গ্ল্যাডিয়েটর -

ছবি- শুভেন্দু সরকার

গ্ল্যাডিয়েটর

“কালকে যে জিতবে,তাকে সম্রাট টাইটাস মুক্তি দেবেন শুনলাম”…

অন্তরা চ্যাটার্জি

“এদিকে আরো একটু মাংস আর সব্জি…”

গলা তুলে বলল মার্সেলাস।

সঙ্গে সঙ্গে ডাইনিং হলের অন্যপ্রান্ত থেকে দ্রুতপদে দুজন পরিবেশনকারী এগিয়ে এল মার্সেলাসদের টেবিলে।একজনের ডেকচিতে ঘন ঝোলভর্তি ভেড়ার মাংস আর একজন এনেছে বিন আর কড়াইশুঁটি সিদ্ধ।রুটি ও ফলভর্তি ঝুড়ি নিয়েও এগিয়ে এল আরেকজন।মার্সেলাসদের টেবিলে গোল হয়ে বসেছিল ক্যাসিয়াস,তাফারি,এটিকাস কোয়ামে,মুসিনাস,বাটো,ভিক্টর,সিমাচিয়াস,ক্যালেন্ডাসরা।যে যতটা পারল মাংস,সব্জি আর ফল তুলে নিল পাতে।আগামীকাল কলোসিয়ামে ওদের মহাযুদ্ধের প্রদর্শনী।কালকের সূর্যের আলো দেখলেও রাতে চাঁদের রশ্মি কে বা কারা দেখতে পাবে,কেউ জানেনা।তাই আজ রাতে ওদের লাস্ট সাপার বা শেষ ভোজের অনুরূপ আয়োজন করা হয়েছে।যত সব সুখাদ্য যে যত খুশি খাবে।অবশ্য এমনিতেই রোমের সবথেকে নামী প্রশিক্ষণশালা লুডুস ম্যাগনাসে ওরা নিয়মিতভাবে যথাযথ পরিমাণে পুষ্টিকর সুস্বাদু খাদ্য পায়।ওদের প্রশিক্ষণশালার মালিক ল্যানিস্টা সিলিয়াস ওদের শরীরস্বাস্থ্য যাতে ভালো থাকে,শরীরের প্রতিটি পেশী যাতে থাকে সচল ও কর্মক্ষম,অনাবশ্যক মেদ যাতে না জমে,দিনে একবার,প্রয়োজনে দুবার ঠান্ডা বা গরম জলে যাতে স্নান করতে পারে,যাতে ওদের রাতে সুনিদ্রা হয়,সেইসব খুঁটিনাটি ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নবান।কিন্তু যতই যত্নে থাকুক,একমাত্র  ক্যাসিয়াস ছাড়া ওরা সবাই ল্যানিস্টা র দাস।শুধু এই প্রশিক্ষণশালারই নয়,ওদের জীবন,পরিবার ও যেটুকু সম্পত্তি আছে সে সব কিছুরই মালিক তিনি।

ওরা সবাই গ্ল্যাডিয়েটর।এদের মধ্যে শুধুমাত্র ক্যাসিয়াস পেশাদার।সে এসেছে এই ভয়ঙ্কর মরণপণ খেলোয়ারি পরোয়ানা স্বেচ্ছায় মাথায় নিয়ে বিপুল অর্থ ও যশলাভের আশায়।তাফারি ও কোয়ামে হল রোমের বাজারে বিক্রি হওয়া আফ্রিকান ক্রীতদাস।বাটো একজন যুদ্ধবন্দী।জন্মসূত্রে সে সিরীয়।বাকিরাও প্রায় সবাই তাই।মার্সেলাস ছিল রোম শহরের এক মধ্যবিত্ত অস্ত্রনির্মাতা ও ব্যবসায়ী।বর্তমান সম্রাট টাইটাসের বিরুদ্ধে রোমান সেনাবাহিনীর একাংশের বিদ্রোহের ষড়যন্ত্রে পাকেচক্রে তার নাম জড়িয়ে পড়ে এবং সে গ্রেফতার হয়।রোম শহরের প্রান্তে যেটুকু সম্পত্তি ও সামান্য জমি ছিল তা বাজেয়াপ্ত করা হয়,তার গর্ভবতী স্ত্রীকে করা হয় নজরবন্দি।কিন্তু ইতিমধ্যে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে তার স্ত্রী।বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা এবং সুস্বাস্থ্যের কারণে তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার বদলে গ্ল্যাডিয়েটরিতে নিয়ে আসা হয় এবং ল্যানিস্টা সিলিয়াসের এই প্রশিক্ষণশালায় প্রায় দেড় বছরের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।এখন সে একজন সেকিউটর অর্থাৎ যারা বড় ঢাল এবং ভারী গ্ল্যাডিয়াস বা তরোয়াল নিয়ে লড়াই করে।তার মুখে থাকে ধাতব মুখোশ ও মাথায় শিরস্ত্রাণ এবং বাঁ হাত ও কাঁধে ধাতব আবরণ। একই সঙ্গে আক্রমণ ও আত্মরক্ষায় সমানভাবে দক্ষ এই সেকিউটররা।আরো নানা বিভাগ আছে গ্ল্যাডিয়েটরদের মধ্যে।মুর্মিলোৱা আবার বড় ছোরা নিয়ে,ঢাল নিয়ে শুধুমাত্র মাথায় শিরস্ত্রাণ ও হাতের ধাতব বর্ম পরে লড়ে।আছে রেটিয়ারিরা,যারা মৎস্যজীবীদের মতো জাল আর ত্রিশূল নিয়ে ময়দানে নামে।দুহাতে দুটি তলোয়ার,কিংবা বর্শা,বল্লম ও ঢাল নিয়ে লড়ে এমন গ্ল্যাডিয়েটররাও আছে।বেষ্টিয়ারিরা বাঘ,সিংহ,হাতি,কুমির,ভল্লুকের মতো ভয়ঙ্কর প্রাণীর সঙ্গে লড়াই করে।কর্পোফোরাস নামে একজন বেষ্টিয়ারি একা প্রায় খালি হাতে এরকম কুড়িটি পশুকে যুদ্ধাঙ্গনে হত্যা করতে সমর্থ হন ও প্রবল জনপ্রিয় হন।আছে ল্যাসেরিয়াসরা,ওরা যুদ্ধে নামে শুধুমাত্র ফাঁসযুক্ত দড়ি নিয়ে,তাদের মজবুত বর্ম ও শিরস্ত্রাণ থাকেনা।তবে কোন অস্ত্র বা বর্ম নিয়েই লড়ার অনুমতি নেই নক্সি আর ড্যামনাটিদের।থাকলে থাকে চক্ষুকোটরহীন ব্রোঞ্জের শিরস্ত্রাণ ও মরচে পড়া পুরনো ভোঁতা তলোয়ার।অর্থাৎ অন্ধ ও এক অর্থে নিরস্ত্র হয়েই লড়তে হয় এদের।এরা আসলে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত অপরাধী।সবসময়,এমনকি খাওয়া এবং শোয়ার সময়েও হাতে পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে রাখা হয় তাদের।ময়দানে গ্ল্যাডিয়েটরদের সামনে এদের খালি হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং বলাই বাহুল্য অসম লড়াইয়ে স্বল্পক্ষণের মধ্যেই তাদের প্রাণ যায় দক্ষ গ্ল্যাডিয়েটরদের হাতে।

খাওয়াদাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কথাবার্তা চলছে।আগামীকাল কলোসিয়ামের বিশেষ আকর্ষণ মার্সেলাস ও বাটোর দ্বন্দ্বযুদ্ধ।এরা দুজনেই রোমের জনপ্রিয় গ্ল্যাডিয়েটর।বিগত পাঁচ বছরে অন্তত সাত আটটি কঠিনতম লড়াইয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে লড়ে এরা জয়ী হয়ে টিকে আছে।রোম নগরীর মানুষের সীমাহীন কৌতূহল এদের দুজনের আগামীকালের দ্বন্দ্বযুদ্ধ নিয়ে।

“কালকে যে জিতবে,তাকে সম্রাট টাইটাস মুক্তি দেবেন শুনলাম”,বলল তাফারি।

“মুক্তি?আগে লড়াইয়ে জিতে বাঁচি!তারপর তো মুক্তির প্রশ্ন!”বললো মার্সেলাস।

“এই অন্ধকূপ থেকে বেরিয়ে দেশে ফেরা,মানুষের মতো জীবনযাপন করা সবই স্বপ্নের মতো মিথ্যা লাগে।বাবা মা হয়তো আর বেঁচে নেই,কিন্তু স্ত্রী পুত্র নিশ্চয়ই বেঁচে আছে।মরার আগে একবার কি পরিবারের সঙ্গে দেখা হবেনা?ঈশ্বর কি আমাকে একবারও করুণা করবেন না?”বাটোর গলা থেকে কথাগুলো যেন ঝরে পড়ল চাপা কান্না আর প্রার্থনা হয়ে।

“মুক্তি ছাড়া জীবনের কাছে আর কিছু কামনীয় আমারও নেই।কিন্তু ঈশ্বরের কৃপা আর ভাগ্যের জোর ছাড়া তা তো সম্ভব নয়।”দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো মার্সেলাস।

কথাবার্তার মাঝখানে একবার প্রহরী এসে তাড়া দিয়ে গেলো।ল্যানিস্টার নির্দেশ আজ বেশিক্ষণ রাতজাগা চলবেনা।অতএব আসর তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে।

“তাহলে অদ্যই শেষ রজনী,ভাই?”বাটোকে আন্তরিক স্বরে বললো মার্সেলাস।

বাটো গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো,”কাল থেকে আমরা আর কেউ ভাই বা বন্ধু নই,আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী।আমি মুক্তি চাই।দেশে ফিরে দেশের মাটিতে মরতে চাই।এছাড়া জীবনে আমারও আর কিছু চাওয়ার নেই।এজন্য যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছলে বলে কৌশলে হত্যা করতে আমার এতটুকুও হাত কাঁপবে না,মনে রেখো।”

গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লো মার্সেলাস।ঠিকই।আগামীকাল দুজনের মধ্যে যেকোন একজন বাঁচবে।কারোরই হাত কাঁপবে অন্যকে মারতে।

ভোজপর্ব শেষ হতে চলেছে।বিশাল হলঘরের বৃহদাকার কাঠের টেবিলগুলো ক্রমশ খালি হয়ে আসছে।বড় বড় মশালগুলো একে একে নিভে আসাতে পাথরের দেওয়ালে দেওয়ালে নাচতে থাকা আলোছায়ার খেলাও ক্রমে ক্রমে শেষ হয়ে আসছে।মার্সেলাস ও তার সঙ্গীরা একে অপরকে আলিঙ্গন করে বিদায় নিলো।মার্সেলাস রওনা দিল অস্ত্রাগারের দিকে।তার সঙ্গে পাহারা দিয়ে চলছে দুজন সশস্ত্র প্রহরী।সে কালকের লড়াইয়ের জন্য একটি নতুন বর্ম বেছে নেবে।তার আগের বর্মটা গতবারের লড়াইয়ে অস্ত্রের আঘাতে দুতিন জায়গায় তুবড়ে ও ফুটো হয়ে গেছে।একটা নতুন শিরস্ত্রাণ ও পায়ের আবরণও তার দরকার।

মশালের আলোয় আলোকিত অলিন্দ পেরিয়ে একটা ছোট দরজা দিয়ে অস্ত্রাগারে ঢুকল মার্সেলাসরা।নানাবিধ অস্ত্র ও বর্মের বিস্ময়কর ভান্ডার থেকে সে বেছে নিল ট্রয়ের যুদ্ধের দৃশ্যখচিত পালক লাগানো একটি শিরস্ত্রাণ,দেবী আথিনার মূর্তিখচিত ধাতব পদাবরণ এবং রুপোর হালকা নকশা করা একটি লোহার বর্ম।সম্পূর্ণ সোনা বা রুপোর বর্মও রয়েছে সেখানে,কিন্তু সেগুলি প্রকৃত যোদ্ধারা কেউই নেয় না।সম্রাট বা রাজা রাজড়াদের কখনো কখনো শখ হয় ময়দানে নেমে লড়াইয়ের খেলায় মেতে ওঠার,তখন এই জাতীয় শৌখিন বর্ম তাঁরা অঙ্গে ধারণ করে থাকেন।অবশ্যই তাঁদের সেই লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে হেরে যেতে হয়।অনেক সময় হিংস্র পশুদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সাধ হয় তাঁদের।তখন বাঘ,ভল্লুকের থেকে উঁচুতে একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে তাদের অস্ত্রে বিদ্ধ করেন তাঁরা।

বাছাই শেষ হলে তার প্রিয় তরোয়ালটির মসৃণ গায়ে একবার হাত বুলিয়ে সে অস্ত্রাগারের বাইরে বেরিয়ে একই অলিন্দ পেরিয়ে মার্সেলাস  চলে এল তার নিজের কক্ষে।প্রহরীরা চলে গেলে সে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল তার একফালি ঘরের ছোট শয্যায়।ঘরে একটিই ক্ষুদ্র পাল্লাবিহীন জানলা।পাথরের ভারী দেওয়াল ছাড়া কিছুই দেখা যায় না সেই জানলা দিয়ে।বিছানায় শুয়ে দূরের কোন একটি মশালের আলোয় স্বল্পালোকিত সেই দেওয়ালের দিকেই শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মার্সেলাস।প্রায় সব রাতই নিদ্রাহীন কাটে তার।আজ রাতে তো তার আর ঘুম আসার কোন সম্ভাবনাই নেই।

জানলার বাইরে পাথরের দেওয়ালটা ভেদ করে বহুদূর উড়ে চলল মার্সেলাসের মন তার স্মৃতির ডানায় ভর করে।রোম শহরের প্রান্তে ছিলো তার সেই ছোট ঘাসজমিওয়ালা বাড়ির লাগোয়া ছোট অস্ত্র কারখানা,যেখানে তার জন্য ও তার জনকয়েক কর্মচারীদের জন্য সকালে ও দুপুরে নিয়মিত নিজে হাতে খাবার রেঁধে আনতো তার স্ত্রী কর্নেলিয়া,একসাথে সবাই মিলে খেতো।পূর্ণিমার রাতে বাড়ির সামনে অলিভগাছটার নিচে হাতে হাত রেখে বসে থাকত দুজনে,ভবিষ্যতের সাদামাটা স্বপ্ন বুনতো।তার তৈরি অস্ত্রের সুনাম ও সুলভতার কথা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিলো রোম শহরে।অনেকেই অস্ত্র কিনতে আসত তার কাছে।কি করে জানবে মার্সেলাস এদের মধ্যে কারা ছিল বিদ্রোহী সৈন্য?একদিন দুপুরে খাওয়ার সময় তার বাড়িতে চড়াও হয় সরকারী আইনরক্ষক বাহিনী, টেনে হিঁচড়ে বিনা বিচারে কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো তাকে।তারপর সে এলো ল্যানিস্টার এই প্রশিক্ষণকেন্দ্রে।তারপর মাসের পর মাস তরোয়াল চালনার নিরন্তর কঠোর অনুশীলন করে গেছে মার্সেলাস শুধুমাত্র একটি আশায়।মুক্তি।একজন গ্ল্যাডিয়েটর পরপর কঠিন লড়াইয়ে প্রবল প্রতিপক্ষকে যদি হারাতে পারে,তাহলে সর্বোচ্চ পুরস্কার হিসেবে তার মালিক অর্থাৎ ল্যানিস্টা বা সিজার তাকে জনসমক্ষে মুক্ত নাগরিক ঘোষণা করতে পারেন।এ ব্যতীত আত্মহত্যা ছাড়া একমাত্র মুক্তির উপায় হল অবসর গ্রহণ।সেটা প্রথমত চল্লিশ পয়তাল্লিশ বয়স অবধি লড়াই করে বেঁচে থাকলে,এবং অবশ্যই তা সিজার বা তার মালিকের ইচ্ছায়,নিজের ইচ্ছায় নয়।অবসরপ্রাপ্ত গ্ল্যাডিয়েটরদেরও অনেকসময় প্রশিক্ষক বা রেফারী হতে বাধ্য করা হয়। স্ত্রী ও অনাগত সন্তানের হৃদয়বিদারক মৃত্যুসংবাদ পেয়ে মার্সেলাস দেওয়ালের পাথরে মাথা কুটে কাঁদতে কাঁদতে অনেকবার নিজের অস্ত্রে গলা কেটে আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছে ।পারেনি।মুক্তি যদি মেলে,এই সুন্দর পৃথিবীর মুক্ত আকাশের নীচে আরেকবার দাঁড়িয়ে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার বড় ইচ্ছে তার।তবে বাড়ি ফেরার আর মন নেই মার্সেলাসের।কি জন্য ফিরবে?কার জন্য ফিরবে?দরজা খুললেই তো ফাঁকা ঘরের শূন্যতা হাঁ করে গিলতে আসবে মার্সেলাসকে।ঘরে ঘরে বোধহয় এতদিনে ধূলোর পাহাড় জমেছে।সাপখোপ ছুঁচো ইঁদুরেরা ডেরা বেঁধেছে আনাচেকানাচে।বাড়ির সামনের ঘাসজমিতে কর্নেলিয়ার নিজে হাতে তৈরি করা গোলাপবাগান এতদিনে নিশ্চিত শুকিয়ে শেষ হয়ে গেছে!যদি মুক্তি মেলে তাহলে বিগত পাঁচ বছরের লড়াইয়ে যা পুরস্কারমূল্য পেয়েছে সে, সেটুকু নিয়ে সে ভ্রমণে বেরোবে।সে যাবে পম্পেই শহরে,অস্টিয়া এন্টিকা বন্দরে,নানা অচেনা মানুষের সঙ্গে পরিচয় করবে,আলবান পর্বতের পাদদেশে ছবির মতো গ্রাম আর আঙ্গুর ক্ষেতগুলোতে ঘুরে বেড়াবে।আর তারপর যদি ইচ্ছে হয়,কিছু অর্থ বাঁচে,না হয় নিজের ভিটায় ফিরে আসবে সে,মৃত্যুর পর প্রিয় অলিভ গাছটার তলায় তার আর কর্নেলিয়ার পাশাপাশি দুটো সমাধিফলক স্থাপনের ব্যবস্থা করে যাবে।

তবে হ্যাঁ,সবই সম্ভব যদি..যদি কালকের মহাযুদ্ধে সে আদৌ জিতে উঠতে পারে।প্রতি লড়াইয়ের আগেই এই বিরাট “যদি”টা সীমাহীন অনিশ্চয়তার একটা কালান্তক খড়্গের মতো ঝুলতে থাকে তার মতোই সব যোদ্ধাদের সামনে।এই কয় বছরের মধ্যে কতজনই তো এলো গেলো।খনি শ্রমিক পলিনাইকাসের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হয়েছিল মার্সেলাসের।পরপর তিনটি লড়াইয়ে জেতার পর চতুর্থবারের লড়াইয়ে মরতে হয় তাকে।আরেক যোদ্ধা গায়াস ময়দান থেকে জিতে ফিরেও চোট আঘাতের জের সহ্য করতে পারলো না।তরোয়াল নিয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়তে লড়তে তাকে মোকাবিলা করতে হয় একটি বাঘের সঙ্গে।প্রতিপক্ষ ও বাঘটিকে অসম সাহসিকতার সঙ্গে লড়ে হত্যা করতে সমর্থ হয় সে,স্বর্ণমুদ্রা ও বিজয়ীর সেরা সম্মান লরেল পাতার মুকুটও পুরস্কার পায়।কিন্তু মাথায় ভয়ঙ্কর চোট ও বাঘের নখের গভীর ক্ষতের সংক্রমণে মৃত্যু হয় গায়াসের।আফ্রিকার ক্রীতদাস কোফি তো এক অভাবনীয় কান্ড করেছিলো।তিনজোড়া গ্ল্যাডিয়েটরদের এক লড়াইয়ে সে অংশগ্রহণ করে।চিরমুক্তির আকাঙ্খায় মরিয়া হয়ে এরা সকলকে চমকে দিয়ে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ময়দানে দর্শকদের সামনে একে অপরকে হত্যা করে,যে পরিকল্পনার বিষয়ে ঘুণাক্ষরেও আগে থেকে কিছু টের পায়নি মার্সেলাসরা।

জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে দোদুল্যমান একটা পলকা দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে চলে ওরা,জানেনা,শুরু থেকে শেষ প্রান্তে পৌঁছতে পারা যাবে,নাকি তার আগেই মরণখাদের অতল অন্ধকারে পতন লেখা আছে ওদের ভাগ্যে।

আজকের মহাযুদ্ধে মনে হচ্ছে জনতার চাপে যেন হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়বে গোটা কলোসিয়াম।অন্তত একমাস আগে থেকেই রোম শহরের রাজপথে রাজপথে বিশাল বিশাল ক্যানভাসে যুদ্ধের আঁকা ছবি ও লেখা সহ বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।গতকাল রাত থেকে শহর ও শহরের বাইরের সমস্ত মানুষের গন্তব্য একটাই।কলোসিয়াম।অলিগলি রাজপথে শুধু পিঁপড়ের মতো চলমান মানুষের সারি।উৎসবের মেজাজে গরিব থেকে মহাধনী সমস্ত নাগরিকরা জড়ো হয়েছে কলোসিয়ামে।গ্যালারির সবথেকে উঁচুতলায় সাধারণ মানুষদের আসন।সেখান থেকে অনেক নিচে লড়াইয়ের দৃশ্য যে খুব ভালো করে দেখা যায় তা নয়,আর শব্দ তো তাদের কানে পৌঁছনোর সম্ভাবনাই নেই।কিন্তু সব থেকে বেশি চিৎকার আর হর্ষধ্বনি ভেসে আসে ওই উঁচুতলার থেকেই।মাঝের সারি নির্দিষ্ট ধনীদের জন্য।আর একদম নিচের তলা লাল ও সোনালী রেশমী কাপড়ে,রঙ্গিন পতাকা দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে।সেখানে, অর্থাৎ রণাঙ্গনের সবথেকে সামনে বসবেন মহামান্য সম্রাট এবং রাজন্যবর্গ।প্রচন্ড গরম আর রোদ আজকে।কলোসিয়ামের কর্মচারীরা গ্যালারিতে থেকে থেকে যন্ত্রের সাহায্যে জল ছিটিয়ে দিচ্ছে দর্শকদের গায়ে।বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে মিষ্টি পানীয়,চিনি মাখানো বাদাম।পুরভরা খেজুর,শুকনো মশলাদার মাছ,চিজ দেওয়া ছোট গোল রুটি ইত্যাদি নানা লোভনীয় খাবার বিক্রিও হচ্ছে গ্যালারির সিঁড়িতে সিঁড়িতে।

আচম্বিতে তীক্ষ্ণ রবে বেজে উঠলো শিঙ্গা,গুড়গুড় করে বেজে উঠলো অসংখ্য ঢাক।খাস সভাসদবর্গ ও দেহরক্ষী পরিবৃত হয়ে সস্ত্রীক সম্রাট টাইটাস প্রবেশ করলেন ও আসনগ্রহণ করলেন।কলোসিয়াম ফেটে পড়ল   সম্রাটের জয়ধ্বনিতে।আর দেরি নয়,দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটবে এখনই।সকলের দৃষ্টি নিবন্ধ ময়দানের চারপাশে সারি সারি বন্ধ বিশাল লোহার দরজাগুলোর দিকে।

দর্শকদের প্রতীক্ষা ও উদগ্র কৌতূহলের নিরসন ঘটিয়ে সশব্দে খুলে গেল একাধিক লোহার দরজা।কিন্তু দরজার ভিতর থেকে কেউ বেরিয়ে আসছে না কেন?আসলে আজকে দুজন নক্সি অর্থাৎ মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীর খেলাচ্ছলে হত্যাপর্ব রয়েছে প্রথমেই।তাই ওই দুজন বেরোতে চাইছে না।দরজার পেছনে লুকিয়ে কাতর স্বরে মিনতি করছে যাতে ময়দানে না যেতে হয়।কিন্তু এতে কোন লাভ নেই।প্রথমে চাবুক মেরে আর তারপর গরম লোহার ছেঁকা দিয়ে তাদের বাধ্য করা হলো ময়দানে নামতে।তাদের পিছন পিছন এল জাল ও ত্রিশূলধারী গ্ল্যাডিয়েটর সিমাচিয়াস।উল্লাসে ফেটে পড়ল কলোসিয়াম।নিরস্ত্র নক্সিদের মধ্যে একজনের আবার সর্বাঙ্গ প্রায় অনাবৃত কিন্তু মুখে একটি চক্ষুবিহীন ধাতব মুখোশ,অর্থাৎ তাকে অন্ধ সেজে লড়তে হবে।ওদের সঙ্গে কিছুক্ষণ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা খেলল সিমাচিয়াস।কিন্তু স্বল্প সময়ে পরই অধৈর্য্য হয়ে উঠল দর্শকরা।তারা সমানে সমানে লড়াই দেখতে চায়।অতঃপর সিমাচিয়াস ওদের একজনকে জাল ছুঁড়ে আবব্ধ করল।সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে আরেকজন এসে প্রাণপণে চেপে ধরল সিমাচিয়াসের গলা।দীর্ঘদেহী,বলশালী সিমাচিয়াস একঝটকায় ফেলে দিল তাকে এবং নিমেষে তার তীক্ষ্ণ ত্রিশূল বিদ্ধ করল পরপর দুজনকে।ওদের দুজনের রক্তাক্ত দেহ টেনে নিয়ে যাওয়া হল ভিতরে এবং মৃত্যু নিশ্চিত করতে ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে দেওয়া হল তাদের গলার নলি।এদের দেহ এরপর ফেলে দেওয়া হবে নদীর ধারের বর্জ্যস্তুপে।কোন ধরণের শেষকৃত্য বা সমাধি হবেনা এদের।

আজকের পরবর্তী আকর্ষণ মেভিয়া নামের একজন মহিলা গ্ল্যাডিয়েটরের সঙ্গে বন্য ভাল্লুকের যুদ্ধ।রণসজ্জায় সজ্জিত মেভিয়ার সর্বাঙ্গ বর্মে আবৃত কিন্তু বক্ষস্থল উন্মুক্ত।দর্শকদের উল্লসিত চিৎকারে কান ফেটে যাওয়ার অবস্থা।মেভিয়া তার ঢাল ও বর্শা উঁচিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে বৃত্তাকারে পাক খেতে লাগল।হঠাৎ করেই উল্টো দিকের একটি লোহার দরজা খুলে গেল আর চাকা লাগানো লোহার খাঁচার খোলা দরজা দিয়ে লাফিয়ে নামল বিশালাকৃতির একটি মিশমিশে কালো ভাল্লুক।ভাল্লুকটা প্রথমে প্রখর সূর্য্যের আলোয়,উন্মত্ত জনতার মাঝে পড়ে  হতভম্ব হয়ে গেল,তারপর ভয় পেয়ে আবার ঢুকে পড়তে গেলো খাঁচায়।কিন্তু তার আগেই তীরবেগে মেভিয়া ছুটে তার পিঠে বিঁধিয়ে দিল বর্শা।ক্ষিপ্ত ভাল্লুকটা তাড়া করল মেভিয়াকে।মেভিয়া ভাল্লুকটাকে বিভ্রান্ত করার জন্য নানাদিকে ছুটতে লাগল।কিন্তু অতর্কিতে মরিয়া ভাল্লুকটা এক বিশাল লাফ দিয়ে মেভিয়াকে একেবারে মাটিতে পেড়ে ফেলল।দুজনের ধ্বস্তাধস্তি আর উথালপাথালিতে ধূলোর ঘূর্ণিঝড় উঠল ময়দানে।সাগ্রহে দর্শকরা সামনে ঝুঁকে পড়ল কি হয় তা দেখার জন্য।অবশেষে শোনা গেল ভাল্লুকটার মরণ আর্তনাদ।ধুলো থিতিয়ে যেতে দেখা গেল মেভিয়ার বর্শা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে ভাল্লুকের বুক।আর তার বিশাল দেহের তলা থেকে বেরিয়ে আসছে রণক্লান্ত মেভিয়া।গ্যালারিতে আরো একবার হর্ষধ্বনি উঠল,কিন্তু মহিলা যোদ্ধারা যতই দক্ষ ও নির্ভীক হোক না কেন,পুরুষ যোদ্ধাদের মতো জনপ্রিয়তা তাদের নেই।ফলে আরো একবার দর্শকদের অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পেল পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য।

আবার ঘর্ঘর শব্দে খুলে গেল কলোসিয়ামের নিচের দরজা।দর্শকদের বিস্ময়ে নির্বাক করে দিয়ে সেই দরজা দিয়ে প্রথমে ছুটে বেরোলো ঢাল ও কুঠার হাতে এক যোদ্ধা আর তার পিছন পিছন ও সরোষে ও সগর্জনে সুতীক্ষ্ণ খড়্গ উঁচিয়ে ধেয়ে এলো রণসাজে সজ্জিত একটি গন্ডার।তার আরোহীর মাথায়,হাতে,পায়ে চর্মাবরণ।তবে হাতে তার ঢাল নেই,শুধুই তরোয়াল।প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো জনতা।এই আরোহীকে রোমের জনতা চেনে।এর নাম গ্লসিও।দক্ষতা ও নিষ্ঠুরতার জন্য খ্যাত এই গ্লসিও।তারা চেনে কোয়ামে নামে এই যোদ্ধাকেও।অত্যন্ত কৌশলী ও দ্রুতগামী এই কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধা।সবেগে ধাবমান গন্ডারটিকে বেশ খানিকটা দৌড়তে হলো কোয়ামের পিছনে।তারপর অবশ্য ধরে ফেলল কোয়ামেকে,কিন্তু ততক্ষণে বেশ খানিকটা ক্লান্ত হয়ে গেছে গন্ডারটা।কোয়ামে গন্ডারটার পাশে পাশে দৌড়তে দৌড়তে সজোরে কুঠার হানলো গ্লসিওর পায়ের পাতায়।রক্ত ছিটকে উঠলো তার জুতোর মধ্যে থেকে।এই অপ্রত্যাশিত আঘাতের জন্য প্রস্তুত ছিলো না গ্লসিও।ভারসাম্য হারিয়ে বাহনের পিঠ থেকে পড়ে গেলো সে।তরোয়ালে ভর দিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়ালো সে,কিন্তু তীব্র যন্ত্রণার সাথে সে বুঝতে পারলো পায়ের পাতার কিছুটা অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।এগোতে গিয়ে সেই কাটা মাংসের সাথে জুতোর চামড়ার ঘর্ষণের বেদনায় ককিয়ে উঠলো সে।খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তবু সে এগোতে লাগলো তার প্রতিপক্ষের দিকে।ওদিকে ঢাল ও কুঠার হাতে প্রস্তুত কোয়ামে আড় চোখে দেখে নিলো তার ঠিক পিছনেই গন্ডারটা দাঁড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।দ্রুতগতিতে মাথা খাটাতে লাগলো কোয়ামে সামনে পিছনে দুজন শত্রুকে কিভাবে মোকাবিলা করা যায়।শরীর ও মস্তিষ্কের প্রতিটি পেশী টানটান করে অপেক্ষা করতে লাগলো কোয়ামে।গন্ডারটা ধুলো উড়িয়ে ক্ষুর ঘষছে মাটিতে।এবার তেড়ে এলো বলে। ওদিকে গ্লসিও এগিয়ে আসছে।দুজনকেই এগিয়ে আসতে দিল কোয়ামে।দর্শকরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখছে কি হয়।মাত্র হাত দেড়েকের পার্থক্য থাকতে থাকতে বিদ্যুৎগতিতে কোয়ামে ওদের মাঝখান থেকে সরে গেল আর গন্ডারের তীক্ষ্ণ খড়্গে গেঁথে গেল গ্লসিওর দেহ।উঠে দাঁড়িয়ে মহানন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো কলোসিয়ামের সমস্ত দর্শক।কিন্তু যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি।গ্লসিওকে ঝেড়ে ফেলে গন্ডারটা আবার এগিয়ে আসছে কোয়ামের দিকে।হাতের কুঠারটা দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে সেও এগিয়ে গেলো ক্রুদ্ধ পশুটার দিকে,মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়িয়ে পাশে এসে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে কুঠারের আঘাত হানল গন্ডারের একমাত্র খোলা ও নরম জায়গা চোখ ও চোখের পাতার উপরের অংশে।এবার কাবু হলো মারাত্মকভাবে আহত জন্তুটা,ভয়ে সরে গেলো দেওয়ালের দিকে।সেখানেই একটা লোহার দরজা খোলা পেয়ে ভয়ার্ত আর্তনাদ করতে করতে ভিতরে উধাও হয়ে গেলো।কোয়ামে এবার এগিয়ে গেলো ভূলুণ্ঠিত গ্লসিওর দিকে।গ্লসিওর পেট ও পা থেকে রক্ত ঝরে ঝরে ক্রমাগত মিশছে রণাঙ্গনের ধূলোয়।কোয়ামেকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করলো সে কিন্তু কোমর থেকে বাকিটা আর তুলতে পারলো না।খুব সম্ভবত কোমর কিংবা মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে তার।তার দেহের দুপাশে পা রেখে উদ্যত কুঠার শূন্যে তুলে দাঁড়ালো কোয়ামে।অতি কষ্টে গ্লসিও হাতের একটা আঙ্গুল তুলে ধরলো।এর অর্থ সে জীবনভিক্ষা চাইছে।এই মুহূর্তে প্রতিপক্ষকে বধ করার সম্পূর্ণ সুযোগ থাকলেও সেটা করতে পারবেনা কোয়ামে।গ্লসিওর বাঁচা মরা এখন নির্ভর করছে সম্রাট ও জনতার ওপর।গ্যালারির প্রতিটা তলা থেকে উন্মত্ত জনতা সমস্বরে চিৎকার করতে লাগলো “ মৃত্যু” “মৃত্যু” “মৃত্যু”….শব্দটা ক্রমশ একটা মন্ত্রোচ্চারণের মতো হয়ে উঠে কানে তালা ধরিয়ে দিতে লাগলো।।সম্রাট টাইটাসের মুমূর্ষু গ্লসিওকে জীবনদানের ইচ্ছা থাকলেও জনতার ইচ্ছাই মেনে নিতে হলো তাঁকে।কারণ কলোসিয়ামের এই বৃহদাকার অঙ্গন শুধুমাত্র এক ভয়ানক ক্রীড়াভূমি নয়,রাজনৈতিক জনপ্রিয়তারও এক মহত্ত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।জনপ্রিয়তার খাতিরে জনতার চাহিদা মেটাতেই হবে তাঁকে।তাঁর নিম্নাভিমুখী বৃদ্ধাঙ্গুলি চোখে পড়া মাত্র আর দেরি করলো না কোয়ামে,সজোরে কুঠারাঘাত করলো গ্লসিওর কন্ঠদেশে।হাজার হাজার জনতার উল্লাসধ্বনিতে চাপা পড়ে গেল গ্লসিওর শেষ আর্তনাদ।গ্লসিওর মৃতদেহ কলোসিয়ামের “মৃত্যুর দরজা” দিয়ে সম্মান সহকারে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো।

দুপুর ক্রমশ ঢলে পড়ছে বিকেলের দিকে।এবার সময় হয়ে এসেছে সবচেয়ে নামী ও সুদক্ষ গ্ল্যাডিয়েটরদের দ্বৈত দ্বন্দ্বযুদ্ধের।এতরকম চিত্তাকর্ষক লড়াইয়ের আয়োজন থাকলেও দর্শকরা কিন্তু অপেক্ষা করে থাকে এই শেষ দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য।কলোসিয়ামের ভেতরে ও বাইরে জুয়া খেলাও চলে কে জিতবে তাই নিয়ে।আজকের মার্সেলাস ও বাটোর মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার অপেক্ষায় বসে আছে গোটা কলোসিয়াম।ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে পরপর সাতবার অস্তিত্বরক্ষার মরণপণ লড়াইয়ে নিজ নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে টিকে যাওয়া এই দুই যোদ্ধার মধ্যে আজকে যে জিতবে তাকে পুরস্কারস্বরূপ মুক্তি প্রদান করবেন সম্রাট টাইটাস।

দ্রিমি দ্রিমি রবে দুন্দুভি বেজে উঠতেই রণাঙ্গনে প্রবেশ করল সুদৃশ্য বর্মে সজ্জিত মার্সেলাস আর বাটো।দুজনের হাতে ঢাল ও তরোয়াল।দুজনেই সুদেহী,দীর্ঘ পেশীবহুল বাহুবিশিষ্ট ও বিস্তৃত বক্ষপট দুজনেরই।দুজন যোদ্ধাকে দেখে সহর্ষ চিৎকার আর করতালিতে ফেটে পড়ল কলোসিয়াম।অনেকেই উঠে দাঁড়িয়ে ওপর থেকে বিপজ্জনকভাবে ঝুঁকে তাদের দিকে হাত নাড়তে লাগলো।তারাও প্রত্যুত্তরে সাড়া দিতে লাগল ময়দানের চারপাশে ঘুরে ঘুরে দর্শকদের উদ্দেশ্যে তরোয়াল উঁচিয়ে।অকস্মাৎ যেন ফাঁক হয়ে গেল রণভূমির একাংশ,সরে গেল একটি কাঠের পাটাতন আর তার ভিতর থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলো একটি ক্ষিপ্ত চিতাবাঘ।এর জন্য প্রস্তুত ছিলো না দুজনের কেউই।মার্সেলাস আর বাটোর মধ্যে নিমেষে চোখে চোখে ইশারা হয়ে গেল,আগে দুজনে মিলে চিতাটাকে মারবে,তারপর নিজেরা যুদ্ধ করবে।ক্ষিপ্রগতিতে চিতাবাঘের পিছনে চলে গেল মার্সেলাস,আর বাটো রইলো সামনে।গোল হয়ে ঘুরতে লাগলো চিতাটা,যেন বুঝে উঠতে পারছে না কার দিকে ধেয়ে যাবে।তারপর যেন মনস্থির করে নিয়েই অতর্কিতে সবেগে ঘুরে লাফিয়ে পড়লো বাটোর উপর।বাটো মাটিতে পড়ে গিয়ে তার বিশাল ঢালটা দিয়ে কোনমতে চিতাটাকে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগলো কিন্তু তরোয়ালের ঘা বসানোর মতো বাগে পেলো না সেটাকে।এবার এগিয়ে গেলো মার্সেলাস।তুমুল ঝটাপটি চলছে মানুষ ও পশুতে।প্রাগৈতিহাসিক,আদিম এক দ্বন্দ্ব যেন আকৃতি নিয়েছে বর্তমানের সভ্যতার এই অঙ্গনে।এর মধ্যে উল্টোপাল্টা আঘাত হানলে চিতার বদলে আহত হবে বাটো।এ সুযোগও ইচ্ছে করলেই নিতে পারে মার্সেলাস,কারণ যুদ্ধে ও প্রেমে সবই ন্যায্য।কিন্তু মার্সেলাস তা করবে না।যুদ্ধশিক্ষার এই পাঠশালা তাকে শুধুমাত্র রণকৌশলই শেখায় নি,শিখিয়েছে নীতিনিষ্ঠ হতে,সৎ হতে,নিজ বাহুবলের উপর ভরসা রেখে শেষ নিঃশ্বাস অবধি নির্ভীকভাবে লড়তে।এই লড়াই তার কাছে যুদ্ধ যুদ্ধ মারণখেলা নয়,এক ধর্মযুদ্ধও বটে।সতর্ক মার্সেলাস বাটোকে বাঁচিয়ে তরোয়ালের এক জোরদার কোপ বসালো চিতাটার পাঁজরের মাঝামাঝি।আহত চিতাটা আর্তনাদ করে উঠে ছেড়ে দিলো বাটোকে,লাফিয়ে পড়লো মার্সেলাসের উপর।কিন্তু আহত চিতাটার দেহে খুব অল্প শক্তিই অবশিষ্ট আছে।সজোরে তার ঢাল দিয়ে এক ধাক্কা দিতেই ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলো চিতাটা আর একমুহূর্ত দেরি না করে এবার বাটো মারাত্মক এক কোপ বসাল তার মাথায়।এবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নীরবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো মানুষের কয়েক মুহূর্তের প্রমোদের শিকার অসহায়,নির্দোষ প্রাণীটা।

এবার মুখোমুখি সংঘর্ষ দুই সমযোদ্ধার।বাটো আর মার্সেলাস একে অন্যের দিকে তরোয়াল উঁচিয়ে দাঁড়ালো।গ্যালারির এক দিক থেকে তালে তালে ধ্বনিত হচ্ছে “বাটো” “বাটো” “বাটো” আর অন্যদিক থেকে সমান তালে “মার্সেলাস” “মার্সেলাস” “মার্সেলাস”।যতবার এই রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে দাঁড়ায় সে,নিজের নামের এই ছন্দোবদ্ধ নিরন্তর চিৎকৃত উচ্চারণ রক্তে তোলপাড় তোলে মার্সেলাসের।বীররসের আদি অকৃত্রিম ধারায় সিক্ত হতে থাকে তার চেতনা।সে ভুলে যায় সে একজন বন্দী,তার নেই কোন ব্যক্তিস্বাধীনতা,নিজস্ব ইচ্ছা,এমনকি প্রার্থনা করার অধিকারও তার নেই।সে কিছুক্ষণের জন্য সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয় তার ব্যক্তিগত দুঃখশোক।তার ভিতরে লুকিয়ে বসে থাকা এক যোদ্ধা বেরিয়ে আসে বুক চিতিয়ে,নির্ভয়ে আক্রমণকারীর চোখে চোখ রেখে দাঁড়ায়,ইস্পাত কঠিন হয়ে ওঠে তার প্রতিটি স্নায়ু।”হয় জেতো,নয় বীরের মতো মরো”…শিক্ষাঙ্গনের এই শিক্ষাই রণাঙ্গনে তার মন্ত্র এই মুহূর্তে।ধনুক থেকে ছোঁড়া তীরের মতো সে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাটোর ওপর।বাটোও প্রস্তুত ছিলো।সঠিক সময়ে ঢাল তুলে সে মার্সেলাসের উদ্যত তরবারির আঘাত প্রতিহত করলো।এরপর কঠিন যুদ্ধ শুরু হলো তাদের মধ্যে।তরোয়ালে তরোয়ালে সংঘর্ষে আগুনের ফুলকি ছুটতে থাকলো।অস্ত্রের ঝনঝনানি,যোদ্ধাদের হুংকার,উন্মত্ত জনতার কলরোল সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো।সহসা মার্সেলাসের অতর্কিত আক্রমণে বাটোর মাথা থেকে খসে পড়লো  তার শিরস্ত্রাণ।একমুহূর্ত হতচকিত হয়ে গেলো বাটো।সেই ফাঁকে আবার তরোয়াল চালালো মার্সেলাস তার ঘাড় ও গলার অনাবৃত অংশ লক্ষ্য করে।চকিতে মাথা সরিয়ে নিয়ে এক পা পিছিয়ে গেলেও আঘাত এড়াতে পারলো না বাটো।তার ঘাড়ের কাছে চামড়া ফাঁক হয়ে গিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগলো।সেই রক্তদর্শনে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো মার্সেলাসের সমর্থকরা।আহত,ক্রুদ্ধ সিংহের মতো এবার বাটো ঝাঁপিয়ে পড়লো মার্সেলাসের উপর।শরীরের সবটুকু শক্তি একত্রিত করে ঢাল দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে একেবারে কোণঠাসা করে ফেললো মার্সেলাসকে।নিজের শরীরের থেকে বাটোকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলো মার্সেলাস,কিন্তু পারলো না।আচমকা কৌশলী মার্সেলাস নিচু হয়ে বসে পড়লো,তারপরই মাটিতে একপাক গড়িয়ে গিয়ে দ্রুত সরিয়ে নিলো নিজেকে আর বাটোর শিরস্ত্রাণহীন মাথা সজোরে ঠুকে গেলো ময়দানের সীমানার দেওয়ালে।বাটো সশব্দে আছড়ে পড়লো,তার হাত থেকে ছিটকে দূরে পড়ে গেলো তার ঢাল।অসহায় দৃষ্টিতে একবার মার্সেলাসের দিকে আরেকবার তার নাগালের বাইরে পড়ে থাকা ঢালটার দিকে তাকালো বাটো।মার্সেলাসও কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো,তারপর নিজের শিরস্ত্রাণ আর ঢাল ছুঁড়ে ফেলে দিলো দূরে।খোলা তরোয়াল উঁচিয়ে বাটোকে উঠে দাঁড়াতে ইশারা করলো মার্সেলাস।বাটো উঠে দাঁড়িয়ে কিছুটা টলমলে পায়ে এগিয়ে গেলো,তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো মার্সেলাসের উপর।আবার অগ্নিময় ভাষায় কথোপকথন শুরু করলো দুই যুযুধান পুরুষের রক্তস্নাত তরবারিদ্বয়।কিন্তু ক্রমাগত রক্তক্ষরণে অবসন্ন বাটো যে ক্রমশ দমে যাচ্ছে মার্সেলাসের জোরালো আক্রমণের সামনে তা দৃশ্যত স্পষ্ট হয়ে উঠলো।কলোসিয়ামের একপ্রান্তে বাটোর সমর্থকদের মধ্যে হতাশার রব উঠলো আর অন্যপ্রান্তে মার্সেলাসের নামে বিজয়োল্লাস শোনা যেতে লাগলো।হঠাৎ এক অপ্রত্যাশিত কান্ড করে বসলো বাটো।জুতোর মধ্যে গুঁজে রাখা একটি ক্ষুদ্র ছোরা বার করে সজোরে তা বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো মার্সেলাসের গলায়।সহজাত সতর্কতার সঙ্গে মাথা সরিয়ে নিল বটে মার্সেলাস,কিন্তু গলার বদলে ঘাড়ে গভীরভাবে গেঁথে গেলো ছোৱাটা,বেসামাল হয়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো সে,হাত থেকেও স্খলিত হলো তার তরবারি।সেই ফাঁকে মার্সেলাসের উপর চেপে বসলো বাটো,দুহাতে উর্দ্ধে তুলে ধরলো নিজের তরোয়াল,কিন্তু আঘাত করার আগেই জ্ঞান হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে উপুড় হয়ে বাটো পড়লো মার্সেলাসের উপর। কলোসিয়ামের স্তম্ভিত জনতা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে পড়েছে দুই তারকা গ্ল্যাডিয়েটরের যুদ্ধের পরিণতি কি হয় তা দেখার জন্য।উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন হতচকিত সপারিষদ সম্রাটও।সময় যেন থমকে গেছে এই রক্তরঞ্জিত রণবৃত্তে,থমকে গেছে ময়দানের উড়তে থাকা ধূলিকণাও।সকলের কৌতূহল ও প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাটোকে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো মার্সেলাস,উল্লসিত জনতার উদ্দেশ্যে একবার হাত নেড়েই আবার ভূপতিত হলো সে,লুটিয়ে পড়ল বাটোরই পাশে।জ্ঞান না হারালেও তার শরীরে আর একবিন্দুও শক্তি অবশিষ্ট নেই যুদ্ধ করবার,সর্বাঙ্গ এলিয়ে পড়েছে তার।এমন সময় সামান্য নড়ে উঠলো বাটো।জ্ঞান ফিরেছে তার,কিন্তু উঠে বসার ক্ষমতা নেই।পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগলো জনতা,তারা চায় আবার লড়াই শুরু হোক,নির্দিষ্ট হোক পরিণতি,যেকোন একজন জিতুক,একজন মরুক।সম্রাট টাইটাস হাত তুলে শান্ত হতে বললেন দর্শকদের।তাদের কোলাহল কিছুটা কমে এলো।সম্রাটকে আলোচনা করতে দেখা গেলো আজকের এডিটর অর্থাৎ রেফারীর সঙ্গে।তারপর সম্রাট নিজ আসন ছেড়ে ময়দানে নেমে এলেন এবং এসে দাঁড়ালেন মাটিতে শুয়ে কাতরাতে থাকা রণক্লান্ত,শক্তিহীন দুই যোদ্ধার সামনে।তাদের দুজনেরই শরীরের রক্ত ক্রমাগত নির্গত হয়ে মিশছে ধূলোয়।তাদেরকে মাঝখানে রেখে একটি সুরক্ষাবলয় রচনা করলো সম্রাটের একান্ত নিজস্ব দেহরক্ষীরা,এদের মধ্যে বেশ কিছুজন প্রাক্তন গ্ল্যাডিয়েটরও বটে।সম্রাটকে দেখে অতিকষ্টে হাঁটু গেড়ে বসলো দুজন,মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো তাঁকে।

সম্রাট দু হাত তুললেন জনতার উদ্দেশ্যে।নিমেষে গোটা কলোসিয়ামে স্তব্ধতা নেমে এলো।জনতা উন্মুখ হয়ে উঠলো সম্রাট এই অভূতপূর্ব দ্বন্দ্বযুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত নেবেন তা জানতে।

“প্রিয় নগরবাসীগণ,আপনাদের বিনোদনের জন্যই আমরা আজ এই বিশাল আয়োজন করেছি।কিন্তু এই মহাযজ্ঞের জন্য বিনোদনই কিন্তু শেষ কথা নয়।শক্তি,সাহস,ক্রীড়ানৈপুণ্য, শ্রম,রণকৌশল সব কিছুরই যথাযথ পরীক্ষা হয় এখানে।অপরাধীরা শাস্তি পায়,যোগ্যেরা ও বিজয়ীরা পায় সম্মান ও পুরস্কার।”

এই অবধি বলে থামলেন সম্রাট।পিনপতনের শব্দও শোনা যাবে এমন নিস্তব্ধতা চতুর্দিকে।

“যে যোদ্ধারা অসম সাহসিকতার সঙ্গে লড়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে জয়লাভ করেছেন, তাঁদের একজনকে এই বছর আমি মুক্ত নাগরিক ঘোষণা করবো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।কিন্তু আজকের দ্বন্দ্বযুদ্ধ আরেক অবিশ্বাস্য দ্বন্দ্বের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাকে।আমি সত্যিই নির্ধারণ করতে পারছি না,কাকে আমি মুক্তির প্রতীক তরবারি এই রুডিস প্রদান করবো।”

সশব্দ গুঞ্জন উঠলো জনতার মধ্যে।আবার হাত তুলে তাদেরকে শান্ত হতে বললেন টাইটাস।

“বাটো মার্সেলাসকে ভূপতিত করলেও নির্ণায়ক শেষ আঘাত হানতে পারেনি।এদিকে মার্সেলাস এই যুদ্ধে নিজেকে একাধিকবার দক্ষতর প্রমাণিত করেছে,এবং নিজের ঢাল ও শিরস্ত্রাণ ত্যাগ করে,প্রতিপক্ষের অসহায়ত্বের সুযোগ না নিয়েও যুদ্ধ চালিয়ে একজন আদর্শ,অনুকরণীয় বীরের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।অর্থাৎ আজ দুই যোদ্ধার মধ্যে কেউই কাউকে পরাস্ত করতে  বা বিজিত করতে পারেনি।সেই কারণে আজকের এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে আমি বাটো এবং মার্সেলাস দুজনকেই বিজয়ী ঘোষিত করছি।”

আবার কলোসিয়াম ফেটে পড়লো তুমুল হাততালিতে এবং সম্রাটের জয়ধ্বনিতে।

“এবার মুক্তির প্রতীক এই তরবারি রুডিস কিন্তু একজনকেই দেওয়া হবে এবং আমি তা মার্সেলাসকেই প্রদান করবো স্থির করেছি।”

সম্রাটের বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হতাশায় দেহ ভেঙ্গে এলো বাটোর।দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে।এবার হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে অর্ধত্থিত হয়ে সম্রাটকে অভিবাদন জানালো মার্সেলাস ও সবিনয়ে বললো,”আমি এখনই মুক্তি চাই না,মাননীয় সম্রাট।আরো এক বছর আমি গ্ল্যাডিয়েটর হিসাবে লুডুস ম্যাগনাসে থাকতে চাই।আরো রণকৌশল শিখতে চাই,আরো অর্থ ও সম্মান অর্জন করতে চাই।আপনি এই রুডিস বাটোকেই প্রদান করুন,সম্রাট।”

“বেশ,তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক তবে।”,এই বলে বাটোর দিকে এগিয়ে ধরলেন কাষ্ঠনির্মিত সুদৃশ্য কারুকার্যময় তরবারিটি।বিস্ময়াহত বাটো কয়েক মুহূর্ত অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকলো মার্সেলাসের দিকে।তারপর নতজানু হয়ে তরবারিটি দুহাতে গ্রহণ করে সশ্রদ্ধ চুম্বন করলো সেটিতে।

 আরো একবার কলোসিয়াম মুখর হয়ে উঠলো সম্রাটের জয়ধ্বনিতে।সম্রাট এবার সপারিষদ গমনোদ্যত হলেন।দর্শকরাও আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সম্রাটের সম্মানে।তারাও এবার রওনা দেবে নিজের নিজের গন্তব্যে। বাটো ও মার্সেলাসকে একটি ঘোড়ায় টানা শকটে পাশাপাশি শুইয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল চিকিৎসা বিভাগের প্রধানের কাছে।

”কেন আমার জন্য নিজের মুক্তিকে বলি দিলে মার্সেলাস?সম্রাট তো তোমাকেই যোগ্য বিবেচনা করেছিলেন!” প্রশ্ন করলো বাটো।

“তোমার দেশে তোমার বাবা মা আছেন,আশা করি বেঁচেই আছেন,স্ত্রী পুত্র আছে।তুমি দেশের মাটিতে মরতে চাও।তোমার মুক্তি আমার থেকে বেশি প্রয়োজন।”উত্তর দিলো মার্সেলাস।

“তাই বলে আবার একবছরের অনিশ্চিত জীবন?পরের লড়াইয়ে বাঁচবে কিনা তার কি কোন ঠিক আছে?”কথা বলতে বলতে কৃতজ্ঞতায় গলা বুঁজে এলো বাটোর।

“এই অনিশ্চয়তাই তো বেঁচে থাকার রসদ যোগাবে,বাটো।আমি ফিরলেই বা কার কাছে ফিরবো?তার থেকে তোমাকে ফেরাতে পেরে আমি আজ অনেক বেশী তৃপ্ত,আনন্দিত।আরেকটা বছর থেকেই না হয় যাই এই জীবন মৃত্যুর খেলার ময়দানে।এর বাইরের পৃথিবীতেও তো সেই একই খেলা!তার থেকে এই খেলা মন্দ কি?”

এই বলে বাটোর বাহু স্পর্শ করে হাসলো মার্সেলাস।আপ্লুত বাটোর মুখে বাক্যস্ফূর্তি হলো না,তার দুই চোখ খালি বারবার জলে ভরে আসতে লাগলো।রূদ্ধবাক বাটো শুধু মার্সেলাসের হাতটা চেপে ধরলো উষ্ণ ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতায়।তারপর বাটোকে নামিয়ে নেওয়া হলো এক চিকিৎসকের কক্ষে।মার্সেলাসকে নিয়ে যাওয়া হলো শল্য চিকিৎসালয়ে,কারণ তার কাঁধে তখনও গেঁথে রয়েছে বাটোর ছোরা।কলোসিয়ামের ভিতরের অলিন্দপথ দিয়ে যেতে যেতে দেওয়ালের সারিবদ্ধ জানলা দিয়ে মার্সেলাস দেখতে পাচ্ছিল রক্ত,ধূলো আর যোদ্ধাদের পদচিহ্নলাঞ্ছিত কলোসিয়ামের নির্মম যুদ্ধাঙ্গনকে  যা এতক্ষণ মহান অথচ হতভাগ্য বীরদের জীবনকে আন্দোলিত করছিলো দুঃসহ,দুঃসাধ্য দ্বন্দ্বে,দিবসাবসানের রক্তিম আলোয় সব কোলাহল থেমে গিয়ে কীভাবে তা পরিবর্তিত হয়ে পড়ছে মৌন,মায়াময়,শান্ত উদাসীন এক বিস্তৃত লীলাক্ষেত্রে,যার মাটির প্রতিটি খণ্ডের নীচে লুকিয়ে রয়েছে অগণিত মানুষের কঠোরতম সংগ্রামের অলিখিত ইতিহাস।চেতনা লুপ্ত হওয়ার আগের মুহূর্তে মার্সেলাস মনে মনে প্রণাম জানালো এই আদিম ও অকৃত্রিম বীরভোগ্যা ভূমিকে যেখানে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে নিরন্তর উদযাপিত হয়ে চলেছে জীবনের জয়যাত্রা।

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *