অমর মিত্র
আমি এ পাড়ায় প্রায় সত্তর বছর। অনেকেই তো পাড়া বদলায়, শহর বদলায়, গ্রামে ফিরে যায় অবসরের পর, আমি যাইনি। যাওয়ার জায়গা নেই আর একটা। আমি অমিতাভ ঘোষ দস্তিদার। ঘোষ বাদ দিয়ে দস্তিদার। অনেককালের মানুষ, পুরোন ইঁটের মত গায়ে ছ্যাতলা ধরে গেছে। আছি। কবে টুপ করে চলে যাব ঠিক নেই। আমি তিনখানা আস্তানা করেছিলাম তিন জায়গায়। নতুন শহরে, বাইপাসের ধারে আর সোনারপুরে, যাওয়া হয়নি। এই এখানেই আছি মনের আনন্দে। দুইজনে থাকি। পুরোন ভাড়াটে ফ্ল্যাট কিনে নিয়ে পাকা বাসিন্দা হয়েছি এখানে। মাঝে মধ্যে পুরুলিয়া বিষ্ণুপুর বেড়াতে যাই, আবার ফিরে আসি। আমার একটা পুরোন অভ্যেস আছে। সকালবেলায় হাঁটা। আমি হাঁটুনে মানুষ। যখন চাকরি করতাম, হাঁটার তেমন বেশি সময় হত না, অবসর নিয়ে হাঁটছি একা একা। সকাল হলে কে আমারে ধরে রাখে? এখন শ্রাবণ মাস। আকাশ ছেয়ে গেছে মেঘে। আমি বেরলাম ফ্ল্যাটের দরজা টেনে। ইয়েল লক। ভিতর থেকে খুললে তবে খুলবে। গতকাল বৃষ্টি থেমেছিল। রোদ হয়েছিল। আজ এখন টিপটিপে বৃষ্টি। ছাতা ব্যতীত উপায় নেই। বাইরে বেরিয়ে দেখি ঘোর অন্ধকার করে আছে। ঠান্ডা বাতাস আসছে কখনো পুব কখনো উত্তর থেকে। বাতাস দেখা যায় না। বাতাসের সঙ্গে কথা হয় না, বাতাসবাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। সেই একই পথে। পথ আবার কত রকমই বা হবে? কতদিকেই বা যাবে। হেলেদুলে একই একই রাস্তায় আমার পা। এই পথে ডানদিকে সব বাড়ি, বহুতল, দ্বিতল ইত্যাদি। এক বহুতলের নাম রাইকমল। আর একটির নাম সপ্তপদী। আর গুলির নাম নেই। কলকাতা পুরসভা তার নামকরণ করতে পারে, গণদেবতা, হাঁসুলীবাঁক, ধাত্রীগ্রাম ইত্যাদি। এ হল তারাশঙ্কর সরণির কথা। তাঁর বাড়িটি রঙ করে ঝলমল করছে। এই রাস্তার সৌন্দর্যের শেষ নেই। দেখা হল কেবল রমানাথের সঙ্গে। রমানাথ জয়নগর থেকে এসেছে। আমাদের কেবল লাইনে কাজ করে। রমানাথ আমার ভরসার লোক। টিভি, ইন্টারনেট ইত্যাদি এদিকওদিক হলে ফোন করি। আরে রমানাথ তুমি থাক কোথায়?
-দু’নম্বর বাস স্ট্যান্ডের ওখানে যে শিবমন্দির, তার পিছনে, আচ্ছা দুনম্বরি বাস বলে কেন স্যার?
-দু’নম্বরি না, বাসের নম্বর দুই, ডাবল ডেকার, উপরে বসে হাওয়া খেতে খেতে বালিগঞ্জ অবধি চলে যাওয়া যেত, বললাম, চল, দু’নম্বর বাস দেখে আসি।
– সে কি দাদা, জানেন না?
-না, কী জানব?
রমানাথ জিজ্ঞেস করল, আপনি সকালে হাঁটেন, আর সারাদিন বসে থাকেন?
-তা কেন গড়িয়ে থাকি। গড়িয়ে বই পড়ি, গড়িয়ে মোবাইল পড়ি খবরের কাগজ দেখি-।
রমানাথ বলল, কাগজে এসব দেয় না, জায়গাটার নাম দু’নম্বর বাস স্ট্যান্ড, কিন্তু কোনোদিন ওখানে দু’নম্বররের বাস ছিল না। কেউ দ্যাখেনি। আমি তো দশ বছর আছি জয়নগর থেকে এসে, আমিই দেখিনি।
বললাম, হবে হয়ত।
রমানাথ বলল, এমনি আর একটা জায়গা আছে ওদিকে, তেত্রিশ নম্বর বাস স্ট্যান্ড। কবি নজরুল যেখানে থাকতেন শুনেছি। তিন এগার তেত্রিশ, একটি বাসও নেই। ওই জায়গার নাম, কবি নজরুল বাস স্ট্যান্ড দিতে পারে দাদা।
রমানাথের প্রস্তাবে আমি খুশি হয়ে মাথা দোলাতে লাগলাম।
রমানাথ বলল, স্যার, কলকাতায় এমনি অনেক জায়গা আছে দাদা, যেমন চালতা বাগান, বকুলবাগান, খুঁজে দেখুন দেখি চালতা গাছ আছে না বকুল গাছ আছে। দু’নম্বর বাস তেমনি একটা বাস, যা কোনোদিন ছিল না, থাকলেও চালতা গাছের মতো কেটে ফেলেছে, আমাদের জয়নগরেও হেলা বটতলা আছে, কিন্তু হেলা বট নেই।
সবই মেনে নিলাম। রমানাথ অসংখ্য চ্যানেল নিয়ে মাথা ঘামায়, তামিল তেলুগু, কন্নড়, মরাঠী, সে জানে বেশি, না জানে কম। সব চ্যানেলই অনেক রকম জ্ঞান সাপ্লাই করে। সেই জ্ঞানের ছিটেফোটা আমি পাচ্ছি। রমানাথ বকতে বকতে চলল আমার সঙ্গে। বলল, এই যে সকালে হাঁটি, অনেকেই তো হাঁটে না, অসুবিধে কিছু নেই। বরং ভালো। সবাই যদি সকালে রাস্তায় বেরিয়ে আসত বাজার বসে যেত দাদা। বলছি হাঁটার কোনো মানে নেই। কচ্ছপ হাঁটে না, বসেই থাকে, নড়েই না, সে নাকি চারশো বছর বাঁচে। তেমনি আর কী তেত্রিশ নম্বর বাস, নেই তবু নাম তার তেত্রিশ, কে দেখেছে তাকে? কচ্ছপকে যেমন কেউ চারশো বছর ধরে বেঁচে থাকতে দ্যাখেনি, তেমনি। আসি দাদা, তিন পাক দিতে হবে।
আমি একা হয়ে গেলাম। আমি যে দু’নম্বর আর তেত্রিশ নম্বরে চেপে হয় বালিগঞ্জ না হয় চেতলা ঘুরে এসেছি তা রমানাথ মানবে না। এখন প্রাতঃভ্রমণের কালে, যদি তারা থাকত, এক একদিন দোতলা বাসের দোতলায় চেপে কলকাতা ভ্রমণ করে আসতাম। পৃথ্বীশদার সঙ্গে ইদানীং দেখা হয় না। পৃথ্বীশ রায়, চিত্রকর। লম্বা পাঞ্জাবি, ঢোলা পায়জামা পরে সকালে বেরতেন। ইদানীং দেখা যায় না। পৃথ্বীশদা সাইকেল চালিয়ে বাজারে আসেন। বাজারেও দেখছি না। অথচ ক;দিন আগে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়ে গেল একাডেমিতে। পৃথ্বীশদা আমাদের কোলাজের পাঠ দিয়েছিলেন। সেই সময়, রণজিত, তপনজ্যোতি আমি তাঁর ঘরে গিয়ে নতুন ছবি দেখতাম। ওলাইচণ্ডী রোড ধরে হাঁটছি, দাঁড়িয়ে গেছি দোতলা বাড়িটির সামনে। ঘুমিয়ে আছে পাড়া। আবার বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে । শেষ রাত থেকে এই চলছে। ভাবলাম, ডাক দিই, পৃথ্বীশদা, পৃথ্বীশদা, ঘুমিয়ে আছেন না জেগে ?
