বাজি বৃত্তান্ত -

ছবি- দ্য হেলথ সাইট ডট কম

বাজি বৃত্তান্ত

রাজবাড়ি থেকে পথঘাটে বাঙালির ঘরে বাজি ঢোকার ইতিহাসও অনন্য….

আলোকের উৎসবে শব্দের সংযোজন : বাজির উৎপত্তি ও বিস্তার।চীনের প্রাচীন ইতিহাসে খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতেই প্রথম আতসবাজির সন্ধান পাওয়া যায়। তাং রাজবংশের সময় চীনারা বাঁশের নল ও সালফারের মিশ্রণ ব্যবহার করে ‘পাও ঝু (爆竹) নামে যে জিনিসটি তৈরি করেছিল, সেটিই আজকের আতসবাজির প্রাচীনতম রূপ। ধারণা করা হয়, প্রাচীন ভারতেও গুপ্ত যুগের শেষে সালফার ও সল্টপিটার মিশিয়ে আগুনের প্রদর্শনী করা হত, যদিও সেটি ছিল সামরিক ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সীমাবদ্ধ।

ভারতে বাজি বা আতসবাজির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় মুঘল যুগে। সম্রাট আকবরের দরবারে ইতালীয় কারিগরদের হাত ধরে প্রথম বৃহৎ আতসবাজি উৎসব হয়। ইতিহাসবিদ আবুল ফজল আয়ন-ই-আকবরি-তে লিখেছিলেন—“When the night was dark, the heavens blossomed with fires of delight.” সেই ধারাই পরে বাংলায় এসে মিশে যায় দীপাবলি ও কালিপুজোর সংস্কৃতিতে।

বাংলায় বাজির আগমন : রাজবাড়ি থেকে পথঘাটে বাঙালির ঘরে বাজি ঢোকার ইতিহাসও অনন্য। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কলকাতার জমিদারবাড়িগুলিতে, বিশেষ করে শোভাবাজার রাজবাড়ি, সতীশচন্দ্র মিত্রের বাগানবাড়ি ও শোভাবাজার রাজা নবকৃষ্ণ দেবের আমলে কালিপুজোকে ঘিরে বাজির প্রদর্শনী এক সামাজিক পরম্পরায় রূপ নেয়।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এক চিঠিতে লিখেছিলেন,

“অমাবস্যার রাত্রিতে কালীঠাকুরের পায়ে যত প্রদীপ জ্বলে, আকাশে তার চেয়ে অনেক আলোক ফোটায় বাজির ফুল।”

ধীরে ধীরে জমিদারবাড়ির পরিসর ছেড়ে বাজি পৌঁছায় সর্বসাধারণের ঘরে। স্বাধীনতার পরে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বর্ধমান, হুগলির গ্রামাঞ্চলে ছোট ছোট আতসবাজি তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। বিশেষত নইলপুর, নদিয়ার হরিণঘাটা, এবং পরবর্তীকালে চকদিঘি (হুগলি),ক্যানিং অঞ্চলে বাজি তৈরির ঐতিহ্য জন্ম নেয়। এদের হাতেই তুবড়ি, রঙমশাল, চরকি, ফুলঝুরি, রকেট ইত্যাদির শিল্পরূপ গড়ে ওঠে।

তুবড়ি শিল্প কেবল আগুনের বিজ্ঞান নয়, রঙের নন্দনতত্ত্বও। মাটির পাত্রের ঘ্রাণ, তার উপর আগুনের ছন্দ এই দুইয়ের মিলনেই জন্ম নেয় সেই মোহনীয় দৃশ্য, যা একসময় কলকাতার ছাদের ওপর, গলির মোড়ে কিংবা বাড়ির উঠোনে একত্রে উপভোগ করত গোটা পরিবার। বুদ্ধদেব বসু একবার বলেছিলেন—

“তুবড়ি হচ্ছে সেই ছোট্ট সূর্য, যে আমাদের অমাবস্যার ভেতর নিজের গ্যালাক্সি তৈরি করে।”

আজও গ্রামীণ বাংলার অনেক জায়গায় তুবড়ি বানানোর কাজ হাতে করা হয়। জিঙ্ক, ম্যাগনেশিয়াম ও তামার গুঁড়োর মিশ্রণে রঙের বৈচিত্র্য তৈরি করা হয়, এবং নিরাপত্তা মেনে এই তুবরিগুলি তৈরি করা একপ্রকার লোকশিল্প।অরুণাচল দত্ত চৌধুরীর তুবড়ির গল্প প্রবন্ধে লিখেছেন,’ গোপন ভাগের হিসেব। বল্টুদা বলত,– শুধু ভাগ বলিস কেন? বলতে হয় পুরোটা। যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের হিসেব। নইলে ওনারা রাগ করেন।

