নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী
আমাদের জীবনে জাতকর্মের সংস্কারের মধ্যে অন্নপ্রাশন,উপনয়ন,বিবাহ সর্বত্রই তামা,পিতল, কাঁসার তৈরি একটা দর্পণ রাখা হয় মাঙ্গলিক চিহ্ন হিসেবে।এর সবচেয়ে বড় কারণ তো এটাই যে,স্থির জল ছাড়াও মানুষ যেদিন প্রথম তামার পাত ঘষে ঘষে চকচকে উপরিতলের ওপর নিজের স্থির প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল,সেদিন থেকেই এই প্রথম আয়নাটা স্মরণে রেখে দিল মানুষ,মাঙ্গলিক হিসেবে এখনও তা অন্নপ্রাশন,বিবাহ কিংবা বহু উপাচারের পুজোয় বরণডালা বা কুলোর মধ্যে দর্পণের স্থান হয়ে গিয়েছে।
শুধু ভারতবর্ষের আস্তিক ধর্ম নয়,নাস্তিবাদী বৌদ্ধদের মধ্যেও অষ্টমঙ্গলের রূপ আছে এবং তার মধ্যে একটা কিন্তু দর্পণ।তিব্বতী বৌদ্ধরা বলেন -বুদ্ধ ছয় বছর ধরে কঠোর পরিশ্রমে তপস্যা করার পর তাঁর শরীর একেবারে শীর্ণ-শুস্ক হয়ে গিয়েছিল,এই অবস্থায় লেক্ষে নামের এক ব্রাহ্মণ রমণী তাকে দই খেতে দেন।সেই দই খাওয়ার পরেই তাঁর শীর্ণ দেহ মেদ -মাংসে ভরাট হয়ে ওঠে এবং তখন তাঁর শরীরের মধ্যে লুপ্তপ্রায় দেবচিহ্নগুলি ফুটে উঠতে থাকে।ঠিক এই সময় আকৃতি দেবী যিনি জীবের দেহ এবং আকার সৃষ্টি করেন ,সেই আকৃতি দেবী বুদ্ধের হাতে একখানি দর্পণ দেন তাঁর আপন প্রতিকৃতি দেখার জন্য।সেই থেকে দর্পণ বৌদ্ধদের কাছেও মাঙ্গলিক।
আরও পড়ুন:
আমরা দর্পণকে মাঙ্গলিক হিসেবে গ্রহণ করেছি বহুকাল।কুষাণ কিংবা শুঙ্গ যুগের শিল্পকৃতিতে আমরা দর্পণের খোঁজ পাচ্ছি,মেয়েরা সামনে আয়না ধরে আপন সৌন্দর্য পরীক্ষা করছে এই খবর আমাদের কাছে খুব বাস্তবোচিতভাবেই স্বাভাবিক।কিন্তু আয়নায় যে -রূপ ফুটে উঠেছে,তার দার্শনিক তাৎপর্য এমনই যে ,সেখানে আমরা মৃন্ময় জাগতিক সত্তাকে চিন্ময়ী হয়ে উঠতে দেখি।আমরা যখন দর্পণে নিজের মুখ দেখি,তখন সেই প্রতিবিম্বকেই আমরা ‘আমি’ বলে ভাবি।সেই ‘আমি’ দেখার পর বেশিরভাগ সময়েই ‘মাছের মধ্যে রুই /আর মানুষের মধ্যে মুই’গোছের দর্পণ- দর্প তৈরি হয় মনে;কখনও- বা যদি এমন হয় যে,নিজের স্বরূপকে নিজের মনে তেমন করে ধরছে না,তাহলে সেই প্রাতিভাসিক প্রতিবিম্ব থেকে শিক্ষা নিয়ে আজন্মলব্ধ মুখ- শরীরে যথাসম্ভব পরিবর্তন এনে নিজেকে যথেষ্ট পরিমাণ গ্রহণীয় করে তোলার চেষ্টা করি।স্বভাবিত এবং স্বচেষ্টায় পরিকল্পিত সেই পরিবর্তিত রূপ আয়নায় দেখে তখন হয়তো ভালোও লাগে।মনে হয় আসল আমি তাহলে এটাই।কিন্তু মনে মনে মানুষ জানে যে আয়নায় দেখা মুখ-চোখ শরীর আমি নই।’আমি’র প্রতিভাস।
