ব্লাউজ বা টপ যাই বলা যাক না কেন, সেটা ট্রেন্ড। তবে ইদানিং এই ট্রেন্ড-এ কিন্তু ট্র্যাডিশন এবং রেট্রো, এই দুয়েরই জোরদার প্রবেশাধিকার ঘটেছে। যেমন শাড়ি যাই পরুন না কেন, সঙ্গে ফ্রিলদেওয়া ব্লাউজ চমৎকার চলছে। বা ব্লাউজের পিঠে যামিনী রায় আর সঙ্গে বেগমপুরি ডুরে! ঐতিহ্যই তো। কিন্তু এখন আকচার পরছেন সবাই। ফলে ট্রেন্ড। তাহলেই বুঝুন, রেট্রো ট্রেন্ড বা ট্র্যাডিশনাল ফ্যাশন আসলেই সোনার পাথরবাটি নয়।
আমার জীবনে শাড়ির যাবতীয় ধ্যানধারণার মূল ছিলেন আমার মা। তিনি এতটাই স্বতন্ত্র ছিলেন যে আমাকে যখন স্কুল থেকে আনতে যেতেন তাঁর ঋজু, লম্বা চেহারাটার দিকে তাকিয়ে অনেক সময়ে ভাবতাম মা এমন কেন? হয়তো খানিকটা সংকোচ বা লজ্জা পেতাম তিনি ব্যতিক্রমী বলে। পরে বুঝেছি তিনি আর পাঁচজনের থেকে আলাদা বলে আমার মনে এই বোধটা তৈরি হয়েছিল। তা এই জ্ঞান এবং রুচিবোধ নিয়ে খানিকটা বড় হবার পর পড়লাম এমন দুই ব্যক্তিত্বের কবলে যেখানে সেই জ্ঞান আর রুচি প্রতিনিয়ত শানিত হতে লাগল।

অপর্ণা সেন আর ঋতুপর্ণ ঘোষ। এঁরা যে আলাদা করে পোশাক বা পরিধান নিয়ে বিস্তর জ্ঞান দিয়েছেন তেমনটা নয়, কিন্তু আচার ঠিক করে তৈরি করতে গেলে যেমন প্রতিনিয়ত তাকে রোদে জারিত করতে হয়, আমার জানাটাও তেমন প্রাত্যহিকী ছিল। তা সে ওঁদের সঙ্গে কাজ করতে করতে শেখা হোক কিংবা ওঁদের পরা পোশাক দেখে। তবে এটাও ঠিক যে আলাদা করে এঁরা দুজনে আলোচনাও করেছেন প্রচুর। অপর্ণা সেন পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে বা তার ব্যতিরেকে এবং ঋতুপর্ণ কারণে অকারণে।
অপর্ণা সেন যখন পত্রিকার ফ্যাশন বিভাগের ভার দিলেন তখন নতুন করে অনেককিছু শেখা শুরু হল – বই পড়ে, পত্রিকার ছবি দেখে, মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে, ফ্যাশন ডিজাইনাদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং সর্বোপরি চোখনাক খোলা রেখে। শিশুকাল থেকে এমন একটা আবহে বড় হয়েছি একটা বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল যে রুচি মানে টাঙ্গাইল বা কাঞ্জিভরম শাড়ি, মাথায় ফুল, ঐতিহ্যমন্ডিত গয়না …। অপর্ণা সেন শেখালেন না পোশাকি রুচি কখনও একমুখী নয়। সিন্থেটিক শাড়িতেও রুচির প্রকাশ ঘটতে পারে, সেটা আমার রুচিবোধের বলয়ের মধ্যে ধরা না পড়লেও সেটাকে হেয় করা যাবে না। নান্দনিক ভাষা আসলে বহুমুখী – তা পোশাকের ক্ষেত্রে হোক বা বাড়ি বানানোতে। যেমন উল্কি বা ট্যাটু সারা পৃথিবীতেই এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষরা করতেন। বাকিরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। কিন্তু এই প্রজন্মে এটা তো সাজেরই অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে। এটি প্রায় এক শিল্পে পরিণত হয়েছে। একটা আর্ট