পুজোর গান,গানের পুজো -

পুজোর গান,গানের পুজো

এমন অনেক গান আছে যা শুনলে আমার এক একটা বয়সের পুজোর সময়টা মনে পড়ে যায়…

শিলাজিৎ মজুমদার

দুই বন্ধু রোয়াকে বসে আছি।মনোরমা কেবিন থেকে সদ্য ভাজা ফিশ ফ্রাইয়ের সুবাস টোকা মারছে নস্ট্রিলসে।দুজনের পকেটে আট টাকা করে যদি না থাকে তাহলে একটা অপশন অবশ্যই যেকোনো একজনের কাছে ষোল টাকা থাকা, আমরা তৃতীয় অপশনটাকেই  বেছে নিয়েছিলাম আর অন্য কোনো অপশন না ভেবে,অনেক কিছুই করা যেত।মানুষের কাছে অপশনের কমতি থাকে না ,কত মানুষ যে কতরকম ভাবনা ভাবতে পারে, একটু ভেটকি মাছের ওপর ডিম আর লেড়ো বিস্কুটের গুঁড়ো ভাজার গন্ধ পেয়ে তার ইয়ত্তা নেই,আমরা তৃতীয় অপশনটাকেই অনুচ্চারিত সম্মতিতে মেনে নিয়ে চূড়ান্ত ভেবে নিতে কষ্ট পাইনি ,আমরা অর্ধভোজনে তৃপ্ত থেকে গান নিয়ে আলোচনা করছিলাম।আর ডি বর্মনের সুরে পুজোয় নতুন গান রিলিজ করেছে রে?

কে গাইছেন,কে লিখেছেন এসবের আগেও আর ডি বর্মনের সুরে। ইয়েস আমরা জানতাম ওনার  পুজো অ্যালবামে উনি গাইবেন,আশা ভোঁসলে গাইবেন,আর উনি একটা অদ্ভুত আওয়াজ তৈরি করবেন,যা অন্যরকম হবে , আর দারুণ হবে।একটা না শুনতে পাওয়া ডিলে যাকে তখন আমরা ইকো বলতাম- কিংবা এমন একটা বাজনার মিশেল যা আমরা অন্য বাংলা গানে শুনতে অভ্যস্ত নই, আর সেই অদ্ভুত সাউন্ড ডিজাইনের গ্রূভে ,ঘোরে আমাদের পুজোর আগের সময় থেকে শুরু করে পুজোর চারটে দিন তা বাজতে থাকবে,বাজতেই থাকবে। ভোমলা দার বক্সে,তখন আমরা স্পিকার টিকার বলতাম বলে মনে হয়না,সে সময় ছিল মাইক আর বক্সের যুগ।তখন আমাদের যৌবন,আমরা যারা এখন হবু সিনিয়র অথবা সিনিয়র সিটিজেন।

আরও পড়ুন :

সেই সময়টা ছিল পুজোর গানের উন্মাদনার মধ্য বা প্রায় অন্তিম যুগ,৮২/৮৩ সালের কথা বলছি কারণ ২০০০ সালের পর থেকে আস্তে আস্তে বাংলা বেসিক গান শুধুমাত্র পুজোর জন্য অপেক্ষা করেনি,বছরের বিভিন্ন সময় নতুন গান রেকর্ড ও রিলিজ হতে শুরু করেছে ঠিকই ,কিন্তু পুজোর গানের চাহিদা যে কোনো কারণেই হোক ফিকে হতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। এসব কেন,কিভাবে,কবে,কোথায়, তত্ত্ব তথ্য এত সব না আছে মাথায় না আসছে হাতে।  আমার মনে পড়ছে আমার খুব ছোটবেলার পুজোর গানের সময়টা,

