সুমন্ত্র মিত্র
– তুমি কি আমার গলা চিনতে পারছ?
-না মানে …
-শোনো আমি সেই …… কাকিমা বলছি ,আমি তো প্রায় একাই থাকি…এর মধ্যে একদিন বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলাম,তোমাদের খুব দেখতে ইচ্ছে করে …একদিন কি আমার কাছে সময় করে আসতে পারবে তুমি তোমার ফ্যামিলিকে নিয়ে ?
(কাল্পনিক নয়,সত্যিকারের ফোনে কথোপকথন )।
আমাদের এই ব্যস্ত জীবনের দৈনন্দিনতা থেকে একটু (নাকি বেশ দূরে ?) প্রান্তিক ,বিচ্ছিন্ন মহিলাদের নিয়েই কিছু কথা।রোজকার কাজকর্মের চাপের ফাঁসে ,একান্নবর্তী পরিবারের ঘেরাটোপ প্রায় মুছে গিয়ে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি,তাদের জীবন যাপনে এই প্রান্তিক ,একা বয়স্ক মহিলাদের খোঁজ নেওয়া,তাঁরা কেমন আছেন জানার সময় কোথায় ?
অথচ এনারা আছেন,আধুনিক, ব্যস্ত শহরে,শহরতলিতে,কাছে -দূরে।শুধু মেগা সিরিয়ালের টেলিভিশনের টিআরপি কমে গেলে যেমন সেই সিরিয়াল সরিয়ে দেওয়া হয় তেমন ব্রাত্য।কিন্তু এনারা একসময় আমাদের সবার জীবনে তাঁদের স্নেহ,মায়া, মমতা দিয়ে আমাদের আগলে রেখেছেন, বনস্পতির মতন ছায়া দিয়েছেন সেইসব ছোটকাকিমা,জেঠিমা,মাসিমা পিসিমাদের কজনকে আজ আমরা মনে রাখি ?সপ্তাহে নয় মাসে একবারও অন্তত ফোন করে খবর নিই যে তাঁরা কেমন আছেন?কিছু ক্ষেত্রে বেশ মর্মান্তিক শোনালেও তাঁদের কজনের ফোন ধরে কথা বলি সময় করে ?
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এজওয়েল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতে ৬০ বছরের বেশি বয়সী সমস্ত বয়স্ক মহিলাদের অর্ধেকেরও বেশি ভারতে লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে প্রান্তিকতা এবং বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি, সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে,’সামাজিক এবং ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক কাঠামোর কারণে, বয়স্ক মহিলারা বিভিন্ন বিধিনিষেধের সাথে জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। তারা প্রায়ই নিজেদেরকে প্রান্তিক এবং বিচ্ছিন্ন মনে করে। প্রায় সব বয়স্ক মহিলা একই সমস্যার সম্মুখীন হয়: স্বাস্থ্য, আর্থিক, মানসিক, অপব্যবহার, বৈষম্য এবং অপরাধ’।
মনে রাখতে হবে এই প্রবণতা বা ব্যাধি আজকের নয় ,বহু প্রাচীন।১৮শ শতাব্দী এবং তার সাজে থেকেও বাল্যবিধবাদের মাথার চুল ছেঁটে সুদুর কাশী পাঠিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল,যাঁরা থাকতেন তাঁরাও সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্রাত্য এবং কঠোর নিরামিষ খাবার আর কঠোরতম নিয়মের বেড়াজালে সারাজীবন অমানুষিক কষ্টে দিন কাটাতেন।
ইংল্যান্ডের ৬৩ বছরের প্রখ্যাত সাহিত্যিক রুথ হেগান সম্প্রতি সমাদৃত ‘দ্য ফিনিক্স বলরুম ‘ বইয়ে এই প্রান্তিক ,বিচ্ছিন্ন ,বিষন্ন মহিলাদের ওপর আলো ফেলেছেন।উনি স্পষ্ট এবং দৃঢ় ভাষায় বলেছেন এই মহিলারা আজকের দিনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং বই হলে এঁদের নিজেদেরকে বা অন্যদের দ্বারা সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া অপরাধসম।’ রুথ হেগান বলেছেন’ আমাদের সমাজে একটা অদ্ভুত বিশ্রী না বলা নিয়ম হল যে একটি বয়সের পর মহিলারা সমাজের মূল স্রোত থেকে বেরিয়ে যাবেন অথবা তাঁদের এই সমাজ বিচ্ছিন্ন করে দেবে।’তাঁর উপন্যাস নিজের বেড়ে ওঠা ,বড় হওয়া ইংল্যান্ডের শহরতলি বেডফোর্ড অঞ্চলে নিয়ে লেখা এবং ওনার আশা বই পড়ার পর অনেকে বেডফোর্ড দেখতে আসবেন।এবং উনি মনে করেন যেহেতু উনি নিজেই ৫০ বছরের পর লিখতে শুরু করেন তাই উনি পারলে বাকি সবাই বয়েস হলেও এককোণে,বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে না থেকে নিজেকে প্রাসঙ্গিক ,প্রাণচঞ্চল এবং প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর জীবন কাটাতে পারবেন।
এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে আজকের এই একা ,বিচ্ছিন্ন মহিলারা একসময় বাবা,মা ,স্বামী পুত্র কন্যাদের নিয়ে জমজমাট পারিবারিক জীবন কাটিয়েছেন কিন্তু এখন একা থাকেন নানা কারণে, হয় তাঁদের পরিবার কাছে নেই দূরে, হয়ত স্বজন বিয়োগ এমন নানা কারণে তাঁরা একা।
এই নিবন্ধে ব্যবহার করা সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’ ছবিতে অপুর মা সর্বজয়ার কথা মনে আছে ?একাকী মা তার ছেলের বাড়ির ফেরার প্রত্যাশায় কিভাবে দিন গুনেছেন?এইটুকু আশা যে এবারে ,এই সপ্তাহে ,এই মাসে তার ছেলে ফিরলে তাকে দেখতে পাবে ,তার সান্নিধ্য পাবে।আজকের এই ব্যস্ত পৃথিবীতে এমন কত সর্বজয়ারা তাদের ছেলে মেয়ে,আত্মীয় স্বজন,বন্ধু বান্ধবের সঙ্গ প্রত্যাশা করে দিন কাটাচ্ছেন আমাদের খেয়াল আছে ?
তাই আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে নিজ নিজ পরিসরে এই একাকী বিচ্ছিন্ন মহিলাদের সমাজের মূল স্রোতে ফেরাবার প্রয়াসে এবং রুথ হেগানের কথা মতন সেই মহিলাদেরও সমাজের নানা কাজে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে,হতাশায় একাকীত্বের দুঃখ ভুলে ,তবেই এই প্রয়াস সেই মহিলাদের এবং পুরো সমাজের পক্ষে সার্থক হবে,আমরা আর একটু বেঁধে বেঁধে থাকতে পারি।
সেই কাকিমার সঙ্গে দেখা করায় ওনার চোখে মুখে ভালো লাগার দ্যুতি, আবার আসার প্রতিশ্রুতি বড় মনোরম ছিল।এইটুকু আশাকরি আমরা সবাই পারি।
তথ্যসূত্র : দ্য হিন্দু,অ্যালেক্স পোপ- বিবিসি উওমেন
শেয়ার করুন :