ফর্ম। সেক্ষেত্রে আমার হয়তো পছন্দ নয় কিন্তু একটা গোটা প্রজন্মের ফ্যাশন এটি। এই ভাবনার বিপুল প্রভাব তো চেখে বন্ধ রেখে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। ঋতুপর্ণ সাজতে ভালবাসতেন। সাজাতেও। তবে তাঁর রুচিতে সর্বদাই ছিল ঐতিহ্যের স্পর্শ। বেনারসের বুনোট যেমনি তাঁর প্রিয় ছিল, ভালবাসতেন ইন্দোনেশিয়ান লুঙ্গি পরতেও। তসরের প্রতি ছিল অদম্য টান। ঋতুর সঙ্গে আমার এই জায়গায় পছন্দের খুব মিলমিশ ছিল। এই রুচির প্রভাব ছিল তার সিনেমার চরিত্রগুলির পোশাকেও। নৌকাডুবিতে যে স্টাইলিং স্বাভাবিক ও অভিপ্রেত ছিল, বাকি গুলোতেও যখন ঋতু স্টাইলিং করেছেন তখনও সেটা ঐতিহ্যমন্ডিত বটে। তবে তার একটা সমকালীন রূপ দিয়েছিলেন। তা সে সব চরিত্র ‘কাল্পনিক’-এ হোক অথবা ‘আবহমান’-এ।
সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় বাংলা ছবিতে বাংলার তাঁতের প্রভাব নিয়ে অপর্ণা সেনকে বলতে বলা হয়েছিল। এই আলোচনার মূল গবেষণার দায় আমার উপর ছিল। অপর্ণা মূল বক্তব্য রাখলেও সেখান আমি তাঁর ছবিতে বাংলার তাঁতের ব্যবহারের কথা বলেছিলাম। প্রথম ছবি থার্টি সিক্স চৌরঙ্গি লেন-এ তিনি নায়িকাকে বাংলার শাড়িই কেবল পরিয়েছিলেন। বেশিরভাগই সুতি টাঙাইল বা ধনেখালি, বিশেষ অনুষ্ঠানে বাংলার সিল্ক আর তসর। ‘ইতি মৃণালিনী’ যখন বানালেন তখনও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অথচ ব্যতিক্রমী হতে পারত, কারণ মৃণালিনী ছিলেন চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় তারকা। কিন্তু অপর্ণা তাঁকে সাজিয়েছিলেন তাঁর নিজের মতো করে। যেন মৃণালিণী ব্যক্তি অপর্ণারই প্রতিবিম্ব। পরবর্তীকালে ‘ঘরে বাইরে আজ’-এর নায়িকা মধ্যেও একই প্রতিফলন দেখি।
অপর্ণা সেন আসলে কেবলমাত্র এক সিনেমাকর্মী নন। তিনি বাংলার অন্যতম একজন আইকন। মেধাতে, রুচিতে। যার বাহ্যিক রূপ আমর তাঁর পোশাকে দেখি। আজও তাঁকে নকল করতে চায়না এমন বাঙালি মেয়ে কমই আছে। যেখানে প্রজন্মের ভেদাভেদ নেই এমনটা আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি।
পরিশেষে একটা কথা আমি সবসময়েই বলতে পছন্দ করি, পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে একটু সচেতন হওয়া দরকার। এটা কোনও জ্ঞান নয়, সজাগ করে দেওয়া। ছিপছিপে মডেলরা অনেক রকম করে শাড়ি ও নানা কায়দার ব্লাউজ পরেন। দেখতে চমৎকার লাগে। তাঁকে দেখে আমি যদি সেই পোশাকটি পরার কথা ভাবি তাহলে একটু তিষ্ঠে সিদ্ধান্ত নেবো। মনে মনে ভাববো যে আমার চেহারা কি তাঁর মতো? তাঁর ব্লাউজের কাটিংটা আমার জন্য শোভন হবে তো? এইটুকুই। তারপর তো বুদ্ধি, বিবেচনা রইলই। মাভৈঃ বলে এগিয়ে চলা।
এই পয়লা বৈশাখে তাহলে ঢাকাইয়ের সঙ্গে কী পরছেন?
বেলুন স্লিভ ব্লাউজ না স্ট্র্যাপি ক্রপ টপ !!
——-
শেয়ার করুন :