তারে আমি চোখে দেখিনি ‘
তখন আমার বয়স কত হবে -৯/১০ ,ক্লাস থ্রি কিংবা ফোর।সেই সময়ের পুজোর দিনগুলোয় ছিলাম মামার বাড়িতে। Pলক্ষী পুজোর সময়টা মনে পড়ছে ,গড়গড়িয়ার বাড়ি থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম গানটা ,একটা মোচ্ছব হচ্ছিল,চোখের সামনে ভাসছে দৃশ্যটা,খামারের ভেতরে সারি দিয়ে বসে আছে গ্রামের সবাই,গরম পাতলা খিচুড়ি,সবজির ঘ্যাঁট,কালো তেঁতুলের টক পরিবেশন করছে পাড়ার বড়রা, আরও বড়রা তদারকি করছে ,বিরাট উনুনে গনগনে আঁচে বিরাট লোহার কড়াইয়ে টগবগ করছে খিচুড়ি ,গোটা গ্রাম মেতে উঠেছে উৎসবে।সেই ছোটবেলার খিচুড়ির গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে ‘তারে আমি চোখে দেখিনি ‘।পরে শুনেছি কিশোর কুমারের এই গানে সুর করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর, সেই ইপির দুপিঠে অন্য গানটি ছিল ‘আমি নেই ভাবতে ব্যাথায় ব্যাথায় মন ভরে যায়,আবার কি আশ্চর্য সেই বছরে লতা মঙ্গেশকরের পুজোর গানে সুর করেছিলেন কিশোরকুমার,গান দুটি ছিল ‘প্রিয়তম কী লিখি তোমায়’ এবং ‘ভালোবাসার আগুন জ্বেলে’। শোনা যায় সেই সময়ে এই দুই কিংবদন্তির কোনও সময়ের কোনও এক মতবিরোধ কে কেন্দ্র করে ওনাদের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সেই দূরত্ব ঘোচাতে এই ইপি র পরিকল্পনা।তারা হয়তো বলে দেবেন কোন গানটা,আমার ঠিক মনে পড়ছে না কিন্তু এই গানের লিরিকের প্রথমটা আমায় বেশ মজা দিয়েছিল, চোখে দেখেনি তবুও তার গল্প শুনেই, একটা মানুষ কি করে তাকে অল্প অল্প ভালবাসতে শুরু করেছিল, সেটা স্ট্রাইক করেছিল, আজও করে। কিন্তু আজও গানটা যখনই কানে আসে, চোখের সামনে গ্রামের বাড়ির মোচ্ছব,সেই আনন্দের এক লহমার স্মৃতি উঁকি মারে। মুখগুলো মনে থাকে না, মুহূর্তগুলো মনে থাকে। এ গান শুনলেই তাই যে কোনও সময় পুজোর মতো আনন্দের ঝলকানি আসে শরীরে। মনে হয় পুজো এসে গেল বুঝি, শরৎ এর আকাশে মেঘ দেখলে ,কাশফুল দেখলে,শিউলির গন্ধ পেলে যেমন মনে হয় ঠিক সেরকম।এমন অনেক গান আছে যা শুনলে আমার এক একটা বয়সের পুজোর সময়টা মনে পড়ে যায়,এত জড়িয়ে আছে সেই গানের সুর আর কথাগুলো পুজোর মুহূর্তগুলোর সাথে।যেমন ‘পরদেশিয়া,ইয়ে সচ হ্যায় পিয়া’।
সেই সময় পুজোর গান মানে কিন্তু শুধু পুজোর জন্যই বের করা গান ছিল না। আমাদের ছোটবেলা থেকে প্রায় যৌবন পর্যন্ত সময়টাতে আপামর বাঙালির গান শোনার দারুণ সময় ছিল পুজোর দিনগুলো।

