সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের উদ্যোগে মহা সমারোহে নন্দন রবীন্দ্রাসদন চত্বরে ১১ থেকে ১৫ই জানুয়ারি আয়োজিত হল লিটল ম্যাগাজিন মেলা। এবারের মেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন ৩৫০ র বেশি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনা এবং ১০০ জন লেখক ও ৪০০ জন কবি।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়,সোমেন চন্দের মতন প্রখ্যাত ১৩জন কবির নামে এবং লিটল ম্যাগাজিন স্মারক সন্মান পুরস্কার পেলেন নবীন কবিরা এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপনে একটি স্মরণ সংখ্যা ও ওনার জীবন ও কাজের প্রদর্শনী এই মেলায় বড় পাওনা।
প্রত্যেকদিনের ভিড়,স্টলে স্টলে গিয়ে বই পড়া ,বই প্রকাশ আর প্রত্যেকদিনের সাহিত্য বাসর অনুষ্ঠানে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতন যা লিটল ম্যাগাজিনের গরিমা,ঐতিহ্যের আবহমানতা ও জনপ্রিয়তার প্রত্যয়।
শেষদিনে বিশিষ্ট কবি,অধ্যাপক ও পশ্চিমবঙ্গ স্কুল এডুকেশন সিলেবাস কমিটির চেয়ারম্যান শ্রী অভীক মজুমদারের সঞ্চালনায় এক মনোজ্ঞ কবিতা পাঠের আসরে নিজেদের মনকাড়া কবিতা পড়লেন প্রখ্যাত কবি শ্রী রঞ্জিত সিংহ,শ্রী গৌর শঙ্কর বন্দোপাধ্যায়,শ্রী অমিতাভ গুপ্ত,বাংলাদেশের কবি সৈয়দ হাসমত জালাল,শ্রীমতি চৈতালি চট্টোপাধ্যায়,নবীন চিত্রনাট্য লেখক ও কবি সম্রাজ্ঞী বন্দোপাধ্যায় এবং উত্তরবঙ্গের কবি শ্রী বিজয় দে।
এদের মর্মস্পর্শী কবিতায় সেই মেয়েটির কথা আছে যে প্রাইমারি পাস করার আগেই ছলনার কারণে গণিকালয়ে এসে ওঠে আর যার মারণ অসুখ কিন্তু তার নিজের কথায় সে যমের অরুচি বলে মরতেও পারছে না। নির্দিষ্ট করে এই আপনাকে বলছি বলে অমোঘ বাক্যবানের কবিতা,মুঠোয় পতাকা চেপে ধরলে তার থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ে এমন কবিতায় চুপ করে বিমূঢ় হতে হয়। আর অবাক হতে হয় সে অর্থে অকিঞ্চিৎ প্রত্যেকটা কাজের জন্য একটা আলাদা দপ্তর আছে শুনে।
বাংলা ভাষায় আবহমান কাল ধরে লিটল ম্যাগাজিন অকল্পনীয় দৃঢ়,সতেজ হার না মানা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে চলেছে এবং প্রায় অধিকাংশ খ্যাতনামা প্রসিদ্ধ কবির আতুঁড়ঘর।এই অজস্র ক্ষুদ্র প্রকাশনা সংস্থা সুদীর্ঘকাল ধরে খনি থেকে তুলে আনা দুষ্প্রাপ্য দুর্মূল্য হিরে পান্নার মতন কবিতা প্রকাশ করে চলেছে ।
লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস নিয়ে দুকথা। বাংলা ভাষায় প্রথম দিকের পত্রিকায় সংবাদ,ধর্ম সংস্কার,জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি ছিল মূল বিষয়।সেই বিচারে কবি ঈশ্বর গুপ্তের সংবাদ প্রভাকরে (১৮৫৩ ) প্রথম লিটল ম্যাগাজিনের লক্ষণ দেখা যায় যা সেই সময়ের প্রথম সাহিত্য পত্রিকা।এর পর দীনেশরঞ্জন দাশ এবং গোকুলচন্দ্র নাগ ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে একটি সাময়িক পত্র বের করেন, নাম দেন কল্লোল। ১৯২৪ এ প্রকাশিত হয় বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত সাময়িকী ‘শনিবারের চিঠি’ যার প্রাণপুরুষ শ্রী সজনীকান্ত দাস। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকাটির প্রারম্ভ সংখ্যাটি পুর্বাশা প্রেসের সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও সত্যপ্রসন্ন দত্ত বিনামূল্যে ছেপে দিয়েছিলেন। কবিতার প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালের ১ অক্টোবর। প্রথম সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র।সহকারী সম্পাদক ছিলেন সমর সেন।কিন্তু এগুলি সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে প্রসিদ্ধ।লিটল ম্যাগাজিনের প্রকৃত চরিত্র অর্থাৎ তার প্রতিবাদী স্বভাব যা একক স্বরের নয় একটি বিশেষ গোষ্ঠীর।বুদ্ধদেব বসু প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র (১৯৫৪) পত্রিকাকেই বাংলা ভাষার প্রথম লিটল ম্যাগাজিন বলেছেন।
লিটল ম্যাগাজিন মেলায় অনেক নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে।তার মধ্যে অন্যতম নবীন লেখিকা অনিন্দিতা পাত্রের প্রথম ছোটগল্পের সংকলন ‘উত্তরণ’। অনিন্দিতার জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা দক্ষিণ ২৪ পরগনার শিরাকোলে।লেখালেখি ছাত্রজীবন থেকেই।বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আর ফেসবুকে অ_ নিন্দিতা শিরোনামে তার স্বাদু ঝরঝরে লেখার পাঠক কম নয়।উত্তরণের ৮টি গল্পের প্রত্যেকটিতে নারীর সংগ্রাম আর বিজয়ের গল্প খুব সহজ এবং সজোরে বলেছেন।ঝিনুকের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার কাহিনী,মণিদীপার দিদির আত্মহত্যার পেছনে আসলে কে ?,দুর্গা পুজোর সময় আয়া সেন্টারের আল্পনা যে অল্পবয়সে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে হওয়ার পর স্বামীর ব্যাভিচার ,অত্যাচার পেরিয়ে মেয়ে অনন্যার স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ পড়তে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে এমন নারীদের উত্তরণের গল্প লিখেছেন অনিন্দিতা।রা প্রকাশন থেকে এই বই আসন্ন বইমেলাতেও পাওয়া যাবে।প্রথম প্রকাশেই সাড়া ফেলেছেন অনিন্দিতা।
লিটল ম্যাগাজিন দুনিয়ায় বোধশব্দ একটি মান্য প্রকাশনা সংস্থা।এদের উল্লেখযোগ্য কাজ শ্রী অজরচন্দ্র সরকারের বাঙ্গালা ভাষার হরফে টাইপ ও কেস ।এনারা দুটি অসামান্য সংগ্রহযোগ্য বুক মার্ক প্রকাশ করেছেন।বুকমার্কে বাংলা স্ল্যাং। বুকমার্কে বাংলা ড্রপ ক্যাপ।বানিয়েছেন শৈবাল মুখোপাধ্যায়। ছেপেছেন সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশেষ সহায়তা অরণ্য সেনগুপ্ত। বোধশব্দের প্রাণপুরুষ সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক,গবেষক ও বাংলা টাইপোগ্রাফি নিয়ে বিশেষ আগ্রহী শ্রী সুস্নাত চৌধুরী।
এই সময় যেখানে বাংলা ভাষাকে তার ঐতিহ্য,পরম্পরাকে সজীব রাখতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে ,এক বিশাল শ্রেণীর অশিক্ষিত বাঙালি অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বাংলা ভাষা বিমুখ করে তুলতে চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখছেন না তার বিপ্রতীপে এই লিটল ম্যাগাজিন মেলায় বিপুল জনসমাগম ,স্টলে স্টলে বই কেনার ভিড় ‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা’র প্রতি অনেক আশা জাগায়।
শেয়ার করুন :