সাধক ওগো,প্রেমিক ওগো,পাগল ওগো -

রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রতিকৃতি। রানী চন্দকে, ২৫শে বৈশাখ ১৩৪২

সাধক ওগো,প্রেমিক ওগো,পাগল ওগো

রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বিস্ময়বোধ এবং মুগ্ধতার শেষ হয় না।

অভীক মজুমদার

                                      ১

প্রখ্যাত লেখক এবং চিন্তাবিদ ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের গ্রন্থ ,’Tagore A  Study’ -গ্রন্থের প্রথম বাক্যটি মনে রাখাই প্রথম দায়িত্ব ’Homage to the great is never ending ritual.’

রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বিস্ময়বোধ এবং মুগ্ধতার শেষ হয় না। হওয়া সম্ভবও নয়।বছর দশেক আগে ইম্ফল শহরে একটি কবিতাপাঠের সভার পর গভীর রাত পর্যন্ত চলেছিল পূর্বাঞ্চলের কবিদের আড্ডা। সেই আড্ডায় আমার রবীন্দ্র আচ্ছন্নতার দিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে ,মণিপুরী ভাষার অগ্রগণ্য কবি ইরোমেচা সিং বলেছিলেন ‘overdose of Rabindranath’।

কথাটা হয়তো বহুলাংশে সত্যি। ফলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখালেখির সমস্যা চিরন্তন।কোথা থেকে শুরু করা যাবে ,কোথায় শেষ হবে ?১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবিকাহিনি’।সেই থেকে ১৯৪১ – তাঁর মৃত্যুর বছর পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে কত সাহিত্যবর্গে কত ধরণের লেখাপত্র।একথাও সত্যি যে তাঁর লেখা -মকশো  শুরু হয়েছে আরো আগে থেকেই।একদিকে সুদীর্ঘকাল এই অভিযাত্রা ,অন্যদিকে সুগভীর এই সারস্বত পর্যটন।তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাহিত্যরূপের বৈচিত্র্য।তাঁর মতো এমন সহস্রভুজ লেখক বিশ্বে মিলবে না।জীবনের নানা সংকটে ,উল্লাসে,একাকিত্বে ,প্রেমে বা ভাঙনে রবীন্দ্রনাথ আমাদের আশ্রয়।আমাদের অনেকের ব্যক্তিগত নির্ভর।প্রত্যেক ২৫শে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণে সেই সম্পর্কের যেন একটা বাহ্যিক সামাজিক স্বীকৃতি উদযাপিত হয়।জনবৃত্তে বা বিজনে ,ঘোষণায় বা নিভৃতচারণে একটা কৃতজ্ঞ সংলাপ যেন চালাতে থাকি আমরা।হয়তো এ এক আনুষ্ঠানিকতা।ধুর্জটিপ্রসাদ কি একেই বলতে চেয়েছিলেন’never ending ritual’?

                                      ২

প্রথমে কয়েকটা কোলাহল ,বলা ভালো ,অভিযোগের কোলাহল দিয়ে শুরু করি। বারণ করে লাভ নেই। এই যে রবীন্দ্রনাথের আজীবনের অজস্র লেখালেখি ,তাকে কতদূর মন দিয়ে পড়েছি আমরা ?কবি বিষ্ণু দে ,একটি বিখ্যাত কবিতায় এই প্রশ্নই একটু ঘুরিয়ে করেছিলেন ,’তুমি কি কেবলই স্মৃতি,শুধু এক উপলক্ষ্য ,কবি ? হরেক উৎসবে হৈ হৈ /মঞ্চে মঞ্চে কেবল -ই -কি ছবি? তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ /আর বাইশে শ্রাবণ?/কালবৈশাখীর তীব্র অতৃপ্ত প্রতিভা /বাদলের প্রবল প্লাবন /সবই শুধু বৎসরান্তে একদিনেই নির্গত নিঃশেষ ?’

প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথকে বিগ্রহ বানাতে আমাদের উৎসাহ বেশি।আমি জানি,অনেকেই রুষ্ট হবেন ,তবু বলি। রবীন্দ্ররচনার প্রতি আমাদের মনোযোগ বা দায়বদ্ধতা অনেক সময়েই উপরিতলের।এই যে,বহু তরুণ- তরুণী রবীন্দ্রনাথের গান মঞ্চে পরিবেশন করছেন,অনেক প্রৌঢ়- প্রৌঢ়াও আছেন,যাঁরা সুন্দর পরিবেশন করেন,দেশবিদেশে যথেষ্ট সমাদৃত,কিন্তু খাতা খুলে বা কাগজ দেখে গান গাইতে হয়।যে রবীন্দ্রসংগীত তাঁদের জীবনচর্যার এক অপরিহার্য মাত্রা ,তাঁদের দেখে গাইতে হয় কেন? নাকি,রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন নেহাৎই  এক পেশা বা ব্যবসায়িক সাফল্যের সোপানমাত্র ?

অন্যদিকে ,বহু সময়েই দেখেছি ,রবীন্দ্রনাথের এক আংশিক,ক্ষুদ্র ,সংক্ষিপ্ত পরিচয় জেনেই বহু ‘বিদ্বান’ তাঁর মূল্যায়নে কিংবা প্রাসঙ্গিকতায় খুচরো মন্তব্যে প্রবৃত্ত হন।তাঁর প্রতি বাহ্যিক অনুরাগ প্রদর্শনকারীরাও দেখি একই অসুখে অনেকসময় আক্রান্ত।রবীন্দ্রনাথ ,আমার পাঠে,আজীবন চেষ্টা করে গেছেন জীবনসৌন্দর্য আর জীবনসত্যকে সামগ্রিকতায় আত্মস্থ করতে।রূপ -অরূপের এক মায়াময় পূর্ণতার কথাই ধ্বনিত হয়েছে তাঁর রচনার অঙ্গে –অঙ্গে।/অভিজ্ঞতা- কল্পনাআর উপলব্ধির স্তরে স্তরে সেই নিরবিচ্ছিন্ন সংলগ্নতার উৎসব।কার সঙ্গে সংলগ্নতা ?এই বিশ্ব ,এই মহাবিশ্ব এই অস্তিত্ব এই জীবনস্পন্দন এই বহুবিচিত্র জীবনপ্রবাহের সঙ্গে সংলগ্নতা।নিজের শিরাধমনীর ক্ষুদ্রতম অংশ জুড়ে তাকে অনুভব করার রোমাঞ্চ।তার অনু পরমাণু পেল কত আলোর সঙ্গ।‘ও তার অন্ত নাই গো নাই।’

সেই গত শতকের শেষদিকে প্রকাশিত হয়েছে ,’ দ্য ইংলিশ রাইটিংস অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর’।প্রকাশক,সাহিত্য অকাদেমি।বিপুল চারটি খন্ড।অন্যগুলির কথা আপাতত সরিয়ে রাখছি। শুধু বলছি তৃতীয় আর চতুর্থ খন্ডের কথা।তৃতীয় খন্ডের সম্পাদনে করেছেন মনস্বী শিশিরকুমার দাশ এবং চতুর্থটির সম্পাদক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক নিত্যপ্রিয় ঘোষ।এই দুই খন্ডে আছে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি রচনার প্রচুর নিদর্শন ।দুটি খন্ডের শীর্ষনাম ‘A Miscellany ‘।এ দুটি মহাকায় গ্রন্থে আছে নানা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ,নিবন্ধ,গ্রন্থসমালোচনা ,গ্রন্থ-ভূমিকা ,ভাষণ ,বক্তৃতা, ঘোষণাপত্র,নোবেল পুরস্কার গ্রহণ বক্তৃতাসহ বিবিধ সাক্ষাৎকার ,সংলাপ ,শুভেচ্ছাবার্তা,প্রয়াণ-লেখ –ইত্যাদি।বিষয় হিসেবে দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।সাহিত্য,ইতিহাস,বিশ্বরাজনীতি,দর্শন,চিত্রকলা,নাটক,সংগীত থেকে শিক্ষা, শিশুশিক্ষা,বিজ্ঞান,ভ্রমণ,এমনকি ভাষাচর্চার সমস্যা- সমস্ত মিলিয়ে এক নিজস্ব দুনিয়া। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব পর্যবেক্ষণ।গভীর বিশ্লেষণ।প্রথম প্রশ্ন ,কতজন এই লেখাগুলির পাঠক ?দ্বিতীয় প্রশ্ন এই ইংরেজি ভাষায় লেখা চিন্তাবীজগুলি বাংলায় তর্জমা হবে না ?আমি নিশ্চিত অনেকেই হাঁই  হাঁই করে উঠে এর সংখ্যা আর বিপুলতা দেখিয়ে নিরস্ত করতে চাইবেন।আমি কিন্তু কিছুতেই দমে যাবার পাত্র নই।বাংলাভাষায় এই রচনাগুলিকে ধারণ করা প্রয়োজন।এজন্য জাতিগতভাবে আমাদের সক্রিয় হওয়ার কথা ছিল ,বাংলাভাষায় রবীন্দ্রনাথের সমস্ত লেখা ধারণ করার গর্ব থেকে কি বাঙালি বিচ্যুত হচ্ছে ?এ ধরণের বড়ো কাজে আমি জানি ,নানাভাবে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগ। শুধু অর্থই নয় ,নানাস্তরের প্রশাসনিক এবং সঞ্চালনা সংক্রান্ত তত্ত্বাবধানেরও প্রয়োজনীয়তা আছে।বিশ্বভারতীর সাম্প্রতিক চেহারা দেখে এ প্রস্তাব নিয়ে বেশি এগোতে সাহস হয় না।বরং মনে হয় ,এসব কথা না তোলাই সমীচীন।এ কাজ কিন্তু সুদূরপ্রসারী অভিভবের সূত্রপাত ঘটাতে পারতো।এসব সময়ে একটি দীর্ঘশ্বাসই হয়তো একমাত্র যতিচিন্হ।                  

উত্থাপন করবো আর একটি প্রসঙ্গ।পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র রচনাবলীর চতুর্থ খন্ড ‘গান’ নিয়ে তৈরি।এখানে গানগুলো গীতবিতানের মতো ভাবমূল বা প্রসঙ্গ অর্থাৎ থীম দিয়ে পর্ব নির্দিষ্ট নয়। ‘প্রেম’ ‘পূজা’ ‘স্বদেশ’ ইত্যাদির বদলে সেখানে কালানুক্রমিক সজ্জা পরিবেশিত হয়েছে।এই খন্ডটির অত্যন্ত তন্নিষ্ঠ পুনর্বিবেচনা,সংযোজন ,সম্পাদনার প্রয়োজন।পাশাপাশি ,বিভিন্ন দিনে রবীন্দ্রনাথের সংগীত রচনার ইতিবৃত্ত নতুন নতুন গবেষণার ভিত্তি প্রস্তুত করতে পারে।আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি ,এক একটি দিনে নানা সময়ে হয়তো রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ভিন্ন -ভিন্ন মুড বা মেজাজের গান।তাদের ভাবকল্প আলাদা,থীম আলাদা ,সুরের চলন আর পরীক্ষাও আলাদা।এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথকে একেক সময়  মনে হয় দানব অথবা ঐশী জাদুকর।

                                ৩

গান রচনার প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের এই ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার একটা ছোট নিদর্শন পাওয়া যাবে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ‘যাত্রাপথের আনন্দগান ‘বইয়ের মধ্যে।নিজস্ব প্রতিভাবলে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় মার্গ সংগীতের নির্দিষ্ট কাঠামোগুলিকে আশ্চর্য যত্নে এবং প্রতিভায় তছনছ করে নতুন সব দিগন্ত উন্মোচন করতে পারতে(ন) তিনি।শৈলজারঞ্জনের গল্পটি আমি জানি ,প্রায় সবারই জানা।তবু একবার মনে করাই।১৯৩৯ সালের বর্ষামঙ্গলে মোট ষোলোটি গান শৈলজারঞ্জন অত্যল্প সময়ের মধ্যে চাপ দিয়ে রবি ঠাকুরকে দিয়ে লিখিয়ে নেন।সেই রোমাঞ্চকর বর্ণনা পড়লে বোঝা যায় সৃষ্টি নৈপুণ্যের কোন শিখরে পৌঁছেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই ক্ষমতা হয়তো প্রকৃতপক্ষে মানবিক নয়,অতিমানবিক। এই প্রক্রিয়ায় শাস্ত্রীয় রাগসঙ্গীতের ঋতু বা রাত্রিদিবসের ধ্রুপদী নির্দিষ্টতা মানেন নি রবীন্দ্রনাথ। ‘বর্ষামঙ্গল’ এর গান লেখাবার সময় শৈলজারঞ্জন এই পর্বে একেকটি রাগের নাম লিখে টেবিলে রেখে আসতেন সেই চাহিদা পূরণ করতেন রবীন্দ্রনাথ।আজ মনে হয় ,শৈলজারঞ্জন ভাগ্গিস এই বিনীত প্রার্থনা নিবেদন করেছিলেন। সন্দেহ হয় ,রবীন্দ্রনাথ কি এইসূত্রে নিজেকে পরখ করলেন ?দেখতে চাইলেন কতদূর তাঁর সৃষ্টিপ্রতিভা প্রসারিত হতে পারে ?দু-একটি দৃষ্টান্তমাত্র দিই।

শৈলজারঞ্জন লিখলেন ‘বেহাগ’।এলো -‘আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে’।লিখলেন ‘ইমন’।এলো ‘এস গো জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি ‘।’কীর্তন’ আর ‘বাউল’ লিখে আনার পর ,গুরুদেব পাঠালেন দুটি গান -‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে ‘ আর ‘শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে’।শেষে একদিন লিখলেন ‘বাগেশ্রী ‘।রবীন্দ্রনাথ প্রথমে অসম্মত হলেন। পরে লিখে পাঠালেন .’সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণধারা’।এ প্রায় অসম্ভব এক শিল্পঘটনা।

১৯৩৯ সালের এই ধারাবিবরণী পুরোটাই অমর্ত্য বিভায় আলোকিত।আমি তার অংশমাত্র পরিবেশন করলাম।ফিরে যাই সেই কালানুক্রমিক গানের প্রসঙ্গে।একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে ,ভাবকল্পের নিরিখে যেমন সকাল আর বিকেলের গান ,কোনো কোনোদিন সম্পূর্ণ ভিন্ন ,পাশাপাশি সুরের বা রাগিনীর প্রয়োগও চমকপ্রদ।আরো লক্ষ্য করার বিষয় অনেক।ঋতুসংগীতের ক্ষেত্রে যেমন ,পাঠক দেখতে পারেন ,রচনাকাল আর ঋতু কি সবসময় একই ,নাকি ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে অবস্থানকালে কল্পনায় রবীন্দ্রনাথ অন্য ঋতুর অনুভবকে স্পর্শ করছেন। Biographical Criticism  এর শৃঙ্খলে শিল্পীমন যে বাঁধা পড়েনা ,এ হয়তো তারই অন্যতম আভাস।

                               ৪

বহুদশক আগে ,১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে,রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘সৃজনী’ নামের একটি বড়োসড়ো সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল।সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন সত্যরঞ্জন সেন।এই ‘রবীন্দ্র শতবর্ষপূর্তি স্মারক সংকলন ‘-এ রবীন্দ্রসৃষ্টিপ্রবাহের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছিলেন সেযুগের রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞবৃন্দ।সঙ্গে ছাপা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের আঁকা কয়েকখানি ছবি ,ছিল পাণ্ডুলিপিও।আমি শুধু বিষয়বিন্যাসের শিরোনামগুলির দিকে নজর দিতে বলবো। শিল্পকথা,কাব্য,সাহিত্য,ধর্ম,দর্শন,মানবতা,সংগীত ,নৃত্য,নৃত্যনাট্য,নাটক,শিক্ষা,সমাজ,স্বদেশ, চিত্রকলা,সংগঠন,দেশভ্রমণ প্রভৃতি। সেভাবে এই গ্রন্থে আলোচনাই হয়নি বাংলা ছন্দ,বানান,ভাষাশৈলী বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার কথা। এই বিস্তৃত পরিধি যাঁর ক্ষেত্র,তাঁকে বুঝতে হয় জ্ঞান,বুদ্ধি,হৃদয় এবং আবেগ দিয়ে।আমি কোনো ধরনের ‘বিগ্রহবাদ’ কে কোনোভাবেই আমল দিতে রাজি নই।কিন্তু প্রচলিত অর্ধমনস্কতায় একটা রীতি তৈরি হয়েছে রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় লেখালেখিকে অসার সব যুক্তিতে খারিজ করে দেওয়ার।তাতে একধরণের অন্ধতা এবং প্রাক নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত জুড়ে থাকে।তার সঙ্গে মেশে কিছু বোধবুদ্ধিহীন,অনৈতিহাসিক আপ্তবাক্য।সমালোচনা  নয় ,একধরণের নস্যাৎ করে দেবার প্রবণতা। বামপন্থী এবং হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে এ ব্যাপারে আশ্চর্য সাদৃশ্য দেখা যায়।

রবীন্দ্রনাথের অত্যাশ্চর্য রচনার বহুদ্যুতিময় উদযাপন বাঙালি রসগ্রাহীদের হাতে বারংবার পরিবেশিত হয়েছে ।আমি তার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে দু -একটি সামান্য ‘অচেনা’ লেখালেখির দু- একটি কে উপস্থাপন কোরবো।প্রথমটি হিটলার,জাতিবিদ্বেষ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাঙ্গনিপূণ রবীন্দ্রনাথ।

‘ঐ শোনা যায় রেডিওতে বোঁচা গোঁফের হুমকি

দেশবিদেশে শহরগ্রামে গলা কাটার ধুম কী।

গাঁ গাঁ করে রেডিওটা ,কে জানে কার জিত

মেশিনগানে গুঁড়িয়ে দিল সভ্যবিধির ভিত।’

আমরা সকলেই জানি স্বদেশে বিদেশে এ ধরণের মুহূর্ত ,এ ধরণের ভয় ,এ ধরণের একনায়কের প্রতাপ ,এ ধরণের রক্তস্নাত সময় প্রায়শই দেখে দেয়।ফলে কোনোভাবেই এ ধরণের লেখার প্রাসঙ্গিকতা হারায় না।আমার তো বারংবার এ সময়ের ‘আধুনিকতা’,বিশেষত ঔপনেবিশেক ‘আধুনিকতা ‘র পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের এই সব অনবদ্য পংক্তি মনে পড়ে-

‘আদর করে মেয়ের নাম রেখেছে ক্যালিফোর্নিয়া

গরম হলো বিয়ের হাট ওই মেয়েরই দর নিয়া

মহেশদাদা খুঁজিয়া গ্রামে গ্রামে

পেয়েছে ছেলে ম্যাসাচুসেটস নামে

শাশুড়ি বুড়ি ভীষণ খুশি নামজাদা সে বর নিয়া

ভাটের দল চেঁচিয়ে মরে নামের গুণ বর্নিয়া’

এই দৃষ্টান্ত অনেক বাড়ানো যায়।আপাতত এই প্রসঙ্গে ইতি টানছি।

                           ৫

প্রখ্যাত রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের দুটি বেশ সমাদৃত গ্রন্থের নাম ‘রবীন্দ্র জীবন কথা ‘ এবং ‘রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জি’।এ দুটি বইতেই প্রভাতকুমারের অনিঃশেষ শ্রম ,মেধা এবং অন্তর্দৃষ্টির প্রমাণ ছড়িয়ে আছে । সে বইদুটি যেকোনো রবীন্দ্রপাঠকের নিত্যদিনের সঙ্গী।খুঁজতে খুঁজতে একটু অবাকই লাগে। দুটি বইতে কোথাও নেই ‘সহজপাঠ ‘প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগের উল্লেখ।প্রভাতকুমারের পক্ষে এই উদাসীনতা প্রায় অসম্ভব।অনুমান করি,শিশুপাঠ্য বই দুটিকে রবীন্দ্রনাথের সারাজীবনের বিপুল ,বিচিত্র,বহুতরঙ্গিত গ্রন্থাবলির প্রবাহে হয়তো একটু লঘু ,একটু তাৎপর্যহীন বা অকিঞ্চিৎকর মনে হয়েছিল তাঁর।অথচ,আজ মনে হয় ,বাংলা শিক্ষা সাহিত্য অঙ্গনে বই দুটির গুরুত্ব এবং প্রভাব অপরিসীম।উল্লেখ করে রাখা ভালো ,সহজপাঠ ৩ এবং সহজপাঠ ৪ প্রকাশিত হয়েছিল বিশ্বভারতী থেকেই ,যদিও সেখানে রবীন্দ্রনাথ সহ অন্যান্য অনেকের রচনা সংকলিত হয়েছিল।সহজপাঠ ১ এবং সহজপাঠ ২ প্রকৃতপক্ষে এক আশ্চর্য উদ্ঘাটন।দীঘদিন ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই বইটির হাত ধরে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের অতুলনীয় ভূখণ্ডে প্রবেশাধিকার লাভ করছে।কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন ,’যে বয়সে ক -খ চিনলেই যথেষ্ট সেই বয়েসেই সাহিত্যরসে দীক্ষা দেয় ”সহজ পাঠ”;এই একটি বইয়ের জন্য বাঙালি শিশুর ভাগ্যকে জগতের ঈর্ষাযোগ্য মনে করি।’ জগতের এতকালের ইতিহাসে কোনোদিন শুনেছেন নোবেল পুরস্কারে ভূষিত কোনো কবি একেবারে বিদ্যালয়ের প্রথম পুঁথি বা প্রাইমার (Primer ) রচনা করেছেন ?

সহজপাঠ প্রথম এবং দ্বিতীয়ভাগ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে।এই সালটি রবীন্দ্রনাথের নানা কর্মচঞ্চলতায় উথালপাথাল।এই বছরই প্যারিসে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী  হচ্ছে, যাচ্ছেন রাশিয়ায়,যাচ্ছেন শেষ সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।সহজপাঠ রচনার প্রথম খশড়া অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে ১৩০২ -১৩০৩ বঙ্গাব্দের কোনো এক  সময়ে।নিজের সন্তানদের ভাষাসাহিত্য শিক্ষার কথা ভেবেই হয়তো সহজপাঠ এর প্রাথমিক পরিকল্পনা। প্রথম ভাগে দশটি পাঠ আর দ্বিতীয়ভাগে তেরোটি পাঠ। দুটি বইতেই গদ্যপদ্য মিলিয়ে এই পাঠগুলি তৈরি হয়েছে।বাঙালি মনের সাংস্কৃতিক নির্মাণে এই দুই পয়লা পুঁথি বিরাট ভূমিকা পালন করেছে।তাদের হাত ধরে নিয়ে গেছে সাহিত্য আস্বাদনের বিপুল সমুদ্রজলে।

এই প্রসঙ্গে দুটি বা তিনটি উদাহরণ টেনে আনবো।প্রথম হলো ,দুই পর্বেই রবীন্দ্রনাথ গদ্যরচনার  ফাঁকে ফাঁকে জুড়ে দিয়েছেন এক ধরণের গীতিময়তা।ছন্দ আর গান মিলেমিশে গদ্যাংশগুলিকে নিয়ে গেছে ধ্বনিসাম্যের এক অনবদ্য সুষমায়।যেমন ধরা যাক –

ক) ‘বেলা হল।মাঠ ধূ ধূ করে ।থেকে থেকে হূ হূ হাওয়া বয়।দূরে ধুলো ওড়ে।চুনি মালী কুয়ো থেকে জল তোলে ,আর ঘুঘু ডাকে ঘূ ঘূ ‘।

খ )’পূর্ব দিকের মেঘ ইস্পাতের মতো কালো। পশ্চিমদিকের মেঘ ঘন নীল।সকালে রৌদ্র ছিল ,নিশ্চিন্ত ছিলাম।’

যতিচিহ্নের সুমিত ব্যবহারে এবং দীর্ঘ ,মাঝারি,ক্ষুদ্র বাক্যের ধ্বনিবিন্যাসে এক সুর স্পন্দিত হচ্ছে। এই স্পন্দটি বাংলা গদ্যের এক অভূতপূর্ব পরীক্ষা।

কবিতাগুলিতে কী আশ্চর্য কল্পনাবিস্তার। শিশুমনে এই কল্পনাই স্থায়ী এক আবেশ রেখে যায়।

ক ) ‘ঘন মেঘ বলে ঋ ,দিন বড় বিশ্রী’

খ)  ‘বায়ু দিকে দিকে ফেরে ডেকে ডেকে সকলেরে’

গ)’আমলকী বন কাঁপে যেন তার বুক করে দুরুদুরু

    পেয়েছে খবর পাতা খসানোর সময়ে হয়েছে শুরু।’

তিনটি ক্ষেত্রেই সহজ সরল প্রায় যুক্তাক্ষরবর্জিত উচ্চারণে শিশুকে যেন ‘সুদূরের পিয়াসী’করে তোলা হচ্ছে।সে বুঝতে পারছে,এই বিশ্ব থেকে মহাকাশ সর্বত্রই প্রাণের হিল্লোল ,প্রাণের হাতছানি।

সেজন্য বায়ু থেকে মেঘ,গাছ থেকে নদীজল সবাই প্রাণের চিহ্নে চঞ্চল।আর আছে চোখ ধাঁধানো মনভোলানো রঙের বিস্তার –

i ) রাতে হবে আলো/লাল বাতি /নীল বাতি

ii )দাদা যায় হাটে/গায়ে লাল জামা/মামা যায় খাতা হাতে/গায়ে সাদা শাল

iii )সেথা করে আসা যাওয়া /নানারঙা মেঘগুলি

iv ) শীতের বেলা দুই পহরে/দূরে কাদের ছাদের ‘পরে/ছোট্ট মেয়ে রোদ্দুরে দেয় /বেগনি রঙের শাড়ি

v )মুখের চাদর সরিয়ে ফেলে /বন্ধ চোখের পাতা মেলে /আকাশ ওঠে জেগে

দৃষ্টান্ত কিংবা  ব্যাখ্যা কোনোটাই আর বাড়াবোনা।

‘যেটা যা হয়েই থাকে সেটা তো হবেই

হয় না যা তাই হলে ম্যাজিক তবেই।

নিয়মের বেড়াটাতে ভেঙে গেলে খুঁটি

জগতের ইস্কুলে তবে পাই ছুটি ।’

লিখেছিলেন পরিণত বয়সের রবীন্দ্রনাথ।সমগ্র জীবন ধরে তিনি এই ম্যাজিককেই অনবরত গড়েছেন, আমাদের উপহার দিয়েছেন।ভাঙা এবং গড়ার এই মহাভাস্বরতায় ঝলমল করছে তাঁর সৃষ্টিভুবন সেখানেই জন্মদিনে আমার নতজানু প্রণিপাত।সত্যিই এক  never ending ritual’          

অভীক মজুমদার বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক,অধ্যাপক- তুলনামুলক সাহিত্য বিভাগ – যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ : ‘সিন্ধুলিপি’(২০১৫), ‘ভিক্ষাপাত্র’ (২০১৫), ‘পাগলের সঙ্গ করো’।                                     

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *