সায়ন্তন ঠাকুর
শ্রাবণ মাসের অপরাহ্ন বড়ো অলস, ক্লান্ত অভিমানিনীর মতন বেদনা মলিন দৃষ্টি মেলে জগত উঠানের পানে চেয়ে থাকে। তেমনই মেঘ-বিকেল ঘনিয়ে এসেছে আজ, সকালে ঘন্টাখানেক একটানা বৃষ্টির পর দুপুরে রোদ্দুর উঠেছিল খুব, কিন্তু এখন সেই রৌদ্রের গরিমা আর নাই, কেমন যেন ম্রিয়মান চারধার, কে যেন করুণ সুরের কোনও রাগ আপন খেয়ালে বাজিয়ে চলেছে। উঠানে দাঁড়িয়ে কালীভূষণ মুখোপাধ্যায় আকাশের পানে চেয়ে সহসা উতলা হয়ে উঠলেন, শ্রাবণের মাসের জল-বাতাসকে বিশ্বাস নাই, কখন যে মুষলধারে বৃষ্টি নামাবে কেউ বলতে পারে না। এদিকে বৈকাল প্রায় পাঁচটা বাজতে চলল, ছটার পর আবার অশ্লেষা তিথি, তার আগেই বরের আসা চাই কিন্তু কারোরই তো দেখা নাই। পইপই করে বলে দিয়েছিলেন ভাবি বেয়ান, মানে পাত্র বিভূতির মা মৃণালিনী দেবীকে, অথচ এখনও তো বিভূতি এল না! তবে কি পথঘাটে কোনও বিপদ হল? কেমন হলদে পারা আলো উঠেছে আজ, এ যেন গায়ে হলুদের আভা…উঠান পার হয়ে সদর দরজা ঘেরা মণ্ডপের বাইরে এসে চিন্তিত স্বরে ভাগ্নে গণেশকে হাঁক দিলেন কালীভূষণ, ‘গণশা, ইদিকে একবার শোন্ বাবা!’
বিয়ে কাজের বাড়িতে কাউকে ডেকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল, এদিকে আয়োজন তো কম নয়, প্রাণপ্রিয় ছোট মেয়ে গৌরীর বিয়েতে যথাসাধ্য এলাহি ব্যবস্থা করেছেন কালীভূষণ—গয়নাগাঁটি, আদর আপ্যায়ণ, খাওয়া দাওয়া, দান সামগ্রী কোথাও একবিন্দু ত্রুটি রাখেননি। জামাই তো আর এলেবেলে গাঁ-গঞ্জের মানুষ নয়, গরীব হতে পারে কিন্তু বিদ্যা? সে জিনিস তো আর বাজার থেকে কিনতে মেলে না। অনেক কষ্টে ছেলের মা’কে এই বিয়েতে রাজি করিয়েছেন, বংশের ধারাটি তো উচ্চ, মানতে কি চায় সহজে, কী কারণ, না ছেলে এখনই সংসার করবে না, পড়বে, এম-এ বি-এ পাশ দেবে, তারপর মাথার উপর বোন রয়েছে…তা পড়ুক না, এত ভালো পরীক্ষার ফল, সেই ছেলে পড়বে না তো কে পড়বে! মোক্তারির কায়দায় ওই এক ছুতোয় মা’কে রাজি করিয়েছিলেন কালীভূষণ, বলেছিলেন, ‘বেয়ান, বিভূতির মতন এমন সোনার টুকরো চেলে কি সহজে মেলে! পড়বে বৈকি বাবাজীবন, বি-এ, এম-এ, আইন সব পড়বে। তার পড়া নিয়ে চিন্তা করবেন নাকো, পড়ার খরচ-খরচা সব আমার। শুধু আমার গৌরীকে ঘরে নিন, দেকবেন, দুটিকে ভারি মানাবে!’
পড়ার কথায় শেষে রাজি হয়েছিলেন মৃণালিনী। সেই ভারি সাধ্য-সাধনার বিয়ে আজ, একত্রিশে শ্রাবণ, একেবারে শেষ দিন তায় আবার কৃষ্ণাচতুর্দশী, বিয়ের তারিখ নিয়ে প্রথমে একটু খুঁতখুঁত করেছিলেন কালীভূষণ, কিন্তু এরপর ভাদ্র-আশ্বিনে বিয়ের আস্য নাই, সেই কার্তিক, শুভকাজে দেরী কি ভালো, তাই নিমরাজি হলেন কিন্তু এদিকে আকাশ ভেঙে আবার বৃষ্টি না আসে, তাহলেই সব আয়োজন পণ্ড হবে। গৌরী বড়ো অভিমানী, বিয়ে নিয়ে ভারি সাধ মনে, সেই মেয়ের মুখ চেয়েই এত কিছু ব্যবস্থা…এদিকে কাউকে যদি ডেকে পাওয়া যায়, এত সব লোক কোথায় রয়েছে কে জানে! বিরক্তির স্বরে গলা তুলে আরেকবার ডাকলেন কালীভূষণ, ‘গণশা, এই গণশা!’