দর্পণে দেখা এই প্রাতিভাসিক সত্যটাকে আমরা যখন দার্শনিকতার মধ্যে প্রতিষ্ঠা করি,তখন কিন্তু এই জড় দর্পণ বস্তুটাকে এক সজীব রূপকের মতো দেখতে পাই।প্রথমেই তখন মনে হয়,দর্পণ নিজেই এক সজীব সত্তার অনুকার।দার্শনিক দৃষ্টিতে মানুষের চোখই কিন্তু আদিম দর্পণ যেখানে ছায়া পড়ে অনন্ত মানুষের,পরিবার -পরিজনের,বন্ধু-বান্ধবের,অন্যান্যের।আমার চোখে যখন অন্যজনকে দেখি,তখন সে কিন্তু আমার চক্ষু দর্পণে নিজেকে দেখছে এবং একইসঙ্গে তার চোখের আয়নায় কিন্তু আমি আমাকেও দেখছি।এই চক্ষু- দর্পণের মাধ্যমেই আমাদের পরস্পরের সম্পর্ক তৈরি হয় এবং সেই পরস্পরের চাক্ষুষ পরিচয়ের পর্যাবসান ঘটে চিত্ত – দর্পণের ছায়ায়।মহাকবিকে তখন লিখতে হয় –
আপনাকে এই জানা আমার ফুরোবে না
সেই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা
দুর্গা পুজার দশমীতে যখন সেই আদিম জল -দর্পণে মহাদেবীর প্রতিমাচ্ছবি ভেসে ওঠে,পুরোহিত মন্ত্র পড়তে থাকেন -‘গচ্ছ গচ্ছ পরং স্থানং স্বস্থানং পরমেশ্বরি’-পরম দেবী আমার!তুমি নিজের জায়গায় যাও এখন।বচ্ছর গেলে তুমি আবার এস এখানে আমার ঘরে -পুনরাগময় চ।এই যে দেবী নিজের জায়গায় যাবেন,সেই নিজের স্থানটুকু নির্দেশ করা হয় দর্পণে-যেখানে দেবীর মৃন্ময়ী সত্তা চিন্ময়ীতে মিলিয়ে যাবে।দর্পণ এখানে সূর্যমন্ডলের প্রতিরূপ।দর্পণের মন্ত্রের মধ্যেই তার এই সূর্যস্বরূপতা ফুটে ওঠে।ঋগ্বেদের ভাবনায় দর্পণ হল সেই পুরাতন আদিম জ্যোতিস্বরূপ যেখানে প্রতিটি দিনের কর্মাকর্ম যেন দেখতে পাওয়া যায়-যেন পশ্যন্তি বাসরম্।আর যজুর্বেদের মন্ত্রে দর্পণের মধ্যবর্তী সূর্য পৃথিবী ভ্রমণ করছেন।এই দর্পণে যখন দুর্গামূর্তির প্রতিভাস ভেসে ওঠে,তখনই বুঝতে পারি জ্যোতিঃস্বরূপিণী যে দুর্গামাকে আমরা এই চারদিন ধরে চক্ষু দর্পণে মৃন্ময়ী রূপে প্রতক্ষ্য করেছি,তিনি আবার চিত্তদর্পণে আশ্রয় নিলেন,তিনি মিলিয়ে গেলেন সূর্যমন্ডলের মধ্যে।এই সূর্যমন্ডল আসলে আমাদেরই হৃদি আকাশে অবস্থিত হৃদয় -দর্পণ।
শেয়ার করুন :