আল্পনা ঘোষ
সৌজন্য – সপ্তর্ষি প্রকাশন
আঠেরো বছরের অজন্তার কোনো প্রেমিক নেই- ওর বান্ধবীরা যাকে বলে বয়ফ্রেন্ড,লাভার। ও এই বিষয় টা নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা করতেও চায় না ।এমনকি নিজের সঙ্গেও না ।এসব ভাবনা যে ওর মনে মনে আসে না তা নয় ।কিন্তু সেসব যেন ক্ষণিক বুদ্বুদ বা শরতের হালকা চালের মেঘের মতো ।শান্ত,নিরিবিলি স্বভাব তার আর তার জীবন যেন অজানা কোনো নদীর মতো সরুখাতে বয়ে যায় ।
তবু তার জীবনেই এমন দুর্ঘটনাই ঘটল, নাহ একে ঘটনা বলাই ঠিক।এসব তো আকছার ঘটছে।
খবরের কাগজে,টিভিতে এসব খবর হয়ে যায় । এমন তো ঘটেই থাকে। কিন্তু অজন্তার জীবনে তো বারবার ঘটেনি -তাই তার কাছে এটা দুর্ঘটনা/তার তো কোনো দোষ ছিল না।কোনো অবদমিত ইচ্ছা? বরং তার গা ঘিনঘিন করছিল।লজ্জা,অপমানে মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিল। অথচ বাসভর্তি লোক -পুরুষ-মহিলা-বৃদ্ধ -বৃদ্ধা শিশু।সকাল দশটার বাস।কি ভাগ্যি বসে তার চেনাজানা কেউ ছিল না।
মুখ লাল করে সে যখন মাসির বাড়ি পৌঁছল ,তখন তার সারা শরীর কাঁপছে। মাসিকে সে কিছু বলেনি। কতবার মাসি জিজ্ঞেস করল তাও না।কপালে গালে ঠান্ডা হাত ছোঁয়ালো। শরবত খাইয়ে ফ্যানের তলায় বসিয়ে খাবার আনতে গেল ।অথচ সে এসেছিল মেসোকে দেখতে ।মেসোর শরীর খারাপ । আর সে,সেটা জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেল।
কথাটা সে কাউকে বলেনি।মা কেও না। তাদের বাড়িভর্তি লোক। মানে আত্মীয়স্বজন।সবাই একসঙ্গে থাকে। আবার থাকেও না।সবাই বলে আজকালকার দিনে এমন জয়েন্ট ফ্যামিলি ভাবাই যায়না। কিন্তুতাদের মস্তবড় পুরোনো কলকাতার বাড়িতে যেমন জায়গায়,জায়গায় ফাটল ধরেছে,ছাদের কার্নিশে গজিয়েছে বট অশ্বত্থের চারা তেমনি তাদের কাকা জ্যাঠাদের সংসারেও ফাটলের আঁকিবুকি । ঠাকুমা ছেলেদের ঘরে ঘরে ঘোরেন না কিন্তু তাঁর চা-জলখাবার-ফল দুধ-ভাত তরকারি পালা করে দেওয়া হয় ।
তাদের পুরোনোদিনের তিনতলা বাড়ি ।নড়বড়ে রেলিং।স্যাঁতস্যাঁতে বাথরুম,পায়খানা।পিছল উঠোন। দোতলা তিনতলা বারান্দা থেকে ভিজে জামাকাপড় ঝোলে। ছাদেও তারভর্তি কাপড় জামা রোদে শুকোয়। হাওয়ায় ওড়ে। যার যার কাজের লোক এসে মেলে, তোলে।
অজন্তাদের কাজের মাসি বেস্পতি । অল্পবয়সে দুই ছেলে নিয়ে গ্রাম থেকে এসে পড়েছিল উত্তর কলকাতার ফুটপাতে। কানা হলেও তার যৌবন ছিল ।তাকে আশ্রয় দেন অজন্তার ঠাকুর্দা।সেই থেকে বেস্পতি থাকা খাওয়ার বিনিময়ে এ বাড়িতে কাজ করে ।অন্য বাড়িতে কাজ করে ফাঁকে ফাঁকে।
তার ছেলেরা বড় হয়ে একজন গ্যারেজে কাজ করে,অন্যজন দেশে গিয়ে পার্টি ধরে বা করে জমি বাড়ি উদ্ধার করে ওখানেই বিয়ে থা করে থিতু হয়েছে । তবু বেস্পতি দেশে যায় না ।অজন্তাকে সে কোলে পিঠে করে বড় করেছে ।অজন্তার বাবা কাকাদেরও দেখেছে।অজন্তার কাকা জ্যাঠারা অবশ্য সবাই তুতো ভাই । পিসিও আছে দুজন । দক্ষিণ কলকাতায় তাদের শ্বশুরবাড়ি । বাংলা ভেঙে ভাগ হলে এরা এপারে আসেন ।বেস্পতি অজন্তার ঘরের বারান্দায় শুয়ে থাকে।দরকার হলে মেঝেয় ।সে বোধয় কিছু আন্দাজ করেছিল।সেও তো জানে মেয়ে মানুষের শরীর।দেহ।অজন্তাকে সেই তো এতকাল আগলে রেখেছে ।সে জানে শিশু হলেও অজন্তা কন্যা। বালিকা হলেও তার নারী শরীরের আভাস পুরুষের চোখের মণিতে। আর বালিকা বলেই,শিশু বলেই সর্বসমক্ষে তাকে চটকানো যায়,চুল ঘেঁটে দেওয়া যায়,কলুষ আঙুলে,হামি খাওয়া যায়। আর আড়ালে নিষ্পাপ শরীরে কখনো কখনো সেসব মাত্রা ছাড়ায়।
বড় বাড়ির আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা আরশোলা মাকড়সার মতোই এসব উৎপাত থাকে।বেস্পতি বাঁচাতো তাকে ।নানা ছলে । সেও তো শরীর বাঁচাতে উঠে এসেছে ফুটপাথ থেকে।পেটের খিদেয় গ্রাম থেকে । ক্ষুধাও তো জান্তব। শারীরিক।এখন বেস্পতি ঝাঁট দেওয়ার সময় তার বাঁকা কোমর আরো বাঁকা করে বন বন হাত ঘুরিয়ে বলে ‘রাই কিশোরীর দেহ ,কিষণ (নো) যদি না খাইত খাইত অন্য কেহ’, মেয়েমানুষের গতরই সব,তার মনডারে কে খুঁজে?’
কথাটা ঠিক। যেতে আসতে,ট্রামে বাসে মেয়েদের যে কত অপমান গায়ে মাখতে হয়,কত কথা শুনতে হয় ।সেসবই শরীর নিয়ে,পোশাক নিয়ে।
হ্যাঁ, সেদিন সে শাড়ি পরেছিল,অনেকটা সময় নিয়ে সেজেছিল,কলেজ আর টিউশন ছাড়া সে একা একা কোথাও যায়না ।বন্ধুদের বাড়িতেও না ।তাই বোধহয় একটা উপলক্ষ পেয়েছিল সে ।সে অবশ্য সাজগোজ পছন্দ করেনা ।অল্প স্বল্প হালকা সাজ তার পছন্দ।একটা বড় গলা সাদা ব্লাউজ ।ম্যাগি হাতা ।গোলাপি লখনৌ চিকন শাড়ি ।হালকা গোলাপি লিপস্টিক,কাজল আর টিপ । ব্যাগে মিষ্টি/একটা পলি প্যাকে আপেল আর মুসুম্বি ।
সকাল দশটার বাস ।বেশ ভিড়/সে দাঁড়িয়েছিল মাঝের রড ধরে ।ওরা যে কখন তাকে ঠেলতে ঠেলতে ঘিরে ফেলেছে সে টের পায়নি । হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখল এক বৃদ্ধ ।নাহ যিনি নন ।এভাবে সে চমকে ওঠে ।বারবার । ডাইনে বাঁয়ে তাকে। ধরতে পারেনা ।তাদের চাপা উল্লাস এবার শোনা যায় ।কান গরম হয়ে ওঠে অজন্তার ।সেই বুড়ো মানুষটা অস্ফুটে বলে ওঠেন ‘কি হচ্ছে এসব?’ ‘দাদুর মালে হাত দিস না মাইরিত। শক খাবি।’ ‘দাদু ওরম গা লাগিয়ে দাঁড়ান কেন?অসভ্যতা ।ফুটুন ফুটুন।এ আমাদের সিস্টার ।’বলে দু তিন জন ওঁকে ঠেলে দেয় লেডিস সিটের দিকে।
এক্ষেত্রে চুপ করে থাকাই ঠিক বলে মনে হয়েছিল অজন্তার/ আর যত সে চুপ করে ভুরু কুঁচকে কুঁকড়ে যাচ্ছিল,ছেলেগুলো তত বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল ।
অজন্তার ইচ্ছে ছিল প্রেসিডেন্সি তে পড়ার। কিন্তু ওকে ভর্তি করা হল বাড়ির কাছে এক্সক্লুসিভ ফর গার্লস কলেজে । তাও যদি ব্রেবোর্ন হতো ।
বাবা বেঁচে থাকলে এটা হত না ।বাবা যেন তার স্বাধীন ইচ্ছে গুলো নিয়ে চলে গেছে ।এদিকে একটা পয়সা কেউ দেবে না কিন্তু গার্জেনগিরি করার বেলায় কাকা জ্যাঠার অভাব হয় না ।মা এখন চাকরি করে সে বাড়িতে এখন লক্ষ্মী,বাধ্য,বৌ,বৌদি,জা । এর চাইতে কোনো ফ্ল্যাটে উঠে গেলে ভাল হতো । তাতে মার আপত্তি । কি নাকি সিকিউরিটি । মা বোঝে না সবাই তলে তলে ফ্লাট কিনছে । মওকা মতো এ বাড়ি বেচে নগদ টাকা নিয়ে ফ্ল্যাটে চলে যাবে ।বেস্পতি পুরোনো লোক। সে জানে এসব গুহ্য কথা ।
বাবা হঠাৎ চলে গেলো ।সে তখন ইলেভেন ।সাতদিনের জ্বরে সব শেষ। বাবার অফিসেই মার চাকরি হল।
কাকুরা সবাই খুব করেছেন।মাসিমনিরাও । টাকা পয়সাও সব নির্ঝঞ্ঝাটে পাওয়া গেল।শুধু অজন্তার জীবনটা হালভাঙ্গা পাল ছেঁড়া হয়ে গেল ।আরো হল মণির কথা ভেবে ।মণি ওর বড়ো-বছর তিনেকের বোধহয় ।বোধহয় কারণ মণির জন্মদিন হয়না ।মণি কুৎসিত।মণি অবাঞ্ছিত ।বাবা মা কেউই মণিকে ভালবাসেনি।মণি বোবা ।শুনতেও পায়না ।তাকে লেখাপড়া শেখানো হয়নি ।শরীরের তুলনায় মাথা ছোটো ।বেঢপ শরীর ।অথচ সে একজন আস্ত মেয়ে ।তাকে মা-ই সামলাতো।এখন একজন মাসি আছে,সেন্টারের ।সকাল আটটা থেকে রাত্রি আটটা পর্যন্ত তার ডিউটি। যে কথাগুলো বলবার জন্য অজন্তার প্রাণ ছটপট করছে সেই কথাগুলো এতো ভারী হয়ে উঠছে দিনে দিনে যে, ও যেন আর বইতে পারছে না। সেদিন থেকে ও আর বাড়ি থেকে বেরোয়নি ।মাকে বলেছে শরীর খারাপ ।বেস্পতি মুখে,পিঠে হাত বুলিয়ে বলে-‘কেন মিচে কতা কও দিদি ?তোমার শরীর লয়, মন খারাপ।
কাগজে খবরটা একেবারে প্রথম পাতায় বেরোল কয়েকদিন ধরে। তাতেই এত আলোচনা। এতটা হতনা যদি সেই ছেলেটা প্রতিবাদ না করত। আর সে একা রুখে দাঁড়িয়েছিল বলে বাসভর্তি লোকের সামনে তাকে চড়ঘুসি মেরে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিয়েছিল ওরা আর তারপরে আরো অশ্লীল শব্দে সেই ছেলেটাকে নিয়ে ওকে টিজ করতে করতে ছেলেগুলো নেমে গেল।
আর সেই জন্যেই এত কথা ।এত গল্প ।জেঠিমারা.কাকিমা,জেঠুরা,কাকুর সঙ্গে এই ব্যাপারে অজন্তা দেখল মার আশ্চর্য মিল,অর্থাৎ দোষটা মেয়েটারই -তারপরই গৌরবে বহুবচন,মানে মেয়েটার পোশাক,চলাফেরা,বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঢলাঢলি ইত্যাদি ।সেই গিলটি ফিলিং থেকেই নাকি মেয়েটা প্রকাশ্যে আসছে না।’বাসে, তো আরো মেয়ে ছিল ।শুধু ওকেই বলল !
‘আরে রাখো,শিওর ছেলেগুলো ওর চেনা ।’
‘না,না, তাহলে মেয়েটা কেঁদে ফেলল কেন ?’
ভয়ে বৌদি ,স্রেফ ভয়ে ,যদি কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোয় ?’
‘এ তো সেই ট্রাফিক সার্জেন্টের কেস হল । সেই মহিলাও তো আসেনি ।ছেলেটা মরেই গেল শেষে। ‘
‘এর পর কে যাবে প্রতিবাদ করতে ?’
এরপরে কথাবার্তা গড়ানোর কথা বর্তমান সমাজ,অবক্ষয়,পার্টিবাজি ইত্যাদিতে কিন্তু অজন্তার কানে এল -‘তুমিও তো পুটুকে একা ছেড়ে দাও বৌদি’।
‘আরে কলেজ আর পড়তে যাওয়ার বাইরে ওকে ছাড়িনা। ‘
‘তাহলে সেদিন ছেড়েছিলি কেন?ও এসে কিছু বলেনি তোকে ?শুনলাম শরীর খারাপ –কদিন কলেজেও যায় না ?’
বাববা এত খোঁজও রাখে ওরা । অজন্তা কিংবা পুটু ভাবে ।
‘তুমি জানলে কী করে দিদি ?মেজদি ফোন করেছিল জামাইবাবুর শরীর খারাপ তাই ।ওর বাসে কিছু হয়নি ।তাহলে আমাকে বলত ।ওতো কিছু জানে না ।কাগজে পড়ে…তবে /’
‘আরে রিমি বলল /’
ওর খুড়তুতো বোন/ফার্স্ট ইয়ারে ঢুকেছে ।স্পাইগিরি করছে নাকি?অজন্তা নিজের ঘরে ঢোকে /এর পরেওরা আহা উহু করবে মণিদিকে নিয়ে ।
সে যে বড় হয়েছে মা স্বীকার করতে চায়না । তার সব বন্ধুর মোবাইল আছে।ওর নেই।মা কিন্তু গলায় মোবাইল ঝুলিয়ে দিব্যি অফিস যায় । সেখানে পুরুষ সহকর্মীই বেশি।তাছাড়া ও লক্ষ্য করেছে …নাহ এসব অজন্তা ভাববে না ।
একটু আগে দেবযানী ফোন করেছিল ।তার অন্য বন্ধুরা কেন যে ফোন করছেনা ?
হয়তো ওরা জেনে গেছে সেই মেয়েটার নাম অজন্তা মুখার্জী,তাদের খুব চেনা ।ওরা হয়তো অজন্তার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখবে না ।
ফোনটা থাকে মা-র ঘরে ।খাটের পাশে ড্রেসিং টেবিলের ওপর ।
সে মা-র ঘরে ঢুকলো। খাটে মণিদি ঘুমোচ্ছে। হাঁ করে। সামনের দুটো দাঁত বেরিয়ে আছে ।লালা পড়ে ঠোঁটের কষ বেয়ে বালিশে দাগ। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বেস্পতি ঘুমোচ্ছে ।
অজন্তা ফোন তুলল –হ্যালো ?
‘দেবযানী বলছি -কী হল আসছিস না কেন ?’
‘কী ব্যাপার ইয়ার –সামথিং রং ?’
‘নারে শরীরটা খারাপ ‘
‘ভাইরাল ফিভার ?খুব হচ্ছে এখন ।কাল যাব তোকে দেখতে ।’
‘নাহ !’আঁতকে ওঠে পুটু –‘এখন ঠিক আছি ।কাল বাদে পরশু কলেজে যাব ।তোদের কষ্ট করে আসতে হবে না ।জানিস তো আমাদের বাড়ি ।’
‘লেসবিয়ান ভাববে নাকি ?’
‘ধ্যাৎ ।পরশু ডেফিনিট ।’
কালকের দিনটা হাতে রইল তাহলে /আজকের রাতটাও ।বন্ধুদের বলবে কিনা এই ছত্রিশ ঘন্টার মধ্যেই ঠিক করে ফেলতে হবে ।একটা ডিসিশন তাকে নিতেই হবে ।আর সেই ছেলেটাকে পুলিশ খুব হ্যারাস করছে –সেটারও একটা ব্যবস্থা করতে হবে যদিও কীভাবে তা ওর জানা নেই ।
ডিমের ঝোল দিয়ে রাতে তিনটে রুটি খেল অজন্তা ।মা খুব খুশি ।
‘একটু ভাল লাগছে ?’
‘কি হয়েছিল তোর পুটু ?’সীমা একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে ।
‘কিছু হয়নি তো। টায়ার্ড লাগছিল। মাথাটাও…বোধহয় — চোখ দেখাতে হবে । তুমি অত ভেবো না । পরশু কলেজ যাব ।আর একটু রেস্ট নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
মেয়েকে সীমা ঠিক বুঝতে পারে না ।এই তো সেদিন বাবা বেঁচে থাকতে কত ঝলমলে ছিল মেয়েটা ।যত কথা যত আবদার সব বাবার সঙ্গে । সুখেন ওকে ছেলের মতই ভাবতেন । মণি তো বোঝা। বাবা মা না থাকলে পুটুকেই দেখতে হবে ওকে ।কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর কেমন চুপ চাপ হয়ে গেছে ও। দূরে চলে যাচ্ছে ।কেমন যেন নিজের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে । তবে কি সীমাই কিছু ভুল করেছে ?এভাবে উনি চলে যাবেন সীমা ভাবতেও পারেনি । তবু সীমা নিজেকে বলে ‘ছি’ ! যখন মনে হয় রিটায়ার করার পর উনি মারা গেলে সীমা কিছুই করতে পারত না । পুটুকেই চাকরি করতে হত । ওর বিয়ে দিতে পারত না ।তার চেয়ে এই ভাল হয়েছে । ‘ছি’ ।
সীমা পাশ গ্র্যাজুয়েট । আর্টসে ।টাইপ জানে না । কম্পিউটার শিখতে হবে ।ও একটা ক্লাশে ভর্তি হয়েছে মাস তিনেক হল । নইলে প্রমোশন আটকে যাবে । অশোকই ওকে উৎসাহ দিচ্ছে ।সুখেনের কলিগ ও বন্ধু । ‘বউদি আপনাকে সুখেনের চেয়ারে বসতে হবে ।উন্নতি করতে হবে ।‘ খুব করে অশোক । তাকে সব সময়ে পরামর্শ দেয় । এ নিয়ে অফিসে একটু ফিশফাশ ,চাপা হাসি ঘুরপাক খায় ওরা বোঝে । দু/ চারটে খুচরো ঠাট্টা,বাঁকা কথাও যে শুনতে হয় না এমন নয় ।
এত বছর থোড় বড়ি খাড়া সংসার করে যে শ্যাওলা পড়েছিল সীমার পায়ে তা উঠতে সময় লাগবে বৈকি । এর মধ্যে পার্লারে গিয়ে ফেসিয়াল করিয়েছে । বেশ ঝকঝকে দ্যাখায় ওকে। বেশি করতে সাহস হয় না। মেয়ে এমন চোখে তাকায় –ঝিলিক দেওয়া দৃষ্টিতে কী যেন প্রশ্ন। সীমার অস্বস্তি হয় ।
দিনে দিনে পুটু যেমন সুন্দর হয়ে উঠছে যে ওর ভয় করে । অথচ অন্য মেয়েদের মত পুটু সাজে না ।
পিতৃহীন এই মেয়েকে ও রক্ষা করবে কী করে ? এমন যৌবনবতী কন্যার জননী হবার গর্বের বদলে ওর মনে জাগে আশঙ্কা । পঁচিশ বছরে দ্বিতীয়বার মা হওয়ার আনন্দ কি তেতাল্লিশে রুপান্তরিত হয়েছে গোপন ঈর্ষায় ? কেন যে মেয়ের শরীরের সঙ্গে নিজের শরীরের এক অবাঞ্ছিত তুলনা অনাকাঙ্খিত ভাবে তার মনে ফোটে ?
কদিন পরে মেয়ে আজ ভাল করে চান করেছে । দিদিকে অনেকটা সময় দিয়েছে । অন্তত রোববারটা মাটি করে নি । তবে সে যে কিছু একটা লুকোচ্ছে মা হয়ে সীমা বুঝতে পারছে ।কিন্তু সেটা কী ?
ভাইরাল ফিভারের কল্যাণে শেষের দুটো ক্লাস হল না ।বাইরে বেরিয়ে অজন্তার মনে হল এবার সে বন্ধুদের বলতে পারে ।
‘সি, এম আর এস,ডি,জি দুজনেরি লাস্ট উইক থেকে জ্বর । যাক তুই বেশি কিছু মিস করিস নি ।‘তিথি বলে । ও এই কলেজেরই হস্টেলে থাকে । ওর মাও এখানে ছিলেন ।ও বলে ‘জানিস হস্টেলটা একটুও পাল্টায়নি । মায়েদের সময় যেমন ছিল এখনো ঠিক সেরকমই আছে । ঠিক ‘তাসের দেশ ‘। ‘দূরে তাকিও নাকো ,ঘাড় বাঁকিও নাকো হি হি ।‘ একটু থেকে কেমন আনমনা বলে ওঠে , ‘এই যে আগে ছুটি পেলাম –একটু আড্ডা মারতে পারব না রে,’
‘না জানলেই হল ।‘ সুমিত্রা বলে ।
‘স্পাই আছে রে ঠিক ম্যাম কে লাগাবে ।‘
‘ঠিকাছে বাবা ,একটুখানি থাক । আইসক্রিম খাওয়াব ।কথা আছে ।‘ বন্ধুদের আটকানোর জন্য কি ঘুষ দিচ্ছে অজন্তা ,না ভালবেসে ? অবশ্য তিথির বেলায় ঘুষ বলা যায় ।
কাল সারারাত সে জেগেছিল । বেস্পতি ছিল বারান্দায় ।বেস্পতি এত গভীর ঘুমে তলিয়ে থাকে যে গায়ে হাত না দিলে ওঠে না । আজকে কলেজে আসবে বলে ওকে ঘরে শুতে দেয় নি পুটু ।
বিডন স্ট্রিটের মশারা ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহক — পুটু মশারি টাঙ্গায় না । একটা ম্যাট জ্বালায় । মধ্যরাতে জানলা খুললে মশারা আসে না । সেটা ম্যাটের জন্য না অতরাতে ক্ষুধার্ত মশারা থাকে না বলে কে জানে ।জানলা দিয়ে জ্যোৎস্না আসে কিন্তু স্বয়ং চাঁদ কে দেখতে গেলে ছাদে উঠতে হয় ।
রাতে ঘুম না হলে ভোরে চান করে নিলে ঝিমুনি কাটে ।বেশ ফুরফুরে লাগে নিজেকে ।বাবার ছবির সামনে ধুপ জ্বেলে প্রণাম করে সে বেরোয় ।আজ সে বন্ধুদের বলবে ।ওর থানায় যাওয়া উচিত কাগজ কিংবা টি,ভি চ্যানেলে –কিন্তু তারপর ? মুখার্জীবাড়ির মানসন্মান ধুলোয় লুটোবে , বাড়িতে পুলিশ আসবে –মা,জেঠুরা ওকে কী আর কলেজে যেতে দেবে ? পাড়ার লোকেরা হাসাহাসি করবে,আঙুল তুলে দেখাবে । উফফ !
-‘কী বলবি বলছিলি অজন্তা ?’ দেবযানী বলে । ওদের হাতে একটা আইসক্রিমের কাপ ।
‘না ,মানে বলছিলাম –ধর ।ওই যে বাসের মেয়েটা যদি আমরা কেউ হতাম ?’
‘তো ?’
‘তাহলে কী করতাম আমরা ? অর্থাৎ এখন ? যা হয়ে গেছে তারপরে ?’ একটা শ্বাসপতন ! সশব্দে ।অজন্তার ।
কয়েক সেকেন্ড ওরা চুপ করে থাকে ।‘আমি হলে ‘ সুমিত্রা বলে ,’মা –কে বলতাম ।তারপর মা যা বলত তাই করতাম ।‘
‘স্রেফ চেপে যেতাম ।‘ দেবযানী বলে ।
‘সুধীশ কে বলতাম ।‘ দিয়ার গলা ।
‘ওই কাঁধে ঝোলা তোর কবি বয়ফ্রেন্ড ?যার সঙ্গে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আর বইমেলায় যাস ? হবে না হবে না ।‘ কিন্তু রাজীব হলে ঠাণ্ডা করে দিত ।গায়ত্রী বলে ।
‘ও তোর হিরো হন্ডা ? ছটা ছেলে পেঁদিয়ে ওকে ইস্ত্রি করে দিত !’
‘ কোনো সলিউশনই তো হল না , আমি যাই ।‘
বটানি অনার্স তিথি বলে । একটু থেমে বাকিটা বলে ,’আসলে আমাদের উচিত রুখে দাঁড়ানো । এবং দেরি হলেও থানায় এফ ,আই, আর করা ফেসিং এভরি হ্যাজার্ড ।‘
‘নট সো ইজি ডিয়ার ।‘অজন্তা বলে ,তারপর সশব্দে বোমাটা ফাটায় –‘কারণ মেয়েটা আমি !’
একটা বজ্রপাতের শব্দে যেন নির্বাক হয়ে গেল সবাই ।
‘ ও গড , তুই ? ’আ্যদ্দিন বলিস নি কেন ?’
‘ ওমা অজন্তা তুই ?’
‘ হ্যাঁ আমি । কষ্টে , ভয়ে, ঘেন্নায় ,লজ্জায় ,অপমানে মরে যাচ্ছি রে ।‘ কেঁদে ফেলে পুটু, ‘ এ কোন সমাজে আমরা বাস করছি ? কাউকে বলিনি । মাকেও না। জানিস তো মণিদিকে নিয়েই মা অস্থির,তার ওপরে এটা যদি শোনে ,আমার বাড়ি থেকে বেরোনই বন্ধ হয়ে যাবে । এমনিতেই বলে গ্রাজুয়েশনের পরে বিয়ে দিয়ে দেবে ।‘ ফোঁপাতে থাকে ও । আবার সেই কষ্ট যন্ত্রণা বয়ে বয়ে ফেরা । আবার বেস্পতির ফুট কাটা ।আবার মা—র বিরক্তি ।গজগজ । মণিদির গোঙানি ।
বন্ধুদের বলে তেমন কিছু হল না ।তবু একটু ঝরঝরে লাগছে ।তারা যদি নিজেদের দুঃখকষ্ট ভাগ করে নিতে না পারে তাহলে কীসের বন্ধুত্ব ?
কত কথাই সে ওদের মুখে শুনে এল ।দেবযানী বছর খানেক হল আইকিডো শিখছে ।ক্যারাটে নয় ।
এ হল আত্মরক্ষার কৌশল। সেই ঘটনার পর থেকে । কলকাতার উত্তরতম প্রান্ত থেকে দক্ষিণতম প্রান্তে চলাচল করা একটা ভিড় বাসে ঘটনাটা ঘটে । সঙ্গে ওর দাদা ছিল তাও । দেবযানীর মুখ খারাপ – তবে তা ওকে মানিয়ে যায় । ‘আরে দাদাভাই তো পেছনের দিকে ছিল ।আমি সামনে লেডিস সীটের সামনে । বাসে ঠাশাঠাশি ভীড় । অনেকক্ষন থেকে পেছনে একটা শক্ত মত কি ঠেকছিল । শীতকাল –সোয়েটার , শাল, চাদরের ঘষার মধ্যে আমার মনে হল গাজরের খোঁচা । সবে বলতে যাচ্ছি কাকু ব্যাগটা … তখনই ব্যাপারটা ঘটল – গা…টার হয়ে গেছে ।শালা শুধু ঠেকিয়েই ।‘অজন্তা অবাক চোখে বলে ,’কী?’ অন্যরা হো হো করে হেসে ওঠে । শুধু তিথি থুথু ফ্যালে ‘স্টপ দেবু ,আমার গুলোচ্ছে ।‘
‘ কী করলি তারপর ?’
‘কী আবার করব ? ওই শীতের রাতে ঠাণ্ডা জলে চান । চুড়িদার টা কাজের মেয়েকে দিয়ে দিলাম । তারপর আইকিডো । এই বয়েসে তো আর ক্যারাটে কুংফু শিখতে পারবনা ।‘
তাহলে তাকে একাই ডিসিশন নিতে হবে ।আঠেরো বছর বয়স কী দুঃসহ , এই বয়েসেই তো বিরাট দুঃসাহসেরা উঁকি দেয় । কিন্তু সেটা তো মেল আঠেরো , ফিমেল নয় । যাকগে এখন ওটাই লেডিস –
কী করবে সে ? এদ্দিন পরে সে কোন থানায় যাবে ?কী করে সেই অচেনা উপকারী কে খুঁজে বের করবে ? কোথায় যেন তাকে ছিঁচড়ে নামানো হয়েছিল ? সে নিজেও তো চুপ করেছিল। সে কেন নেমে গিয়ে ওকে ‘থ্যাঙ্কু বলল না ? মেয়েরা এই রকমই ।
কিন্ত আজই তো খাবার টেবিলে মা বলল যে , কোন স্কুলে দিদিমণিদের পোশাক নিয়ে ফতোয়া দিয়েছে স্কুল কতৃপক্ষ । গার্জেনরাও নাকি নোংরা নোংরা কথা বলেছে ।
দাঁতে দাঁত চেপে অজন্তা বলেছিল ‘শীট’! যেন সে এক্ষুনি লাফিয়ে উঠবে চেয়ার থেকে ।কিংবা ছুটে বেরিয়ে যাবে বাইরে ।
সীমা অবাক !‘ও কী রে পুটু ,এসব অসভ্যতা শিখলি কোথায় ? মেয়েদের অবস্থা এরকমই ।’
‘ তা বলে এতদূর ! বেশ করেছে ওরা থানায় গেছে । আমি হলেও যেতাম।‘
‘ না যেতে না । বি, এ পাশ করলেই তোমার বিয়ে দেব । হাড় জুড়োয় আমার । মণি তো আছেই – না পারি ফেলতে না পারি গিলতে । আমার হয়েছে মরণ। উনি তো ডঙ্কা বাজিয়ে চলে গেলেন আমার ঘাড়ে সব ফেলে ……‘
মা এখন বকেই যাবে। পুটু উঠে পড়ে । মা নিজে চাকরি করে এসব কথা বলছে ।
আসলে মাও তাকে বোঝা ভাবে ।
বাবা থাকলে মা এসব বলতও না । বাবা চাইত পুটু নিজের পায়ে দাঁড়াবে , তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে । সেও তাই চাইত ।
পুটু খুব সাধারণ মেয়ে —সে বিরাট কিছু চায় না—এম,এ পাশ করে নেট স্লেট দিয়ে একটা সন্মানজনক চাকরি তারপর মণিদি আর মাকে নিয়ে একটা ফ্ল্যাটে চলে যাবে। সুস্থ্য ,পরিচ্ছন্ন ,ভদ্র একটা জীবনের আকাঙ্খা তার । এইটুকু অর্জন করতেই এত বাধা কেন ? মা তাকে বিয়ে দিতে চায় ।যেন তাতেই সব সমস্যা মিটে যাবে । কেন যে মেয়েদের এমন দশা ।যেন তারা মানুষ নয় ,মাংসের টুকরো ।এদিকে সুযোগ পেলে সুনীতা উইলিয়ামসদের মতো মেয়েরাও এই ভারতবর্ষেই জন্মায় আর তাদের মতো কীটপতঙ্গেরাও জন্মায় পুরুষের খাদ্য হিসেবে । এই ২০১৯ সালেও ।
এখন তার ফুস্ফুসে খানিকটা টাটকা অক্সিজেন চাই । তার যদি একটা বন্ধু থাকতো । ইউক্যালিপ্টাস গাছের মতো ঋজু । আকাশ ছোঁয়া মানুষ ! বন্ধুই ,প্রেমিক কিম্বা স্বামী নয় । কিন্তু এই হেলান দেওয়া ইচ্ছে টা জাগছে কেন ? সে কি নিজের ভার নিজে বইতে পারছে না ? তার কি করা উচিত এর কি করা উচিত নয় সে বুঝতে পারছে না নিষেধের উদ্যত তর্জনী । অতিক্রম করতে পারছে না তাকে ঘিরে থাকা অদৃশ্য লক্ষণরেখাটি । অশ্রুজলে, নিষ্ফল ক্রোধ ও হতাশার কান্নায় তার উপাধান সিক্ত হয় – সে কি দেবযানীর মতো আইকিডো শিখবে ? দেবযানী এবং অজন্তা এবং ……।
ভাবতে ভাবতে তার মাথায় বিদ্যুৎতরঙ্গ ঝিলিক দেয় – চোখে যদিও লোনা জল । নাহ শুধু দেবযানী আর অজন্তা কেন ? সুমিত্রা ,তিথি, গায়ত্রী ,রেখা ওর চেনা আধচেনা, অচেনা মেয়ের দল যদি এক হয়।
মানে একজোট ? স্কুলে,কলেজে,পাড়ায় পাড়ায় ,উত্তর থেকে দক্ষিণের মেয়েরা যদি দল বেঁধে প্রতিবাদ করে ? রাস্তায় ,পার্কে ,সিনেমাহলে ? একা কোনও কাজ হয় না । পৃথিবীতে কোন কাজটা একা হয় ?
‘একলা চলো রে …’ র সঙ্গে জুটিয়ে নিতে হবে সাথীদের ।
ভাবতে ভাবতে বেশ একটা স্বস্তি জোটে ওর – উপুড় হয়ে ও সেই জোট বাঁধা মেয়েদের স্বপ্ন দেখে —
জেগে জেগে । ঘুমিয়েও পড়ে নিজেই নিজেকে এই আপাত সান্ত্বনা দিয়ে । কালকে কলেজে কথাটা
বলতে হবে ভাবতে ভাবতে ।
নারী নির্যাতন নিয়ে সেমিনার হয় । মিটিং মিছিল লেখালেখি চলে ।অজন্তারা আবার বেরোয় ।স্কুলে কলেজে যায় । জীবন এভাবেই চলে যতদিন না অজন্তাদের শুকনো অশ্রুচিহ্নের ওপরে ফুটে উঠছে শ্রদ্ধা ও মর্যাদার আনন্দকুসুম ।
শেয়ার করুন :