বাড়ির পেছনে রান্নার কাজে তদারকি করছিল গণেশ, এখনই ছানার ডালনা না চাপালে রাতে বরযাত্রীদের পাতে দেওয়া যাবে না। আয়োজন তো কম নয়, জাঁক করে যজ্ঞিবাড়ির আয়োজন করেছে মামা! লুচি, ছানার ডালনা, কুমড়োর ছক্কা, পাকা রুইয়ের কালিয়া, দই-কাতলা, পটলের দোলমা, ঘন মুগ ডাল, ছ্যাঁচড়া—উনানে আঁচ তুলে সবে মাছ বড়ো লোহার কড়াইয়ের তেলে ছাড়ল শিবু ঠাকুর, যে সে কারিগর নয়, এদিগরে তার রান্নার খ্যাতি মুখে মুখে ফেরে। সেই আড়ংঘাটা থেকে শিবু ঠাকুরকে ডাকিয়ে এনেছেন কালীভূষণ। শুধু কি মাছ, তরকারি, এরপর রয়েছে রকমারি সব মিষ্টি—সরভাজা, পান্তুয়া, সন্দেশ, বরফি, তাও ভিয়েন ভোর রাতে হয়ে যাওয়ায় মিষ্টির হ্যাপা আজ আর নাই। তাছাড়া পাত্র আম খেতে ভালোবাসে বলে বরযাত্রীদের জন্য মামা এই শ্রাবণে ভাগলপুর থেকে গাছপাকা ল্যাঙড়া আমের ব্যবস্থা করেছে! এ কি যার তার বিয়ে, পানিতর গাঁয়ের বড়োলোক মোক্তার কালীভূষণ মুখুটির মেয়ের বিয়ে বলে কতা! হঠাৎ মামার হাঁক শুনে সদরের দিকে দৌড়াল গণেশ, এমনি অল্পবয়সী করিতকর্মা ছেলে হলে হবে কী, গত সাতদিন তার নাওয়া-খাওয়ার সময় নাই। এত ধকল কি আর শরীরে সয়! কেন আবার ডাক পড়ল এখন, কে জানে।
সাদা ধুতি আর ধপধপে গেঞ্জি গায়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন কালীভূষণ, গলায় এক ভরির হার আর হাতের তিন আঙুলে চারখানি সোনার আঙটি দেখেই বোঝা যায় মানুষটির অর্থের অভাব নাই। মুখখানি আজ একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছে, নান্দীমুখ নিজেই করবেন বলে সারাদিন উপবাসে রয়েছেন, তার উপর মেয়ের বিয়ের দুশ্চিন্তা কোন্ বাপেরই বা না থাকে!
মামার কাছে এসে গণেশ শুধোল, ‘আমাকে ডাকচিলেন মামা?’
বিরক্ত সুরে কালীভূষণ বললেন, ‘কোতায় থাকিস তোরা সব? হেঁকে ডেকে সাড়া পাওয়া যায় না!’
‘এই যে মামা, শিবু ঠাকুরের কাচে রান্নার দেখভাল করচিলাম। তা কিচু হইচে? ডাকচিলেন যে!’
‘শিবু ঠাকুরের দেখভাল তোমায় করতে হবে না! তার জন্যি মন্টু, গোপাল সব রইচে তো। এদিকে পাঁচটা বাজল, ছ’টার আগে বরের আসার কতা, সেদিকে হুঁশ আচে তোমাদের? বরযাত্রী নিয়ে বিভূতি কদ্দূর পৌঁচাল, খোঁজ খবর নিইচিস কিচু? মুরাতিপুর থেকে পথ তো নেহাত কম নয়, তায় আবার শাওন মাসের দিন!’
মামার কথা শুনে সামান্য হাসল গণশা, ‘সে কতা আপনাকে আর বলতি হবিনিকো! আমি সেই কখন সতে,বিশের সাথে গোয়ালপাড়ার জনা দশেক ছেলেকে ইস্টিশানে পাটাই দিইচি। বর নিয়ে এই এল বলে, আপনি চিন্তে করবেন নি! বিষ্টিও একন আর হবে বলে মনে হচ্চে না!’
‘হ্যাঁ, চিন্তে করবেন নি! তুমি তো বলেই খালাস! আর বিষ্টির কতা কে বলতে পারে? ভাব দেকে মনে হচ্চে তুই যেন ইন্দ্রদেবের আপিসের বড়োবাবু, সব জেনে বসে রইচে!’
মামার গলার স্বর শুনে গণশা বুঝল, আজ মেজাজ সপ্তমে চড়ে রয়েছে! ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আচ্চা আমি একুনই আগায় গিয়া দেকচি। আপনি বাড়ির ভেতর যান, সারাদিন উপোস আচেন, শেষে শরীলের ভালোমন্দ কিচু একটা হয়ে গেলি বিপদ হবে।’
অধৈর্য কণ্ঠে বেজে উঠলেন কালীভূষণ, ‘হ্যা, যাও সেকেনে, গিয়ে দেকো গে। আমার শরীরের কতা তোকে ভাবতে হবে না!’
কালীভূষণের আশঙ্কা অবিশ্যি সত্য হল না! প্রথম প্রহরের লগ্নে বিয়েকাজ সুষ্ঠভাবেই শুরু হয়েছে। সত্যিই ভারি মানিয়েছে দুজনকে—কতই বা বয়স, বিভূতির এখনও তেইশ বছরও পোরেনি আর গৌরী সবে চৌদ্দ বছরে পা দিয়েছে! লাল বেনারসী, গয়নায় সাজনো গৌরী যেন আজ অলীক কোনও জাদুকরীর মন্ত্রবলে বালিকা থেকে মুহূর্তে পূর্ণ যুবতি হয়ে উঠেছে, পানপাতা মুখে ভ্রমরকৃষ্ণ চঞ্চলা আঁখি দুটিই অলঙ্কার, তার পাশে বাকি গয়নাগাটি, সাজ সব ম্লান হয়ে গেছে। গৌরীর পাতলা ঠোঁট দুটি অস্ফুট কুসুমের মতন কাঁপছে আর পাশে গরদের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরা বিভূতির মুখখানি শ্রাবণের দমচাপা গরম আর বিয়ের যজ্ঞের আগুনে রাঙা হয়ে উঠেছে, কপালে চন্দনের রেখা বিস্রস্ত, তবুও নবীন হাসির মতন রূপ যেন চারধার আলো করে রেখেছে। বিশ্বেস পাড়ার ন’বউ সেদিকে তাকিয়ে পাশে পাল গিন্নির গায়ে ঠেলা দিয়ে বলল, ‘রূপ যেন ফেটে পড়চে গা! জীবনে নতুন বর-কনে তো কম দেকি নাই কিন্তু এমনপারা জোড় কোতাও দেকিনি! মোক্তার মশাই খুঁজে খুঁজে বের করচেন বটে, ধন্যি চোক যাহোক!’