– কে অমিতাভ? এখন আমি সকালে ঘুমই, বিকেলে হাঁটি।
না কেউ উত্তর দেয়নি, আমিও ডাকতে পারিনি। তাকিয়েই ছিলাম শূন্য ব্যালকনির দিকে। ডাক দিলেই পরের পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসত মুখ, কে কে? কেউ না কেউ না। তেত্রিশ নম্বর আর দু’নম্বরের মতো কেউ না। পাড়ার এইসব লোক, পাড়ার লোক, বিকেলে হাঁটে, সকালে ঘুমোয়।

দুই
আজও ভোর রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু তার আয়ু বেশিক্ষণ ছিল না। এখন রাত বড় হতে শুরু করেছে। আলো ফুটতে দেরি হয়। তাতে আমার অসুবিধে। ঘড়ির কাঁটায় একই সময়ে ঘুম ভাঙে। অন্ধকারে চুপ করে শুয়ে থাকতে হয়। রাত চারটের আজান হয়ে গেছে, সাড়ে চারটে নাগাদ যে উড়ান রওনা হয়, সেও চলে গেছে মেঘের ডাক ডেকে। আন্দামান যায় মনে হয়। সকালে বেরলাম। সকাল সাড়ে পাঁচ। আকাশে মেঘ আছে। রোদ না হলে হন্টন ভালো হয়। এখন রোদের তাত খুব বেশি। মেঘ ভাঙা তো। থানার পাশ দিয়ে তারা মা মন্দিরের দিকে হেঁটেছি। প্রাতঃভ্রমণকারীরা বেরিয়ে পড়েছে। কেউ খুব গম্ভীর। কেউ স্মিত হাসি মুখে ঝুলিয়ে হাঁটছে। আমি হলাম গম্ভীর। সবই গুরু গুরু। মেঘের মতো বলা যায়। একদিন সকালে দেখা হয়েছিল বাবলুর সঙ্গে। বাবলু নাকি সারারাত বসে আছে ঝিল পুকুরের পাশে বেঞ্চে। শুয়ে ঘুমিয়েছে কিংবা বসে সারারাত জেগেছে। বাবলুর ভাই ডব্লু এসেছে সক্কালবেলায়, রাস্তায় দেখা, ডবলু হাঁটছে। মধুমেহ ধরেছে তাকে, তাই খুব বিমর্ষ থাকে। দেখেই মনে হল, জিজ্ঞেস করবে না তো, দাদাকে দেখেছ, দাদা কি তোমাদের বাড়ি গিয়েছিল অমিতাভদা ?
– না তো।
-রাতে বাড়ি ফেরেনি দাদা।
কেন ফেরেনি? এমনি ফেরেনি। অফিস না হয় নেই এখন, কিন্তু বাড়িতে তো থাকবে। রিটায়ার করে গেছে বাবলু। তার এক নাম ছিল মঙ্গল। অপূর্ব ছিল পায়ের কাজ। সুযোগ সন্ধানী। মোহনবাগানের মঙ্গল পুরকায়স্থ । তো বাবলু ছিল খালি পায়ের ফুটবলে হিরো। তারপর ১৮ বছরে চাকরি। বাবা চলে যাওয়ায় সেই চাকরি নিয়েই সারাজীবন নিজেকে টেনে চলল। তাই ভালো লাগত না। অফিস যেত না, পাড়ার ফুটবলে খেলা আছে। না থাকলে ফুটবল দেখতে যে কোনো মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে পড়ত। বিকেল দুপুর অফিসে গেলে হবে? তখনই মঙ্গল পুরকায়স্থ পায়ে চোট পেয়ে অকালেই বসে গেল, আর বাবলুর ফুটবল গিয়ে সব গেল। ধুর ভাল্লাগে না, সে অফিস যায় না। সব মনে পড়তে লাগল। বাবলুর ভাই ডবলু দাদাকে খুঁজতে কিংবা হাঁটতে অন্য দিকে গেল। তাকে দেখলেই মনে হয়, দাদাকে খুঁজতে বেরিয়েছে সারারাত অপেক্ষা করার পর।
মনে পড়ল, একবার, অনেক বছর আগে বাবলুর সঙ্গে দেখা হল ঝিল পার্কে। আমাকে দেখে বলল, অমিতাভ, তুই বাইরে চলে গেছিস চাকরি করতে?
– গিয়েছিলাম। মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, এখন বারুইপুর যাই।
-সেখেনে অনেক বড় বড় মাঠ, তাই না?
-হ্যাঁ, ডাহি পুরাতন পতিত।
-ইস, আমাকে অফিস যেতে হয়, অফিসে মাঠ নেই তো ফুটবল নেই।
বাবলুর কলিগরা ওকে ভালোবাসত। মঙ্গল পুরকায়স্থ । চোট পেয়ে অমন সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলাই ছেড়ে দিল বাধ্য হয়ে। আমাদের পাড়ার লোক মঙ্গল অফিস করতে করতে খেলাটা নষ্ট করে মাঠে গিয়ে একা বসে থাকে। একা একা ফুটবল নিয়ে দৌড়য়। গোলকিপারকেও ড্রিবল করে বল নিয়ে গোলে ঢুকে যায়। বাবলু সেদিন বলেছিল, অমিতাভ, তুই আমার চাকরি নে, আমি বাঁকুড়া চলে যাই। অত অত খেলার মাঠ, কেউ কিছু বলবার নেই, অফিসে যাবই না।
কতদিন আগের কথা তা। আমি হাঁটতে হাঁটতে ঝিল পুকুরে। পাখিরা গুড মন্নিং গুড মন্নিং কইছে সকাল থেকেই। পুকুর ঘিরে পার্ক। গাছ-গাছালিতে ভরা। এখানে কত মানুষ যে হাঁটতে আসে। আঠের থেকে একাশি। সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে সাতটা-আটটা পর্যন্ত মেলা বসে যায় স্বাস্থ্যবিধি মানা মানুষজনের। আমি বাবলু মঙ্গল পুরকায়স্থকে খুঁজছি। আছিস নাকি বাবলু? আমি অমিতাভ দস্তিদার, তোর খবর নিতে এলাম, পাড়ার কেউ হারিয়ে গেলে খোঁজ করতে হয় তো। বাবলু এদিকে আসেনি। আসতে পারবে না। শরীর ভেঙে গেছে। বিয়ে থা করেনি। ভাইয়ের কাছে থাকে। বাবলু উঠে আসতে চায় বিছানা থেকে, পারে না। চুপ করে শুয়ে থাকে। আমি বৃদ্ধ সঞ্জয়বাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা দাদা, আপনি কি বাবলুকে চিনতেন?
সঞ্জয়বাবু চুরাশি। বললেন, কত বাবলু আছে, কোন বাবলু?
-মঙ্গল। পুরকায়স্থ মঙ্গল।
-হ্যাঁ হ্যাঁ চিলব না কেন, ওর নাম বাবলু নাকি? আমি তো জানি মঙ্গল। সমনামী। না না, ওর নাম বাবলু রায়। মঙ্গল নাম দিয়েছিল পাড়ার লোক। কী দারুণ ছিল পায়ের কাজ। অসম্ভব সুযোগ সন্ধানী। মাইনাস চান্সকে প্লাস করে দিত। মঙ্গল মঙ্গল, গোওওল। সঞ্জয় গুপ্ত শুনলেন, তারপর বললেন, আচ্ছা আচ্ছা, তার নাম বাবলু। সে তো এক একদিন আসে। বসে থাকে। ক’দিন দেখিনি।
-শেষ কবে দেখেছেন?
-মনে পড়ছে না। দেখেছি আবার নাও দেখতে পারি। কেন কী দরকার?
– একদিন সকালে ওকে নিয়ে আসব। টালা পার্কের সবুজ ঘাসে বসিয়ে দেব, দেখবেন উঠে দাঁড়াবে।
-তাই, তবে তাই করুন। আমিও আছি। আমি অবশ্য খেলতে পারতাম না। মাঠের সীমানার বাইরে বসে দেখব। মঙ্গল মঙ্গল, অপূর্ব এক গোল দিয়েছিল বি এন আরের সঙ্গে ম্যাচে। দেখতে গিয়েছিলাম, মনে পড়ে। তা আবার হোক। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামল। অশ্রুপাত। আপাতত এখানেই আজ থামতে হয়। পাড়ার লোক ছেড়ে আমি যাব কোথায়? ইস, ডবলুকে জিজ্ঞেস করা হল না, পাড়ার লোক বাবলু, মঙ্গল পুরকায়স্থ কেমন আছে?
শেয়ার করুন :