সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার: কঠোরতর হচ্ছে নিয়মাবলি
সিঙ্গাপুর এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের বিভিন্ন সরকার এখন শুধু পোস্টের বিষয়বস্তু নয়, বরং কে সামাজিক মাধ্যমে অংশ নিতে পারবে সেটিও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে।
ভিয়েতনামে নতুন ডিক্রি ১৪৭ অনুযায়ী, ব্যবহারকারীদের জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্থানীয় মোবাইল নম্বর দিয়ে অ্যাকাউন্ট ভেরিফাই করতে হবে। মালয়েশিয়া ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করেছে। ইন্দোনেশিয়া ১৮ বছর বয়সের নিচে প্রবেশ নিষিদ্ধের কথা ভাবছে, আর অস্ট্রেলিয়া ইতিমধ্যে ১৬ বছরের নিচে শিশুদের নিষিদ্ধ করেছে।
এই পরিবর্তন কেবল পোস্ট নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং কারা অংশ নিতে পারবে—তা নিয়ন্ত্রণের দিকে এগোচ্ছে। বয়স, পরিচয়পত্র, অবস্থান—এসব হয়ে উঠছে প্রবেশাধিকার নির্ধারণের মূল শর্ত। এতে অংশগ্রহণের সুযোগ সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে।
অতিরিক্ত সুরক্ষা না হয়ে যেন হয় না বর্জন
সব বয়সের, বিশেষত তরুণদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে যদি তাদের পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়, তাহলে তারা নিরাপদ পরিবেশের বদলে অনিয়ন্ত্রিত প্ল্যাটফর্মে চলে যেতে পারে। যেমন, অস্ট্রেলিয়ার ১৬ বছরের নিচের শিশুদের নিষেধাজ্ঞা বিশ্বজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে, কিন্তু তা কতটা কার্যকর হয়েছে তা এখনো পরিষ্কার নয়।
ব্রিটিশ গবেষক সোনিয়া লিভিংস্টোন এর মতে, তরুণদের জন্য অনলাইন জগতে নিরাপদ ও অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই উচিত। শুধুমাত্র পরিচয় যাচাই না করতে পারলে কাউকে বাদ দেওয়া উচিত নয়।চিহ্নিত ব্যবহারকারীরাও অপরাধী হতে পারে।পরিচয় প্রকাশ বা অজ্ঞাত থাকা,উভয় ক্ষেত্রেই অনলাইনে ক্ষতি হতে পারে। অনেক সময় পরিচিত নামেও অপরাধ সংঘটিত হয়। সুতরাং, সমস্যার মূল নয় পরিচয় গোপন, বরং দায়বদ্ধতার অভাব।
দৃশ্যমানতা সবসময় গুণ নয়
আজকের বিশ্বে যেকোনো কিছুতে দৃশ্যমানতা যেন গুণ হয়ে উঠেছে, আর অদৃশ্যতা যেন ঝুঁকি ,এই ধারণা ভুল। অনেক সময় গোপনতা প্রয়োজন হয়, বিশেষ করে হুইসেলব্লোয়ার, নির্যাতনের শিকার বা প্রান্তিক সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য। গোপনতা কখনও-সখনও সৃজনশীলতা, পরীক্ষামূলক চিন্তা ও আত্ম-প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়।
প্রবেশপথে নিরাপত্তা নয়, প্রতিক্রিয়ার দক্ষতা জরুরি
অনেক দেশ এখন পরিচয় যাচাই, বয়স যাচাইয়ের মতো ‘দ্বাররক্ষী’ নীতিতে জোর দিচ্ছে। এতে যেন প্রবেশদ্বারে নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত নিরাপত্তা তখনই আসে, যখন সিস্টেম বিপদে সঠিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে।
সিঙ্গাপুরে এই ভারসাম্য আনার চেষ্টাই দেখা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, POFMA আইনটি ছিল ভুল তথ্য সংশোধনে ব্যবহৃত, না যে সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্লক করবে। পরবর্তী Online Safety Act আরও ক্ষমতা দিয়েছে যেমন শিশুর যৌন নিপীড়ন, আত্মহত্যা প্ররোচনা বা সহিংসতা প্রচারের কনটেন্ট সরাতে। তবুও, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতিকর কনটেন্ট এখনও এই আইনের আওতার বাইরে।
২০২৬ সালে আসছে Online Safety (Relief and Accountability) Bill, যা একটি Online Safety Commission গঠনের মাধ্যমে শুধুমাত্র গুরুতর ক্ষতির ক্ষেত্রে পরিচয় জানাতে বাধ্য করবে—আর সেটিও আইনি প্রমাণ ও প্রেক্ষাপটে।
সিস্টেম সংস্কারই আসল চাবিকাঠি
সরকারগুলো যা সহজে বোঝে, তাই করছে—আইডি যাচাই, বয়স ফিল্টার, অথচ আসল প্রশ্নগুলো তোলা হচ্ছে না।কেন সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম বারবার নেতিবাচক, উসকানিমূলক কনটেন্ট সামনে আনে?রিপোর্ট করার ব্যবস্থা কেন এত জটিল ও অকার্যকর?কেন কিছু প্ল্যাটফর্ম দ্রুত ক্ষতির প্রতিক্রিয়া দেয়, আর কিছু দেয় না?সোশ্যাল মিডিয়াকে নিরাপদ করতে হলে দরকার ব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার,এমন ডিজাইন, যেগুলো ব্যবহারকারীকে গুরুত্ব দেয়, সহানুভূতির সঙ্গে পরিচালনা করে এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে।
সংক্ষিপ্ত সার:
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রবেশাধিকার কঠোর হচ্ছে। শুধু কনটেন্ট নয়, এখন কে প্ল্যাটফর্মে আসবে সেটাও নির্ধারিত হচ্ছে। অথচ, নিরাপত্তা মানে কেবল প্রবেশ আটকে দেওয়া নয়, বরং ক্ষতির সময় কার্যকর প্রতিক্রিয়া দেওয়া। সুরক্ষা আর বর্জনের মধ্যে ভারসাম্য রাখাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সূত্র- চ্যানেল নিউজ এশিয়া,গার্ডিয়ান।
শেয়ার করুন :