এক প্যান্ডেলের সঙ্গে আরেক প্যান্ডেলের মাইক বাজানোর প্যাঁচ খেলা হতো যেন।পাড়ায় পাড়ায় বেরিয়ে পড়ত ব্যক্তিগত পছন্দের গানের সম্ভার, পাড়াতে কয়েকজনের বাড়িতেই তখন পাওয়া যেত রেকর্ড প্লেয়ার,মাইকওলারাও তাদের পছন্দ মতো কিছু রেকর্ড দিয়ে যেত যা ছিল সীমিত, এর পর বেশিটা ডিপেন্ড করত পাড়ার লোকেদের ওপর।অনেকে তাদের মূল্যবান রেকর্ড ‘বারোয়ারি ‘ করতে চাইতো না। কেউ কেউ আবার সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন তাদের ডিস্ক গুলো,তার সময়মতো শুনিয়ে আবার ফেরত নিয়ে চলে যেতেন, এরাই ছিলেন সেই অর্থে লোকাল ডিজে।এদের রেডিও টিভিতে গান শোনার সময় ছিল সীমিত,নিজের ইচ্ছে মতন বিভিন্ন ধরণের গান শোনার পুজো ছিল সোনার সময়,যে গানগুলো জনপ্রিয় হয়েছে তার সঙ্গে জুড়ে যেত টাটকা নতুন পুজোর গান,বাংলা বেসিক গানের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ শুনতো প্রায় সব ধরণের গান,বাংলা হিন্দি ছবির জনপ্রিয় গানের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশী গানও ঢুকে পড়ত বাঙালির গান শোনার ফর্দে।অমিতাভ বচ্চন রেখার ‘মিস্টার নটবরলালের’  “পরদেশিয়া” গানটা শুনলেই যেমন আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে জোড়াবাগান পার্কের পুজোর মেলা,আমি এখনও দেখতে পাই আমার ছোটবেলা,পাঁচ পয়সা দিয়ে কাঠের নাগরদোলায় পাক খাচ্ছে। 
একটা মানুষের দুটো মুণ্ডুর মতো ম্যাজিক,বেতের রিং ছুঁড়ে দু বছরের পুরোনো লাইফবয় সাবান পাওয়ার চেষ্টায় ভিড় ,বেলুন ছেড়ে ঝুলতে থাকা পয়সা বা পেরেক টার্গেট করে একের পর এক গুলি ছোঁড়া,শুধু চোখে নয় নাকেও ধাক্কা মারে শালপাতার সঙ্গে ঘুগনি,তেঁতুলজল আর অমলেটের গন্ধের মিকশ্চার,তার সাথে সাথে ফলো করে পাশের গলির ঐ মেয়েটার তাকানো ,পুজোর গানের ভাঁজে ভাঁজে জড়িয়ে থাকা কৈশোরের প্রথম কোনো মেয়েকে ভালো লাগার শিহরণ।

আমরা তারা যারা বিবিধ ভারতীর সময়ে বড় হওয়ার মধ্যে পড়ি.আমাদের বয়সীদের কাছে -সমস্ত গান শোনার সময় ছিল পুজোর সময় ,চোঙ্গায় চোঙ্গায় পাল্লা দিয়ে বাজত মহম্মদ রফির ‘এই শতদল মাথায় রাখি ‘,ভূপেন হাজারিকার ‘দোলা’, ‘বিস্তীর্ণ দুপারে’, ‘যাযাবর’, মান্না দে – র ‘ললিতা’,আর ডি বর্মনের ‘মনে পড়ে রুবি রায়’, পাশাপাশি অজস্র  বাংলা হিন্দি ছবির হিট গান ,’আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল আজ’,আর জোড়াবাগানের মিঠুন চক্রবর্তী (আমার ছোটবেলার গৌরাঙ্গ কাকা) বলিউডের হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম সুপারহিট সুরক্ষা ছবির  ‘গানমাস্টার জি নাইন,তুম যো ভি হো,দিল আজ দো’। ………

আর এইসব গানের সঙ্গে পুজোর সময় আরেকটা ব্যাপার আমরা পেতাম, যেটা হলো অ্যানাউন্সমেন্ট মাইক। কঙ্কালের মত স্টিলের যে মাইকে পাড়া প্রতিভারা ঠিক একটা সময় ফাঁক পেয়ে যেত যন্ত্রটা দখল করার,আর গোটা পাড়াকে নিজের গলা শুনিয়ে যে কি উত্তেজনা,কি মজা সেটা এখনকার ছোটদের বোঝাই কি করে,তাদের পৃথিবী এখন টেকনোলোজিকালি এত মডার্ন যে তাদের এসব শুনে ছেলেমানুষি ছাড়া কিছু না মনেও হতে পারে।
আমাদের ছোট্ট পাড়ায় একদিন হঠাৎ ইস্কুল থেকে ফিরে দেখতাম বাঁশ গুলো ডাঁই করে রাখা। কতগুলো বাঁশ যে কি সাংঘাতিক অ্যাড্রিনালিন বইয়ে দিত শরীরে বুঝবে না পারবে ?
ঠিক যেমন এই ইউটিউব এর যুগে বোঝানো সম্ভব না যে আমাদের ইংরেজি গান শোনার সুযোগ ছিল রবিবার দুপুরে সাকুল্যে একঘন্টা। আমরা বনি এম, অ্যাবা, বিজিস শুনতে পেতাম হাতেগোনা কয়েকটা পুজো প্যান্ডেলে। আমাদের ছোটবেলার পুজোর কদিন ছিল নানাধরনের গান শোনার সুযোগ। নতুনের সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো,দেশী বিদেশী,সব।
মনে সন্দেহ হতো পুজোর গান নাকি গানের পুজো?

সবার বাড়িতে রেকর্ড প্লেয়ার থাকতো না, আর থাকলেও সেটা পটাং করে চালিয়ে দেবে সেটাও সম্ভব হতো না। আমাদের বাপের বাড়িতে রেডিও ছাড়া ছোটবেলায় কিছু ছিল না, গান শোনার জন্য। আমার নটা মামার, একজনের বাড়িতে ছিল একটা লাস্ট স্টেজের দম দেওয়া গ্রামাফোন,গুটি কয়েক রেকর্ড, আর ফুলমামুর বাড়িতে ছিল রেকর্ড প্লেয়ার, মামু চালালে আমরা শুনতে পেতাম, সে ছিল প্রায় সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার মতো।৭০ সালের শেষদিকে অথবা ৮০র গোড়ার দিকে সম্ভবত, সেসময় মধ্যবিত্ত বাড়িতে গান শোনার সামর্থ্য হল ক্যাসেট রেকর্ডারের সৌজন্যে।

যদিও গুগল জেঠু বলছে ৬৩ সালে একজন ডাচ মানুষ লৌ ওটেন্স আর তার দলবল ক্যাসেট রেকর্ডার উদ্ভাবন করেন, ফিলিপ্স কোম্পানির হয়ে।মনে পড়ছে ১৯৮২ তে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগে পরে আমি বা আমার বন্ধুরা একটা দুটো ক্যাসেট কেনার কথা ভাবতে পারতাম, পকেট মানি বাঁচিয়ে।

লেখাটা শুরু করেছিলাম দুই বন্ধু রকে বসেছিলাম,আর ডি বর্মনের পুজোর অ্যালবাম বেরিয়েছে কিনা আলোচনা হচ্ছিল,বাকিটা বলিনি।বুবুন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি উত্তরে গুনগুন করে গেয়েছিলাম একটা গান –
‘তুমি থাকো ছোট্ট পাখি হয়ে /নিরালায়,দিন যায়/ যাক বয়ে ….’
বুবুন বলল, বেরিয়ে গেছে ? আমি বললাম, হ্যাঁ, বুবুন বলল, জিও ,কালকেই কিনতে হবে। আমার ঢপটা ধরা পড়ে গেছিল কিছুদিনের মধ্যে। সেবার আর ডি বর্মনের কোনো অ্যালবাম বেরোয়নি, আমার বানানো গানটা শুনে ও যে ভেবেছিল এটা আর ডি বর্মনের পুজোর নতুন গান, এটা আমাকে কনফিডেন্স দিয়েছিল। দু তিনটে ক্যাসেটের দোকান ঘুরেও যখন বুবুন আর পিঙ্কি এরকম কোনো গান খুঁজে পায়নি তখন বুঝতে পেরেছিল যে আমি প্র্যাঙ্ক করেছি ।
৮৪/৮৫ সাল হবে , আর ডি- র পুজোর গান বলে নিজের দু – লাইনের বানানো গান চালিয়ে দিয়েছিলাম ভাবলে এখনো মজা লাগে,কিন্তু ওই দু লাইনের পর আর এগোয় নি গানটা,তাই এ পুজোতেও রিলিজ করতে পারব না।

     

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *