এখন আশ্চর্য ও অবিশ্বাস্য মনে হলেও এমনটা ঘটেছিল। স্বয়ং স্বামী বিবেকান্দর ওপর দক্ষিনেশ্বর মন্দিরে ঢোকা নিষিদ্ধর ফরমান এসেছিল।
এর মতানৈক্যে দুটি কারণ ও সেই সময়ের ঘটনার কথা উল্লেখযোগ্য :
এটা মনে রাখতে হবে সেই সময়ের অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষের দিকে সমাজের রীতি নীতি ও গোঁড়ামি কঠোর ছিল। সেই সময় কেউ বিদেশ যাত্রা করলে তাকে ম্লেচ্ছ আখ্যা দেওয়া হত এবং অনেকসময় সমাজে একঘরে করে রাখা হত। দ্বিতীয়ত সেই সময় মন্দিরে অধিক সংখ্যায় নারী প্রবেশ কে ভালো নজরে দেখা হত না। কি ভয়ঙ্কর বৈপরীত্য ,যে মন্দিরে মায়ের মূর্তি পুজো সেই মন্দিরে মেয়েদের প্রবেশে কুন্ঠা ও বিরক্তি।
১৮৯৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথিতে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে দেহ ব্যবসায়ী যাদের সেই সময় ‘পতিতা’ বলা হত তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ায় সেবারে অনেক বেশি সংখ্যায় জমায়েত হয়েছিল।
পুরোনো কোলকাতার চিৎপুর রোডের উপর জোড়াসাঁকো পর্যন্ত লাল সালুতে লেখা বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল –” দক্ষিনেশ্বরের শ্রী রামকৃষ্ণ জন্মতিথি পালন মহোৎসবে স্ত্রীলোক মাত্রেরই যোগদান নিষিদ্ধ ।” শহরের অন্যান্য অঞ্চলেও একই নিষেধ ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। কেন এমন বিজ্ঞপ্তি? জানা যায়, ১৮৯৬ এর আগের বেশ কয়েক বছর উৎসব প্রাঙ্গণে পতিতাদের সমাগম দেখে বিভিন্ন মহলে কটুক্তি বর্ষণ হয়েছিল, তাই স্বামী ত্রিগুনাতীতানন্দ (সারদা মহারাজ ) কয়েকজন সেবককে নিয়ে এই বিজ্ঞপ্তির ব্যবস্থা করেন।
কিন্তু সেই বিজ্ঞপ্তি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বিপুল সংখ্যায় ‘নানা শ্রেণীর মহিলা’ মন্দিরের মূল ফটকের কাছে এলে ত্রিগুনাতীতানন্দ স্বামী মন্দিরের প্রধান ফটক বন্ধ করার নির্দেশ দিলে জলপথে বিশাল সংখ্যক মহিলারা এসে মন্দির চত্বরে ঢুকে পড়েন, এরপর গিরিশ চন্দ্র ঘোষের অনুরোধে প্রধান ফটক খুলে দিলে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত বিপুল জলস্রোতের মত মহিলারা আসতে থাকেন।
প্রত্যক্ষদর্শী স্বামী অখন্ডানন্দ তাঁর ‘স্মৃতি কথা’ তে লিখেছেন -“অনেকেই বলিল, বাধা দেওয়ার ফলে এ বৎসর স্ত্রীলোকের সংখ্যা খুব বেশী হইয়াছে “!
এই বিশাল সংখ্যক ‘কলঙ্কিত’ মহিলাদের মন্দিরের উপস্থিতি বিব্রত রক্ষণশীল সমাজের প্রতিনিধি রামদয়াল মুখোপাধ্যায় সেই সময়ে বিদেশে থাকা স্বামী বিবেকানন্দকে অভিযোগ করে চিঠি লেখেন এবং আশা করেন যে এর বিরুদ্ধে বিবেকানন্দ কিছু বললে সেটা সবচেয়ে কার্যকর হবে।
কিন্তু তাদের আশায় জল ঢেলে বিদেশ থেকে বিবেকানন্দ সুদূর লেক লুসার্ন, সুইজারল্যান্ড থেকে ২৩ শে অগস্ট ১৮৯৬ শশী মহারাজ (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ ) কে লেখা চিঠিতে স্বামীজি রামদয়ালের অভিযোগ এর উত্তর দিলেন
– ‘বেশ্যারা যদি দক্ষিনেশ্বরের মহাতীর্থে যাইতে না পায় কোথায় যাইবে? পাপীদের জন্য প্রভুর বিশেষ প্রকাশ,পুণ্যবানের জন্য তত নহে।’ আরও লিখেছিলেন, ‘যাহারা ঠাকুরঘরে গিয়াও ওই বেশ্যা,ঐ নীচ জাতী, ঐ গরিব, ঐ ছোটলোক ভাবে তাহাদের (অর্থাৎ যাহাদের তোমরা ভদ্রলোক বলো )সংখ্যা যত কম হয় ততই মঙ্গল।’
আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল আর তখনকার রক্ষণশীল সমাজ আর মন্দির কতৃপক্ষ সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন। সুযোগ এসেও গেল।
২১ শে মার্চ ১৮৯৭ সালে স্বামী বিবেকানন্দ খেতরির মহারাজা আরও কিছু সাধু ভক্তদের সঙ্গে মন্দিরে সেবায়েতকে জানিয়ে প্রবেশ ও ভ্রমণ করেন। ঠিক তার পরদিন সেবাইত ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস পত্রিকার মারফত জানান – ‘বিদেশ প্রত্যাগত স্বামী বিবেকানন্দর দক্ষিনেশ্বর মন্দিরে প্রবেশ অনভিপ্রেত ছিল ও এখন থেকে নিষিদ্ধ হল।’
শৈলেন্দ্রনাথ ধরের স্বামী বিবেকানন্দের আত্মজীবনী থেকে জানা যাচ্ছে পরের দিন বঙ্গবাসী পত্রিকায় মন্দিরের কতৃপক্ষ বাবু ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস বলেন ‘ আমরা কাউকে আমন্ত্রণ করিনি আর স্বামী বিবেকানন্দকে গতকালই মন্দির ভ্রমণের সময় অনুরোধ করে চলে যেতে বলা হয়েছিল কারণ আমি এমন কোনও মানুষের সংস্পর্শে আসতে চাইনা যে ম্লেচ্ছ, বিদেশ ভ্রমণ করেছে তও নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দেয়।’
এই ঘটনায় আমরা সেই সময়ের সমাজব্যবস্থার দুটি ছবি দেখতে পাই। প্রথমত তখন মেয়েদের বিশেষ করে দেহ ব্যবসায়ীদের সমাজ কি চোখে দেখত এবং তৎকালীন গোঁড়া সমাজের কঠোর সামাজিক রীতিনীতি যার রোষানল থেকে স্বয়ং বিবেকান্দও ছাড় পান নি।
আর একটি আশ্চর্য ও পরিতাপের বিষয় হল স্বামী বিবেকানন্দকে সেই সময় শুধু গোঁড়া,রক্ষণশীল হিন্দুদের বিরোধিতা সহ্য করতে হয়নি,ক্রিস্টান মিশনারিদের এবং ব্রাহ্ম সমাজের প্রতাপ চন্দ্র মজুমদারের কাছ থেকেও প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল এবং এই দুই আপাত বিরোধী গোষ্ঠী এক্ষেত্রে একসুরে ওনার বিরোধিতা করেছিলেন।
তথ্যসূত্র: এ কম্প্রিহেন্সিভ বায়োগ্রাফি অফ স্বামী বিবেকানন্দ-শৈলেন্দ্রনাথ ধর।রেডিট ডট কম।
শেয়ার করুন :