প্রেম
বসন্ত ঋতুর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক শুধু অধুনা জনপ্রিয় ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপনে নয় বরং বেশ প্রাচীন।গ্রিক পুরাণে প্রেমের দেবতা কিউপিডের মতন আমাদের পুরাণ অনুযায়ী প্রেমের দেবতা কামদেবের বৈশিষ্ট কোকিল,মলয় বাতাস আর বসন্ত ঋতু।এই বসন্তের বাতাসে ফাগুনের হাওয়ায় এমন কিছু আছে যাতে মনটা প্রেম প্রেম করে ওঠে যেমন রবীন্দ্রনাথের গানে,’ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান,আমার আপনহারা প্রাণ,আমার বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ।’বৈষ্ণব মতে কোনো এক ফাল্গুনী পূর্ণিমায় প্রেমিক কৃষ্ণ রাধা আর গোপীদের সঙ্গে দোল খেলেছিলেন। রাধা-কৃষ্ণ,লায়লা-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট, দেবদাস-পার্বতী,অমিত-লাবণ্য,পৃথু-কুর্চি, অনিমেষ -মাধবীলতা প্রেমকে অমরত্ব দিয়েছে।পাতাঝরা শীতের বেলায় যেমন গাছের সব পাতা ঝরে গিয়ে প্রকৃতি রুক্ষ শুস্ক হয়ে ওঠে আর বসন্তে আবার ফুলে ফলে সবুজ পাতায় পূর্ণ হয়ে ওঠে সেরকমই আমাদের জীবনে যখন হতাশা, দুঃখে শুকিয়ে ওঠে তখন তাকে ভালোবাসায় প্রেমে পরিপূর্ণ করে তোলে এই বসন্তকাল তাইতো বিশ্বকবি লিখেছেন,’মধুর বসন্ত এসেছে,মধুর মিলন ঘটাতে।‘
বিরহ ,একাকীত্ব
কিন্তু বসন্তে কি শুধু প্রেম একা আসে? না সঙ্গে করে আনে বিরহ আর একাকীত্বও? এই বসন্তে প্রেমের মরশুমে বিশেষত গণমাধ্যমে প্রেমের সাড়ম্বর উদযাপনে.কোকিলের কুহুতানে কি মনে পড়েনা পুরোনো কোনো বিরহ ব্যাথার কথা ? আর যারা একা ?এই সময় তাদের একা থাকার যন্ত্রণা চারিদিকে এত প্রেমের সোচ্চার উল্লাসে বেড়ে ওঠে না ? যে প্রেম ছিল কিন্তু এখন আর নেই,প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে গানে,’যে আলো হয়ে এসেছিল কাছে মোর তারে আজ আলেয়া যে মনে হয়’এমন।আর এই সময়ে যে একা ,জীবনে প্রেমে পড়েনি এমন মানুষ যেমন পাওয়া অসম্ভব তেমনই সব প্রেম তো পরিপূর্ণতা পায় না সেই জয় গোস্বামীর বেণীমাধব কবিতার সেই দোকানে কাজ করা মেয়েটির মতন যার জীবনে মোহনবাঁশি তমাল তরুমূলে বাজলেও কুঞ্জে অলি গুঞ্জে তবু, ফুটেছে মঞ্জরী’ প্রেম পূর্ণতা পায়নি সেই হাহাকার আর আত্মগ্লানির কথা মনে পড়ে যায় যা এই সময়ে চারিদিকে ‘প্রেমের জোয়ারে’ আরও অসহ্য হয়ে ওঠে।আর যার জীবনে প্রেম আসেনি।যে কাউকে মুখ ফুটে আমি তোমায় ভালোবাসি বলে উঠতে পারেনি।একবুক প্রেম নিয়ে যে আজও অপেক্ষায়।
হৃদয় দিয়ে হৃদি
না বলা প্রেম।শুধু দুজনে জানে কিন্তু প্রকাশ করেনি।ঠিক পুরোপুরি প্লেটোনিক নয় কারণ কেউ কোনোভাবে কাউকে প্রেম নিবেদন করেনি।।ছোটোবেলার খেলার সাথী,কোচিং সেন্টারে, কলেজে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দলবেঁধে, অফিসে,কাজের জায়গায় শুধু দুজনে দেখা হলে পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘যে টেলিফোন আসার কথা’ কবিতার ’অপেক্ষামান বুকের ভিতর কাঁসর ঘন্টা শাঁখের উলু /একশ বনের বাতাস এসে একটা গাছে হুলুস্থূলু’ হয়ে মনপ্রাণ চনমন করে ওঠে আর সে জানে এই আকুলতা তাই তাতে প্রশ্রয় অথবা তারও তাকে ভালোলাগে বা হয়তো ভালোবাসে।যে কোনো আড্ডায় তাকে একটু বেশি মনোযোগ,ঠিক করে বাড়ি ফিরল কিনা খোঁজ নেওয়া,তার বিভিন্ন ভালোলাগার প্রতি যত্নশীল এমন।কোন ভ্যালেন্টাইন্স ডেতে কেউ কাউকে উইশ না করলেও সেই না বলা প্রেমের বর্ণিল বিভা, মার্জিত মাধুর্য অম্লান থেকে যায়।হিন্দিতে একটি কথা আছে ,’ইস রিশতে কা কোই নাম মত দো’, সেই রিশতা,সেই সম্পর্ক যা শুধু দুজনের ‘কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব‘করে।
যুগে যুগে আবহমান কাল ধরে বসন্ত আর প্রেম মিলেমিশে একাকার।প্রেম প্রকাশের ভঙ্গি সেই কবেকার রোজ বিকেলে শুধু চোরা চোখে তাকানো,বন্ধুর হাতে প্রেমপত্র,লুকিয়ে দেখা করা পেরিয়ে আজকের সোচ্চার অকুণ্ঠিত প্রেমের প্রকাশ আর গণমাধ্যমে ,ফেসবুক স্ট্যাটাসে বাধাহীন উদযাপনে এই বসন্ত উৎসব বাঙালির ভালোবাসার দিন হয়ে ‘আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা/কারা যে ডাকিল পিছে! বসন্ত এসে গেছে’।
শেয়ার করুন :