– ওনারা মানে? কারা?মন্ত্রগুপ্তি শোনানোর ভঙ্গীতে বল্টুদা বলত ফিসফিস করে, – কারা আবার? ওই সোরা গন্ধক পটাশ লোহাচুর অ্যালুমিনি কাঠকয়লার পাউডার মানে ওই সবের মাঝে লুকিয়ে থাকা বাজির ভগবানেরা। উড়ন আর বসন দুরকমের আবার ভগবান আলাদা সেটা জানিস তো?’

রঙমশাল, যাকে অনেকেই রঙের মশাল বলেন, মূলত একধরনের বড় ফায়ারওয়ার্ক বা রকেট জাতীয় আতসবাজি। এটি জ্বালালে আকাশে উঠে বিস্ফোরিত হয় নানা রঙের ফুলের মতো আলো। কেউ বলে “ফুলঝুরি”, কেউ বলে “স্কাই বোমা”,কিন্তু রঙমশালের নিজস্বতা হলো এর রঙের ভাষা।

 প্রাচীন বাজিশিল্পী, হুগলির লক্ষ্মণ মণ্ডল, এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,”আমরা রঙমশালে কালী মাতার চোখের মতো রঙ রাখি—নীল, লাল, সোনালি।”

এই রঙের বিস্ফোরণই যেন দেবীশক্তির প্রতীক—অন্ধকারকে ছিন্ন করে বেরিয়ে আসে আলোর ঝলকানি। কালিপুজোর রাত্রিতে যখন অমাবস্যার অন্ধকার সবচেয়ে গাঢ়, তখনই আকাশে সেই রঙমশালের গর্জন—যেন কালী মা নিজে রণদেবীর মূর্তি ধারণ করেছেন।বহু মানুষ আজ বাজিকে শুধুমাত্র আনন্দ বা বিনোদনের অংশ ভাবলেও, এর গভীরে রয়েছে এক আধ্যাত্মিক তাৎপর্য। কালী হলেন “অন্ধকারের মধ্যে আলোর জন্মদাত্রী। তাঁর উপাসনা মানে জীবনের সমস্ত ভয়, অজ্ঞান ও অশুভের অন্ধকারকে জ্বালিয়ে দেওয়া।তাই কালিপুজোর রাতে বাজির শব্দে, আলোয় ও রঙে আমরা যেন এক প্রতীকী রণধ্বনি শুনি“অন্ধকার বিদূরিত হোক, জয় হোক আলোর।”শাস্ত্র মতে, আগুন হচ্ছে পবিত্রতার প্রতীক। অথর্ববেদ-এ বলা হয়েছে,অগ্নির্মূর্ধা দ্যৌঃ প্রিথিবী অযম্।অর্থাৎ, অগ্নিই হলেন স্বর্গ ও পৃথিবীর সংযোগসূত্র। তাই কালিপুজোর বাজির আগুন আসলে সেই পবিত্র আগুন, যা ঘরের অন্ধকারও মুছে দেয়, আর মনের ভয়ও পোড়ায়।

ভূত-তাড়ানোর প্রতীক হিসেবে আগুন ও শব্দের ভুমিকা নিয়ে দু’কথা।প্রাচীন ভারতীয় এবং চীনা সংস্কৃতিতে আগুন ও শব্দ ,এই দুই উপাদানকে অশুভ তাড়ানোর শক্তি বলে মনে করা হতো।

চীনে নববর্ষে বাঁশের গুড়ির ভেতরে আগুন দিয়ে “পাওঝু” নামের বাজি জ্বালানো হত, বিশ্বাস ছিল দুষ্ট আত্মা “নিয়ান” সেই আওয়াজে পালিয়ে যায়।ভারতের গ্রামীণ সমাজেও বিশ্বাস ছিল, জোরে আওয়াজ করলে ভূত-প্রেত, অশরীরী ও অপদেবতা দূরে সরে যায়।বাংলায় কালীপূজা মূলত অমাবস্যার রাতে, যখন আকাশ সম্পূর্ণ অন্ধকার। এই রাতকেই লোকবিশ্বাসে “ভূতের রাত্রি”বা “অশুভ শক্তির সময়”বলা হত।

তাই সেই রাতেই দেবী কালীকে আহ্বান করা হয়  তিনি “অশুভ বিনাশিনী, “চণ্ডিকা”, “রক্ষাকর্ত্রী”।এই ভাবনা থেকেই লোকবিশ্বাসে বলা হত,“কালী মাতার পূজোর রাতে যত আলো আর আওয়াজ হবে, ততই ভূত পালাবে।এই বিশ্বাস থেকেই তুবড়ি, রঙমশাল,চরকি, বোমা ইত্যাদির ব্যবহার শুরু হয়েছিল,অর্থাৎ, আলো (যা অন্ধকার তাড়ায়) এবং আওয়াজ (যা ভূত তাড়ায়)

গ্রাম বাংলায় কালিপুজোর আগের রাতে ছেলেরা ছোট বাজি বা “খরকি, “ফাটকা” ফাটিয়ে চিৎকার করত— “ভূত পালাও, কালী এলেন!”অনেক জায়গায় এখনো প্রবীণরা বলেন “কালির রাতে আলো কম রাখো না, নয়তো ভূত বসে পড়বে।‘’একইভাবে, গ্রামের পুকুরঘাট, বনপথ বা শ্মশানপাশে বাজি জ্বালানোর প্রথাও ছিল—যাতে অশুভ শক্তি বা প্রেতাত্মা ভয় পেয়ে সরে যায়।শাস্ত্র অনুযায়ী, কালী হলেন অন্ধকারের দেবী, কিন্তু তাঁর অন্ধকারই আলো জাগায়। সেই আলো হচ্ছে জ্ঞান ও সাহসের প্রতীক।বাজির আগুন তাই কেবল বিনোদন নয়, এক প্রতীকী আচার যা অজ্ঞতা, ভয়, ও অশুভ শক্তিকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া।

আধুনিক যুগে যখন দূষণ ও শব্দদূষণ নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে, তখন বাজির ব্যবহার নিয়েও বিতর্ক উঠেছে। অনেকেই এখন ইকো-ফ্রেন্ডলি বাজি বা গ্রীন ক্র্যাকার্স-এর দিকে ঝুঁকছেন। এতে শব্দমাত্রা কম, ধোঁয়া ও কার্বন নিঃসরণও নিয়ন্ত্রিত।

কলকাতা হাই কোর্ট ও ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইব্যুনাল বহুবার এই বিষয়ে নির্দেশ জারি করেছেন ,কালীপুজোয় শুধুমাত্র অনুমোদিত গ্রীন বাজি ব্যবহার করা যাবে। এক অর্থে, এটি পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি ঐতিহ্যকে নিরাপদ রাখারও প্রচেষ্টা।যেভাবে কালী মূর্তির সামনে জ্বলে হাজার প্রদীপ, তেমনই আকাশে বাজির রঙে যেন দেখা যায় সেই প্রদীপেরই প্রতিচ্ছবি। রূপালি স্ফুলিঙ্গগুলো যেন মাতৃমুখের হাসি, লাল আলো যেন তাঁর রক্তাভ চোখের দীপ্তি।চিত্রশিল্পী যামিনী রায় বলেছিলেন,“আলোক, শব্দ ও গতি—এই ত্রয়ী মিলে বাজিকে করে তোলে শিল্পের এক রূপ।”

অবশেষে, দীপাবলির আলোর উৎসব ও কালীপূজোর অগ্নি–জ্যোতি আমাদের মনে এক গভীর প্রশ্ন জাগায়,কীভাবে আমরা প্রকৃত অন্ধকারটিকে মুছে ফেলব? আতসবাজির ঝলকানিতে রাতের আঁধার মিলিয়ে যায় বটে, কিন্তু বিদ্বেষ, হিংসা, নারীর প্রতি অবমাননা আর অন্যায়ের যে ঘন অন্ধকা তা দূর করতে হবে আমাদের হৃদয়ের আলোয়। আসুন এই দীপাবলিতে, মা কালীর চরণে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের সমাজ থেকে এই অমানবিক অন্ধকার, অন্যায় আর ঘৃণার বিষ ছায়া চিরতরে মুছে দেন, আর সত্য, প্রেম ও ন্যায়ের আলোয় মানবতার দীপ জ্বালিয়ে রাখেন চিরকাল।

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *