উত্তমকুমারকে নিয়ে যতই লেখা হোক না কেন, যেন কিছুই যথেষ্ট নয়। রূপালি পর্দার রোমান্সের সম্রাট, বাংলা সিনেমার মহানায়ক, একজন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য,উত্তমকুমার একাধারে অনুভব, এক বিস্ময়, এক অমরতা। তবে উত্তমকুমারকে যিনি সম্পূর্ণভাবে একজন অভিনেতা হিসেবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তিনি হলেন চলচ্চিত্রের জাদুকর সত্যজিৎ রায়। একজন কিংবদন্তির চোখে আরেক কিংবদন্তির যে মূল্যায়ন, তা আজও সিনেমা-ইতিহাসের একটি বিশাল অধ্যায় হয়ে আছে।
১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রজগতে পা রাখলেও উত্তমকুমারকে দর্শক মনে রেখেছে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’,’সবার উপরে’,‘হারানো সুর’,‘সপ্তপদী’,’চৌরঙ্গী’,’বাঘবন্দী’,’যদুবংশ’,’সন্ন্যাসী রাজা’,’
‘নায়ক’এর মতো অগণিত ছবির জন্য। ষাট ও সত্তরের দশকে উত্তম-সুচিত্রার যুগলবন্দি বাংলা সিনেমার এক অনন্য স্বর্ণযুগ গড়ে তোলে। কিন্তু শুধুই রোমান্টিক নায়ক বললে উত্তমকুমারের প্রতি অবিচার করা হবে।
সত্যজিৎ রায় উত্তমকে প্রথম আন্তর্জাতিক মানের অভিনেতা রূপে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নায়ক’ (১৯৬৬) ছবির মাধ্যমে। সেখানে একজন সফল, কিন্তু অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত সিনেমা তারকার মনের দ্বন্দ্বকে উত্তম যেভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তা বিশ্ব-সিনেমার ইতিহাসেও বিরল।
সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন:“নায়ক চিত্রনাট্যটা লেখার সময় আমার মনে ছিল শুধু একজন-উত্তম। আমি জানতাম, এই চরিত্রে ও ছাড়া কেউ পারবে না।”
‘নায়ক’-এ উত্তমকুমার অভিনয় করেন অভিজিৎ রায়ের চরিত্রে—এক সুপারস্টার, যার বাইরের গ্ল্যামারের আড়ালে লুকিয়ে আছে চাপা অপরাধবোধ, অনুতাপ, অহংকার ও অতৃপ্তি। ট্রেনে এক সাংবাদিক তরুণীর সঙ্গে আলাপ এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসে অভিজিতের ভেতরের মানুষটা।
সত্যজিৎ রায়ের ভাষায়-“আমি উত্তমকে দেখেছি চরিত্রের গভীরে ঢুকে পড়তে। আমার চিত্রনাট্য পড়ে ও রিহার্সাল ছাড়াই অনেক দৃশ্য একবারেই নিখুঁত করে তুলেছে।”
উত্তমকুমারের শরীরী ভাষা, সংলাপের ওঠাপড়া, চোখের ভাষা—এইসব মিলিয়ে এক অভিনয়ের স্টাইল তৈরি করেছিলেন তিনি।বিখ্যাত অভিনেতা ও শিক্ষক সন্তোষ সিংহের কাছে থেকে ৫৬ রকম মুখের এক্সপ্রেশন শিখেছিলেন। সত্যজিৎ রায় বলতেন,“উত্তমের সবচেয়ে বড় গুণ, ও কখনও অতিরিক্ত করে না। ওর মধ্যে একটা ভারসাম্য আছে, যেটা একমাত্র প্রকৃত শিল্পীর মধ্যেই থাকে।”
‘নায়ক’-এর একটি দৃশ্য—যেখানে উত্তম বিছানায় শুয়ে ছেলেবেলার অপমানের কথা মনে করছে, মুখে কোনো সংলাপ নেই, কেবল চোখে অভিব্যক্তি,সেই দৃশ্য আজও বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটি পাঠ্যদৃষ্টান্ত।
সত্যজিৎ কখনোই বাণিজ্যিক অভিনেতাদের অভিনয়গুণ নিয়ে সরল প্রশংসা করতেন না। কিন্তু উত্তমের বেলায় তাঁর অবস্থান ছিল আলাদা।“উত্তমের মধ্যে একটা স্নিগ্ধতা আছে, একটা আত্মবিশ্বাস আছে, আবার একটা ভাঙাচোরা মানুষও আছে। এই বৈপরীত্যটাই অভিনয়ে তাকে অনন্য করে তোলে।”
তিনি বারবার বলেছেন, উত্তম শুধু নায়ক ছিলেন না,তিনি ছিলেন একজন ‘থিঙ্কিং অ্যাক্টর’ ‘thinking , মানে যার অভিনয়ের পেছনে ছিল উপলব্ধি, বিশ্লেষণ এবং চরিত্রমনের ভেতরে ঢোকার ক্ষমতা।
সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ মুক্তি পায় বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। সেখানে বিদেশি সমালোচকরাও উত্তমের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন। ইউরোপিয়ান পত্রপত্রিকায় লেখা হয়, “অ্যান অ্যাকটর অফ সুপ্রিম স্যাটেলিটি অ্যান্ড গ্রেস।”
সত্যজিৎ বলেছিলেন,“ওই ছবিতে উত্তম যেভাবে অন্তর্মুখী যন্ত্রণাকে ফুটিয়ে তুলেছে, তা যে কোনও আন্তর্জাতিক স্তরের অভিনেতার সঙ্গেই তুলনীয়।”
যদিও উত্তমকুমার অনেক আগেই সুপারস্টার হয়ে উঠেছিলেন, সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরেই তিনি হয়ে ওঠেন “মহানায়ক”,শুধু বাংলার নয়, গোটা ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক অন্যতম উচ্চতা।
সত্যজিৎ বলেছিলেন, “উত্তমকে নিয়ে আমি আরও ছবি করতে চেয়েছিলাম। ওর মধ্যে বিশাল সম্ভাবনা ছিল। আফসোস, সময় পেলাম না।”
উত্তমকুমার ছিলেন স্টারডমের প্রতীক। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন এক নিখুঁত অভিনেতা একজন “পুরো মানুষ”। তাঁদের একসঙ্গে কাজ শুধু সিনেমাকে নয়, দর্শকদের মনকেও সমৃদ্ধ করেছে।আজ উত্তম নেই, সত্যজিৎও চলে গেছেন। কিন্তু ‘নায়ক’ ছবির সেই ট্রেনের কামরায় অভিজিৎ রায়ের মুখোমুখি সত্য উন্মোচনের মুহূর্ত আজও আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়।
কারণ উত্তম শুধু অভিনয় করতেন না, তিনি বেঁচে থাকতেন তার চরিত্রের মধ্যে। আর সত্যজিৎ রায় সেই সত্যিকারের উত্তমকুমারকেই আমাদের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন।
শেয়ার করুন :