ডেঙ্গু ফিভার ,যা এই মুহূর্তে শহরে একটা ভীষণ উদ্বেগ আর আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই বিষয়ে কথা বলতে চাই।ডেঙ্গু ফিভার বলতে আমরা কী বুঝি ।ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাল অসুখ।মশার কামড়ে একটা ভাইরাস মানুষের ব্লাড সার্কুলেশনে চলে আসবে,এবং আসার পরে মাল্টিপ্লাই করে যে টক্সিন থাকে সেটা ম্যানিফেস্টেশন হয় তাকেই ডেঙ্গু বলা হয়।
এর ৫টি লক্ষণ আছে – জ্বর,মাথাব্যথা,শরীরে ব্যাথা,বমি ভাব আর স্কিন র্যাশ যা নিয়ে রুগী ডাক্তারের কাছে আসে।একটা মশার কামড়ের পরে যদি তাতে ডেঙ্গু ভাইরাস থাকে তার ইনকুইবেশন পিরিয়ড হল এক থেকে দু সপ্তাহ মানে ১৪/১৫ দিনের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তাই যে অঞ্চল ডেঙ্গু প্রবণ অর্থাৎ জল জমে আছে এমন জায়গায় যদি কেউ অসতর্ক হন সেখানে মশা কামড়ের ফলে ডেঙ্গু হতে পারে ।ডেঙ্গুর মশা সাধারণত ভোরে অথবা সন্ধ্যেবেলায় কামড়ায় তাই এই সময়ে ও এই ধরণের জায়গায় সতর্ক ও পারলে এড়িয়ে যাওয়া উচিত ।বিশেষত বাচ্চা ও বয়স্করা যদি ফুল হাতা পোশাক ,পায়ে জুতো মোজা থাকলে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ,অসুবিধে হলেও ,সম্ভব হলে যদি কান মাথা ঢাকা দেওয়া যায়।এইভাবে বাইরে ডেঙ্গু বাহিত মশার কামড় রুখতে পারি আর বাড়িতে মস্কুইটো রেপেলেন্ট ব্যবহার করা ,সম্ভব হলে পেস্টিসাইড স্প্রে করা,এবং বিশেষ করে যেখানে মশার প্রাদুর্ভাব বেশি সেখানে সন্ধ্যের সময়ে ও পরে দরজা জানলা বন্ধ করে রাখা,বাড়ির মধ্যে জমা জল ,যেমন ফুলদানি ,সেই জল নিয়মিত বদল করা ,এছাড়া বাথরুমে কোথাও জল জমে আছে কিনা নজর রাখা ,বাড়ির আসে পাশে এমন কোনো জায়গা যেখানে ময়লা বা পুরোনো ভাঙা জিনিসে যাতে জল না জমে সেদিকে সতর্ক থাকা যাতে সেখানে মশার লার্ভা থেকে ডিম পাড়তে না পারে।এভাবে আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে পারি।
ডেঙ্গুর প্রথম দু তিন দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ সেই সময়ে টেম্পারেচার বেশি থাকে ,ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করতে হয় এবং নিউট্রেশন আর ফ্লুইড এগুলো যদি অপর্যাপ্ত হয় তাহলেই কিন্তু তাহলেই কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অসুখের জটিলতা বাড়ে তাই এই সময়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে। বেশি জ্বর হলে প্রথমেই ব্লাড টেস্ট করে শুধু ডেঙ্গু নয় ,ম্যালেরিয়া থাকলেও তাকে নির্মূল করতে হবে। যদি দেখা যায় ম্যালেরিয়া নয় কিন্তু ব্লাড কাউন্ট কম যাকে চিকিৎসা পরিভাষায় লিউকোপেনিয়া বলা হয় সেখানে প্লেটলেট না কমলেও WBC কাউন্ট কমে যায় যার ফলে শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম একটু কমজোরি হয়ে যায় এবং বিশেষ করে মনে রাখা দরকার এই সময়ে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য ওষুধ খাওয়ার কথা নয়।সিম্পটোমেটিকালি হয়তো বমির একটা ওষুধ খাওয়া যেতে পারে কিন্তু সেই সময়ে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বা স্ট্রং অ্যানালজেসিক এড়িয়ে যেতে হবে। এছাড়া ৩ থেকে ৪ দিনের সময় যখন জ্বরের প্রকোপ কমে আসে সেই সময়ে WBC ও প্লেটলেট কাউন্ট একটু নিচের দিকে নেমে যায় তখন যদি রোগীর সঠিক হাইড্রেশন না হয় সেই সময়ে ব্লাড প্রেশার ফল করা ,প্লাজমা লিকেজ হয়ে অ্যালবমিন ফল করে অ্যাবডোমেনে ফ্লুইড জমার সম্ভাবনা থাকে।ওই সময় রোগী একদম খেতে পারে না ,গা গুলোয় ,উঠে দাঁড়ালে মাথা ঘুরে যেতে পারে সেক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকা উচিত যদি রোগী বাড়িতে থাকে ,তাই এই লক্ষণ যদি বেশি হয় তাহলে রোগীকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত।
হসপিটালে এলে আমরা আইসোলাইট অর্থাৎ যেখানে গ্লুকোজ থাকে ,স্যালাইন থাকে সেগুলো যথেষ্ট পরিমাণে সাপ্লিমেন্ট করা হয় ,তাতে ব্লাড প্রেশার মেন্টেন করে এবং প্লেটলেট ফল কাউন্টকে আটকানো যায়। ডেঙ্গুর অসুখে ৪ থেকে ৭ দিন হচ্ছে খুব সঙ্কটকালীন কারণ যদি কোনো রোগীর অবস্থা ভালো না থাকে ,প্লেটলেট কমে গিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্লিডিং হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাধারণত যদি প্লেটলেট উল্লেখযোগ্য ভাবে না কমে যায় ,অর্থাৎ ২০০০০ থেকে ১৫০০০ নেমে গেলেও প্লেটলেট দেওয়া হয়না কিন্তু যদি ব্লিডিংয়ের ম্যানিফেস্টেশন থাকে সেক্ষেত্রে প্লেটলেট দেওয়া হয়।এই সময়ে সেকেন্ডারি ইনফেকশনের চান্স বেড়ে যায় ,যেমন সর্দি-কাশি,পেট খারাপ সেগুলোকে আমরা সিম্পটমেটিক্যালি চিকিৎসা করার চেষ্টা করি।
৭ দিন পেরোনোর পর আরোগ্য হতে শুরু হয় ,ব্লাডের প্যারামিটারসের উন্নতি হয়,একটা সুস্থতার লক্ষণ আসে,খাওয়া দাওয়ায় আগ্রহ বাড়ে ,কিন্তু এর পরেও ১ সপ্তাহ বিশ্রামে থাকা উচিত আর সেই সময়ে সঠিক নিউট্রিশন আর বিশ্রামের ওপরেই আরোগ্য নির্ভর করে। বিলিরুবিন,এসজিপিটি এই ধরণের এঞ্জাইম্স গুলো বেড়ে যাওয়ার কারণে যে রোগী খেতে পারেনা ,অরুচি একে স্বাভাবিক অবস্থায় আসার সময় দিতে হবে যেটা পরিপূর্ণ বিশ্রামেই সম্ভব আর ২/৩ সপ্তাহের মধ্যেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।
সেইজন্য ডেঙ্গুর কারণে আতঙ্ক ও ভয় পাওয়ার কারণ নেই কিন্তু এটা বুঝতে হবে কোন সময়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত ,ব্লাড টেস্ট ঠিক সময়ে করা উচিত ,প্রথম টেস্টে আমরা ডেঙ্গু ns1 পসিটিভ পাই ,৭ দিনের পরে ডিঙি আইজি এম,আইজি জি ইমিউনোলোজিক্যাল টেস্ট যেটা পসিটিভ আসা মানে ডেঙ্গুর সঙ্গে লড়াই করার অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায় যার ফলে ডেঙ্গু ভাইরাস মারা যায় আর রোগী সুস্থ হতে শুরু করে।
আপনারা জানলেন আর মনে রাখবেন ডেঙ্গুর কারণ,সতর্কতা ,হলে আতঙ্কে না থেকে কী করবেন,কি করে সাবধান হবেন ,ঠিক সময়ে ডাক্তার দেখানো ,ব্লাড টেস্ট,প্রপার ফ্লুইড সলিউশন্স মেন্টেন সেগুলো ঠিক রাখা,প্লেটলেট ফল করলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া কারণ বাড়িতে থাকলে জীবন বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রামের সময়।
বিদেশে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন এলেও এদেশে তত সুলভ নয়।অনেক সময়ে ডেঙ্গুর ns1 ,আই জি জি,আই জি এম পসিটিভ আসেনা অন্য ধরণের ভাইরাল ফিভারও হতে পারে সেগুলোকে অবহেলা করা উচিত নয় ।কিছু জায়গায় ডেঙ্গু পি সি আর টেস্ট হয় যাতে অনেক আগে ডেঙ্গুর প্রকোপ সনাক্ত করা যায় আর ম্যালেরিয়ার লক্ষণ যেহেতু প্রায় একই হয়ে থাকে তাই তাকেও ব্লাড টেস্ট করে রোগমুক্ত হতে হবে।
ডঃ শুভাশিস গাঙ্গুলি -এম ডি,কনসালটেন্ট ফিজিশিয়ান & কার্ডিওলজিস্ট ।অ্যাপোলো,আমরি,টেকনো গ্লোবাল হসপিটালসের ভিজিটিং কনসালটেন্ট।চেম্বার -১২ হরিনাথ দে রোড,এম এন চ্যাটার্জি মেমোরিয়াল আই হসপিটাল,২৯৫/১ এ পি সি রোড,(রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের বিপরীতে )। ফোন – 9831081811 ,7044227928 , 9007824699
*এই নিবন্ধটি সাধারণ তথ্যের জন্য যা কোনোভাবে ওষুধ আর চিকিৎসার বিকল্প নয়। অসুখ হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
শেয়ার করুন :