অনিরুদ্ধ সরকার
১।।
প্রথমেই একটা চমকে দেওয়ার মত তথ্য দিয়ে শুরু করি, বাঙালির হাতেখড়ি হয় যে বই দিয়ে সেই বর্ণপরিচয় কবে প্রকাশিত হয়েছিল জানেন? পয়লা বৈশাখের দিনে। বিদ্যাসাগরমশাই এই পয়লা বৈশাখকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন তাই বাঙালির হাতেখড়িরর বর্ণপরিচয়ের আত্মপ্রকাশ ঘটান এই দিনেই। আর এই পয়লা বৈশাখে বর্ণপরিচয়ই নয় আরও বেশ কিছু গ্রন্থ এবং পত্রিকারও আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল এই পয়লা বৈশাখেই। যেমন ধরুন বঙ্কিমবাবুর ‘বঙ্গদর্শন’ কিংবা সুরেশচন্দ্র সমাজপতির ‘সাহিত্য’ পত্রিকা। আবার রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রবাসী’ থেকে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ‘সন্দেশ’ পত্রিকার যাত্রা শুরু হয়েছিল এই পয়লা বৈশাখেই।
চলে আসি হালখাতার প্রসঙ্গে। ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই ‘হালখাতা’ শব্দটি। কীভাবে পয়লা বৈশাখের সঙ্গে এর যোগ হল? ইতিহাস কি বলছে? আসুন জেনে নিই। এই পয়লা বৈশাখ পালনের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি এদিন হালখাতার বিশেষ রেওয়াজও পালন করে আসছে সেই মহারাজা শশাঙ্ক কিংবা তারও আগে থেকে।
সহজ কথায় হাল চালানো বা হাল দেওয়া থেকে ‘হাল’ শব্দটির আবির্ভাব এবং সেই হাল চালানোর হিসেব যে খাতায় রাখা হত সেই ‘খাতা’ থেকে রেওয়াজটির নাম হয়েছে ‘হালখাতা’। অতএব সেই হাল চালানোর সময় এবং হিসেব রাখার সময় থেকেই হালখাতার রেওয়াজ পালিত হচ্ছে। আরও ভেঙে বলতে গেলে, মানুষ যখন লাঙলের ব্যবহার শিখল তখন তারা এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করল এবং তখন চাষ করা দ্রব্যের বিনিময় প্রথা শুরু হল। এই হালের দ্রব্য বিনিময়ের হিসেবের জন্য একটি খাতায় নিজেদের মতো করে তারা তা লিখে রাখতে শুরু করেছিল। সেই সময়কার ভাষায় তা লিপিবদ্ধ করা হত। সেই লিপিবদ্ধ করা খাতাটিরই নাম ছিল ‘হালখাতা।” হাল শব্দটি সংস্কৃত এবং ফারসি, দু’টি থেকেই এসেছে বলে দাবি করা হয়। সংস্কৃত হলে তার মানে ‘লাঙল’। আর ফারসি হলে হাল-এর মানে নতুন। তাই এই দু’টি শব্দই হালখাতার ক্ষেত্রে যথাযোগ্য।
আরও পড়ুন:
মুষ্টিমেয় একশ্রেণির বাঙালি মনে করেন- খাজনা আদায়ের জন্য পয়লা বৈশাখে চালু হয় এই ‘হালখাতা’। বিভিন্ন রাজ্য তথা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত হয় নববর্ষ। হালখাতাও কখনও হয় রামনবমীতে, কখনও দেওয়ালিতে। ভেবে দেখুন, আমাদের এখানে অক্ষয় তৃতীয়াতেও কিন্তু হয় হালখাতা।
২||
আকবরের আমল থেকেই যে এই পয়লা বৈশাখ পালিত হচ্ছে তাতে একশ্রেণির বাঙালি বেশ আত্মহারা। কয়েকজন ঐতিহাসিক এবং গবেষক তো ঘরে বসে দায়িত্ব নিয়ে এই তথ্যকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। যাই হোক এনিয়ে বিতর্ক থাক্তেই পারে কিন্তু কেন বিতর্ক তা একটু জেনে নিলে মন্দ হয় না। আসুন জেনে নিই- আকবরের আমলে ১ বৈশাখের দিন জমিদারদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার জন্য নববর্ষের দিন হালখাতার সূচনা হয়েছিল। খুব ভালো কথা। শুধু তাই নয়, বঙ্গাব্দের প্রচলনও না-কি আকবরের হাত ধরে। সত্যিই কি তাই! আকবের আগে তো বাংলায় মল্লরাজারা মল্লাব্দের প্রচলন করে ফেলেছিলেন তাহলে? আর শকাব্দ, গুপ্তাব্দ, বিক্রমাব্দ এসবও তো ছিল তাহলে!!! এবিষয়ে একশ্রেণির ঐতিহাসিক জোর গলায় বলছেন, বঙ্গাব্দের প্রচলন হয়েছিল মহারাজ শশাঙ্কের রাজত্বকালে।
এবার গবেষক সুকুমার সেনের কথায় আসি। উনি লিখছেন, “নতুন খাতার (নতুন খাতার আসল নাম হালখাতা) একটু ইতিহাস আছে। বাংলাদেশ অধিকার করে আকবর এখানে রাজস্ব সংগ্রহ ও রাজ্য শাসনের জন্যে হিজরিকে বর্ষ রূপে চালিয়েছিলেন। তিনি যে নতুন বছর করলেন তার নাম দিলেন ‘ফসলি’। ’ (এই ‘ফসলি’ এখন আমাদের বাংলা সাল। তবে এর বর্ষারম্ভ ১ বৈশাখ)। অর্থাৎ ফসল তোলার কাল। হিজরি পুরোপুরি গ্রহণ করার পক্ষে একটা বিশেষ বাধা ছিল। হিজরি বছর ৩৫৪ দিন। সুতারাং হিজরিতে নববর্ষ বছর এগার দিন পিছিয়ে যাবে। এই অসুবিধা দূর করার জন্যই আকবর হিজরি সালকে নিয়ে তা করলেন ৩৬৫ দিনের। এইটিই হল ‘ফসলি’ সাল। এই ফসলি সাল ধরে জমিদারদের খাজনা দিতে হতো। জমিদাররা নিজেদের খাজনা আদায়ের সুবিধের জন্যে ফসলি সালে নববর্ষের দিন ঠিক করতেন। পণ্ডিতেরা এই দিনের নাম দিয়েছিলেন ‘পুন্যাহ’ অর্থাৎ (পুন্য দিন)।”খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন।”
৩||
এবার অতীতের জমিদারি প্রথার অন্দরে একটু খোঁজ নিয়ে দেখা যাক কি ইতিহাস মেলে। অতীতের কিছু পুরোনো দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে জানা যায়- একসময় জমিদাররা পয়লা বৈশাখ অথবা বছরের প্রথম দিকে পুণ্যাহ বলে একটা উৎসব পালন করতেন। সেদিন কাছারিবাড়িটা সাজানো হতো। তার সামনে থাকত নানা বাদ্যযন্ত্রের ব্যান্ড। দেশি আর বিলিতি বাদ্যযন্ত্রের সমাহারে জমিদারদের বাড়িতে এক সুরের আবহ তৈরি হত। যাতে থাকত সানাই, ক্লারিওনেটের মত বাদ্য। তবে সব ছাপিয়ে থাকত ঢাকের বাদ্যি। বাড়ির বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ঢাকের তালে কোমর দোলাতো। কোনো কোনো জমিদারদের নিজস্ব ব্যান্ড থাকত। বাজনাদারেরা আসতেন সারাবছরের বায়না নিতে। কেউ বা আসত বিভিন্ন পুজোর বায়না নিতে। প্রজারা চলে যেত কাছারির ভেতর। সেখানেই চলত আদান-প্রদান। সহজ কথা এই পুণ্যাহ বিষয়টা ছিল অনেকটা হালখাতার মতো। এই দুয়ের পার্থক্যটা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন- আসলে ‘হালখাতা’ ছিল ক্রেতার সঙ্গে দোকানদারের দেনা-পাওনাসংক্রান্ত একটি বিষয় ; আর ‘পুণ্যাহ’ ছিল প্রজাদের সঙ্গে জমিদারের দেনা-পাওনার বিষয়।
ঐতিহাসিকদের মতকে আরও সহজভাবে বলতে গেলে, “দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কর আদায়ের জন্য আকবরের অর্থমন্ত্রী তোডরমল জোর দিয়েছিলেন আঞ্চলিক সুবিধার উপরেই। রবি শস্যের ফসল ওঠার পরে লোকের হাতে অর্থ, সম্পদ থাকত। তাই পয়লা বৈশাখের মধ্যে কর জমা দিতে হত।”
৪||
এক ঐতিহাসিক আকবরের সময়কালে পালিত এই উৎসবের বিষয়টি নিয়ে লিখছেন- পহেলা বৈশাখ এক আনন্দের দিন। ভোরের সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে এই পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। প্রত্যেক প্রজাকে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সমস্ত খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। এই উৎসবের রুপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বইকেই বোঝানো হয়। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাঠের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হাল-নগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকনদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকেন। মোঘল আমলে স্বর্ণশিল্পীরা নিজেদের দোকানে এই রেওয়াজ পালন করতেন।”
তাহলে প্রশ্ন জাগে আজকের এই আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের রীতিটি এল কবে থেকে? ঐতিহাসিক এবং গবেষকদের মতে, ১৯১৭ সালে না-কি প্রথম নববর্ষ পালিত হয়। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর ‘পহেলা বৈশাখে’ হোম-যজ্ঞ, কীর্ত্তণ এবং পূজনের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়।
৫||
এবার একটু গ্রামবাংলার লোকসংস্কৃতিতে ফেরা যাক। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি বা মহাবিষুবসংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়কপূজা অর্থাৎ শিবের উপাসনা। এইদিনেই সূর্য মীন রাশি ত্যাগ করে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে। এদিন গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজিত হয় চড়ক মেলা। এই মেলায় অংশগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করে মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকে। এছাড়া বহু পরিবারে বর্ষশেষের দিন টক এবং তিতা ব্যঞ্জন ভক্ষণ করে সম্পর্কের সকল তিক্ততা ও অম্লতা বর্জন করে। এই প্রতীকী প্রথা একবিংশ শতাব্দীতেও বিদ্যমান। ঠিক তার পরের দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ একটি নতুন বছরের সূচনা হয়। গ্রাম লাগোয়া নদী কিংবা পুকুরে প্রতিটি পরিবার ভোরে স্নান সেরে প্রাচীন মন্দিরে পুজো দেন। তারপর বাড়ির বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করে মঙ্গলকামনা করে থাকেন। বিভিন্ন লোক উৎসব পালিত হয়। ধর্মীয় বিভিন্ন রীতি-রেওয়াজ ও প্রথা মেনে চলে পুজো। বাড়িতে বাড়িতে এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলিতে চলে মিষ্টান্ন ভোজন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশই এদিন থেকে তাদের ব্যবসায়িক হিসেবের নতুন খাতার উদ্বোধন করে, যার পোশাকি নাম হালখাতা। গ্রামাঞ্চলে এবং কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে এই পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হয় বৈশাখী মেলা।
৬||
আসুন এবার এই পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষ নিয়ে আমাদের বাঙালি কবিদের কার কি ধারণা একটু দেখে নিই।
কবি ইশ্বচন্দ্র গুপ্ত ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে লিখছেন, “খৃস্ট মতে নববর্ষ অতি মনোহর। প্রেমাননন্দে পরিপূর্ণ যত শ্বেত নর।/ চারু পরিচ্ছদযুক্ত রম্য কলেবর। নানা দ্রব্যে সুশোভিত অট্টালিকা ঘর।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘নববর্ষ প্রবন্ধে লিখেছেন ‘অহোরাত্রান্যার্ধমাসা মাসা ঋতবঃ সম্বৎসরা ইতি বিধৃতাস্তিষ্ঠন্তি’ অর্থাৎ ‘যে অক্ষর পুরুষকে আশ্রয় করিয়া দিন ও রাত্রি, পক্ষ ও মাস, ঋতু ও সংবৎসর বিধৃত হইয়া অবস্থিতি করিতেছে, তিনি অদ্য নববর্ষের প্রথম প্রাতঃ সূর্যকিরণে আমাদিগকে স্পর্শ করিলেন৷ এই স্পর্শের দ্বারা তিনি তাঁহার জ্যোতির্লোকে তাঁহার আনন্দলোকে আমাদিগকে নববর্ষের আহ্বান প্রেরণ করিলেন৷’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নববর্ষের আবাহন মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন এই প্রবন্ধে। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে গেয়েছেন ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’
কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখছেন,
‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর,
তোর সব জয়ধ্বনি কর
ওই নূতনের কেতন ওড়ে,
কালবৈশাখী ঝড়
তোর সব জয়ধ্বনি কর’।
৭||
এবার বাঙালি নববর্ষে দক্ষিণেশ্বর যাওয়ার একটা বেশ ধুম দেখা যায়। এই হিড়িক কিন্তু আজকের নয়। যুগপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে অবস্থান করা থেকেই এই পরম্পরা চলে আসছে। আর এই ঐতিহ্যকে আজও জাগ্রত করে রেখেছে আবেগপ্রবণ বাঙালি তাই হালখাতা পুজোর জন্য চৈত্র সংক্রান্তির রাত থেকেই লম্বা লাইন পড়ে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের বাইরে। ভোর চারটেয় মঙ্গলারতি হওয়ার পর থেকে রাত পর্যন্ত চলে পুজো। কয়েক লক্ষ পুণ্যার্থীর ভিড় জমে। কোনো কোনো বছর পুজো দেওয়ার লাইন পৌঁছে যায় বালি খাল পর্যন্ত। দিনে পাঁচ-ছ’কেজি পেঁড়া রাখা হয় দোকানে। নববর্ষের দিনে যা রাখা হয় ১২ থেকে ১৫ কেজি। ভাবা যায়! নববর্ষের দিন সকালে লক্ষ্মী-গনেশের পুজো দেন বাঙালি, কারও হাতে পেতলের লক্ষ্মী-গনেশ, তো কারও হাতে থাকে মাটির লক্ষ্মী-গনেশ।বছরের শুরুতেই হালখাতা মা ভবতারিণীয়ের পায়ে ছুঁইয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের আশির্বাদ নেন ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষ। একসময় দক্ষিণেশ্বরের যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। মনে পড়ে ঠাকুর যখন নরেনকে একবার দক্ষিণেশ্বরে আসার জন্য পীড়াপীড়ি করছে তখন নরেনের সাফ উত্তর, “এতদূর রোজরোজ আসা যায় না। তার ওপরে খরচ আছে।” উত্তরে ঠাকুর মুচকি হেসে নরেনকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যেখানে দক্ষিণা থাকে সেই জায়গাটি।বলেছিলেন, “প্রয়োজন পড়লে ওখান থেকে নিয়ে নিস।” আজ দক্ষিণেশ্বর যাত্রাপথ সহজ হয়েছে।জলপথ, সড়কপথ, রেলব্যবস্থা সবই রয়েছে। মন্দির অবধি মেট্রো চালু হয়ে যাওয়ায় সহজেই মানুষ পৌঁছে যাচ্ছেন। স্কাইওয়াক নিয়ে যাচ্ছে একেবারে মন্দিরের প্রধান দরজার সামনে। ফলে মানুষ ফুল–মিষ্টি নিয়ে পুজো দিতে পারছেন। হাজারো গরমকে উপেক্ষা করে নববর্ষে মানুষ পুজো দেন দক্ষিণেশ্বরে।জিনিসপত্র,ঠাকুরের ছবি, এটা সেটা কেনেন।আর পুজো শেষে উপোস ভঙ্গ করেন হিঙের কচুরি আর মিষ্টি খেয়ে।কেউ বা খান লস্যি।
একইভাবে পয়লা বৈশাখের দিন উল্লেখযোগ্য ভিড় চোখে পড়ে কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ভোর থেকে প্রতীক্ষা করে থাকেন দেবীকে পূজা নিবেদন করে হালখাতা আরম্ভ করার জন্য। ব্যবসায়ী ছাড়াও বহু গৃহস্থও পরিবারের মঙ্গল কামনা করে দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে কালীঘাটে গিয়ে থাকেন। মন্দির এলাকার ৪০০-৪৫০ পেঁড়ার দোকান ঘিরে কেনাবেচা থাকে চোখে পড়ার মতো। কালী টেম্পল রোডের পেঁড়ার দোকানগুলিতে থাকেন শয়ে শয়ে পাণ্ডা। সবমিলিয়ে কালীঘাট জমজমাট । নিয়ম অনুযায়ী, সকাল ৬টায় খোলে কালীঘাট মন্দিরের দরজা। আর বন্ধ হয় রাত ১২টা নাগাদ।
৮||
এইদিন আবেগপ্রবণ বাঙালির তার বাঙালিয়ানা জাহির করে। অনেকেই ঐতিহ্যবাহী পোশাক ধুতি-পাঞ্জাবি এবং শাড়ি পরে রাস্তায় বের হন।
নববর্ষ উদযাপিত হয় প্রভাতফেরি, গণেশ পুজোর মধ্য দিয়ে। পয়লা বৈশাখ মানেই বাড়িতে সকলে মিলে একটা গোটা দিন একসঙ্গে কাটানোর একটা আবদার। নতুন কেনা পোশাক, মায়ের হাতের রান্না, নতুন বই, নতুন গান, নতুন সিনেমা– সব মিলিয়ে একটা নতুন বছর যেন অনেকগুলো নতুনের মালা গেঁথে নিয়ে আসে।
বাঙালি কলেজস্ট্রিট বইপাড়ায় এলেই আজীবন কেমন একটা নস্টালজিক হয়ে পড়ে।আর তা যদি নববর্ষের দিন হয় তাহলে তো কথাই নেই। বাঙালি খোঁজে অতীতের হারিয়ে যাওয়া খেরোর খাতা, জমিদারি পালকি, ঘোড়ার গাড়ি, ঢাকের আওয়াজ, ডাবের জল, জমাটি আড্ডা, নতুন গল্প, নতুন বই কিংবা পয়লা বৈশাখে প্রকাশিত প্রিয় লেখকের প্রথম পাতায় স্বাক্ষর!
সবকিছুর সংমিশ্রণে নববর্ষের প্রথম দিনটায় বইপাড়া থাকে জমজমাট। অজস্র স্মৃতি ভিড় করে কবি-সাহিত্যিকদের মনে। প্রকাশক-লেখক-পাঠকের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের এক অনন্য ছবি ফুটে উঠে আজও। চলুন এবার আমরাও একটু নস্টালজিক হয়ে পড়ি। ফিরে যায় অতীতের সেই কলেজস্ট্রিটে। যে কলেজস্ট্রিটে একসময় রাজত্ব করেছেন বিদ্যাসাগর, রামমোহন। পয়লা বৈশাখ প্রকাশকদের স্টলে উঁকি দিলেই দেখা যেত বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, প্রবোধকুমার সান্যালদের কিম্বা যে কলেজস্ট্রিটে পরে দেখা যেত সমরেশ, সুনীল কিম্বা শক্তিকে। সেসময় আজ অতীত। এখন বাঙালি ‘সোশ্যাল লাইক’ আর ‘অযাচিত দেখনদারিতে’ ব্যস্ত। কিন্তু একটা সময় এমনও ছিল যখন প্রথিতযশা সাহিত্যিক থেকে নবাগত লেখক, একবার হলেও এই দিনটায় ঢুঁ দিতেন বইপাড়ায়।
৯||
অতীত কাহিনির অনুসন্ধান করতে করতে জানা যায়, নববর্ষ উপলক্ষে বইপাড়ায় প্রকাশনা সংস্থা, বইয়ের দোকানে পরিষ্কার পর্ব চলত বেশ কয়েকদিন আগে থেকে। তারপর হত রং। আর পয়লা বৈশাখের দিন থাকত বিশেষ পুজো। তারপর সকলে মিলে এক অনাবিল আড্ডায় মেতে উঠতেন আট থেকে আশি। ঢাক বাজত। বাড়ি জুড়ে থাকত একটা পুজো পুজো ভাব। ট্রাম লাইনের উপর সেযুগে পালকি চলত। আর বাঙালির সঙ্গে বাঙালিয়ানা থাকত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে।
বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির অনন্য ছবিটাও ওই দিন ধরা পড়ত পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। প্রকাশকরা জানিয়েছেন, লেখকদের আড্ডা জমে উঠত।ধীরে-ধীরে কৌলীন্য হারিয়েছে নববর্ষের আড্ডার। সবাই আড্ডার জায়গায় টিভিতে মুখ দেখাতে ব্যস্ত। সেলফি-যুগ যখন আসেনি তখন লেখকের সই-ই তখন নববর্ষে পাঠকের সেরা প্রাপ্তি বলে মনে করা হত। কিন্তু সে রেওয়াজ আর নেই। কলেজ স্ট্রিট বদলেছে। বদলেছে নববর্ষের আড্ডার সেই চিরায়ত ট্রাডিশন ।
একটু আগেই বলছিলাম, একটা সময় লেখকের অটোগ্রাফেই সন্তুষ্ট থাকতে হত পাঠকদেরকে। বইয়ের প্রথম পাতায় লেখকের অটোগ্রাফ ছিল পাঠকদের কাছে প্রাপ্তি। দিন বদলালো। ”অটোগ্রাফ থেকে এল ‘ফটোগ্রাফ’ সংস্কৃতি। আর তা বদলে এল সেলফি। সঙ্গে সেলফ প্রমোশন। একটা সময় নববর্ষের দিন মানেই ছিল বিশেষ ছাড়।আজ সারাবছর ছাড় থাকে বইপাড়ায়। কলেজ স্ট্রিটেরও অনেক বদল হয়েছে। শুধু কলেজ স্ট্রিটই নয়, ধীরে-ধীরে কৌলীন্য হারিয়েছে নববর্ষের আড্ডা। সেলফি-যুগ যখন আসেনি তখন লেখকের সই-ই তখন নববর্ষে পাঠকের সেরা প্রাপ্তি।কলেজ স্ট্রিট হয়তো বদলেছে। কিন্তু নববর্ষের আড্ডার সেই চিরায়ত ট্রাডিশন আজও বদলায়নি।
আজও মাছে ভাতে বাঙালি নববর্ষে কিংবা হালখাতায় নিজের ঐতিহ্য খোঁজে। নস্টালজিয়ায় ডুব দেয়। তুলে আনে অতীতের হাজারো স্মৃতি।
শেয়ার করুন :