পাল গিন্নি সায় দিল কথায়, ‘যা বলেচ! এ যে সাক্ষাত হরগৌরী গা! শিবপুজোর জোর আচে বিটির!’
ঘটের উপর নিজের প্রসারিত চওড়া করতলের পরে গৌরীর সলাজ হাতখানি দেখে বিভূতির সহসা কী জানি কেন চাঁপাফুলের কথা মনে ভেসে এল। এ বাড়ির উঠানে চাঁপা গাছ আজ সত্যিই ফুল থইথই, মাঝে মাঝে বাদুলে বাতাসে উথালিপাতালি সুবাস ভেসে আসছে। পরক্ষণেই বিভূতির মন অন্য কথায় ভরে উঠল—ভাগ্যের কী ফের দেখো! বাবার মুখে শুনেছিল এই পানিতরেই তাদের আদি ভদ্রাসন ছিল। ঠাকুরদা কবিরাজ তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়তি আর অভাবের ফেরে একসময় এখানকার বাস তুলে স্ত্রী,সন্তান নিয়ে চালকি-বারাকপুর চলে গেছিলেন, পিতৃপুরুষের ভিটা ছেড়ে সে ছিল বড়ো কষ্টের যাত্রা, সহায় সম্বলহীন দরিদ্র মানুষের ভরসাই বা কী ছিল সেদিন, কিচ্ছু না…সেসব কবেকার কথা, তারপর আজ আবার ভাগ্যদেবী মুচকি হেসে কেমন তার জীবনতরীটি পিতামহের ছেড়ে যাওয়া গ্রামে এনে বাঁধলেন, নিজেদেরই চালচুলো নাই, উপার্জন নাই, কলেজের পড়াও বাকি, ওদিকে বিধবা মা, ভাইবোন সবাই মামাবাড়ির আশ্রিত…তারই মাঝে এই সুহাসিনী বালিকা আজ থেকে জীবনের আধেক অংশ হয়ে উঠল! একবার মনে হল, বড়ো ঘরের মেয়ে কি পারবে অভাবের সংসারে মানিয়ে নিতে? কে জানে কী আছে কপালের লিখন!
কোথা থেকে একমুঠি দমকা বাতাস ভেসে আসায় আগুনের লকলকে শিখার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বিভূতির কেমন যেন ঘোর লেগে গেল। ছেলেবেলা থেকে এ জিনিস তার প্রায়ই হয়, বিশেষ করে যখন বৈকাল ঘন হয়ে আসে, ফাল্গুন কি চৈত্র মাসে ঘেঁটু ফুলের ঝোপে পড়ে রয় অস্তাপরাহ্নের আলো, নিঝুম বাবলা বন আলো করে ফোটে হলদে ফুল, বুনো ঝোপের আশ্চর্য সুবাসে ভরে ওঠে জগত, তখন এই ধুলাখেলার জীবন ছাড়িয়ে বিভূতির মন কোন্ দূরদেশে যেন ভেসে চলে…ছবির মতন কত দৃশ্য আসে, আবার কোথায় হারিয়েও যায় তারা…আজও বিয়ের অনুষ্ঠানের মাঝে তেমনই ঘোরের মধ্যে সে দেখল, একখানি কালো পাড় নীল শাড়ি পরে গৌরী একা একা ঘাটে বাঁধা নৌকোয় উঠে বসছে, সঙ্গে কেউ নাই…নৌকোটি আপনমনেই গৌরীকে নিয়ে কোন্ অচিন গাঙ বেয়ে দুলে দুলে চলেছে…চলেছে তরীখানি…নিঃসঙ্গ চৈতি বাতাসের মতন কালসায়রে ভেসে চলেছে।
২
বিয়েকাজ মিটতেই বিপদে পড়ল বিভূতি! সদ্য যুবক ছেলেটির বাসর ঘর সম্পর্কে কোনও ধারণাই নাই, থাকলে এমন দমবন্ধ পরিস্থিতির মাঝে সে কিছুতেই আসত না! চেনা মুখ বলতে শুধু ভাই নুটু, কিন্তু সে একেবারেই ছেলেমানুষ, এতজন মেয়েমানুষের ভিড়ে লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে একপাশে বসে রয়েছে। এদিকে কলকাতা থেকে রিপন কলেজের সহপাঠী-বন্ধুদের আসার কথা ছিল—কৃষ্ণধন, ননী,জ্যোর্তিময়,বৃন্দাবন, বিকেলে নাগাদ সব দলবেঁধে আসবে বলেছিল, কিন্তু কোথায় কী! এখন রাত প্রায় ন’টা, অথচ কারোর দেখা নাই। তারা থাকলে তাও মনে বল পেত একটু, আর এদিকে একদল অল্পবয়সী কিশোরী আর যুবতি তাকে প্রায় ঘিরে ধরেছে। কিন্নরদলের হাট বসেছে যেন, হাসি আর কলকল কথার শব্দে কান পাতা দায়! কে যে কী বলছে, তাও স্পষ্ট বুঝতে পারছে না। ঘরের মেঝের উপর ফরাস পাতা হয়েছে, সাদা ফুটফুটে চাদর, হ্যাজাকের আলোয় চারদিক উজ্জ্বল, শিশিরের মতন সন্ধ্যা রাতের চাঁপাফুলে ভরে আছে সমস্ত বিছানা, একপাশে নরম তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে গৌরীও বসে রয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে তো এখনও ভালো করে আলাপ অবধি হয়নি। সেও কি এদেরই দলে? নাহলে ঘোমটার আড়ালে মুখ টিপে হাসছে কেন? কী আতান্তরেই না পড়া গেল!
অনেকক্ষণ বিভূতিকে চুপ থাকতে দেখে একখানি চাঁপা ফুলের মালা তার গলায় আচমকা পরিয়ে দিয়ে খিলখিল শব্দে বেজে উঠল একজন কিশোরী, ‘ও জামাইবাবু, শুদু গৌরীদি’কেই মনে ধরল আপনার? আমরা বুজি সব বানের জলে ভেসে এসচি!’
পাশ থেকে কে যেন হাসতে হাসতে বলে উঠল, ‘ও গৌরী, শ্যামা যে তোর বরের গলায় মালা দিয়ে দিল রে! কী হবে? এবার সতীনকাঁটা নিয়ে ঘর করো বাপু তুমি!’
হাসির বন্যার মাঝে পানের ডিবে থেকে একখিলি পান তুলে পাশের বাড়ির ফুলি বৌদি বিভূতির মুখের কাছে এনে রঙ্গসুরে বলল, ‘ও নতুন জামাই, পান খাবে না? ঠোঁট রাঙা নাহলে যে বউ তোমার রাগ করবে গো!’
বিভূতি মনে মনে প্রমাদ গুণে বুঝল, মুখ বুজে থাকলে এদের থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে না! এমনিও ছেলেবেলা থেকেই মেয়ে মহলে তার তেমন আড় নাই, পাড়ার মেয়ে-বৌদিদের সঙ্গে সহজ সুরে কথা বলতেই অভ্যস্ত। এখানেও স্বাভাবিক গলায় শুধোল, ‘পানের বদলে যদি একটা গল্প শোনাই তোমাদের, শুনবে?’
নতুন বরের এমনধারা স্পষ্ট কথায় শ্যামা নিজের চিবুকে তর্জনী ছুঁইয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে কৌতুকের সুরে বলে উঠল, ‘মাগো! এ যে দেখি ডাকাত! পেটে পেটে এত? মুখখানি দেখে তো মনে হয় ভাজা মাচটি উল্টে খেতে শেকেনিকো!’
গৌরীর দিদি আশালতা পাশ থেকে ফুট কাটল, ‘তা হবে না কেন লো! বর যে আমাদের কলকেতার কালেজে পড়ে, পেটে বিদ্যা কী কম! তারপর আবার শুনেচি গানের গলাও নাকি ভারি সোন্দর!’
গানের কথা শুনে শ্যামা বিভূতির হাতখানি ধরে বলল, ‘তাইলে আজ একখান গান আমাদের শোনাতেই হবে! নইলে ছাড়চি নে!’
চট করে বিভূতির মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল, নুটুর দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘গান ভালো জানে আমার ভাই, নুটু! বাবার কাচে ওই গান শিখেচিল কিনা!’
সমস্বরে প্রতিবাদ করে উঠল মেয়ের দল, ‘না,না, বাসরে নিতবরের গান চলবে না! আমাদের নতুন বরের গলায় গান চাই!’
‘গান আমি সত্যিই জানি নে!’
‘খুব জানেন, এখনই শোনাতে হবে! নইলে আজ আমরা ছাড়চিনিকো! নতুন বউয়ের কাচেও যেতে দেব না! গান চাই আমাদের!’
হইচইয়ের মাঝে কে যেন বাইরে থেকে এসে খবর দিল, ‘কলকেতা থেকে বরের সব বন্ধুরা এসচে!’, কথা শেষ হওয়ার আগেই হুড়মুড় করে বাসরে এসে ঢোকে বিভূতির বন্ধুর দল। ননী,জ্যোর্তিময়,বৃন্দাবন, কৃষ্ণধন—হাজির সবাই, তাদের দেখে বিভূতির মনে হল, যাক্, এবার তারা দলে ভারী দেখে মেয়েমহল একটু চুপ হবে! হেসে ননীকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী রে তোদের এত দেরী? আমি তো ভাবলাম পথ হারিয়েচিস বুঝি!’
সাদা বাংলা শার্ট আর ধুতি পরা ননী কিছু বলার আগেই কৃষ্ণধন বলে উঠল, ‘আর বলিসনে ভাই! ট্রেন তিনঘন্টা লেট, নাহলে কখন সেই বিকেল বিকেল এসে পৌঁছুতুম!’
ফরাসের উপর নিজের পাশে জায়গা দেখিয়ে বিভূতি বলল, ‘আয়! আয় সব! এখানে এসে বস!’
‘বসব পরে ভাই! আগে খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত কর দিখি। পেটে ছুঁচো ডাকছে, সেই দুপুরে মেসের খাবার খেয়ে বেরিয়েছি, নাড়িভুড়ি শুদ্ধ সব হজম হয়ে গেছে!’
কৃষ্ণধনের কথায় আবার ঘরে হাসির ফোয়ারা উঠল, ফুলি বউদি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনার ভাই আসুন আমার সাথে, এখনই খাওয়ার ব্যবস্তা করচি!’
শ্যামা আড়চোখে বিভূতির পানে চেয়ে দুষ্টুমির সুরে বলল, ‘সঙ্গীসাথী দেকে ভেবেচেন পার পেয়ে যাবেন! ওটি চলবে না, গান আমাদের চাই!’
বিভূতি শ্যামার কথায় কাতর দৃষ্টিতে ননীর পানে চাইলে সে হাসতে হাসতে বলে উঠল, ‘তুই গান ধর বিভূতি। আমরা জঠরাগ্নিকে শান্ত করে আসি গে!’
‘আমাকে এই অবস্থায় ফেলে তোরা সব পালাচ্চিস? ছিঃ ছিঃ, বন্ধুর প্রতি একটা দায় নাই রে তোদের?’
‘তোমার শালীদের তুমিই সামলাও ভাই! বিয়ে করলে এসব সইতে হয় বৈকি।’, অম্লানবদনে হাসতে হাসতে কথাকটি বলেই বৃন্দাবন ফুলি বৌদিরে পানে চেয়ে বলল, ‘চলুন দিদি। কোথায় খাওয়ার আয়োজন হয়েছে আমাদের সেখেনে নিয়ে চলুন।’
আবার একা হয়ে পড়ল বিভূতি, তবে এবার উল্টে নিজেই মজা শুরু করল। মনে মনে নিজেকেই বলল, দাঁড়াও তোমাদের গান শোনাচ্চি, ভারি ফাজিল হয়েচ সব, এমন গান শোনাব যে পালাবার পথ পাবে না!
হাত তুলে ঘরের সবাইকে থামিয়ে শ্যামার দিকে চেয়ে বলল, ‘বেশ, গান গাইচি, কিন্তু সবটা শুনতে হবে। রাজি তো?’
‘রাজি রাজি!’, সমস্বরে কলকল করে জবাব দিল মেয়ের দল।
ঘরের জানলা দিয়ে শ্রাবণের মেঘলা বাতাস ভেসে আসছে, দূরে কোথাও বৃষ্টি নেমেছে বোধহয়, আর সেই বাতাসে বাসর সাজানো চাঁপাফুলের দল যেন আরও উন্মনা হয়ে উঠেছে। অকাতরে সুবাস বিলিয়েই চলেছে তারা, কুসুমপানে চেয়ে বিভূতির মনে হল এমন রাতে গুরুদেবের লেখা গান ছাড়া আর কিছুই মানাবে না। ঘোমটার আড়ালে গৌরী আড়চোখে বিভূতির পানেই চেয়ে রয়েছে। তার মনেও বর্ষা মেঘের দোলা, হ্যাজাকের আলোয় কী সুন্দর দেখাচ্ছে ওঁকে! এমন রূপবান স্বামী আবার গানও জানেন, কিশোরী হৃদয় কোন্ অজানা ছন্দে যেন সহসা বেজে উঠল। বিভূতির মনে কবির একটি শ্রাবণের গান ভেসে এল, গানের গলা তার মন্দ নয়, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে গৌরীর পানে চেয়ে উদাত্ত কণ্ঠে গাইল, ‘আজি শ্রাবণঘন গহন মোহে গোপন তব চরণ ফেলে, নিশার মত নীরব ওহে, সবার দিঠি এড়ায়ে এলে।’
গৌরীর প্রথম পঙতিটি শুনে মনে হল, উনি যেন তারই কথা বলছেন! সব কথার অর্থ ভালো বুঝতে পারছে না কিন্তু তবুও কী সুন্দর, গোপন চরণ ফেলেই তো তার মনদুয়ারে তিনি এসেছিলেন। সেই যে গেলবার চৈত্র মাসে পুকুরঘাটে প্রথম চোখে চোখ লেগেছিল, লজ্জায় এক মুহূর্তের বেশি চেয়ে থাকতে পারেনিকো সে নিজে, চঞ্চলা পায়ে দৌড়ে ঘরে এসে খিল দিয়েছিল…আর সেই মানুষটি আজ তার সামনে বসে রয়েছেন, কপালে চন্দনের নকশা আর গলায় গোড়ের মালায় যেন ঠিক রাজপুত্তুর…তার নিজের লোক, মিতে, কবেকার মিতে…তার স্বামী…হঠাৎ শ্যামার কথায় স্বপ্নস্বপ্নভঙ্গ হল গৌরীর!
‘এসব প্যানপেনে গান চলবেনিকো বাসরে! আমাদের অন্য গান চাই!’, শ্যামার টরটরে গলা শুনে মনে মনে ভারি অখুশি হল গৌরী। চুপ কর মুখপুড়ি! তুই এই গানের বুজিস কী বাপু!
বিভূতি অবশ্য জানত কবির উঁচু ভাবের গান এই বালিকাদের ভালো লাগবে না, নিরীহ মানুষের মতন মুখ করে হাসি চেপে বলল, ‘আচ্চা আচ্চা! গোল করোনি! আমি অন্য গান গাইচি!’
পরের গানটি অবশ্য বাসর ঘরের ভিড় ভাঙার পক্ষে যথেষ্ট ছিল! বাগেশ্রী রাগে বিভূতি মন্দ্র স্বরে শুরু করল, ‘নাহি সূর্য নাহি জ্যোতিঃ নাহি শশাঙ্ক সুন্দর, ভাসে ব্যোমে ছায়া-সম ছবি বিশ্ব চরাচর।’
দু-তিন পঙতি গাওয়ার পর সত্যিই রণে ভঙ্গ দিল মেয়ের দল। গানের মাঝেই শ্যামা উঠে দাঁড়িয়ে বাকি সব মেয়েদের দিকে চেয়ে কপট রাগের সুরে বলল, ‘ওলো! চল সব! এত বিদ্বান বর নিয়ে গৌরীদিদিই থাকুক, আমরা হলাম গে মুক্যুসুক্যু মেয়েমানুষ, এসব ভাবের কতা বুজবোনিকো!’
তারপরেই গৌরীর দিকে তাকিয়ে কিশোরী-হাসিতে বেজে উঠল, ‘দেকো দিদি, এত চাঁপা দিয়ে বাসর সাজালাম, তা সেসব যেন ভাবের চাপে আবার মিচে না হয়ে যায়!’
দূর দেশে কোথায় যেন অস্ফুটে কদম ফুটিল, ছিন্ন মেঘের দল সহস্র বৎসর পূর্বে বিরহী যক্ষের বেদনাভার ফেলিয়া ভাসিয়া যাইল আপনখেয়ালে, আকুল শ্রাবণ চঞ্চলা শ্রীমতীর রতি-অভিসারের মতন নামিয়া আসিল এই জগতের একখানি ক্ষুদ্র গ্রাম পানিতরে…সে এখন নিশ্চুপ দাঁড়াইয়া রহিয়াছে ভদ্রাসনের নিঝুম দিঘির পৈঠায়, তাহার হাতে সলাজ চাঁপাফুলের দুইখানি মালা, সহচরী বাতাস বহিয়া যাইতেছে মন্দাক্রান্তা ছন্দে…এমন মধুরাতে বিভূতি-গৌরীর বাসর ঘরের দরজায় দাঁড়াইয়া আমরা কী করিব, ওই যে কপাট বন্ধ হইল, আলো নিভিয়া যাইল…মহারাত্রি নিজ হাতে লিখিতে শুরু করিলেন এক অপরূপ প্রেমাখ্যান!
৩
এবছর ভাদ্র মাস যেন রুদ্ররূপ ধারণ করেছে, শুকনো আকাশে গনগনে রোদ্দুরের আঁচে প্রাণ ওষ্ঠাগত। বেলা গড়ালেই পথঘাট দেখে মনে হয় কোন্ এক রাক্ষসী তার রুক্ষ তেলহীন কেশরাজি জগতে বিছিয়ে দিয়েছে। গাছপালায় শ্রী নাই, বাতাসে মধু নাই, পথের পাশে কুকুরগুলি হা-ক্লান্ত শুয়ে থাকে, ফিরিওয়ালার হাঁকডাকও তেমন বড়ো একটা শোনা যায় না, গেরস্ত বাড়ির দরজা-জানলা নিপাট বন্ধ, উঠানের কুয়োতলা শুখা পড়ে রয়েছে, মাঝে মাঝে দু-একজন ভিস্তিওয়ালার দেখা মেলে বটে, তবে তাদেরও ভিস্তির জল গতবারের তুলনায় এখন বেশ আক্রা। আটের এক স্বর্ণময়ী রোডে বিভূতির মেসবাড়ির উঠানে কুয়োর জলস্তর এই ভাদ্রে অনেকটা নেমে গেছে, বালতি নামিয়ে জল ওঠানোর সময় মনে হয় অনন্তকাল বুঝি বয়ে চলেছে। আজ দুপুরে তাড়াতাড়ি কলেজ থেকে মেসে ফেরার সময় বিভূতির মনে হচ্ছিল রোদ্দুরের তাপে যেন গায়ে ফোসকা উঠে যাবে, একটু স্নানের জন্য প্রাণ আটুপাঁটু করছিল। তাই ফিরেই দোতলার ঘরে জামা-ধুতি খুলে রেখে গামছা পরে কুয়োতলায় চলে এসেছে, বালতির জলে স্নান করে অবশ্য তার কোনও কালেই তৃপ্তি হয় না! সে গাঁয়ের ছেলে, এমন দাবদাহে নদী কি দিঘির জলে ঝাঁপাইয়ের অভ্যাস, এইটুকু তোলা জলে স্নান করে কি আর মন ভরে! কিন্তু যস্মিন দেশে যদাচার, প্রতিদিন বাগবাজার গঙ্গার ঘাটে নাওয়া তো সম্ভব হয় না, তাই মেসবাড়ির এজমালি কুয়োতলা নিয়েই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। দু-বালতি জল গায়ে ঢেলেছে কি ঢালেনি ওমনি উঠানের বামহাতে টানা বারান্দার এককোণে আপিসঘর থেকে বেরিয়ে এসে মেস-ম্যানেজার অবনী বাবু বিভূতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বিভূতি, তোমার নামে একটা চিঠি এয়েচে। স্নান করে যাওয়ার সময় নিয়ে যেও’খন।’
চিঠির কথায় একটু অবাকই হল সে, তাকে আবার কে এখন চিঠি দিল! হাত দিয়ে মুখের জল মুছে শুধোল, ‘আমার নামে চিঠি?’
‘হ্যাঁ, তোমার নামে এয়েচে। তুমি খেয়েদেয়ে কলেজ বেরুলে আর সকালের ডাকে পিওন এসে দিয়ে গেল। তা চিঠির খামখানা বাপু বেশ বাহারি!’
বাহারি খামে চিঠি? তবে কি সে পাঠাল? নাহ! আজ আর স্নানে মন বসবে না। দ্রুত দু-বালতি জল মাথায় ঢেলে কোনওক্রমে গা-মাথা মুছে আপিসঘর থেকে চিঠি নিয়ে দোতলায় নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল বিভূতি। খামটি সত্যিই বেশ বাহারি, পাখির ছবি আঁকা সারা গায়ে, উপরে মেয়েলি ছাঁদের অক্ষরে তার নাম আর ঠিকানা লেখা। হাতে নিয়েই মুখে অস্ফুট হাসি ভেসে উঠল, এ নিশ্চয় সে পাঠিয়েছে, চালকি-বারাকপুর থেকেই এসেছে পত্র!
চিঠি আসে মাসে একখানি, বিভূতিও উত্তর দেয়, জানতে চায় বাড়ির কথা। এখন তো মুরাতিপুরের মামার বাড়ি নয়, গতবছর ছোট বোন মণির বিয়ের পর মা, ভাই নুটু আর গৌরী চালকি-বারাকপুরের ভদ্রাসনেই থিতু হয়েছে। অভাব মেটেনি কিন্তু বাপ-পিতেমোর ভিটে ছেড়ে পরবাসের থেকে সুখ অনেক বেশি। নিচু ক্লাসের কয়েকটি ছেলে পড়াতে শুরু করেছে বিভূতি, এদিককার খরচা সামলে পুরোটাই প্রায় বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়, এখানকার খরচ নিয়ে অবিশ্যি খুব চিন্তা নাই, শ্বশুরমশাই কালীভূষণবাবু তাঁর কথা রেখেছেন, পড়ার খরচ যা পাঠান সেখান থেকেই বিভূতির মেসভাড়া হয়ে যায়। সময় কি আর থেমে থাকে, দেখতে দেখতে বিয়ের একবছর হয়ে গেল, গতবছর ষোলোই অগাস্ট ছিল বিয়ের দিন, আর আজ অগাস্ট পার হয়ে সেপ্টেম্বর এসে গেল! এদিকে বি-এর নতুন ক্লাসে ভারি মন বসেছে বিভূতির, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের কাছে যাতায়াত ইদানিং বেড়েছে তার, জ্ঞানতাপস বৃদ্ধের সৌম্য মুখখানির দিকে তাকালেই মনে হয়, জগতে লেখাপড়ার থেকে আনন্দের আর কিছুই নাই। কত নতুন বই, নতুন জগত, সংস্কৃত সাহিত্যের ক্লাসে বসে
মনে হয় কী সব আশ্চর্য আখ্যান এই ভারতবর্ষেই একসময় লেখা হয়েছে। ওদিকে পশ্চিম দেশের সাহিত্যের দরজাও এখন সামনে খোলা, ভিক্টর হুগোর লা মিজারেবল বইখানা গেল হপ্তায় লাইব্রেরি থেকে নিয়ে এসেছে, কয়েক পাতা পড়ে আর অবাক হয়ে ভাবে মানুষের কান্না-হাসির গল্প তবে এমন ভাবেও লেখা যায়!
একদিন রাতে হ্যারিকেন জ্বেলে বইখানায় কোসেতের কথা পড়ছে, চারপাশ বেশ নিঝুম, হঠাৎ পড়তে পড়তে বিভূতির চোখের সামনে তাদের পুরনো বাড়ির কথা ভেসে উঠল। আহা রে, কতটুকুই বা বয়স কোসেতের, সাত বছরের বালিকা মাত্র, কী অত্যাচারই না সহ্য করে, থেনারদিয়ে দম্পতির মার মুখ বুজে সহ্য করে, এতটুকু অভিযোগ অবধি নাই, ঠিক যেন তার নিজের কথা! মার সে খায়নি কখনও কিন্তু লাঞ্ছনা কি কম সহ্য করতে হয়েছে। বাবা কোন্ দূরদেশে গিয়েচে, কবে ফিরবে তার ঠিক নাই, এদিকে মায়ের হাতে সম্বল বলতে সামান্য কয়টি টাকা, তিন ভাইবোন মিলে সে কী এক দিন মাতার উপর দিয়ে গেচে। ইস্কুলে ভর্তির জন্য বায়না করায় মা লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে সিঁদুর লাগা টাকা বের করে দিয়েচে, একা একা সেই সামান্য পয়সা ধুতির খুঁটে বেঁধে অতদূরের বনগাঁ হাই-ইস্কুলে যাওয়া…হেডমাস্টারমশাই চারুবাবু না থাকলে ভর্তি হওয়া তার হত না…পড়ে থাকে লা-মিজারেবল একপাশে, নিজের ফেলে আসা দিনের কথায় ভেসে যায় বিভূতি। নিজেকেই বলে, আচ্ছা, আজ চোদ্দই সেপ্টেম্বর উনিশশো আঠারো, দশ বছর আগে আজকের দিনে কী করচিলাম? দশ বছর পরই বা কোতায় থাকব?
জীবনে কিছুই স্থির করে হয় না, এ এক আশ্চর্য যাত্রাপথ, পথের দেবতা শুধু মুচকি হেসে সেই অপার রহস্যময় বিচিত্র জীবনপথের দিকে তাকিয়ে থাকেন!
পরমুহূর্তেই গৌরীর মুখখানি মন-আকাশে ভেসে ওঠে! তিনমাস দেখা হয়নি তার সঙ্গে, আচ্ছা, এখন, এই এত রাত্রে কী করচে সে? সন্ধে হলেই তো মায়ের কোলের কাছে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যায়! আহা রে, কতই বা বয়স, সংসারের বোজেই বা কী! শেষবার বাড়ি গিয়ে দেখেচি, নুটুর সঙ্গে তার বেজায় ভাব। আবার তেমনই ঝগড়া! সব পুতুল সাজিয়ে বেচারি খেলতে বসেচিল,হঠাৎ নুটু এসে দিলে সব তছনছ করে, ওমনি মায়ের কাচে তার নালিশ! মা বড়ো ভালোবাসে গৌরীকে, বুকে আগলে নিয়ে রেকেচে! মায়ের মতন কে হয়? কত অভাব, লাঞ্ছনা, অনাহার, তবুও মুখের হাসিটি এখনও নেভেনি। কী পেলে সারাজীবন? কিচ্চু না! অনেক বড়ো হতে হবে, চাকরি পেতে হবে, মাকে শেষ বয়সে সুখে না রাকলে কীসের এত পড়াশোনা, কীসের এত পরিশ্রম!
এইসব আলগা ভাবন-লাটিমের সুতো খেলার মাঝেই আবার চকিতে গৌরীর মুখখানি বিভূতির মনে পড়ে! দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকায়, ওই যে সামনের মাসে তারিখের উপর লাল গোল দাগ, ওইদিন থেকে কলেজে ছুটি! পুজোর ছুটি! বাড়ি যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এল, হাতে কড় গুণে হিসাব করে, আর কুড়ি দিন! আচ্চা, গৌরীর জন্য কিচু নিয়ে গেলে হয় না? কী নেবে? শাড়ি? কিন্তু মা, তার জন্য নেব না কিচু? অত পয়সা কে দেবে একন? টিউশনির টাকা দিয়ে বড়ো জোর একখান সস্তার শাড়ি হতে পারে। আচ্চা, শাড়ির দাম কত বাজারে? কখনও তো কিনি নাই!
অর্থ চিন্তার মাঝেই বিভূতির দুচোখের পাতায় ঘুমদেবী আসন পিঁড়ি পেতে বসেন! হ্যারিকেনের নিভু আলোয় যুবক মুখখানি স্বপ্নারুণ হয়ে উঠেছে, গোলাপি মেঘ ভাসছে বন্ধ চোখের অন্তঃপুরের আকাশে, বৈকালের আলো ঘন হয়ে এসেছে সেখানে, সে এক আশ্চর্য আলো, কারোর ছায়া পড়ে না সেই অলীক অপরাহ্নে, নিশ্চিন্দিপুর বলে এক অজ পাড়াগাঁয়ে জীর্ণপ্রায় কোঠাবাড়ির দরিদ্র দাওয়ায় খেলা করছে একজন বালক, আদুর গা, পরনে একখান মলিন ধুতি, হাতে টিনের তরবারি, সামনে কালকাসুন্দে ঝোপের মাথায় অস্ত আলো আর ছায়া পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রয়েছে…কোথায় ওই দেশ? কে থাকে সেখানে? ওই বালকই বা কে? তার বাপ-মা নাই? খেলার সঙ্গী নাই?
দেখতে দেখতে ভাদ্র পেরিয়ে আশ্বিনের আকাশ রূপবান হয়ে উঠল। মেঘগুলিকে কে এক রহস্যময়ী ধুয়েমুছে তকতকে করে তুলেছে, বাতাসে মিশিয়ে দিয়েছে মিহিন কুয়াশার আতর, শিউলি গাছের ডালে ফুটিয়েছে কমলা টিপ পরা সাদা ফুল, রাত্রিকে দিয়েছে মধু আয়ুধ, আর সবকিছু ছাপিয়ে সেই চিররহস্যবতী জগত-উঠানে বাজিয়ে চলেছে কোন্ আদ্যিকালের সুর—আয়, আয়,ঘরে ফিরবি না তোরা?
ফিরছে বিভূতি, ওই যে রেলগাড়ি চড়ে বসল, হাতের পুঁটলির মধ্যে একখান কালোপেড়ে সস্তা শাড়ি, কতগুলি কদমা, একঠোঙা রসের গজা রয়েছে। খুব ভিড়ের মাঝে এককোণে বসে রয়েছে। ঝমঝম ছুটছে রেলগাড়ি, পার হয়ে চলেছে দিগন্তবিথারি খেত, পুকুর, ধানি জমি, সুনীল আকাশ, কলাঝোপ, কাশের চর, বাবলা বন আর হৃদি-টলোমলো শরৎকাল! পার হয়ে যাচ্ছে সকরুণ আখ্যান, কত প্রেম-পিরিত, গেরস্থালি, কত ডিঙি নৌকো পার হয়ে এক চিরকালের যুবক ফিরছে তার চিরকালের মায়ের কাছে, সংসারের কাছে! তার যাত্রাপথ আগলে বসে আছেন উমা, বসে আছে গৌরীও!
ছবি-অনুপ রায়
লেখক পরিচিতি – সায়ন্তন ঠাকুর মূলত গদ্য লেখেন, পূর্ব প্রকাশিত উপন্যাস ‘নয়নপথগামী’আবির্ভাবেই প্রশংসিত।’বাসাংসি জীর্ণানি’ প্রথম গল্পগ্রন্থ।’নিমফুলের মধু’,’গল্প, অত্যন্ত জনপ্রিয়। ‘শাকম্ভরী’,এক যে ছিল রাজা’ হাড়ের বাঁশি খ্যাতি অর্জন করেছে।কুয়াশাচ্ছন্ন ভাষায় প্রকৃতি বর্ণনায় অলীক জগতের আঁশ জড়িয়ে থাকে বাক্যে।
শেয়ার করুন :