দ্রোহ,প্রেম ও আন্তিগোনে -

দ্রোহ,প্রেম ও আন্তিগোনে

সংসৃতি’ প্রযোজনা,নির্দেশক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়।

সুদেব সিংহ

সোফোক্লেসের ‘আন্তিগোনে’ নাটক শুরু হয় থিবস্‌-এ, রাজা অয়দিপাউসের প্রাসাদের সামনে অবস্থিত উন্মুক্ত এক স্থানে। প্রাসাদের সামনে প্রধান প্রবেশ-দ্বার। অয়দিপাউসের দুই পুত্র এতোয়ক্লেস ও পলুনেইকেস দুজনেরই পতন ঘটেছে। দুই ভাই তীব্র লড়াইয়ের পর, একই সঙ্গে পরস্পরের বুকে অস্ত্র বিধিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। পলুনেইকেস আর্গোস থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে আক্রমণ করেছিল থিবস্‌ নগরী। এর পর শুরু হয় যুদ্ধ, যার শেষে দুই ভাইয়ের মৃত্যু।

অয়দিপাউসের দুই পুত্র এতোয়ক্লেস এবং পলুনেইকেস। দুই কন্যা আন্তিগোনে ও ইসেমেনে। দুই পুত্র সাবালক হওয়া পর্যন্ত তাদের মামা ক্রেয়ন রাজ্য শাসন করতেন। তৎকালীন বিধান অনুসারে নর হত্যাকারী যে-পাত্রে খায় সে-পাত্র অপবিত্র হয় এবং তা ফেলে দিতে হয়। যেহেতু অয়দিপাউস পিতৃ-হত্যাকারী, তাকে খাবার দেওয়া হত লোহার পাত্রে। একদিন অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় ক্রুদ্ধ অয়দিপাউস দুই পুত্রকে অভিশাপ দিলেন। একদিন তাদের লোহা দিয়ে রাজ্য ভাগ করতে হবে। এই লোহায় লোহায় বাঁধবে ভীষণ লড়াই। এইভাবে পেলোপাসের অভিশাপ তৃতীয় প্রজন্মেও সঞ্চারিত হল।

লাইয়ুস অল্প বয়সে পিতার মৃত্যুর পর আশ্রয় নেন আর্গোসে। তাঁকে আশ্রয় দেন পেলোপাস। জিউস-পুত্র ধনুর্ধারী দেবতা আপোল্লো সাবধান করেন লাইয়ুসকে। লাইয়ুস এবং ইয়োকাস্তের বিবাহ হয়। ইয়োকাস্তে ক্রেয়নের বোন। লাইয়ুস এবং ইয়োকাস্তের ছেলের নাম অয়দিপাউস। অয়দিপাউসের হাতেই ঘোর দৈব দুর্বিপাকে নিহত হন তাঁর পিতা রাজা লাইয়ুস। অয়দিপাউস তাঁর পিতৃপরিচয় জানতেন না। তিনি বিবাহ করলেন ইয়োকাস্তেকে, অর্থাৎ নিজের মাকে। মাতৃশয্যা কলুষিত করলেন অজান্তেই। এভাবেই সঞ্চারিত হয়েছে অভিশাপের ধারা।

‘আন্তিগোনে’ নাটকে প্রবেশ করতে গেলে সোফোক্লেস-এর ‘রাজা অয়দিপাউস’ নাটকটির বৃত্তান্ত উল্লেখ জরুরি। ‘আন্তিগোনে’ নাটকের মূল ঘূর্ণাবর্তটি পলুনেইকেসকে সমাধিস্থ করা নিয়ে। এতোয়ক্লেসকে বীরের মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয়েছে। পলুনেইকেস-এর দেহ ফেলে রাখা হয়েছে উন্মুক্ত স্থানে, শৃগাল-শকুনের জন্যে। ‘আন্তিগোনে’ বলে, তার দুই ভাইয়ের একজন পাবে মৃতের প্রাপ্য সমাদর, অন্যজন সেই সম্মানের অযোগ্য। মহান ক্রেয়ন পরোয়ানা জারি করেছেন, পলুনেইকেস-এর সদগতি করতে গেলে তা বিবেচিত হবে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে। পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হবে সেই বিরুদ্ধাচারীকে। ক্রেয়নের বক্তব্য, রাষ্ট্র আমাদের যথার্থ আশ্রয়, নিরাপত্তা, কল্যাণ-বিধানে সক্ষম। রাষ্ট্র আমাদের বন্ধু। একমাত্র নির্ভরস্থল। রাষ্ট্র-হিতই মানব-হিত। পলুনেইকেস পিতৃপুরুষের পবিত্র নগরীর মর্যাদা লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রদ্রোহে যোগদানকারী।

 ‘সংসৃতি’ প্রযোজনা ‘আন্তিগোনে’ কেবলমাত্র সোফোক্লেসকে অনুসরণ করে নয়। নির্দেশক দেবেশ চট্টোপাধ্যায় অনুসরণ করেছেন জঁ আন্যুইকেও। গ্রিক পুরাণ উজ্জীবিত হয়েছে বারবার। নবতর ভাষ্যের আকার পেয়েছে জঁ আন্যুই, জঁ-পল সার্ত্র, আলবেয়ার কাম্যু প্রমুখের হাতে। সিনেমার ক্ষেত্রেও পিয়ের পাওলো পাসোলিনি, মিক্লোস ইয়ানচো, মাইকেল ক্যাকোইয়ানিস প্রমুখ রচনা করেছেন তাঁদের সেল্যুলয়ড-ভাষ্য। গ্রিক পুরাণ এবং গ্রিক নাটক এমনই এক চলমান প্রক্রিয়া। বুদ্ধদেব বসুও রূপ দিয়েছিলেন কলকাতার ‘ইলেকট্রা’-কে।

   একসময় অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনা ও অভিনয়ে মঞ্চস্থ হয়েছে ‘আন্তিগোনে’। সেখানে কেয়া চক্রবর্তী ছিলেন আন্তিগোনের চরিত্রে। পরবর্তীকালে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত অভিনয় করেছেন ক্রেয়নের ভূমিকায়। তাঁর প্রযোজনায় আন্তিগোনে হয়ছেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। ফলে দেবেশ চট্টোপাধ্যায় যখন পুনরায় মঞ্চে ফিরিয়ে আনেন সেই বিদ্রোহিণীকে, তখন আমাদের প্রত্যাশা বৃদ্ধি পায় খুব সঙ্গত কারণে। জঁ আন্যুইয়ের ‘আন্তিগোনে’ মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯৪৪ সালে, নাৎজি অবরোধের প্রেক্ষাপটে। মুসোলিনি, হিটলারের যুদ্ধজিগীরের মধ্যেই রূপ পেয়েছিল আন্যুইয়ের নবতর রচনা। দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের মঞ্চায়ন বেশ শক্তিশালী। তিনি চিত্তরঞ্জন ঘোষের রচনাকে অনুসরণ করেছেন। মনস্বী চিত্তরঞ্জন ঘোষ, জঁ আন্যুই এবং সোফোক্লেস-এর পৃথক দুটি নাটক অনুসরণ করে নতুন নাট্যরূপটি প্রস্তুত করেন।

   ক্রেয়ন এবং আন্তিগোনেকে গড়া হয়েছে পরস্পরের বিরোধী করে। ক্রেয়ন শাসক। রাষ্ট্রযন্ত্র তাঁর অবলম্বন। রাষ্ট্রীয় শক্তি, সেনা, অস্ত্রশস্ত্র, মন্ত্রী-পারিষদ সব নিয়ে একটা গোটা ব্যবস্থার প্রতিনিধি ক্রেয়ন। তিনি রাষ্ট্রনায়ক। রাষ্ট্রপ্রধান। আজকে যে-অর্থে ‘nation state’ আমরা বলি, ঠিক সে-অর্থে না হলেও, রাষ্ট্র যে ক্ষমতার প্রধান কেন্দ্র তা স্পষ্ট ছিল সোফোক্লেস-এর সময়ে, স্পষ্টতর হয়েছে জঁ আন্যুইয়ের রচনায়। এক অর্থে নারীর অবস্থান সমাজে প্রান্তিক। নারী যেন পুরুষের সাপেক্ষে গড়ে তোলা দ্বিতীয় সামাজিক সত্তা। পৌরুষের সঙ্গে রাষ্ট্র-শাসনের অঙ্গাঙ্গী যোগ।

   ক্রেয়নের আনুগত্য রাষ্ট্রের প্রতি, বা নিজেই তিনি রাষ্ট্রশক্তির প্রতিভূ। অন্যদিকে আন্তিগোনে নারী, তাঁর ভাবনা পরিবার, রক্তবন্ধন নিয়ে। এক ভাইয়ের শেষকৃত্য হবে, আরেক ভাইয়ের হবে না, এই ভাবনায় তিনি আন্দোলিত। মৃত্যুর পরে আর কি কোনও দোষ-গুণ বিচার করা যায়— এই প্রশ্নটিও উত্তেজিত করে তাঁকে। আন্তিগোনের বোন ইসেমেনে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন— ক্রেয়ন একজন পুরুষ, আমরা নারী। নারী-পুরুষে যুদ্ধ হয় না। পুরুষের সঙ্গে যুদ্ধ আমাদের কাজ নয়। ক্রেয়ন পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে সচেতন এবং নারীর কর্মক্ষেত্রের সঙ্কীর্ণতা বিষয়ে ততটাই কৃতনিশ্চয়। এই দ্বন্দ্বের আখ্যান আন্তিগোনে। আবার, সেই আন্তিগোনেই বিদ্রোহিণী। প্রথাগত মূল্যবোধ অনুসরণ করেই তিনি বিদ্রোহ করছেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সামাজিক প্রথা, মর্যাদা, ঐতিহ্য প্রভৃতির মধ্যেই আন্তিগোনে খুঁজে নিয়েছেন নিজস্ব যুক্তি।

হেগেল বলেছিলেন, ক্রেয়ন ও আন্তিগোনে নিজ নিজ যুক্তিগত অবস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অবশ্য কোনো একটি চরিত্রকে সোজাসুজি সমর্থন করার প্রবণতা সোফোক্লেস-এর ছিল কি না, এটা ঠিক বলা যাবে না। জঁ আন্যুইও ‘আন্তিগোনে’ রচনার ঠিক দশ বছর পর লিখবেন ‘লালুয়েৎ’ বা ‘The Fire Bird’. সেখানেও ধর্মীয় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা সহায় হবে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনায়। ধর্মীয় অস্ত্র প্রয়োগ করা হবে সাধারণ মানুষকে বশ্যতা স্বীকার করাতে। মৌলবাদের সূক্ষ্ম নিপুণ কাঠামোর মধ্যেই মাথা তুলেছিল জ্যন দ্য আর্ক।

   ‘আন্তিগোনে’ নাটকটির নতুন প্রযোজনাকে কেন্দ্র করে পুনরায় অনেকগুলি প্রশ্ন পুনর্বিবেচিত হওয়ার সুযোগ উপস্থিত হল। রাষ্ট্রের কেন্দ্র-প্রবণ ঝোঁক বা একাধিপত্যবাদ জনকল্যাণকে সুনিশ্চিত করতে পারে কি? না কি, রাষ্ট্রের অবদমনকামীতা যাবতীয় বিরুদ্ধ স্বরকে এক ছাঁচে ঢেলে দিতে চায়? বিরুদ্ধ স্বরগুলি দমিত করা গেলে বা নিশ্চিহ্ন করতে পারলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারীরাও নিশ্চিন্ত হতে পারেন। আন্তিগোনে, সে সোফোক্লেস-এর সময়ে হোক বা জঁ আন্যুইয়ের, সেও প্রশ্নে প্রশ্নে বিদ্ধ করে রাষ্ট্রকে।       

   আমাদের মনে পড়বে, ১৮৫৮ সালে বেলগাছিয়া নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হয়েছিল মাইকেল মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক। এর পর ১৮৭৩ সালে, বেঙ্গল থিয়েটার পুনরায় ‘শর্মিষ্ঠা’ মঞ্চায়নের সময়ে স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রীরা। এই ঘটনাও ছিল তৎকালীন প্রথার বিরুদ্ধে এক কবির বিদ্রোহ। বেলগাছিয়া নাট্যশালায় যা সম্ভব হয়নি, সেবিষয়টি মাথায় রেখে এই দাবি তুলেছিলেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর রচয়িতা। বিদ্রোহী ইন্দ্রজিৎ-এর সন্ধান মিলবে আরও পরে, ১৮৬১ সালে। এই বিদ্রোহেরই নতুন রূপ আরব সাগর তীরে সৃষ্টি করবেন এব্রাহিম আলকাজি, জঁ আন্যুইয়ের ‘আন্তিগোনে’ মঞ্চায়নের মধ্যে দিয়ে। মহাভারত-কাহিনির চরিত্র যযাতিকে কেন্দ্র করে শর্মিষ্ঠা ও দেবযানী – এই দ্বন্দ্বসমাস ফিরে আসবে গিরিশ কারনাডের হাত ধরে, ১৯৬০ সালে। অর্থাৎ ‘শর্মিষ্ঠা’ রচনার ১০২ বছর পরে। সেখানেও বৈধ প্রেম, অবৈধ প্রেম— এই বিষয়ে মুখোমুখি সংঘাত।

  ‘আন্তিগোনে’ নাটকেও রাষ্ট্র-অনুমোদিত প্রেমের ভাষ্যকে হেলায় উড়িয়ে বিদ্রোহিণী আন্তিগোনেকে আলিঙ্গন করেন তাঁর প্রেমিক হাইমন। এই হাইমন আবার ক্রেয়নেরই পুত্র। ক্রেয়ন যাঁকে ঘিরে রাষ্ট্রশক্তির উত্তরাধিকারের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা চুরমার হয়ে যায় হাইমনের বিদ্রোহে। হাইমনকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয় আরেকটি প্রশ্নপট। ক্রেয়ন আন্তিগোনেকে মান্যতা দিয়েছিলেন তাঁর ভাবী পুত্রবধূ হিসেবে। এই প্রেম-প্রণয়ই সৃষ্টি করল অন্তর্ঘাত। আন্তিগোনের মৃত্যু আদতে হাইমনেরও মৃত্যুসংবাদ। প্রেম-প্রণয় যখনই রাষ্ট্রীয় অনুমোদনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তখনই রাষ্ট্র তাকে বহিষ্কার করে। সেইজন্য হাইমন পিতার বিরুদ্ধে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। কিন্তু, এই অন্তর্ঘাত বা subversion সম্প্রসারিত হয় ক্রেয়নের রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরেও। রানি ইউরিডিসে পুত্রের মৃত্যু-যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হন। জঁ আন্যুই কিংবা সোফোক্লেস, উভয়ই এই অন্তর্ঘাতকে অবিকৃত রেখেছেন নিজের নিজের সময়ে। প্রাচীন গ্রিক নাটকের সময়েও প্রেমের শক্তি বিদ্রোহকে প্রাবল্য দেয়, আবার জঁ আন্যুইও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রেমকে অন্যতম অস্ত্র বিবেচনা করেন। গিরিশ কারনাডের ‘যযাতি’-র ক্ষেত্রেও পুরুষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার অধিকার নিয়ে দুই নারীর সংগ্রাম।

  গ্রিক ট্র্যাজেডি ও নাটক বিষয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক, চিন্তক এইচ.ডি.এফ. কিটো সোফোক্লেস-এর ‘অ্যাজ্যাক্স’ ও ‘আন্তিগোনে’ নাটক দুটিকে পাশাপাশি রেখে বলেছেন, উভয় নাটকের ক্ষেত্রেই একই সমালোচনা বারবার শোনা গেছে। দুটি নাটকেরই নায়ক/নায়িকা এক অর্থে প্রায় একই অপরাধের শরিক— দুজনেই মৃত্যুবরণ করেন এবং নাটক থেকে ছিটকে যান প্রায় মাঝপথে। ‘অ্যাজ্যাক্স’-কে খানিকটা গৌণ সাব্যস্ত করতে গিয়ে যদিও সমালোচকরা ‘আন্তিগোনে’ নাটকের ত্রুটি-নির্ধারণ বিষয়ে তুলনায় কম সোচ্চার। এলিজাবেথীয় নাটকে যে মৃত্যুর ভয়াবহতা দেখা গেছে, সোফোক্লেস সেসবকে এড়িয়েই চলতেন। কিন্তু ‘আন্তিগোনে’-তে, ক্রেয়ন-পত্নী ইউরিডিসের মৃত্যু ঘটে যায় হাইমনের মৃত্যুর ঠিক পরেই, প্রায় নিঃশব্দে। কেবল সংবাদ জানতে পারেন ক্রেয়ন। হাইমনের মৃতদেহ ফিরে এলেও, আন্তিগোনের মৃতদেহের উপস্থিতি সোফোক্লেস-এর নাট্যনির্মাণে নেই। অথচ নাটকের নাম ‘আন্তিগোনে’। আন্তিগোনে এবং তাঁর বিদ্রোহই যদি এই নাটকের মূল উপজীব্য হত, সেক্ষেত্রে সমালোচকদের একাংশের ‘ill-balanced play’ অভিযোগ যথার্থ হত। বরং সোফোক্লেস এক ভারসাম্যে বিন্যস্ত করেছেন এই নাটকে। আন্তিগোনের বক্তব্য স্পষ্ট এবং সুদূরপ্রসারী, অপরদিকে সোফোক্লেস-এর প্রধান চরিত্র ক্রেয়নকে তাঁর রাষ্ট্র-হিতের সপক্ষে গৃহীত তাবৎ সিদ্ধান্তের ভার বহন করতে হয় নাটকের শেষ পর্যন্ত। তাইরেসিয়াস-এর অভিসম্পাত-সমান বাক্যাবলি, কোরাসের হাহাকার, সবই বর্ষিত হয় নিঃস্ব ক্রেয়নকে লক্ষ্য করে। আন্তিগোনে যেখানে ছন্দময় বাক্যে তাঁর অভিপ্রায় স্পষ্ট ব্যাক্ত করেন, ক্রেয়নকে প্রতি ক্ষেত্রে শব্দচয়ন কিংবা যুক্তি-বিন্যাসে নিজের সঙ্গেই তীব্র সংগ্রামে রত হতে হয়।

দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনার সর্বাধিক সাফল্য এখানেই যে, তিনি এই জটিল বিন্যাসের তন্তুজালকে নাট্যসৃজনে এবং আখ্যান-বর্ণনে সুচিন্তিতভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছেন। বিষয়টা সহজ নয়। এই premise-এর ওপর রচিত নাট্যকৃতির যে মর্যাদা তিনি রক্ষা করেছেন, তা নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্তমূলক। দেবেশ নিজে নাট্য-চিন্তক, গ্রন্থ লেখক। গ্রিসে গিয়ে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। এসব সত্ত্বেও কেউ ব্যর্থ হতেই পারেন। দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের মেধা-মনন ‘আন্তিগোনে’ নাটকের যে উত্থান-পতন এবং এইচ.ডি.এফ. কিটো কথিত যে ‘double foundation’, তাকে সফলভাবে এই বাংলা প্রযোজনায় নিয়ে এসেছে। দেবেশ যেন সেই প্রাচীনদের মতো করেই বুঝতে চেয়েছেন এবং ঐতিহ্যের বিস্তারে অগ্রসর হয়েছেন। সোফোক্লেস এবং আন্যুইয়ের মনোরথের ঠিকানা তাঁর করায়ত্ত। দর্শক প্রায় প্রথম দৃশ্য থেকেই বুঝতে পারছেন আন্তিগোনের ললাটলিখন— এটা সোফোক্লেস এবং আন্যুই, উভয়েরই অভিপ্রায়। এই চিন্তাবীজের চমৎকার উপস্থাপনও করেছেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে শাসক ক্রেয়নের একের পর এক ভাগ্য-বিপর্যয়ের নাটকীয়তা ক্ষুণ্ণ হয়নি তাঁর অতি দক্ষ পরিচালনায়। তাইরেসিয়াস এবং কোরাসের ভূমিকা নিয়ে পরিচালককে দু-একটি কথা জিজ্ঞাসার ইচ্ছা রইল।

এই প্রযোজনায় মঞ্চসজ্জা বা গ্রিক সৈন্যদের পোশাক বহু-দেখা, কিছুটা সাধারণীকৃত ছবির মতো দেখায়। কলকাতার মঞ্চে এখন রেওয়াজই হয়ে গিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দেবশঙ্কর হালদারের অবতরণ। ক্রেয়ন, বিবেকানন্দ, শ্রী অরবিন্দ, ‘চার অধ্যায়’-র অতীন, ‘মাধবী’ নাটকে গালব, সর্বত্রই তিনি। সোফোক্লেস, জঁ আন্যুই, রবীন্দ্রনাথ হয়ে ব্রাত্য বসু— সকলেরই তিনি একনায়ক। তুর্ণা দাশ অভিনয় সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। তবে পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে প্রত্যাশা বিস্তর বলেই এই সামান্য কথাগুলির উল্লেখ।  

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *