সন্মাত্রানন্দ
‘আমি জানি ও বস্তু কোথায় আছে, কার কাছে আছে। কিন্তু সেকথা জেনে তোমার কোনো লাভ হবে না, যুবক!’ কথাটা বলেই পণ্ডিত ধাতুধরণ অপাঙ্গ দৃষ্টিতে আমেনহোটেপের দিকে চাইলেন। তারপরই চকিতে কণ্ঠলগ্ন অঙ্গবস্ত্রটি দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডল মার্জনা করে নিলেন।
আমেনহোটেপ বিভ্রান্ত বোধ করছিল। রৌদ্র থেকে ছায়াবৃত্তের মধ্যে সরে এসে নিম্নস্বরে সে বলল, ‘কিন্তু কেন? আমি তো ও পুথির জন্য শত দ্রম্ম দিতেও প্রস্তুত। তাহলে…’
আমেনহোটেপের মুখের কথা মুখেই রইল, সুদীর্ঘ শিখাসমেত শিরোদেশ দুপাশে দুলিয়ে ধাতুধরণ অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন। খানিক পরে নিজেকে সামান্য সামলে নিয়ে বাজপাখির মতন সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমেনহোটেপকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করতে করতে বললেন, ‘ঐতিহ্য! ঐতিহ্য কী জিনিস, তা কি তুমি বোঝো, হে মিশরীয়?’
ঐতিহ্য? আমেনহোটেপের হাসি পাচ্ছিল। বিগত সহস্র সহস্র বৎসর ধরে যে-পুরোহিতেরা প্রাচীন ফ্যারাওদের সেবা করে এসেছেন, তাঁদেরই রক্ত বইছে আমেনহোটেপের শিরায়, ধমনীতে। সেই মহান পুরোহিতবংশের উত্তরাধিকারী আমেনহোটেপকে আজ ঐতিহ্য বোঝাচ্ছে তামিল ব্রাহ্মণ ধাতুধরণ? সময়ের কী বিচিত্র পরিহাস! দীর্ঘকালের ঘোলা জলে সুদূর অতীতের ঐতিহ্য কীভাবে ধুয়ে বেরিয়ে যায়, আমেনহোটেপ তা নির্ঘাত জানে। তা না হলে প্রাচীন যুগে একদিন যে-সোবেক দেবতার ভয়ে সারা মিশর থরথর করে কাঁপত, আজ সেই সোবেক দেবতার মূর্তি খোলা বাজারে রোমান সেঞ্চুরিয়নদের পুত্রকন্যার খেলনা হিসেবে সস্তা দামে বিক্রি হয়? সোবেকের সেই ভয়ংকর কুম্ভীরাকৃতি মুখকেও কেউ আর ভয় পায় না আজকাল। অর্থ দিয়ে, ক্ষমতা দিয়ে ক্রয় করা যায় না, কী এমন আছে এই পৃথিবীতে? কিন্তু সেসব কথা এই বৃদ্ধ ধাতুধরণকে বোঝানো অসম্ভব। তাই মনের কথা মনেই গোপন রেখে মুখে একটা বিব্রত ভাব ফুটিয়ে তুলে আমেনহোটেপ বলল, ‘তবু আপনি বলুন, ব্রাহ্মণ! কোথায় গেলে ও পুথির দেখা মিলবে? কার কাছে আছে? কিনতে না পারি, চোখে দেখেও তো একবার সাধ মেটাতে পারব, নাকি?’
ধাতুধরণ গম্ভীর ভাব ধারণ করলেন। তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘রাজনর্তকী ইন্দুমুখীর কাছে ও পুথি আছে। ওই পুথি ওদের পারিবারিক সম্পত্তি। ইন্দুমুখী, তার মা করুণৈ, করুণৈ-র মা সুধাবিন্দু, তারও পূর্বনারীরা সকলেই ছিল রাজনটী। ওই বারাঙ্গনাদের পরিবারটিই ওই পুথির অধিকারী। ও পুথির প্রতিদিন পূজা না করে তারা জলগ্রহণ পর্যন্ত করে না আজও অবধি।’
‘শুধু পূজা করে? পুথিটি কি তারা পড়েনি, বিপ্র?’ আমেনহোটেপের কৌতূহল বাঁধ মানতে চায় না।
‘পড়বে না কেন? ইন্দুমুখীর মতো বিদুষী নারী—যার পাণ্ডিত্যের কাছে চোল রাজার সভাপণ্ডিতরা পর্যন্ত হার মেনে যায়—সে ওই পুথির চর্চা করেনি বলছ? সেই চর্চা সে করেছে, খুবই করেছে। চর্চা না করলে লোকের মুখ দেখামাত্রই ইন্দুমুখী মানুষের মনের ভাব বুঝে যায় কীভাবে? কিন্তু একথাও ঠিক যে, সে-পুথি তাদের পারিবারিক উপাসনালয়ে রক্ষিত অতি পবিত্র বস্তু। হাতে নিয়ে একবার তোমাকে দেখতে দিলেও দিতে পারে, তবে অর্থের মূল্যে বিক্রয় করবে—এমন দুরাশা তুমি স্বপ্নেও কোরো না,’ বলতে বলতে ধাতুধরণ উঠে দাঁড়ালেন। তাঁকে অন্যত্র কোথাও যেতে হবে, অযথা বাক্যালাপে কালক্ষয় করার মতন অবসর নেই।
অগত্যা ব্যর্থমনোরথ আমেনহোটেপ তামিল পণ্ডিত ধাতুধরণের কুটির পরিত্যাগ করে রাজপথে নিষ্ক্রান্ত হল। চারিদিকে প্রখর রৌদ্র। পন্থা অতিবাহন করতে ক্লান্ত লাগছিল। তবুও এত ব্যর্থতা সত্ত্বেও এক বিষয়ে কিন্তু কিছুটা স্বস্তি। আজ এতদিন পরে অন্তত ‘সামুদ্রচন্দ্রিকা’ পুথির খোঁজ পাওয়া গেছে। ওহ্, কম আয়াস সে করেছে আজ এই কটা বছর এর জন্যে?
দেশেঘরে থেকে দিন চালানো তাদের কঠিন হয়ে উঠেছে। প্রাচীন থেবাই নগরীতে আমেনহোটেপের পৈতৃক ভিটে। থেবাই নগরীর সে-জলুস যেমন আর নেই, রোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়ে মিশরীয়দের একদা সমৃদ্ধ রাজধানীটি আজ যেমন প্রায় এক ধুলামাখা গ্রাম, ঠিক তেমনই থেবাইয়ের পুরোহিতকুলগুলিও দারিদ্র্যদুঃখে আজ বহু শতক ধরে নিপতিত। তাদের কুলোচিত বিদ্যা কিছু কিছু এখনও আমেনহোটেপের আয়ত্ত, কিন্তু বিদ্যা থাকলেই কি আর হয়? সেসব বিদ্যার চাহিদা সমাজে এখন ফুরিয়ে এসেছে। এখন মানুষের মনে আছে শুধু জ্যোতিষশাস্ত্রে আগ্রহ, ওই দিয়েই যা যতটুকু উপার্জন। থেবাইয়ের ছেলেবুড়ো ছাড়াও রোমান সেনাবাহিনীর সৈনিকেরা, সেনাপ্রধান লেগেটরা আসে ভবিষ্যৎ জানতে। তাদের ভবিষ্যৎ বলে দেয় বটে আমেনহোটেপ, কিন্তু নিজের ভবিষ্যৎ কী, তা সে দেখতে পায় না।
বরং অতীতের দিকে শূন্য চোখে চেয়ে থাকে আমেনহোটেপ। বেশ বুঝতে পারে, হাজার পাঁচেক বছরের এত প্রাচীন একটা সমৃদ্ধ দেশ মিশর, শুধু পিরামিড গড়তে গড়তেই কীভাবে তার আয়ু ফুরিয়ে গিয়েছে। মিশরের বিপুল ধনরত্ন-সম্পদ চিরকালই লুব্ধ করে এসেছে বৈদেশিকদের। মিশর জুড়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের অভ্যন্তরীণ কলহ, আর সেই কলহের সুযোগ নিয়ে একের পর এক আছড়ে পড়েছে বিদেশী শক্তি মিশরের মাটিতে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই বৈদেশিক আক্রমণের ঢেউ। প্রথমে আসিরীয়, তারপর পারসিক, তারপর গ্রিক, অবশেষে গত তিনশো বছর ধরে চলছে রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তার।
সে-মিশর আর নেই, অবলুপ্ত হয়ে গেছে ফ্যারাওদের নীলনদের দুই তীরবিস্তারী সাম্রাজ্য, থেবাই গিয়েছে, মেমফিস গিয়েছে, যেন একটা প্রকাণ্ড ধ্বংসস্তূপের উপর বসে আছে আমেনহোটেপ ও অন্যান্য প্রাচীন পরিবারের সন্ততিরা। নিজের নামটার দিকে তাকাতে পর্যন্ত লজ্জা লাগে আমেনহোটেপের। ওই নামে তিন তিনজন প্রবল পরাক্রান্ত ফ্যারাও ছিলেন একদা মিশরে। পিতামাতা হয়তো সেসব অবসিত গৌরবের আগুনেই হাতপা সেঁকতে চেয়েছিলেন পুত্রের নামকরণের সময়; কিন্তু একটু বড়ো হতেই এই নাম তার আত্মমর্যাদায় উত্তাপ ছড়িয়েছে যত, তার থেকে ছ্যাঁকা দিয়েছে বেশি। আ-মে-ন-হো-টে-প! কোথায় সেই সব পরাক্রান্ত সম্রাট, আর কোথায় এই দরিদ্র ধুলামলিন জ্যোতিষী।
তবু সে যুবক—আত্মগ্লানিতে ডুবে থাকা তার সাজে না। যুবাবয়সের ধর্মই হল অন্ধকারের মধ্যে নতুন কোনো পথ খোঁজা। সেই পথই খুঁজছিল আমেনহোটেপ থেবাইতে বসে। কিন্তু কিছুতেই আয়বৃদ্ধি আর করতে পারছিল না। অবশেষে…
অবশেষে সে একটা অদ্ভুত বিদ্যার খোঁজ পায় এক রোমান ব্যাপারির কাছে। ব্যাপারিরা জলযানে চড়ে কত দূর দূর দেশে ভেসে যায়। সেসব দেশ থেকে শুধু মুনাফা আর বাণিজ্যদ্রব্য নিয়েই দেশে ফেরে না, নিয়ে আসে অজস্র সম্ভব, অসম্ভব গল্প। তো সেই রোমান ব্যাপারি ভারতবর্ষ বলে একটা দেশ থেকে ফিরেছে তখন সদ্য। সে-লোকটাই প্রথম আমেনহোটেপকে বলেছিল এক বিচিত্র বিদ্যার কথা।
এমন নাকি শাস্ত্র আছে, যার সাহায্যে মানুষের শারীরিক গঠন থেকে মানসিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিখুঁতভাবে বলে দেওয়া যায়। শরীরের কোথায় কোথায় তিল থাকলে মানুষটা কামুক প্রকৃতির হয়, হাত-পায়ের আঙুলের দৈর্ঘ্য থেকে স্থির করা যায় মানুষটা কোমল নাকি কঠোর, শৌচাদিগমনকালে মূত্রধারা বামদিকে হেলে গেলে লোকটা ভোগী, ডানদিকে হেলে গেলে ত্যাগী, নিদ্রাকালে কতটা নিঃশ্বাস পড়ছে তার থেকে বলা যায় মানুষটা কতদিন বাঁচবে… এমনই আরও কত যে আজব সব নির্ণয়! আর এসব নির্ণয় নাকি অভ্রান্তভাবে প্রমাণিত হয়েছে, এমনই বলছিল সেই রোমান বণিক।
শুনতে শুনতে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে যুবক আমেনহোটেপ। তা কী নাম এই শাস্ত্রের? রোমান ব্যাপারি বলল, এর নাম হল সামুদ্রিক শাস্ত্র। ভারতে, বিশেষত দক্ষিণ ভারতে এই শাস্ত্র খুবই প্রচলিত। প্রচলিত রয়েছে বিশেষত রাজবংশাবলীর ভিতর। এই বিদ্যার সহায়তায় ভারতবর্ষের রাজারা নাকি নিজেদের ও অন্যদের চরিত্র নির্ণয় করে কর্তব্যকর্ম সম্পাদনা করে থাকেন।
এসব শুনতে শুনতে মাথার ভেতর যেন একটা পর্দা খুলে যায় আমেনহোটেপের। একবার যদি সে এই বিদ্যা আয়ত্ত করতে পারে, তাহলে এ দিয়েই তো সে তার ভাগ্য পরিবর্তন করে ফেলতে পারবে! কোনো মিশরীয়র কাছে এই বিদ্যা নেই। এই সামুদ্রিক শাস্ত্র শিখে নিতে পারলে জ্যোতিষী হিসেবে তার কদরও বেড়ে যাবে খুবই। তখন কি আর সে এই থেবাইতে বসে থাকবে? রোমান সেঞ্চুরিয়নের প্রাসাদে বসে সে ভাগ্য গণনা করবে, কে কতদিন বাঁচবে, কখন যুদ্ধ ঘোষণা করা ঠিক হবে, কার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করতে হবে, কাকে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া যাবে না—সব সে অভ্রান্তভাবে নির্ণয় করে দিতে পারবে। কী বিপুল খ্যাতি হবে তার, কত উপার্জন হবে—ভাবতে ভাবতে আমেনহোটেপের মন স্বপ্নরঙিন হয়ে ওঠে। কে বলতে পারে, হয়তো স্বয়ং সম্রাট ফ্লেভিয়াস ক্লডিয়াস জুলিয়ানাস-এর প্রাসাদেই তার ডাক পড়বে। এই রোমান সম্রাট জুলিয়ান যে খুবই বিদ্যোৎসাহী, সেকথা তো সে শুনেছে। রাজানুগ্রহে নিজ পরিবারের হৃতগৌরব উদ্ধার করতে পারবে সে এই সামুদ্রিক শাস্ত্রের সাহায্যেই।
কিন্তু এ জিনিস শেখা যায় কোথা থেকে? ব্যাপারিদের মুখে সে শুনেছিল, ভারতের লোক সহজে কোনো বিদ্যা হস্তান্তর করতে চায় না। তার জন্যে নাকি ‘অধিকারী’ হতে হয়। রোমান ব্যাপারিটি আরও বলেছিল, সামুদ্রিক শাস্ত্রের অনেক পুথিই নাকি ভারতে চালু আছে, যদিও সেসব পুথি আসলে একটি মূল পুথিরই বিকৃত অনুকরণ। আর বিকৃত অনুকরণ হলে যা হয়, ওসব পুথিতে ভেজাল মিশে গেছে অনেক। মূল পুথির নাম—‘সামুদ্রচন্দ্রিকা’। তামিল ভাষায় লেখা। সে-পুথির নাম শোনা যায় বটে, কিন্তু তার দেখা পাওয়া দুষ্কর। কোথাও কোনো সম্পন্ন পরিবারে লুকোনো আছে হয়তো তার একটি দুটি অনুলিপি। তবে তামিল ভাষার পুথি যখন, তখন থাকলে ভারতের দক্ষিণদেশগত কোনো স্থানেই থাকবে।
ধীরে ধীরে মনস্থির করে ফেলেছিল আমেনহোটেপ। এখনও সে বিয়ে-থা করেনি, মা-বাপ ছাড়া সংসারে অন্য পিছুটান নেই। অনেক ভেবেচিন্তে ব্যাপারিদের বাণিজ্যপোতে চেপে বসেছিল সে। যে-সময়ের কথা বলছি, সেই খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকেরও বহু পূর্বকাল থেকেই ভারতের সঙ্গে সমুদ্রপথে বাণিজ্য-সম্পর্ক রচিত হয়েছে কত ভিনদেশের। গ্রিস, রোম, আরব, ব্যাবিলন, আলেকজান্দ্রিয়া—কত দূর দেশ থেকে সমুদ্রের লবণাক্ত বাতাস গায়ে মেখে বণিকের দল ভারতে আসত বাণিজ্যের প্রয়োজনে। আমেনহোটেপও অমনই তিন মাস্তুল টাঙানো অর্ণবপোতে চেপে বসল একদিন। লক্ষ্য সেই সাগরপারের ভারতবর্ষ। সেই বাণিজ্যতরীর গঠন বড়ো অদ্ভুত, কাঠের তক্তাগুলো পেরেক বা আংটা দিয়ে জোড়া নয়, বরং অত্যন্ত মোটা ও শক্ত কাছি দিয়ে বাঁধা—সামুদ্রিক তুফান কিংবা ভারত মহাসমুদ্রের প্রবালদ্বীপের সংঘাত সেই সুদৃঢ় কাছির বাঁধনই একমাত্র সহ্য করতে পারে, পেরেক বা আংটা নয়। জাহাজে মাঝি-মাল্লা-ব্যাপারিরা ছাড়াও ক্রীতদাসদাসী, বাণিজ্যোপযোগী সুরা, সোনা, টিন, শিশা, প্রবাল, মুক্তা ও নানা দুর্মূল্য রত্নরাজি বোঝাই। এসবের মধ্যেই একপাশে আমেনহোটেপ চলেছিল দীর্ঘ এক বর্ষব্যাপী ক্লেশকর সমুদ্রযাত্রায়। অর্ণবপোতেও সে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকেনি। সৌভাগ্যক্রমে এ যাত্রায় সে পেয়ে গিয়েছিল এক তামিল বণিকের সাহচর্য। তার কাছ থেকে তামিল ভাষা বলতে, বুঝতে, লিখতে, পড়তে শিখেছিল সে। খুব বেশি যে শিখতে পেরেছিল, তা নয়। তবু যতটুকু তামিল ভাষা জানলে বাগ্বিনিময় করা সম্ভব হয়, ততটুকু অন্তত শিখেছিল আমেনহোটেপ। সমুদ্রপথে ভারতে পৌঁছে দক্ষিণদেশের প্রধান প্রধান বাণিজ্যবন্দর—নিরণম্, বিলীনম্, মুচিরি, টোন্ডি, মরণ্ডাই, নারাভু, বরকলাই, পোরকাড, কুমারী, মারুঙ্গুপট্টিনম্, কয়াল, সালিয়ুর, কোরকাই, আরিকামেডু, মারাক্কানম্, নাগপট্টিনম্ সর্বত্র ঘুরেছে সে ওই পুথির সন্ধানে। কিন্তু কোথাও কিচ্ছু পায়নি। অবশেষে কাবেরী নদীর স্রোত বেয়ে এসে পৌঁছেছে এই কাবেরীপট্টিনম্ পুহার নগরে। যতজন বিশেষজ্ঞের কাছেই সে গিয়েছে, শেষ পর্যন্ত সকলেই এই পুহার নগরীর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন। থাকলে সামুদ্রচন্দ্রিকার পুথি ওই পুহারেই থাকবে, না থাকলে অন্যত্র কোথাও নয়—এই ছিল বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
কিন্তু আজ এ কি হরিষে বিষাদ হল? পুথির খোঁজ যদি-বা পাওয়া গেল, তারই সঙ্গে জানা গেল সে-পুথির অপ্রাপণীয়তা। পুহারের জনাকীর্ণ রৌদ্রদগ্ধ জনপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হতাশ ক্ষিণ্ণ, মনে আমেনহোটেপ ভেবে চলেছিল এই প্রাণান্ত প্রয়াসের এমন প্রায়-অসফল পরিণতির ব্যাপার।
পুহারের রাজপথ বেয়ে চলেছে অগণ্য মানুষের স্রোত—ধনী-দরিদ্র নাগরিক, সুবেশ রাজপুরুষবৃন্দ, কলহাস্যমুখরিতা রমণীর দল, পুরোহিত, সৈনিক, দেশী-বিদেশী ব্যবসায়ী, ভৃত্য, ভৃতিকা, গণিকা—কে নেই এই জনস্রোতে? পুহার এক বন্দর-নগরী; তাই নানা দিগ্দেশাগত বিচিত্রবেশ অতিথিদেরও পুহারে কিছুমাত্র অভাব নেই। বিচিত্রদর্শন ভিনদেশীদের দেখে এখানকার মানুষ অবাক চোখে তাকায় না আর। আমেনহোটেপ মিশরীয় পুরোহিত, পশুচর্মনির্মিত কোনো আবরণ তখনও অবধি মিশরীয় পুরোহিতদের অঙ্গে শোভা পেত না। আমেনহোটেপের পায়ে প্যাপিরাসের ছাল থেকে তৈরি পাদত্রাণ, কটিদেশ থেকে পদপাত পর্যন্ত লম্বিত শনের আঁশে বোনা ধূসর বস্ত্র, বলিষ্ঠ তাম্রাভ শরীর, কণ্ঠে ও বাহুতে শুষ্ক পত্রাস্থিমালা, দুই আয়ত কালো চোখে গাঢ় কাজলের রেখা টানা, কর্ণে কুণ্ডলজাতীয় কর্ণাভরণ, মুণ্ডিত মস্তকের এক পার্শ্বে লম্বিত সুদীর্ঘ বেণী—এমন বিচিত্র আকার এই মিশরীয় যুবকের—তথাপি পুহার নগরপথের পথিকেরা, এমনকি অল্পবয়েসি মেয়েরা পর্যন্ত আমেনহোটেপের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে তাকাচ্ছিল না। কাবেরীর জলরেণুমাখা বাতাস মধ্যে মধ্যে পথশ্রান্ত আমেনহোটেপের কপালের স্বেদবিন্দু মুছিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল বটে, কিন্তু আকাশে মেঘ আছে—মোটের উপর আবহাওয়া গুমোট।
আমেনহোটেপ দেখেছে, যখনই সে দ্রুত পায়ে হাঁটে, তখনই ভাবনাগুলো বিশৃঙ্খল হয়ে যায়। আবার চিন্তা নিয়ন্ত্রিত হলে, শ্বাসপ্রশ্বাস ধীর হয়, চলার বেগ কমে যায়। কিছুক্ষণ দ্রুত হাঁটার পরে সে এখন পথিপার্শ্বস্থ বৃক্ষছায়ার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। মনে হল তার, পণ্ডিত ধাতুধরণের কথায় এখনই এতদূর বিমর্ষ হওয়ার কোনো কারণ আছে কি? আমেনহোটেপ বরং ভাবছিল ইন্দুমুখীর কথা। ধাতুধরণের বয়ান অনুসারে ইন্দুমুখী রাজনর্তকী, বারাঙ্গনা; অথচ সে নাকি এতই বিদুষী যে বিদ্বান পণ্ডিতেরাও তার কাছে হার মেনে যায়। আলেকজান্দ্রিয়াতে এমন কয়েকজন বিদুষী নারীর কথা আমেনহোটেপ শুনেছে, কিন্তু তাঁরা সকলেই সম্ভ্রান্ত গৃহস্থ পরিবারের সন্তান। অথচ এখানে ভারতবর্ষে বারাঙ্গনারা বিদুষী, তাদের গৃহেই সংস্কৃতিমনস্ক, বিদ্বান মানুষদের যাতায়াত। আমেনহোটেপ ভাবছিল, সে কি একবার এই ইন্দুমুখীকে দেখতে যাবে না? সামুদ্রচন্দ্রিকার পুথি ইন্দুমুখী বিক্রয় করে বা না-করে, হাতে নিয়ে অন্তত দেখতে একবার দেবে নিশ্চয়। রাজনটী যখন, তখন তার আবাস খুঁজে বের করা এমন শক্ত কী কাজ? ভাবতে ভাবতে আমেনহোটেপ মনস্থির করে ফেলল।
অতঃপর দ্রুত পায়ে অতিথিশালায় ফিরে মধ্যাহ্নভোজন সমাধা করে সে অধীর আগ্রহে সন্ধ্যাগমের অপেক্ষা করতে লাগল।
দুই
বাইরের দিকের একটি আলো-আঁধারি কক্ষে আমেনহোটেপকে বসতে বলে গেছে পরিচারিকা। সম্ভবত এখানেই ইন্দুমুখীর প্রণয়প্রার্থীরা অপেক্ষা করে। ইন্দুমুখীর প্রাসাদটি প্রাচীন ও বৃহৎ, এর সাজসজ্জা দেখে বোঝা যায়, গৃহস্বামিনী বিত্তবতী। তা হওয়াই স্বাভাবিক, চোলরাজার নটী যখন। যেখানে আমেনহোটেপ বসে আছে একটি কাষ্ঠাসনের উপর, সেটি একটি নিম্নবর্তী কক্ষ, এখান থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি একটি দালানের দিকে উপরে উঠে গেছে। এই নিম্নবর্তী কক্ষ আর উপরের ওই দালানের মাঝখানে ঊর্ণাজালের মতন একটি অর্ধস্বচ্ছ পর্দা লম্বিত রয়েছে। এখানে বসে আমেনহোটেপ দালানে কী হচ্ছে না হচ্ছে, তা আবছামতো দেখতে পাচ্ছিল। পর্দার ওদিকে একটি প্রকৃষ্ট দীপাধারে প্রদীপ জ্বলছে। সেখানে চার-পাঁচজন মানুষের একটি জটলা। একজন নারী, সম্ভবত সে পর্যঙ্কের উপরে আসীন; অন্যরা সম্ভবত কক্ষের চারিপাশে উচ্চাসনে উপবিষ্ট। কী একটি বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে নিগূঢ় আলোচনা চলছে। আলোচনাকারী ব্যক্তিদের মুখ বা অবয়ব এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না আমেনহোটেপ, কিন্তু একটু সন্তর্পণে কান পাতলে তাদের কথাবার্তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। সাধারণ লৌকিক তামিল ভাষায় কথোপকথন চলছে, তাই বুঝতে তেমন সমস্যা নেই।
শ্বাসপীড়িত দুর্বল কণ্ঠে কে একজন পুরুষ বলে উঠল, ‘এখনই এত নিশ্চিত হচ্ছ কী প্রকারে? জ্বরজারি কি মানুষের হয় না? অসুখ হয়েছে, সেরে যাবে। ঔষধ যা দিয়েছি, খলনুড়িতে মেড়ে যথাসময়ে যদি খাওয়াও আর পথ্যাদি যদি নিয়মিতভাবে চলে, তাহলে এ যাত্রায় কয়েকদিনের মধ্যেই করুণৈ সুস্থ হয়ে উঠবেন বলেই তো মনে হয় আমার। তা আমার উপর কি আর আস্থা রাখতে পারছ না তুমি?’
সে-কথার উত্তরে যেন একটি বীণানিন্দিত করুণ নারীকণ্ঠ বেজে উঠল, ‘না-না, ভিষগ্বর! আপনার উপর ভরসা আমার যায়নি। কিন্তু মা এতদিন ধরে ভুগছেন। যেন বিছানার সঙ্গে তাঁর ক্ষীণতনু মিলিয়ে গিয়েছে। আপনারা তো জানেন, আমি পিতৃপরিচয়হীনা অনাথা। এ মহল্লার সকলেই প্রায় তাই। মায়ের পরিচয়েই আমাদের পরিচয়। আমার যা কিছু শিক্ষা—নৃত্যকলা, সংগীত, প্রসাধন, শাস্ত্রবিদ্যা—সবই আমি আমার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। তাঁর অনুপস্থিতি আমি কল্পনাও করতে পারছি না। সেই জন্যেই এতটা ভয় আমার প্রাণে চেপে বসেছে। ঔষধ, পথ্যাদি নিয়মিত চলছে ঠিকই, তবু মায়ের একটা ব্যাপার আমি প্রায় নিশ্চিতভাবেই জেনে ফেলেছি, ভিষগ্!’
পূর্বের সেই শ্বাসাহত পুরুষকণ্ঠ জিজ্ঞাসা করল, ‘কী জেনেছ, ইন্দুমুখী?’
‘মায়ের শরীরের স্ফীতি, গতি ও অন্যান্য শারীরিক চিহ্নাদি বলছে, মায়ের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে এসেছে। খুব বেশি হলে আর এক পক্ষকাল। আপনারা জানেন, সামুদ্রিক শাস্ত্রের গণনা অভ্রান্ত!’
ঘরের ভিতর সুবিপুল নিস্তব্ধতা। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলছে না। এরই মধ্যে বোধহয় কোনো পরিচারিকা দালানে ঢুকল। কঙ্কনবলয়ের ঠিনঠিনি তুলে পরিচারিকাটি সম্ভবত গৃহস্বামিনী ও অতিথিবর্গকে সুরা পরিবেশন করল। আরও কিছুক্ষণ পরে জনৈক যুবাবয়স্ক কেউ বলল, ‘এখনই এত শোকার্ত হলে কি চলে, প্রিয় বান্ধবী? কতদিন হল তুমি ঠিকমতো স্নান-পান-আহারাদি করছ না। কেশসংস্কারও করনি। রাজপুরী থেকে এখনই যদি ডাক আসে, কী করবে তুমি? সেই তো প্রস্তুত হয়ে যেতে হবে।’
ভারী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে নারীকণ্ঠ ঈষৎ জড়িত স্বরে বলল, ‘সে তো আমার কর্তব্য, কুমারণ! কর্তব্যপালনে শৈথিল্য করব না আমি। কিন্তু এর মধ্যে মা চলে গেলে কী হবে আমার, ভেবে দেখেছ?’
এবার অন্য এক মধ্যবয়স্ক পুরুষের কণ্ঠস্বর বেজে উঠল, ‘দ্যাখো, ইন্দুমুখী! অযথাই দুশ্চিন্তা করছ তুমি। মা-বাপ কারওই চিরকাল থাকে না।’
‘কিন্তু মা? মায়ের কী হবে? মা কোথায় যাবে? এভাবেই মায়ের শেষ?’ ইন্দুমুখীর উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর।
আবার সেই মধ্যবয়স্ক পুরুষ: ‘সকলেরই যা হয়, তোমার মায়েরও তাই হবে। তুমি তো মনস্বিনী! শাস্ত্রবাক্য তোমার অবিদিত নয়। মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়—হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা সাধনা করে তাই-ই তো আবিষ্কার করেছেন। এসব তুমি জেনেও বালিকার মতন উদ্বিগ্ন হচ্ছ মিছিমিছি। সাপের খোলস তুমি দ্যাখোনি কি? খোলসের অন্য নাম কঞ্চুক। কঞ্চুক জীর্ণ হলে সাপ সেই কঞ্চুক ছেড়ে চলে যায়। আবার কালক্রমে সাপ নতুন কঞ্চুক নির্মাণ করে নেয় নিজের চারিদিকে। ঠিক তেমনই দেহেরই মৃত্যু হয়, দেহীর কখনও মৃত্যু হয় না। সাপ যেমন বিশীর্ণ কঞ্চুক ছেড়ে চলে যায়, দেহ জীর্ণ হলে দেহী জীবাত্মাও তেমনই সেই রোগজীর্ণ দেহ পরিত্যাগ করে চলে যায়। আবার নতুন দেহ নির্মাণ করে নেয় জন্মান্তরে। দেহটা তো তুচ্ছ একটা কঞ্চুকের মতন।’
নারীকণ্ঠ অধীর স্বরে বলে উঠল, ‘জানি, জানি, এসব কথা তো আমি জানি। মৃত্যুতে দেহেরই বিনাশ, আত্মা মৃত্যুহীন। কিন্তু আমি অজ্ঞানাচ্ছন্ন সামান্য মানুষ। আমি তো মাকে এতদিন ওই দেহরূপেই দেখে এসেছি। মাকে ওই দেহ বলেই জানি। আমার মায়ের মৃত্যু হলে আপনারা তো তখন তাঁর মৃতদেহ চিতাগ্নিতেই অর্পণ করবেন, তাই না?’
শ্বাসাহত ভিষগের স্বর বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটাই তো প্রথা! সাধু হোক, চোর হোক, রাজা হোক, ভিক্ষুক হোক, নটী হোক বা সতী হোক—আগুন সবারই শরীর খায়। এতে অস্বাভাবিক কী আছে? এ নিয়ে প্রশ্ন করছ কেন?’
আবার কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। তারপর নারীকণ্ঠে যেন মন্থর চিন্তা মিশ্রিত হল, ‘প্রশ্ন করছি… কেননা… তারপর থেকে আমি তো আর আমার মায়ের মুখ দেখতে পাব না… যে-মুখ দেখে রোজ ঘুম থেকে উঠতাম, সে-মুখখানি দেখব না আমি আর। যে-হাত বেদনার মুহূর্তে আমার পিঠের উপর সান্ত্বনার মতো নেমে আসত, সে-হাতের আদর পাব না আর কোনোদিন! যে-চোখের তারায় ভরা মমতার মেঘ আমার বুকের জমিতে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসত শ্রাবণসন্ধ্যায়, সে-চোখ তখন আর নেই… যে-বুকে মুখ গুঁজে আমি দিনান্তে ভুলে যেতাম জগতের দেওয়া যত অপমান লাঞ্ছনা, সে-বুক তখন এক মুঠি ছাই হয়ে যাবে…ওহ্, মায়ের অদর্শনে কীভাবে যে আমি বাঁচব সেই অমোঘ শূন্যতা বুকে নিয়ে…?’ সকলেই চুপ করে গেল। সব কথা যেন নৈঃশব্দ্যের মধ্যে জমাট পাথর হয়ে গিয়েছে। সেই নীরবতা ইন্দুমুখীর শোক, তাপ, উদ্বেগের উপর নিরাময়ের সান্ত্বনা দিতে পারল না। অবশেষে এক এক করে নিঃশব্দে অতিথিরা গাত্রোত্থান করলেন। ঊর্ণাসদৃশ যবনিকা সরিয়ে দালান থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে আমেনহোটেপের পাশ দিয়ে তাঁরা একে একে প্রাসাদ হতে নিষ্ক্রমণ করতে লাগলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ উপেক্ষাভরে আমেনহোটেপের দিকে একবার চেয়ে দেখলেন, কিন্তু কেউই কিছু বললেন না। এখন দালানে ঊর্ণার অন্তরালে পর্যঙ্কের উপরে কেবল ইন্দুমুখীর অস্পষ্ট উপস্থিতি আভাসিত হতে লাগল।
প্রায় অর্ধদণ্ড পরে পূর্বদৃষ্ট পরিচারিকাটি এসে আমেনহোটেপকে ভিতরে যেতে বলল। আমেনহোটেপ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ঊর্ণা সরিয়ে দালানের মধ্যে উপস্থিত হল। স্বল্পালোকিত দালানটির চারিদিকে ইতস্ততোবিক্ষিপ্ত কাষ্ঠাসনগুলির আবরণ মর্দিত, একখানা উৎপীঠিকার উপর কতগুলো অর্ধপূর্ণ পানপাত্র ও চষক পড়ে রয়েছে। কিন্তু সেদিকে ভালো করে দৃষ্টিক্ষেপের আগেই আমেনহোটেপের চোখ দালানের কেন্দ্রে পর্যঙ্কের উপর একটি কোমল উপাধান-আশ্রয়ী অর্ধশায়িত নারীমূর্তির প্রতি ধাবিত হল। যদি আকাশের বিদ্যুতকে কোনো মন্ত্রবলে স্তম্ভিত করা যায়, একমাত্র তবেই এ নারীরূপের তুলনা হতে পারে। অথবা শয্যার উপর অর্ধশায়িত একটি সুবঙ্কিম তরবারিই বুঝি এ সুন্দরীর সার্থক উপমা। যুবতী ঈষৎ শ্যামাঙ্গী, কিন্তু তার নির্মেদ শরীরের প্রতিটি বক্রতা অতি নিখুঁত, পরনে ঈষৎ স্বচ্ছ ঘাগরা জাতীয় একটি পরিধেয়, সুকোমল পদপল্লবে সুচারু নূপুর, উন্মুক্ত বাহুলতা দুটি তরুণ কদলীকাণ্ডের মতন কমনীয়, হাতের প্রতিটি আঙুল চম্পককলির মতন সুচারু, কেশপাশে উন্মুক্ত ঝটিকার মেঘ আর তার সেই কালো চোখদুটিতে যেন সুদূর সিন্ধুপারের কোনো নির্জন বিষাদমধুর দ্বীপভূমির আহ্বান।
নারীর ইঙ্গিতে আমেনহোটেপ আসন গ্রহণ করল। কিছু পরে জড়তা পরিহার করে সে মুখ খুলল, ‘অভিবাদন, ভদ্রে ইন্দুমুখী! আমি মিশরদেশাগত পুরোহিত আমেনহোটেপ। একটি বিশেষ প্রয়োজনে আমি আপনার দর্শনপ্রার্থী।’
ইন্দুমুখী প্রত্যভিবাদন জানাল। তারপর বলল, ‘আমার সঙ্গে কী প্রয়োজন, যদি সংক্ষেপে বলেন, ভদ্র!’
আমেনহোটেপ উত্তর দিল, ‘পেশায় আমি জ্যোতিষী। আমাদের মিশরদেশের জ্যোতিষশাস্ত্র ভারতের জ্যোতিষশাস্ত্রের থেকে নানাভাবে ভিন্ন। সম্প্রতি এক বিশেষ বিদ্যার সন্ধানে আমি এদেশে এসেছি। বস্তুত সে-বিদ্যার চর্চা আমার স্বদেশে মোটেই হয় না।’
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমেনহোটেপের মুখের দিকে খানিক নিরীক্ষণ সেরে নিয়েই ইন্দুমুখী তরল কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আপনি কি সামুদ্রচন্দ্রিকার পুথির জন্য আমার কাছে এসেছেন? ও পুথি আমার কাছে আছে, একথা কে বলল আপনাকে—পণ্ডিত ধাতুধরণ?’
চমৎকৃত হওয়ারই কথা! এই নারী মেধাবিনী, একথা আমেনহোটেপ আগেই শুনে এসেছে। কিন্তু এতটা বুদ্ধিমতী, ভাবতে পারেনি। তবু চমৎকৃত হয়ে বসে থাকার সময় এখন নয়, আমেনহোটেপ দ্রুত উত্তর দিল, ‘আপনি ঠিকই ধরেছেন, মনস্বিনী! কিন্তু আপনি কীভাবে—?’
ঈষৎ দর্পিত ভঙ্গিতে হেসে উঠে ইন্দুমুখী বলল, ‘সে-অনুমান করা কি খুব কঠিন, ভদ্র? জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কিত কোনো বিদ্যার জন্যে মিশর দেশ থেকে একজন পুরোহিত কেনই বা এক বারাঙ্গনার কাছে আসবেন? তার জন্য তিনি তো পুরোহিতদের কাছেই যাবেন, জ্যোতিষ যাঁদের ব্যবসা। এক্ষেত্রে আপনি আমার কাছে এসেছেন, নিশ্চয়ই সামুদ্রচন্দ্রিকা পুথি এ গৃহে আছে, একথা জানতে পেরেছেন বলেই। ধাতুধরণের মতন চার-পাঁচজন স্থানীয় ব্রাহ্মণ, যাঁরা আমার ঘনিষ্ঠ, তাঁরাই ওকথা জানেন। একটু আগে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরাও ওকথা জানেন। কিন্তু তাঁরা আপনার পরিচিত হলে নিশ্চয়ই এ গৃহ থেকে নিষ্ক্রমণকালে তাঁরা আপনার সঙ্গে বাক্যালাপ করতেন। তা যখন করেননি, তাহলে পরিশেষ-ন্যায় অনুসরণ করে বলতে হয়, ধাতুধরণ বা তাঁর মতন কেউ আপনাকে ওই পুথির কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে ধাতুধরণের সম্ভাবনাই প্রবল, কেননা তাঁর গৃহেই ভিনদেশাগত অতিথিদের যাতায়াত অধিক।’
মুগ্ধ আমেনহোটেপ উত্তর দিল, ‘আপনার তীক্ষ্ণ অনুমানশক্তির প্রশংসা না করে পারছি না। আমি এখানে এসে অনেক ঘুরেছি। সামুদ্রচন্দ্রিকার যেসব পুথি আমার নজরে পড়েছে, সে সবই মূল পুথির বিকৃতি, বন্যার জলের মতন ঘোলা। মূল পুথিটি আপনার কাছে আছে জেনে অত্যন্ত আশা নিয়ে এসেছি।’
‘আপনি কী চান?’
‘আ-আমি পুথিটি একবার দেখতে চাই। যদি আপনি আমার প্রতি বিশেষ কৃপাদৃষ্টি করে পুথিটি দান করেন… অথবা যদি বিক্রয় করেন… আমি শত দ্রম্ম দিতেও প্রস্তুত… জানি, আমার এ অনুরোধ অত্যন্ত অন্যায়…তবু যদি…’
ইন্দুমুখী এবার পর্যঙ্কের উপর সোজা হয়ে বসল। তারপর মাথার উপর দু-হাত তুলে উন্মুক্ত কেশপাশ আলগোছে বেঁধে নিতে নিতে বলল, ‘তা কীভাবে সম্ভব, ভদ্র? পুথিটি আমাদের পরিবারের মাঙ্গলিক বস্তু। পুথি আমি দান বা বিক্রয় করব, একথা দূরতম স্বপ্নেও আমি কখনও ভাবিনি। সে হয় না। তবে দেখতে চাইলে দেখাতে পারি।’
‘যদি আমি অনুলিপি করে নিই?’
‘আপনি তামিল লিখতে, পড়তে পারেন?’
‘হ্যাঁ, তা কিছুটা পারি।’
‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে এখন। কিন্তু ইদানীং আমি বড়ো বিব্রত অবস্থায় আছি। পক্ষকাল পরে যদি আসেন, তাহলে আমি আপনাকে পুথিটি দেখাতে পারি। এখন আমার মা অত্যন্ত অসুস্থ, মৃত্যুশয্যাশায়ী। এখন আমার মানসিক স্থিরতা নেই।’
আমেনহোটেপ কিছু একটা বলবে বলবে করছিল, কিন্তু বলে উঠতে পারছিল না। তার সেই সংকুচিত ভাব দেখে ইন্দুমুখী বলল, ‘আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন আর?’
‘হ্যাঁ। আসলে আমি অজান্তেই আপনার প্রতি একটা অপরাধ করে ফেলেছি।’
এবার প্রশ্রয়ের হাসি হেসে ফেলল ইন্দুমুখী। বলল, ‘কী করেছেন? বলুন!’
‘আমি সম্মুখবর্তী কক্ষ থেকে আপনাদের আলোচনা শুনে ফেলেছি। তার থেকে আপনার মানসিক অবস্থা কিছুটা হলেও আমি বুঝতে পারছি!’
ইন্দুমুখীর মুখমণ্ডল পুনরায় বিষাদমেঘে ঢেকে গেল। সে ধীরে ধীরে বলল, ‘হ্যাঁ, ভদ্র! মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। মা চলে গেলে আমি সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ হয়ে যাব। মাকে আর দেখতে পাব না, মাকে আর ছুঁতে পারব না, একথা ভাবতে গেলেই আমার হৃদয় যেন বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। জানি, মৃত্যু অবধারিত, এই অদর্শনই স্বাভাবিক, তবু…’
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে কী যেন আকাশপাতাল ভাবতে লাগল আমেনহোটেপ। তার মাথায় একটা বিশেষ চিন্তা খেলা করছে। অনেক ভেবে ভেবে একটা বুদ্ধি এল যেন। নরম স্বরে বলল, ‘আমি কি আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি?’
‘আপনি কী করবেন, ভদ্র? মৃত্যুকে কে রোধ করতে পারে? আমরা যারা মানুষকে দেহ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না, আমাদের জন্যে শোক-পরিতাপই অন্তিমে অপেক্ষা করে থাকে!’ ভারী দীর্ঘশ্বাসে ইন্দুমুখীর সমুন্নত বুক দুটি সামান্য নমিত হল।
‘এক্ষেত্রে আমার কিছু করার আছে,’ আমেনহোটেপ চিন্তামগ্ন স্বরে বলল, ‘যদি আপনি আমাকে অনুমতি দেন… যদি আমার কথা-অনুযায়ী কাজ করেন…’
ইন্দুমুখীর মুখপদ্মে বিস্ময়ের ঘোর ফুটে উঠল, সে বলল, ‘কী করতে চাইছেন, বুঝতে পারছি না… এখন অবধি শুধু এইটুকুই জানি, আমার মায়ের মৃত্যু আসন্ন… এক পক্ষকালমাত্র সময়…’
আমেনহোটেপ দৃঢ়স্বরে বলল, ‘আমি চাই সামুদ্রচন্দ্রিকার গণনা মিথ্যা হোক, আপনার মা সুস্থ হয়ে উঠুন। কিন্তু যদি তা না হয়, যদি সত্যিই পক্ষকালের মধ্যে তাঁর মৃত্যুকাল ঘনিয়ে আসে, তাহলে…’
‘তাহলে?’
‘…তাহলে আপনি সেকথা এখানকার কাউকে জানাবেন না। মায়ের মৃত্যুসংবাদ গোপন রাখবেন। আর আমাকে একটু সংবাদ পাঠাবেন। আমি বর্তমানে কাবেরীতীরস্থ শিবমন্দিরের পার্শ্ববর্তী অতিথিশালাটিতেই বসবাস করছি।’
ইন্দুমুখীকে দেখে মনে হল, আমেনহোটেপ কী করতে চাইছে, সেকথা ইন্দুমুখী এবার কিছুই বুঝতে পারছে না। বিস্ময়-বিমূঢ় অবস্থায় আচ্ছন্নস্বরে সে শুধু বলল, ‘আচ্ছা, বেশ। যদিও জানি না, আপনি ঠিক কী করতে পারবেন সেক্ষেত্রে। তবু আমি আপনার কথা মেনে চলব। মায়ের মৃত্যুসংবাদ কাউকে না-জানিয়ে আপনার কাছেই যত দ্রুত সম্ভব প্রেরণ করব।’
ইন্দুমুখীর কথা শুনে মৃদু হাসল আমেনহোটেপ মনে মনে। তারপর বিদায়-অভিবাদন জানিয়ে আসন থেকে উঠে দাঁড়াল।
তিন
সামুদ্রচন্দ্রিকার গণনা কিন্তু অভ্রান্ত। ঠিক চৌদ্দ দিনের মাথায় পরিচারক-মারফৎ আমেনহোটেপ খবর পেল, ইন্দুমুখীর মা করুণৈ আর নেই। আর এক মুহূর্ত দেরি না-করে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি একটি সম্পূটকে নিয়ে আমেনহোটেপ ইন্দুমুখীর গৃহে উপস্থিত হল।
শোকার্ত ইন্দুমুখীকে দেখে মনে হল, এ ইন্দু সে ইন্দু নয়। যেন কমলবনে মত্ত হস্তী সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। মেয়েটির চোখ দুটি জবাপুষ্পের মতো লাল, রাত্রিজাগরণের ফলে চোখের নীচে কালি পড়েছে, সমস্ত শরীরে যেন মৃত্যুশোক আর বিয়োগবিলাপ আঁধিয়ার মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
আমেনহোটেপ উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, ‘কে কে জানে এখনও অবধি করুণৈদেবীর মৃত্যুসংবাদ?’
ইন্দুমুখী ক্ষিণ্ণস্বরে উত্তর দিল, ‘তেমন কেউই না। আমি আর আপনি ছাড়া দুয়েকজন বিশ্বস্ত দাসদাসী একথা জেনেছে। কিন্তু তারা সকলে এই প্রাসাদেই থাকে। আপনার পরামর্শমতো বাইরের কাউকেই এখন একথা না-জানানোর কঠোর নির্দেশ দিয়েছি।’
আমেনহোটেপ বলল, ‘বেশ। এখনই আপনি আমাকে আপনার মায়ের কক্ষে নিয়ে চলুন।’
করুণৈ-র কক্ষে উপস্থিত হয়ে আমেনহোটেপ দেখল, করুণৈ-র মৃতদেহ পর্যঙ্কে শায়িত। একেবারে রোগজীর্ণ শরীর। যেন একটি ম্লান অতসীপুষ্পের মতো করুণৈ ব্যধির সঙ্গে মহাসমরে পরাস্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কী করুণ সেই অন্তিম শয়ন!
ইন্দুমুখী চক্ষে অঞ্চল চাপা দিয়ে বালিকার মতো অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছিল। আমেনহোটেপ বলল, ‘আপনি মাকে এভাবেই তো দেখতে চান, তাই না? তাঁকে ছেড়ে থাকতে চান না, তাঁকে নিজের কাছে ধরে রাখতে চান…’
আমেনহোটেপের কথায় ইন্দুমুখীর ক্রন্দনবেগ আরও বৃদ্ধি পেল। অশ্রুপরিপ্লুত স্বরে সে বলে উঠল, ‘তা আর সম্ভব নয় গো, ভদ্র! মা আমাকে ছেড়ে কোথায় যে চলে গেলেন…’
আমেনহোটেপ উত্তর দিল, ‘কোথাও যাননি। আপনি রোদন সংবরণ করুন।’
আমেনহোটেপের কণ্ঠস্বরে কী যেন ছিল। আঁচলে চোখ মুছে ইন্দুমুখী অবাক হয়ে আমেনহোটেপের দিকে চোখ তুলে তাকাল।
আমেনহোটেপ বলতে লাগল, ‘শুনুন, ভদ্রে! আপনাদের ভারতীয়দের মতো আমরা মিশরীয়রা একথা বিশ্বাস করি না যে, শরীরের মৃত্যু হলেই আত্মা শরীর ছেড়ে চলে যায়। বরং আমরা মনে করি, শরীরটা যতদিন অবিকৃত থাকে আত্মাও ততদিনই জীবিত থাকে। শরীরটা পুড়িয়ে ফেললে বা কোনোভাবে শরীরটি নষ্ট হয়ে গেলে তখনই একমাত্র আত্মার মৃত্যু হয়। আপনার মা করুণৈদেবী কোথাও যাননি, তিনি এখানেই আছেন। শুধু দেখতে হবে, যাতে এই শরীরের কোনো পচন বা বিকার না ঘটে।’
এত শোকের মধ্যেও ইন্দুমুখী বিস্ময়াবিষ্ট স্বরে বলে উঠল, ‘অদ্ভুত বিশ্বাস!’
আমেনহোটেপ আত্মপ্রত্যয়ী স্বরে বলল, ‘অদ্ভুত, কিন্তু সত্য। যা বলছি, তা করুন। সমস্ত কিছু আমার কাছে নেই, কতগুলো দ্রব্য লাগবে। আমি এখনই একটি তালিকা তৈরি করে দিচ্ছি। যত শীঘ্র সম্ভব আমাকে সেগুলো এনে দিন। এসব মিশরীয় গুপ্ত বিদ্যা। পাঁচকান করবেন না। এ প্রাসাদে কোথাও কি কোনো গুপ্ত কক্ষ আছে?’
ইন্দুমুখী বলল, ‘হ্যাঁ। পাণ্ড্যরাজাদের দ্বারা চোলরাজ্য দশ বৎসর পূর্বে আক্রান্ত হয়। শত্রুসৈন্যের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে তখন এই প্রাসাদের নিম্নে একটি পাতালঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। আমরা ওই পাতালঘরকে নিগূঢ় কক্ষ বলে থাকি। সেখানে পাশাপাশি দুটি কক্ষ আছে। সেই কক্ষদুটি এখন অব্যবহৃত হয়েই পড়ে থাকে।’
আমেনহোটেপ বলল, ‘উত্তম। তবে এখনই করুণৈদেবীর দেহটি সেই নিগূঢ় কক্ষে স্থানান্তরিত করুন। আমাকে এখন থেকে আড়াই মাসকাল এ গৃহের নিগূঢ় কক্ষেই থাকতে হবে। এই সময়ের মধ্যে আপনারা কেউ আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবেন না বা ওই নিগূঢ় কক্ষের ভিতরে যাবেন না। আমার আহারাদি পাতালের সোপানের উপর রাখলেই হবে।’
ইন্দুমুখী বিহ্বল স্বরে বলল, ‘কিন্তু কী করতে চাইছেন, তার যদি কিছুটা হলেও ইঙ্গিত দিতেন—?’
‘আপনি তো চান, আপনার মা আপনার কাছেই থাকুন? আমি এমন ব্যবস্থা করব, যাতে চিরকাল তিনি আপনার সঙ্গেই থাকেন। আপনি তাঁকে স্পর্শ করতে পারবেন। সেবা করতে পারবেন। কথা বলতে পারবেন। হ্যাঁ, তিনি আপনার সেবা নেবেন, কথাও শুনবেন। আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না। আপনি শুধু আমার উপরে সামান্য বিশ্বাস রাখুন!’ আমেনহোটেপ অনুনয়-সহকারে বলল।
যেন আস্থার শেষ খড়কুটো চেপে ধরে শোকসাগরে ডুবন্ত ইন্দুমতী সেকথা শুনে বলে উঠল, ‘সত্যি? সত্যিই এমন হবে? সত্যিই যদি আপনি এমন পারেন, ভদ্র, তাহলে আমি আপনার চিরদাসী হয়ে থাকব। আর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমাদের পারিবারিক উপাসনালয়ে রক্ষিত সামুদ্রচন্দ্রিকার পুথিটি আমি আপনাকে উপহার দেব, কথা দিচ্ছি।’
আমেনহোটেপ হাসতে হাসতে বলল, ‘সে যখনকার কথা, তখন দেখা যাবে। এখন যা যা বললাম, তাই করুন তো দেখি!’
বিশ্বস্ত দাসদাসীর দ্বারা অতি সাবধানে মৃতদেহটি পাতালঘরে নিয়ে যাওয়া হতে লাগল। প্রায়ান্ধকার সোপানশ্রেণী, সংকীর্ণ সুড়ঙ্গপথ পার হয়ে শববাহকেরা সন্তর্পণে চলেছিল, তাদের সবার সামনে প্রদীপ হাতে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ইন্দুমুখী। আর সকলের পেছনে সম্পূটক পিঠে ধীরে ধীরে নামছিল আমেনহোটেপ। মাটির অনেক নীচে সেই নিগূঢ় কক্ষদুটির একটিতে মৃতদেহটিকে একটি সমুচ্চ পর্যঙ্কে শুইয়ে দেওয়া হল। কিছুক্ষণের মধ্যে আমেনহোটেপের তালিকানিবদ্ধ দ্রব্যগুলিও সংগ্রহ করে আনা হল। তারপর ইন্দুমুখী ও তার দাসদাসীরা আমেনহোটেপকে পাতালঘরে রেখে উপরে চলে গেল।
আমেনহোটেপ এখন একা। পার্শ্ববর্তী নিগূঢ় কক্ষে সে তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। এখানেই তাকে আড়াই মাসকাল অতিবাহিত করতে হবে। শত শত বৎসর পূর্বে তার পূর্বপুরুষেরা যে-কাজ অনেকে মিলে করতেন, সেই কাজ তাকে একলা হাতে করতে হবে। কাজটি কঠিন, এক বিন্দু ভুলচুক হলেই সর্বনাশ।
এ বিদ্যা তাদের বংশগত বিদ্যা। মৃত ব্যক্তির মমি প্রস্তুত করার বিদ্যা। যদিও এর প্রয়োজন এখন এই চতুর্থ শতকে আর হয় না, তবু পারিবারিক সূত্রেই তাকে এসব হাতেকলমে শিখতে হয়েছিল কৈশোরে। তখন দুয়েকটি মৃত পশুপাখির উপরই এ বিদ্যা প্রয়োগ করতে পেরেছিল, এতদিন পরে মানুষের মৃতদেহের উপর প্রয়োগের সুযোগ এল।
সেই দিন থেকেই শুরু হল আমেনহোটেপের কঠিন পরীক্ষা। ঘৃতদীপের আলোতে পর্যঙ্কে শায়িত মৃতদেহটির মমি প্রস্তুত করতে হবে। প্রথমেই বিশেষ ধরনের কর্তরী দিয়ে তলপেট সামান্য চিরে মৃতার শরীর থেকে ফুসফুস, পাকস্থলী, যকৃৎ ও অন্ত্রাদি বের করে আনল আমেনহোটেপ। তারপর একটি দীর্ঘ সূচীমুখ মৃতদেহের নাসাপথে প্রবেশ করিয়ে অতি সন্তর্পণে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে মৃতার মস্তিষ্ক সে টেনে বের করে আনতে লাগল। প্রতিটি অঙ্গ—মস্তিষ্ক, ফুসফুস, পাকস্থলী, যকৃৎ, অন্ত্র—পৃথক পৃথক মৃন্ময় পাত্রে অতি যত্নে সংরক্ষিত হল। কিন্তু মৃতার হৃৎপিণ্ড আমেনহোটেপ বের করে আনল না। মিশরীয়দের বিশ্বাস, মৃত মানুষটির চিন্তা ও সমগ্র সত্তার উৎস হৃৎপিণ্ড—যা অবিকৃত রাখাই প্রয়োজন। এইরূপে পরিষ্কৃত দেহটি উত্তম সুরা দিয়ে প্রলিপ্ত করা হল। কেননা সুরা জীবাণুনাশক।
এর পরের কাজ, শরীরটিকে শুষ্ক করার কাজ। আমেনহোটেপের কাছে এক বিশেষ ধরনের রাসায়নিক ছিল, এক বিশেষ প্রকারের লবণ, যা উত্তর মিশরের নত্রন উপত্যকায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। সেই রাসায়নিক দ্রব্য কাপড়ের ছোটো ছোটো পুঁটুলিতে মৃতার শরীরের ভিতর ভরে দিল আমেনহোটেপ। মৃতদেহটিকে ওই লবণ দিয়ে সম্পূর্ণ ঢেকে দিল।
এবার চল্লিশ দিনের অপেক্ষা। করুণৈ-র শরীর সম্পূর্ণভাবে জলীয়তামুক্ত হবে। এই অবসরে আমেনহোটেপ পাতালের নিগূঢ় কক্ষ থেকে ইন্দুমুখীর কাছে একটি আবেদন পাঠাল। দাসদাসীরা সোপানের উপর প্রত্যহ আমেনহোটেপের খাবার রেখে যেত, উচ্ছিষ্ট পাত্রগুলি ফেরত দেওয়ার সঙ্গে একদিন একটি পত্র প্রেরণ করল আমেনহোটেপ। সেই পত্রে কাঠের তৈরি একটি পেটিকার চিত্রিত পরিকল্পনা ছিল। পেটিকাটির আয়তন মৃতদেহের সমান। ধাতু বা পাথরের শবাধারই যদিও বৈধ, তবু এক্ষেত্রে নীচে নামানোর সুবিধে হবে বলে কাঠের পেটিকারই আর্জি জানিয়েছিল আমেনহোটেপ। নানা ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে নিরত আমেনহোটেপ অতি সংযত চিত্তে পেটিকাটির অপেক্ষা করতে লাগল। পুহারের দারুশিল্পীদের দ্বারা নির্মিত পেটিকাটিও এসে পড়ল দুই সপ্তাহের মধ্যেই।
এখানে দিনও নেই, রাত্রিও নেই—শুধুই অন্ধকার। এখানে ইতিও নেই, নেতিও নেই—শুধুই শূন্যতা। এখানে জীবনও নেই, মৃত্যুও নেই—শুধুই স্থবিরতা। নিগূঢ় কক্ষে দিনের পর দিন নিঃশব্দে বাস করছিল আমেনহোটেপ, পার্শ্ববর্তী কক্ষে শায়িত ছিল শুধু শুষ্কপ্রায় হিমশীতল একটি মৃতদেহ।
চল্লিশ দিন পরে আমেনহোটেপ সেই রাসায়নিকের প্রলেপ সরিয়ে দেখল, মৃতদেহটি শুকিয়ে কুঞ্চিত কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। এর পরেই বেশ কঠিন কাজ। বহু দিন ধরে তৈল-সহযোগে মৃতদেহটির অঙ্গসংবাহন করতে লাগল আমেনহোটেপ। ধীরে ধীরে মরদেহের মাংসপেশীগুলি নরম হয়ে এল, যেন একটা প্রাণনার আভাস ফুটল। অক্ষিকোটরে নকল দুটি বেলেপাথরের চক্ষু স্থাপন করল আমেনহোটেপ, রংতুলি দিয়ে প্রস্ফুট করে তুলতে লাগল শরীরের বিভিন্ন সংস্থান। অতঃপর দেবদারু ও সরলবৃক্ষ হতে উৎপন্ন উষ্ণ রজন দিয়ে মরদেহটিকে প্রলিপ্ত করে পট্টবস্ত্র দ্বারা ভালোমতো বাঁধতে লাগল। এই সব কাজে কেটে গেল আরও কুড়ি দিন।
অবশেষে এক বিশেষ ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ডের অনুষ্ঠান করল সে, যাতে করুণৈ-র প্রতিটি অঙ্গদ্বার সামান্য উন্মুক্ত হয়। নাক, চোখ ও মুখের রন্ধ্রপথ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট মুখমণ্ডলে অবিকল চর্মবর্ণের একটি মুখচ্ছদ পরিয়ে দিল। করুণৈ-র শরীরে তার পূর্বপরিহিত বস্ত্রগুলি একে একে পরাল আমেনহোটেপ। সারা শরীর সাজিয়ে দিল প্রসাধনে। চোখদুটির পাতা খুলে দিল। কাজল পরালো নীল চোখে। মমীকৃত শরীরটিকে এবার স্থাপন করল অলংকৃত কাঠের শবাধারে। তারপর উপরে সংবাদ পাঠাল—ক্রিয়া সমাপ্ত হয়েছে, গৃহকর্ত্রী একাকী যেন নিগূঢ় কক্ষে এসে দেখা করেন।
ভয়ে, বিস্ময়ে, মায়াটানে বিহ্বল ইন্দুমুখী হাতে একটা ঘিয়ের প্রদীপ নিয়ে সোপান বেয়ে নেমে এসে নিগূঢ় কক্ষে উপস্থিত হল। সে দেখল, সেই বৃহদায়তন কাষ্ঠপেটিকার ভিতর মা করুণৈ জীবন্ত শুয়ে আছেন। তাঁর চোখ দুটি খোলা, মুখে সেই চিরপরিচিত হাসি। এই তো মা তার দিকে চেয়ে মধুর হাসছেন! আহা, কী এক অপার্থিব শান্তি মায়ের চোখেমুখে, সমস্ত শরীরে!
আমেনহোটেপ মুগ্ধা ইন্দুমুখীর মুখপানে চেয়ে দেখল। ডানহাতে প্রদীপ তুলে ধরে নতমুখে বিস্ময়াবিষ্ট দৃষ্টিতে ইন্দুমুখী করুণৈ-র দিকে চেয়ে রয়েছে। প্রদীপের আভায় আভায়িত ইন্দুর সেই মুখে বিস্ময় আছে, মুগ্ধতা আছে, সম্ভ্রম আছে। কিন্তু কী যেন একটা নেই! কী নেই, তা আমেনহোটেপও বুঝে উঠতে পারছিল না। তন্ন তন্ন করে দেখছিল, তবু ইন্দুমুখীর মুখে কী একটা ভাব আমেনহোটেপ কিছুতেই খুঁজে পেল না।
যেন একটা সুচ্ছন্দিত সুনির্মিত কবিতা লিখেছে আমেনহোটেপ। লিখবার পরে ইন্দু্মুখীকে পরিশীলিত উচ্চারণে পড়ে শোনাচ্ছে। ইন্দুমুখী শুনতে শুনতে কবিতার গঠনকাঠামোয় মুগ্ধ হয়ে গেছে, বিস্ময়-শিহরিত হয়েছে। তবু যেন শ্রোত্রী ইন্দুমুখী কিছুতেই সে-কবিতায় ভাবাবিষ্ট হচ্ছে না, সম্মোহিত হচ্ছে না।
আমেনহোটেপ ভাবল, আরও কিছু সময় যাক। নিশ্চয়ই হবে। এই তো সবে আরম্ভ। নৈঃশব্দ্য ভেঙে বলল আমেনহোটেপ, ‘আপনার মা আপনার কাছেই ফিরে এসেছেন, ইন্দুমুখী! আপনার কাছেই এখন থেকে থাকবেন। আমি তাঁর শরীরকে অবিকৃত করে দিয়েছি। এখন থেকে তাঁর আর মরণ নেই। তিনি এখানেই আছেন। আমাদের সব কথা তিনি শুনতে পাচ্ছেন। আগে যেমন যা যা সেবা করতেন, অবিকল তাই-ই করে চলুন। তাঁর প্রিয় দ্রব্যাদি, অলংকার বস্ত্রাদি সব এ ঘরে এনে রাখুন। আজ থেকে নিয়মিতভাবে তাঁকে আহার্য, পানীয় দেবেন। কোনো অযত্ন করবেন না।’
ইন্দুমুখী ধীরে ধীরে মুখ তুলে বলল, ‘আমি সত্যিই আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ, ভদ্র। আপনি আমার মাকে চিরজীবন দিয়েছেন। আপনার এ ঋণ আমি কোনোদিন পরিশোধ করতে পারব না।’
আমেনহোটেপ ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘আমি এখন যাব, ইন্দুমুখী। দিন তিনেক পরে আবার আসব। বহুদিন এই নিগূঢ় কক্ষে রয়েছি। এবার আমার বিশ্রামের প্রয়োজন। সুস্থতার প্রয়োজন। কয়েক দিনের মধ্যেই ফিরে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করব আমি।’
সেই অর্ধদীপিত কক্ষে ইন্দুমুখীকে রেখে সোপান বেয়ে আলোকিত পৃথিবীতে উঠে এল আমেনহোটেপ।
চার
তিনদিন নয়। প্রায় এক সপ্তাহ লাগল আমেনহোটেপের সুস্থ হতে। মানুষ পৃথিবীর উপরিভাগের জীব। পাতালের নিগূঢ় কক্ষের আবছা অন্ধকার ও বদ্ধ বাতাসে সে সুস্থ থাকতে পারে না। তার সুস্থ জীবনধারণের জন্য পৃথিবীর উপরিভাগের মুক্ত আলোহাওয়ারই প্রয়োজন হয়।
সাতদিন পরে এক অপরাহ্ণবেলায় আমেনহোটেপ ইন্দুমুখীর প্রাসাদে এসে উপস্থিত হল। দর্শনকক্ষ হতে পরিচারিকা তাকে একেবারে প্রাসাদের ছাদে নিয়ে গেল। এখানেই ইন্দুমুখী তার সঙ্গে দেখা করবে। ছাদের অলংকৃত মেঝেতে একটি কিলিঞ্জক অর্থাৎ মাদুর জাতীয় আসন বিছানো রয়েছে। কয়েকটি সুচিত্রিত উপাধানও কিলিঞ্জকের উপরে সাজানো রয়েছে। উপাধানে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে আমেনহোটেপ অধীর আগ্রহে ইন্দুমুখীর অপেক্ষা করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে ইন্দুমুখী ছাদে এল। তার পরনে একটি বাসন্তী রঙের দুকূল ও কেশপাশ কবরীবদ্ধ। কবরীতে একটি যূথিকাপুষ্পের মালা সুরভি ছড়াচ্ছে। অনেকদিন পরে ইন্দুমুখীকে দেখে মনে হল, নিজেকে সে যেন অনেকখানি সামলে সুসংবৃত করে নিতে পেরেছে। হাতে তার লাল শালুতে বাঁধা একটি পুথি।
ইন্দুমুখী কিলিঞ্জকে এসে বসল। পরিচারিকা উভয়ের জন্য পানীয় পরিবেশন করে গেল। ইন্দুমুখী সেই পুথিটি আমেনহোটেপের হাতে দিয়ে বলল, ‘এই আপনার দীর্ঘবাঞ্ছিত সামুদ্রচন্দ্রিকার পুথি। এতদিন আমাদের পূজার ঘরে ছিল। আপনি আমার যে-উপকার করেছেন, তারই প্রত্যুপকারস্বরূপ আমি এ পুথি আপনাকে উপহার দিলাম।’
ইন্দুমুখীর হাত থেকে পুথিটি নিয়ে বাঁধন খুলে দেখতে লাগল আমেনহোটেপ। তামিল ভাষার অলংকৃত পুথি। স্পষ্টাক্ষরে লিখিত। পঠন-পাঠনে কোনো অসুবিধা হবে না। মানুষের শারীরিক আকার ও বিভিন্ন অঙ্গসংস্থান থেকে মানুষটির মানসিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ এ পুথিতে অনিবার্যভাবে লিখিত রয়েছে।
অতিথিশালায় ফিরে গিয়ে বিস্তারিতভাবে অধ্যয়ন করা যাবে, এই কথা ভেবে আমেনহোটেপ আপাতত পুথিতে বাঁধন দিয়ে লাল শালুতে বেঁধে নিল। তারপরে পানপাত্রে চুমুক দিয়ে ইন্দুমুখীকে প্রশ্ন করল, ‘তারপর? এখন কেমন বোধ করছেন? এখন মনে শান্তি পেয়েছেন তো?’
‘হ্যাঁ,’ ইন্দু সংক্ষেপে উত্তর দিল।
‘আপনার মাকে আপনি নিরন্তর কাছে কাছে পাচ্ছেন তো?’
‘না।’
আমেনহোটেপ নিতান্ত বিস্ময়াহত হয়ে পানপাত্রটি কিলিঞ্জকের উপর নামিয়ে রেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘পাচ্ছেন না? সে কী! কেন?’
ইন্দুমুখী বলল, ‘না, পাচ্ছি না। কারণ নিগূঢ় কক্ষে শায়িত ওই দেহটি আমার মা নন!’
ছাদের উপর সহসা বজ্রাঘাত হলেও আমেনহোটেপ বোধহয় এতখানি অবাক হত না। কিছুক্ষণ সে কোনো কথা বলতে পারল না। স্তব্ধবাক বসে থেকে থেকে অবশেষে নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞাসা করল আমেনহোটেপ, ‘কিন্তু কেন এমন কথা মনে হল আপনার? আমি তো সমস্ত ক্রিয়াকাণ্ডের বিধিবৎ অনুষ্ঠান করে করুণৈদেবীকে পুনর্জাগরিত করেছি। ওই দেহটি সহস্র সহস্র বৎসরেও নষ্ট হবে না। আর তাই ওরই সঙ্গে করুণৈদেবী দীর্ঘকাল লগ্ন হয়ে থাকবেন। এতে কি আপনার বিশ্বাস হয় না?’
অনেক দূরের আকাশের দিকে চেয়ে থেকে থেকে ইন্দুমুখী ধীরে ধীরে বলল, ‘না। এতে আমার বিশ্বাস হয় না, ভদ্র। আমি বুঝতে পেরেছি, প্রায়ান্ধকার কক্ষে শয়ান ওই দেহটি আমার মা নন। কোনোকালেও ছিলেন না। আপনি সুদীর্ঘ ও সযত্ন প্রয়াসে একটি মৃতদেহকে দীর্ঘস্থায়ী করেছেন মাত্র। আর কিছু নয়। ও দেহ নড়ে না, চড়ে না। বোবা চোখ মেলে শুধু চেয়ে থাকে। আমি আহার্য দিই, সে-আহার্য যেমনকার তেমনই অস্পৃষ্ট পড়ে থাকে। আমি কথা বলি, কিন্তু তিনি আমার কথা শুনতে পান বলে মনে হয় না। আমি তাঁকে দেখি, কিন্তু তিনি আমাকে কি দেখতে পান? আমি তো দূরস্থান, তিনি নিজেকেও কি অনুভব করতে পারেন? যা নিজেকে অনুভব করতে পারে না, তা প্রাণহীন জড়পদার্থ ছাড়া আর কিছু নয়। স্বানুভবই জীবিতের প্রথম লক্ষণ।’
আমেনহোটেপ নিজের বিশ্বাসের ভূমিকে অতিক্রম করে এই ভিনদেশী মেয়েটির মনোভূমিকে আত্মস্থ করবার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। খানিক ভেবে নিয়ে সে বলল, ‘আচ্ছা। কিন্তু মাকে আপনি যেভাবে তাঁর মৃত্যুর আগে দেখেছেন, এখনও তো ঠিক সেই আকারেই দেখছেন। নয় কি?’
ইন্দুমুখী উত্তর দিল, ‘মাকে কি আমি একপ্রকার আকারেই দেখেছি, ভদ্র? আমি যখন শিশু ছিলাম, আমার মা তখন যুবতী। ধীরে ধীরে আমি যুবতী হয়ে উঠলাম, আমার চোখের সামনেই মা ধীরে ধীরে প্রৌঢ়া হয়ে গেলেন। আমার যুবতী মায়ের সেই নীলোৎপল আঁখি, যৌবনের সেই থিরবিজুরি রূপ, সেই সুঠাম সুচ্ছন্দিত দেহগঠন সমস্তই একে একে চলে গেল। কৃষ্ণকেশ পলিত হল, বলিরেখায় আক্রান্ত হল মুখ, চর্ম শিথিল হল, উন্নত স্তনদ্বয় লোল হল, কটিদেশ থেকে হারিয়ে গেল বিভঙ্গবিদ্যুৎ। যৌবন চলে গিয়ে জরা এল মায়ের সমস্ত শরীর জুড়ে। কই, আমি তো মায়ের সেই যুবতী-রূপ চলে যাওয়াতে শোক করিনি তখন? মায়ের বৃদ্ধাবস্থার রূপকেই শান্ত মনে মেনে নিয়েছি। এই পরিবর্তনেরই অন্য নাম জীবন। কিন্তু আপনি আজ দুঃসাধ্য চেষ্টায় মায়ের যে-বার্ধক্যের রূপটিকে স্থায়িত্ব দিয়েছেন, তাতে তার আর কোনো পরিবর্তন হবে না। সে দীর্ঘ হবে না, হ্রস্ব হবে না, তার কেশপাশ বর্ধিত হবে না, ক্ষয়প্রাপ্তও হবে না। চোখের পাতাও তার বন্ধ হবে না আর। এরকমই নিষ্প্রাণ পুতুলের মতো সে শুধু অনন্তকাল চোখ খোলা রেখে হেসে চলবে অন্ধকারে। এই যে স্থায়িত্ব, এই যে গতিহীনতা, এই যে স্থবিরতা—এই-ই তো মৃত্যু। আপনি আমার মাকে মৃত্যু থেকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনতে পারেননি, ভদ্র। কেউই পারে না। আপনি শুধু আমার মায়ের মৃত্যুকেই চিরস্থায়িত্ব দিয়েছেন।’
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে আছে। দূরের আকাশ বেয়ে কোনো অজানা পাখির ডাক ভেসে আসছে। আমেনহোটেপ বলল, ‘তাহলে আমার এই প্রয়াস আপনার কোনো কাজেই লাগল না, ভদ্রে!’ তার গলায় নিতল নৈরাশ্যের সুর বেজে উঠছে।
ইন্দুমুখী বলল, ‘তা নয়। অবশ্যই আপনি আমার মহদুপকার করেছেন। আজ সাতদিন আমি নিগূঢ় কক্ষে ওই দেহটির সঙ্গে কাটিয়েছি। আমি বুঝতে পেরেছি, মৃত্যু কী। আর তার বিপরীতে জীবনই বা আসলে কী। ওই দেহটি আমার মা নন। ওটা একটা নিষ্ঠুর করুণরঙিল পুতুল মাত্র। আপনার বহুশ্রমে নির্মিত। এক রাত্রে স্বপ্ন দেখলাম, মা এসেছেন। তিনি আগের মতনই হাঁটছেন, অঙ্গসঞ্চালন করছেন, কথা বলছেন, আমাকে আদর করছেন। ঘুম ভেঙে মনে হল, স্বপ্নে দেখা আমার ওই মায়ের যতটুকু জীবন আছে, পর্যঙ্কে শায়িত এই মৃত পুত্তলিকাটার ততটুকু জীবনও নেই। আমাদের দেশের প্রাজ্ঞ মনীষীরা যে বলেন, মানুষ আসলে দেহনিরপেক্ষ আত্মা—সেকথা আমি আজও বুঝিনি। কিন্তু এই ক-দিনে আমার এটুকু বোধ অন্তত হয়েছে যে, মানুষ আর যাই হোক, সে এই মাংসল জড়পিণ্ড শরীর নয়। কোনোকালেও ছিল না। আপনার প্রচেষ্টার ফলেই আমি একথা বুঝতে পেরেছি। এখন আমার আর কোনো মোহ নেই। সেজন্যেই আমি আপনার কাছে সবিশেষ কৃতজ্ঞ!’
শুনতে শুনতে আমেনহোটেপের মনের অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে যেন একটা বাতায়ন অস্পষ্টভাবে খুলে যেতে লাগল। সে যেন একটু একটু করে ইন্দুমুখীর কথাগুলো এবার বুঝতে পারছে। যেন হাজার হাজার বছরের স্থবির বিশ্বাসের অজস্র পিরামিড ভেঙে পড়ছে আমেনহোটেপের মনের মধ্যে। সেসব বিভগ্ন মৃত্যু-উপত্যকা থেকে স্যাক্রোফেগাসের আবরণ সরিয়ে উঠে বসছে গণনাতীত মমীকৃত মানুষ। তারা বিলাপ করছে, হাহাকার করছে, জড়িয়ে জড়িয়ে কাকে যেন অভিশাপ দিচ্ছে আকাশে দু-হাত তুলে…
ধীরে ধীরে ইন্দুমুখীর করতলে লাল শালুতে মোড়া সেই পুথিখানি প্রত্যর্পণ করল আমেনহোটেপ। অশ্রুসজল দুই চোখ তুলে আমেনহোটেপ মন্থর স্বরে বলল, ‘প্রিয় বান্ধবী! তবে এ পুথিখানিরও আমার আর প্রয়োজন নেই। এর প্রতি লোভ নেই এখন আর আমার মনে। মানুষ যদি দেহই না হয়ে থাকে, মানুষ যদি দেহ ছাড়া অপর কিছুই হয়ে থাকে, তবে দেহের গঠনভঙ্গিমা থেকে মানুষের চরিত্র বা মনোগঠন নির্ণয়ের বিদ্যাও নিতান্তই অর্থহীন। ওই বাসনা আমি এখনই ত্যাগ করলাম।’
দিগন্তে তখন এক আশ্চর্য সূর্যাস্ত হচ্ছিল। দিনান্তের সেই আলো এসে খেলা করছিল ইন্দুমুখী ও আমেনহোটেপের মুখে। ওরা তাকিয়ে রইল দুজনে দুজনার দিকে সেই আলোর ভিতর। এ সেই আলো, যার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে জীবন ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বে, আশা ও ভয়ের ঊর্ধ্বে, বিশীর্ণ কঞ্চুক এই দেহের সমস্ত দাবির ঊর্ধ্বে মানুষ মানুষকে চিরকাল নির্ভয়ে বলেছে: ‘ভালোবাসি’।
লেখক পরিচিতি – সন্মাত্রানন্দ গদ্যকার, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। তাঁর লেখা নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা, ছায়াচরাচর, তোমাকে আমি ছুঁতে পারিনি, দীনেশ গুপ্তের রিভলভার, হাওয়ার মতন নেশার মতন, শ্রীগদ্যশরীর,একা একা অক্ষরেরা,ভামতী অশ্রুমতী, ধুলামাটির বাউল ইত্যাদি জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি অর্জন করেছে।
শেয়ার করুন :