দীপঙ্কর দাশগুপ্ত
নিরামিষ পদটির নামই হল, ‘মজার মিলন’। করলা আর কাঁচা আমের অভিনব মিলন মজার হবে না তো কী! খেয়েছেন কখনও? দেখুন না একবার পরখ করে। চাক চাক করে করলা কেটে রাখুন। কাঁচা আম খোসা ছাড়িয়ে টুকরো করুন। এবারে সর্ষের তেল গরম করে তেজপাতা মেথি ফোড়ন দিয়ে পেঁয়াজ কুচি সাঁতলে করলা, আম, কাঁচালঙ্কা চেরা আর স্বাদমতো লবণ দিয়ে ঢেকে দিন মাঝারি আঁচে। মাঝে একটু নেড়েচেড়ে দিন। জল মরলে নামিয়ে গরম ভাতে খান। ভাবছেন, এ কী! নববর্ষ উপলক্ষে কোথায় পোলাও-মাংস-কোপ্তা-কালিয়ার গপ্পো হবে, তার বদলে তেতো!
তাহলে শুনুন, নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একদিন খেতে বসে তাঁর প্রিয় বিদূষক গোপাল ভাঁড়কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘গোপাল, প্রথমে কী খাওয়া যায় বল তো।’ সপ্রতিভ গোপালের তাৎক্ষণিক উত্তর ছিল, ‘মহারাজ, আগে ‘পোড়া’ খান। ‘পোড়া’ মুখে সব ভালো লাগবে।’ তেমনই আমরা বলব, তেতো দিয়ে শুরু করুন, তেতো মুখে সব ভালো লাগবে। তার ওপরে তেতোর এই ব্যতিক্রমী পদটি তো আমার নিজের কোন উদ্ভট কল্পনা-প্রসূত নয়, বিস্মৃত এই রন্ধন-প্রণালীর স্রষ্টা খোদ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। আজ থেকে ১২২ বছর আগে যখন বাংলায় কোন রান্নার বই ছিল না, তখন রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি প্রজ্ঞাসুন্দরী শুধু নিজের হাতে রান্না করে প্রিয়জনদের খাওয়ান নি, যত্ন করে প্রতিটি রন্ধন-প্রণালী লিখে রেখে গেছেন সকলের জানার জন্যে। ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’ বইটির ভূমিকায় তিনি লিখছেন, ‘যেটি আমরা খাই ও আমাদের ভালো লাগে, অল্পব্যয়ে যে সুস্বাদু সামগ্রী প্রস্তুত করি সেটি সকলে কেন জানিবে না?’ বইয়ে সঙ্কলিত প্রণালীগুলির এমন অনেকগুলি পদ তাঁর নিজের উদ্ভাবিত। প্রতিটি পদ নিজে রেঁধে, তবে লেখা।
আরও পড়ুন –
যে কোন শাক-সবজি কত বিভিন্ন ভাবে রান্না করা যায়, অতি সাধারণ উপকরণ দিয়েও রান্নায় কতরকম বৈচিত্র্য আনা যায় এবং একটি খাবারকে কিভাবে সুস্বাদু ও রুচিকর করে তোলা যায় তার হদিস পাওয়া যায় পারিবারিক রান্নার ঐতিহ্যে, পুরনো কালের রান্নার বইপত্র ঘাঁটলে। রন্ধনশিল্পে সৃজনশীলতা ও নান্দনিকতা কোন সুষমায় উদ্ভাসিত হয়েছিল তা জানতে এবং বাঙালির রসনাপ্রিয়তার সাক্ষ্য পেতে হলে আমাদের নজর ফেরাতে হয় ঊনবিংশ শতকের শেষ ও বিংশ শতকের গোড়ায়।
এই যুগে দাঁড়িয়ে যথার্থ রসনাবিলাস ধারণা করা শক্ত। এমন প্রশ্নও ওঠে, বাঙালি কি আদৌ ভোজনরসিক? হাল আমলে সর্বত্র বাইরে গিয়ে খাবার অথবা বাইরে থেকে খাবার আনাবার সীমাহীন ঝোঁক। গভীর রাতেও চোখে পড়ে লেবানিজ শওরমা, তিব্বতি মোমো, চাইনিজ কিংবা মোগলাই ও বিরিয়ানির দোকানের সামনে স্যুইগি ও জোম্যাটোর স্কুটারের ভিড়। সপ্তাহান্তে বা উৎসবের মরসুমে আগে থেকে আসন সংরক্ষণ করা না থাকলে ফাইন ডাইনিং রেস্তোঁরায় জায়গা মেলে না। নববর্ষই হোক কি পুজোর দিনগুলি, ভাইফোঁটা বা জামাইষষ্ঠী — বিভিন্ন রেস্তোঁরায় বিশেষ মেনু ও থালির সমারোহ। হোম শেফদের পপ-আপ থেকেও খাবার আনার চল ক্রমেই বাড়ছে। আর বারোমাস নিজের গৃহের রান্নাঘরটি বেতনভুক রান্নার মাসির হেফাজতে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত স্বাদ-পূরণের ভার আধুনিক সমাজে কার্যত এখন পুরোটাই আউটসোর্সড। নিজস্ব ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্যে এবং ভালো-মন্দ খাওয়ার বাসনা মেটাতে উপযুক্ত ক্ষেত্রে এখন মূল্য ধরে দেওয়াই রেওয়াজ। কিন্তু ‘খাবার সামগ্রীটি অনেক টাকা খরচ করিলেই যে ভালো হয় তাহার কোন অর্থ নেই। কোন জিনিসটা দু’ আনায় যেমনটা হয়, হয়ত সেখানে দু’ টাকা খরচ করিলেও তেমনটা হইবে না। কারণ, খাদ্যপাকের কৌশল জানা না থাকিলে কেবল অর্থব্যয়ে কোন ফলই হয় না,’ লিখেছিলেন প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। তাঁর এই কথাটির তাৎপর্য এখন যেন আরও প্রাসঙ্গিক।
অতীতে ভোজনরসিকদের পাত আলো করত যে সব মনোহর, সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য সেই সব জিনিস আজ গেল কোথায়, এই প্রশ্ন ওঠা তো অস্বাভাবিক নয়। দক্ষিণের দোসা-ইডলি, রসম, আপ্পাম বা চেট্টিনাড চিকেন, উত্তর ভারত বা পাঞ্জাবি খানায় তন্দুরি রুটি, বাটার নান, ডাল মাখানি আর চিকেন বাটার মশালা, প্রতিবেশী রাজ্য বিহারের লিট্টি-চোখা, ঝাড়খন্ডের ধুসকা বা ওড়িশার ডালমা বা পখালা ভাতও যখন নিজস্ব রাজ্যের গন্ডি ছাড়িয়ে দেশের অন্যত্র তো বটেই, এমনকি বহু বিদেশিরও নজর কেড়েছে তখন আমাদের বাঙালি আমিষ ও নিরামিষ রান্নার এত বৈচিত্র্য থাকতেও আমরা কেন তাকে দুনিয়ার সামনে আজও উপযুক্ত মর্যাদায় তুলে ধরতে পারলাম না? বাংলার পরিচিতি কি শুধু মিষ্টি দই আর রসগোল্লাতে সীমাবদ্ধ?
মনে পড়ে যায় নিরামিষ রান্না নিয়ে বুদ্ধদেব বসু কী চমৎকার লিখেছিলেন — ‘আমার ঠাকুমার নিরিমিষ রান্না — সে আবার এক অন্য জগৎ .., সেখানকার বাসিন্দারা ভারী বিনয়ী, ছেঁচকি ঘন্ট শাক শুক্তো এই সব অনুজ্জ্বল নামে বিরাজ করে, কুমড়ো-বীচি লাউয়ের খোশার মতো ওঁচা জিনিসও সেখানে সম্মানিত। কিন্তু ওই সব বিজ্ঞাপনহীন সৃষ্টি থেকে যা আস্বাদ বেরিয়ে আসে তা প্যারিসের সেরা রাঁধুনির কল্পনাতীত। যেমন রামধনুর সাতটাকে মিশিয়ে অসংখ্য রঙ বের করে আনেন চিত্রশিল্পীরা, তেমনই মাত্র তিনটে-চারটে মোটা আস্বাদের মধ্যেই জিভের জন্যে বিপুল বৈচিত্র্য রচনা করেন আমার মা-ঠাকুমারা, সেই তাঁদের স্টুডিওতে, যার সরঞ্জাম অত্যন্ত মামুলি।’ তাঁর এই বিবরণে খাদ্য সম্ভারের একটি অনুপম বর্ণময় চিত্রই যে শুধু ফুটে উঠেছে বা আহারের পরিতৃপ্তি প্রকাশ পেয়েছে তা নয়, পারিবারিক জীবনচর্যার স্পষ্ট ছবিও এতে ভারি সুন্দর ধরা পড়েছে। এই আহার নিছকই আটপৌরে হলেও একইসঙ্গে অত্যন্ত পরিশীলিতও বটে। তিনি আবার নিজেই আফশোস করেছিলেন যে বাঙালি রান্নার মস্ত ত্রুটি হল তাকে ব্যবসায় খাটানোর যথার্থ কৌশল রপ্ত হয়নি। তাই ফাইন ডাইনিং রেস্তোঁরা ও এখনও টিঁকে থাকা গুটি কয়েক পাইস হোটেলের অস্তিত্ব সত্ত্বেও ‘রান্নায় স্বাদু ও পরিবেশনে সুপ্রসারিত’ মাছের ঝোল-ভাতের তৃপ্তিকর ঘরোয়া মেনুর যথার্থ রেস্তোঁরা আজও সত্যিই দুর্লভ।
সন্দেহের অবকাশ নেই যে, স্বাদের স্বাতন্ত্র্যই খাদ্যের দুনিয়ায় ভালো ও খারাপের মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা গড়ে দেয়। ঔপনিবেশিক বঙ্গে খাদ্য সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বাদ ও নান্দনিকতার পরিচয়। সেটি স্থির করে দিত তার আভিজাত্য বোধ ও সাংস্কৃতিক অবস্থান। আবার মধ্যবিত্ত সমাজের সেই স্বাদের স্বকীয়তা অর্জন সম্ভব হয়েছিল নারীর প্রাত্যহিক শ্রমকে স্নেহ ও মমতার প্রতীক হিসেবে মূল্যায়ন করে। গৃহস্থের পরিবারে বাড়ির মেয়ে-বউদের রান্নাবান্নায় দৈনন্দিন শ্রমের বিষয়টি ছিল উপেক্ষিত। ঔপনিবেশিক বঙ্গে খাদ্য সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিকতার তাৎপর্য থাকলেও বাঙালি হিন্দু পরিবারের রান্নাঘরের সঙ্গে জড়িত ছিল পবিত্রতার অনুষঙ্গ। পবিত্রতা রক্ষার বিষয়টি ছাড়াও রান্নার সঙ্গে স্নেহ ও মমত্বের আবেগ জড়িত থাকায় বেতনভুক পাচক ঠাকুরের তুলনায় বাড়ির রান্নায় গৃহিণীর অংশগ্রহণ ছিল আকাঙ্খিত।
নতুন যুগের নারীকে আধুনিক করে তোলার জন্যে শিক্ষার সঙ্গে প্রথাসম্মত রন্ধনশৈলী ও গৃহস্থালির স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কেও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। উত্তরপাড়া হিতকারি সভার মতো কিছু বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল রন্ধনশিল্প। ১৮৮৯ সালে মধ্য বাংলা সম্মিলনী রান্নায় দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে চালু করেছিল একটি পুরস্কার। আবার রক্ষণশীল হিন্দু আদর্শে বিশ্বাসী মহাকালী পাঠশালা ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে কিংবা ভিক্টোরিয়া কলেজের মতো আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ছাত্রীদের রন্ধনশিল্প আয়ত্ত করার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিল। স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে রন্ধনবিদ্যা রাখার পাশাপাশি নারীকে আধুনিকতার আলোয় নিয়ে আসার জন্যে সমসাময়িক সময়ে বিভিন্ন গার্হস্থ্য বিজ্ঞান নির্দেশিকা এবং মহিলা পত্রপত্রিকায় নানারকম রান্নার প্রণালী প্রকাশিত হতে শুরু হল। ঊনবিংশ শতক থেকেই শুরু হল বাংলায় রান্নার বই ছাপাও।
বাড়ির মহিলাদের কী কী শেখা উচিত সে ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছিলেন সেকালের বিখ্যাত লেখক প্রিয়নাথ বসু। চাল-ডাল কোথায় রাখা হবে, বিভিন্ন ঋতুতে আচার, চাটনি, জারক ফল কিভাবে তৈরি করতে হবে, চট করে কিভাবে স্বল্প খরচে খাবার বানাতে হবে, কোন রান্না আগে, কোন রান্না পরে করতে হয় সেটা যেমন মেয়েদের জানতে হবে, তেমনই শিখতে হবে পোলাও, কোপ্তা, কালিয়া, চপ, কাটলেট বানানো। সুস্বাদু ডাল রান্না কিংবা শাক-সবজি, পালা-পার্বণ অনুযায়ী পিঠে-পুলি সবই ভালো করে বানানো এবং সুন্দর করে পরিবেশনের নিয়ম জানতে হবে। অসুস্থদের পথ্য হিসেবে সহজ পাচ্য খাবার এবং বার্লি বা অ্যারারুট জ্বাল দিয়ে শরবত বানানোও জানতে হবে। রান্নার নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ারও অভাব ছিল না। সাংবাদিক, গবেষক, প্রাবন্ধিক এবং যিনি প্রথম হিন্দুত্ব শব্দটি ব্যবহার করে একটি বই লিখেছিলেন সেই চন্দ্রনাথ বসু যথেষ্ট আলো-বাতাস পূর্ণ পরিচ্ছন্ন ও প্রশস্ত রান্নাঘরের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা দীনেশ চন্দ্র সেন রান্না করতে করতে মহিলাদের কাপড়ে হাত মোছার অভ্যাসের সমালোচনা করেছিলেন। খাবার পরিবেশনের সময় উপযুক্ত হাতা ও চামচ রাখার ব্যাপারে মহিলাদের সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি এও বলেছিলেন, ভাত ও ডাল বসানোর আগে চাল-ডাল যেন খুব ভালো করে ধোওয়া হয়।
তবে একথা ভুললেও চলবে না, সেকালের নামজাদা ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের মধ্যেও অনেক বড় বড় পাচক ছিলেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথায় জানা যায়, মহামহোপাধ্যায় রাখালদাস ন্যায়রত্ন ছিলেন এমনই একজন বিখ্যাত ও পটু পাচক। সেই সময় যে পুরুষ লাঠি খেলতে, সাঁতার দিতে, কুস্তি লড়তে বা ঘর গেরস্থালির কোন একটা কাজ ভালোভাবে জানত না তাকে লোকে গোবর গণেশ বলে ঠাট্টা করত। বড় দিগগজ পন্ডিত যেমন এক দিকে পান্ডিত্যের সাগর ছিলেন, তেমনই অন্যদিকে নানা শিল্পকাজে পারদর্শী ছিলেন। হালিশহরের বলরাম বিদ্যাভূষণও ছিলেন এক সুখ্যাত পাচক। কাজেই রন্ধনশিল্পে পুরুষেরাও পিছিয়ে ছিলেন না।
উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের গোড়ায় সাহিত্য, সঙ্গীত ও শিল্পকলার সঙ্গে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির রন্ধনশালাতেও সৃজনশীলতার উন্মেষ ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী নানারকম মিষ্টি বানাতেন। বিখ্যাত ছিল তাঁর মানকচুর জিলিপি, দইয়ের মালপোয়া, পাকা আমের মিঠাই, চিঁড়ের পুলি ইত্যাদি। কবি নিজেও রান্নাঘরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, তবে সব ক্ষেত্রে ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। তাঁর দাদা হেমেন্দ্রনাথ ছিলেন বিজ্ঞানী। রান্না সম্পর্কে তিনি নিজে খুবই আগ্রহী ছিলেন। স্ত্রী নীপময়ী দেবী দারুণ রাঁধতেন। কন্যাদের রন্ধনশিল্পে পারদর্শী করে তোলার জন্যে হেমেন্দ্রনাথ সুদক্ষ পাচক রেখে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল, বিজ্ঞানের পাঠ্যবই রচনার পাশাপাশি তিনি একটি রান্নার বই লিখবেন। চাটনি, মোরব্বা, হালুয়া প্রভৃতি বেশ কিছু প্রণালী তিনি লিখে রেখেছিলেন। চিত্রা দেবের লেখা থেকে জানা যায়, ঠাকুরবাড়িতে রোজকার ব্যঞ্জন ছিল ‘ডাল-মাছের ঝোল-অম্বল, অম্বল-মাছের ঝোল-ডাল’। তবে সব মেয়ে-বউই অল্পস্বল্প রান্না শিখতেন। রবীন্দ্রনাথের দিদি সৌদামিনীদের রোজ একটা করে তরকারি রান্না শিখতে হত। তবে রান্নার প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল প্রজ্ঞাসুন্দরীর। ‘পুণ্য’ পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পাতায় পাতায় বিভিন্ন আমিষ ও নিরামিষ রান্নার প্রণালী ছাপতে শুরু করেন। গৃহিণীদের জন্যে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় টুকিটাকি পরামর্শ তিনি দিতেন। ‘বিনা পেঁয়াজে পেঁয়াজের গন্ধ করা’র জন্যে আদার রসে হিং ভিজিয়ে রেখে তা নিরামিষ তরকারিতে দিলে পেঁয়াজের গন্ধ হয় কিংবা ডাল-তরকারি সামান্য পোড়া লাগতে শুরু করলে তাতে কয়েকটা আস্ত পান ফেলে দিলে গন্ধ কমে যায় সে আর ক’জন জানে? তাঁর বিভিন্ন রান্না ছিল অভিনব। রবীন্দ্রনাথের ৫০ তম জন্মদিনে তৈরি করেছিলেন ফুলকপি, দুধ, আমন্ড, কিশমিশ ও জাফরান দিয়ে কবি সংবর্ধনা বরফি। এমনই বেশ কিছু রান্নার সঙ্গে জুড়ে দিতেন প্রিয়জনের নাম। যেমন ‘রামমোহন দোলমা পোলাও’, ‘দ্বারকানাথ ফির্নি পোলাও অথবা তাঁর অকালমৃতা মেয়ের নামে ‘সুরভি’। আবার অনেকরকম বিচিত্র পদও তিনি উদ্ভাবন করেছেন — ‘খেজুরের পোলাও’, ‘আপেলি পোলাও’, ‘রসগোল্লার অম্বল’, ‘ঝিঙাপাত পোড়া’, ‘মিছা দই মাছ’, ‘কাঁচা তেঁতুলের সরস্বতী অম্বল’ এমন আরও কত কী! এই সব পদের কথা ভাবলে বোঝা যায়, প্রাত্যহিক খাবার নিয়ে চিন্তা ভাবনা ছিল কতটা গভীর।
আবার পূর্ব বঙ্গের দিঘাপতিয়ার জমিদার ছিলেন শরৎকুমার রায়। তাঁর বিদুষী পত্নী কিরণলেখা রায় ছিলেন রন্ধন পটিয়সী। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠেছিল তাঁর মার্জিত রুচিবোধ ও অভিজাত দৃষ্টিভঙ্গি। বংশ পরম্পরায় প্রচলিত রান্ধনশৈলী ছাড়াও বরেন্দ্রভূমির ঐতিহ্যবাহী রান্নার পদ্ধতি ও বৈশিষ্ট্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি করে গেছেন। তার সাক্ষ্য রয়েছে ‘বরেন্দ্র রন্ধন’ গ্রন্থে সংকলিত নানা সুখাদ্যের প্রণালীতে। পান্তা বা ‘পর্যুষিত অন্ন’ থেকে শুরু করে ‘ক্ষুদ্র মাছের পুড়পুড়ি’, ‘রুই মাছের টিকলি ভাজি’, ‘পাঁঠার মেটে ভাজি’, ”মটন চপ,’ ‘খাতাই কাবাব’, ‘খরখরি’ ইত্যাদি অসামান্য সব পদের হদিস রয়েছে বইটিতে। একই সঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, পূর্ব বঙ্গের মুক্তাগাছার জমিদার পরিবারের বধূ রেণুকা দেবী চৌধুরানীর ‘রকমারি আমিষ রান্না’ ও ‘রকমারি নিরামিষ রান্না’ বই দুটির কথা। সাধারণ শাক-সবজি, চাল-ডাল দিয়ে নিরামিষ রান্নার বৈভব কিংবা আমিষ রান্নার যে কী ঐশ্বর্য রয়েছে তা জানতে হলে একালের উৎসাহী খাদ্যরসিকদের এই সব পাকপ্রণালী পরখ করে দেখতেই হবে। নববর্ষের সকালে জলখাবারে ‘নারিকেলের মিষ্ট লুচি’ বা ‘বিলাতি কুমড়ার লুচি’ যদি খেতে হয় তাহলে দেখতে হবে বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘মিষ্টান্ন পাক’। তবে একটা অত্যন্ত লোভনীয় জিনিসের কথা বলি। সেটি হল, ‘ব্রহ্মানন্দ পুরি’। একটু ঝাল-মিষ্টি আলুর দমের সঙ্গে একবার খেলে তা আর ভোলা যাবে না। তৈরি করা কিন্তু মোটেই কঠিন কিছু নয়। ময়দায় লুচির মতো ময়ান দিয়ে একটু বড় লেচি করে রাখুন। একটি কড়াতে সামান্য ঘি দিয়ে পুর ভরার উপযোগী পরিমাণে খোয়াক্ষীর লালচে করে ভাজতে হবে। নামিয়ে ঠান্ডা করে ক্ষীরের সঙ্গে ভালো করে মাখতে হবে গুঁড়ো চিনি, গোলমরিচ গুঁড়ো, জয়িত্রী গুঁড়ো, বড় এলাচ গুঁড়ো। এবারে মশলা মাখা ক্ষীরের পুর ভরে লুচি বা কচুরির মতো ভাজতে হবে। খেয়ে দেখুন, অসাধারণ জিনিস! তেতোর পদের প্রণালী দিয়ে শুরু করেছিলাম। মধুরেণ সমাপয়েৎ করলাম ব্রহ্মানন্দ পুরি দিয়ে।
রসনাবিলাসের কথা উঠলে স্মরণ করতেই হয় বহু সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের কথা, বাংলার খাদ্য বৈচিত্র্য যাঁদের গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। রাজা রামমোহন রায়, মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর, কবি ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত, বিদ্যাসাগর, বিপিন চন্দ্র পাল বা সুকুমার রায় সকলেই ছিলেন ভোজনপ্রিয়। তাঁদের মধ্যে অনেকের পরিপাক শক্তিও ছিল অবিশ্বাস্য। রাজা রামমোহন রায় গোটা একটা পাঁঠার মাংস খেতে পারতেন। পঞ্চাশটি আম, এক কাঁদি নারকেল ও বারো সের দুধ খাওয়া তাঁর কাছে ছিল অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। হিমালয় ভ্রমণে গিয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ রোজ ভোরে দশ-বারো সের করে গরুর দুধ খেতেন। প্যারীচরণ সরকারও ছিলেন বিরাট হজম শক্তির অধিকারী। নিমন্ত্রণ বাড়িতে পেট পুরে লুচি মাংস খাওয়ার পর বারাসতে উৎকৃষ্ট ছানাবড়া খাওয়ার প্রতিযোগিতায় এক সের ছানাবড়া খেয়েছিলেন। কথিত আছে, বারাসতে নবকৃষ্ণ মিত্রের বাড়িতে আস্ত পাঁঠা রান্না হলে তার অর্ধেক প্যারীচরণ আর উপস্থিত থাকলে অর্ধেক খেতেন বিদ্যাসাগর। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ভরপেট পোলাও মাংস খাওয়ার শেষে দু’সের রসগোল্লা খেয়ে ফেলতেন। সেই পরিপাক শক্তি বা রসনাপ্রিয়তা এখন সবই অবশ্য গল্প-কাহিনী।
শেয়ার করুন :