সুমন্ত্র মুখোপাধ্যায়
– ‘বিচিত্রগুপ্ত, বিচিত্রগুপ্ত’…
– ‘আজ্ঞে মহারাজ’
– ‘বলি এ সব হচ্ছেটা কী’ ?
– ‘আজ্ঞে আপনি বিচলিত হবেন না। আপনার আবার বায়ুচাপ বেড়ে যাবে। আপনি অনেকদিন পর রাজসভায় এসেছেন। একটু ঠান্ডা হন, জলটল খান। আপনাকে
আমি সব বলব।’
-‘রাজসভার সামনে ওঁরা কারা ? গিজগিজ করে শুধু মাথা। রাজসভায় ঢুকতে যাব, বলে কিনা ও মশাই লাইনে আসুন। আমারই রাজসভা আর আমাকে বলছে লাইনে
আসুন। নিজের পরিচয় দিলে বলছে, ও রকম মনে হয়। ওঁরা কারা বিচিত্রগুপ্ত’ !
– ‘ওঁরা মানুষ মহারাজ। সবাই মর্ত্য থেকে এসেছেন। ও আপনি চিন্তা করবেন না। আপনি একটু ঠান্ডা হন, আমি সব বলছি।’
পেটের ব্যামো। উচ্চ রক্তচাপ সারিয়ে প্রায় চার মাস পর যমালয়ে ফিরেছেন যমরাজ। আর এসেই দেখছেন যমপুরীর ভূগোলই বদলে গিয়েছে। রাজসভার ঢোকার
আগে কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। এখনও তাঁর কাছে সব কিছু ধোঁয়াশা।
– ‘বিচিত্রগুপ্ত, আর আমার রক্তচাপ বাড়িয়ে দিও না। আমি আর এই চাপ নিতে পারছি না। দয়া করে এবার ঝেড়ে কাশও তো, যমপুরীতে এত মানুষের ভিড় কেন ?
মর্তে কী জায়গা কম পড়েছে’ ?
– ‘আজ্ঞে মহামারি মহারাজ।’
– ‘বলো কী হে, সে তো শতাব্দী আগে একবার হয়েছিল, এত বড় একটা ঘটনা, আর আমাদের কাছে কোনও খবরই নেই’ !
– ‘আজ্ঞে ছিল মহারাজ। কিন্তু আমার কথার কেউ গুরুত্ব দেয়নি। গত শীতে আমার এক চৈনিক দূত প্রথম খবরটা পাঠিয়েছিল। সতর্ক করে বলেছিল, আর
কয়েকদিনের মধ্যে পৃথিবী প্রায় খালি হয়ে যাবে। খবর পাওয়া মাত্র, আমি আমার উপর মহলে জানাই। প্রতিশ্রুতি মেলে, আপনার কানে তুলে দেওয়া হবে….’
– ‘ডাকো তোমার উপর মহলকে। দেখাচ্ছি মজা। আমার কানে তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আমি বার করছি। কোথায় চিত্রগুপ্ত’ ?
– ‘আজ্ঞে উনি বেগতিক দেখে আপনার পরে পরেই ছুটিতে চলে গিয়েছেন’।
– ‘তার মানে গত চার মাস তুমি একা দায়িত্ব সামলাচ্ছো’ ?
– ‘হ্যাঁ মহারাজ। আমি আর আমাদের ছশো কোটি দূত। তাতেও পরিস্থিতি হাতের বাইরে। খাগের কলম, দোয়াতের কালি, খাতার পাতা সব শেষ মহারাজ। আপনার অনুপ্রেরণায় ছেলে-মেয়েগুলো রাতদিন এক করে দিচ্ছে। ওদের আর আলাদা করে মর্তে যেতে হচ্ছে না। ওরা যাওয়ার আগেই সবাই উপরে চলে আসছে।আর সামলানো যাচ্ছে না। আর কিছুদিন চললে আমরা সঙ্কটে পড়ে যাব মহারাজ। যমালয় নিঃস্ব হয়ে যাবে। রোজই পৃথিবী থেকে লাখো লাখো নারী-পুরুষ জড়ো হচ্ছে যমালয়ের সামনে। বুঝতেই পারছি না, কে মহামারির শিকার, আর কে এমনি আয়ু শেষ করে এখানে এসেছে। আমাদের খাতাও ফেল। যাঁর আসার কথা পঁচাত্তর বছর পরে, তিনি এসে গিয়েছেন দশ বছরের মধ্যেই।আর যাঁর আসার কথা ছিল তিরিশ বছরের মধ্যে, তিনি এলেন ষাট পেরিয়ে। হিসেব সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে মহারাজ।’
– ‘বটে’, গম্ভীর মুখে উত্তর দিলেন যমরাজ। ‘তা আমাকে একটা খবর দেবে তো’! বেশ উতলা মনে হল তাঁকে।
– ‘আজ্ঞে নারদকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলাম মহারাজ। বলেছিলাম খুব দরকার, মহারাজকে আসতে হবে না, কিন্তু কী করা যায়, যেন একটু বলে পাঠান। কী করে
জানব মহারাজ, আপনি একেবারেই অন্ধকারে’।
– ‘ওটা আর একটা আহাম্মক। এর কথা ওকে, ওর কথা তাকে লাগাতে ওস্তাদ। সারাদিনে কাজের কাজ কিস্যু করে না। খালি পিরিং পিরিং।’ এরমধ্যেই যমালয়ে ঢুকল নারদ।
– ‘এই যে নারদ। তোমায় বিচিত্র গুপ্ত বলেছিল, আমাকে একটা খবর দিতে, তা তুমি দাওনি কেন’ ? নারদকে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন যম।
– ‘আজ্ঞে মহারাজ, আমি তো বিচিত্র গুপ্তের বার্তা নিয়ে আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু পথে কয়েকজন মর্তের বাসিন্দার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাঁদের মধ্যে বেশ
কয়েকজন যুবতী অপরূপাও ছিলেন। আমাকে চিনতে পেরে ওমনি আমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলে। আমি বললাম, ছাড়ুন আমার কাজ আছে। তাঁরা বললে, না, না,একবার যখন আপনাকে পেয়েছি, স্বর্গের সব খবর নিয়েই ছাড়ব। সব কথার পর একটা যন্ত্র বার করলে। সোজা করে ধরতে আয়নায় আমার ছবি দেখতে পেলাম। কীযেন একটা টিপতেই খচ করে শব্দ হল। একজন বলল, যাই পোস্ট করে দিই। নারদের সঙ্গে সেলফি, এবার যমের সঙ্গে তুলব’।
– ‘আঃ, তুমি আর গোল পাকিয়ো না। একে সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিলাম চার মাস পর রাজসভায় ফিরছি, একটু অন্যরকম স্বাগতম পাব। কিন্তু ঘেন্না ধরে গেল
জীবনে।’ বেশ বিরক্তির সুরেই নারদকে বললেন যমরাজ। ‘তা বল, তোমার এখানে কাজ কী ? যা বলবে জলদি বল, দেখতেই পাচ্ছো বাইরের ছবিটা। আমাদের আর
বিরক্ত কর না। কবে যে আবার বাড়ি ফিরতে পারব।’
– ‘আজ্ঞে তিন মাথা এক হয়েছেন। আপনার উপর মহলেও যমালয়ের খবর গিয়েছে। আপনাকে জরুরি তলব করেছে, তাই আমি আপনাকে ডাকতে এসেছি।’
– ‘হতভাগা, আগে বলবে তো এ কথা। ওরে বাবা, একে মহামারিতে পিলে চমকে উঠছে। তার উপর চাকরি নিয়ে টানাটানি। একশো বছর আগে সামলে দিয়েছিলাম।
এবার ডাহা ফেল। চল নারদ, আর দেরি কর না। হাতে আর সময় নেই। তোমার ঢেঁকিতে পিছনটা ঠেকিয়ে চলে যাব।’
– ‘মহারাজ’। পিছু ডাকলেন বিচিত্র গুপ্ত।
– ‘আঃ, পিছু ডেকে না বিচিত্র গুপ্ত। দেখছ, চাকরি নিয়ে টানাটানি। তুমি আবার এর মধ্যে পিছু ডাকছ, কী হল কী তোমার’ ?
– ‘আজ্ঞ আমার প্রোমোশন’। কাতর সুরে বললেন বিচিত্র গুপ্ত।
– ‘শোন বিচিত্র গুপ্ত, গত দেড় কোটি বছরেও যখন তোমার কোনও কিছুই হয়নি, এবারও হবে না। আগে আমি চাকরি বাঁচাই, তারপর তোমার বেতন বৃদ্ধি নিয়ে ভাবব’। এই বলে নারদের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন যমরাজ।
এরমধ্যে বিচিত্র গুপ্তের কাছে জাবদা খাতা নিয়ে হাজির দুই দূত। ‘স্যর আবার হিসেব মিলছে না, কী করব’ ?
– ‘কী করবে, ওই জাবদা খাতা আমার মাথার উপর বসিয়ে দাও। প্রাণটা বেরিয়ে গেলে যমালয় থেকে ছুঁড়ে আমাকে ফেলে দেবে। সারাদিন রক্ত তুলে খাটব আমরা,
আর চাকরি বাঁচানোর নামে ক্ষীর খাবেন বাবুরা।’ বিচিত্র গুপ্তর এই বিরক্তির মধ্যে থেকে ভেসে এল ক্ষোভের গর্জন।
– ‘এই যমরাজ আর না, আর না…’
২
ইন্দ্রলোকের পরিবেশ আজ বেশ থমথমে। পাশাপাশি বসে আছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করছেন। যমরাজ থেকে দেখেই মহাদেব বললেন, ‘ওই যে ঢ্যাড়সটা এলেন। তোমার কী কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই হে, এই পরিস্থিতিতে বাচ্ছা ওই বিচিত্রগুপ্তর হাতে একা যমালয় ছেড়ে ছুটিতে চলে গেলে। আর কই তোমার আর এক সাকরেদ, ওই ব্যাটাকে পেলে তো আমি গর্দান নেব।’ হাওয়া বেশ খারাপ, মহাদেবের বিমারেই বুঝে গেলেন যমরাজ। আড় চোখে দেখলেন মিটি মিটি হাসছে নারদ। মনে মনে বললেন, ‘আচ্ছা আমায় কেস খাইয়ে এখনও হাসা হচ্ছে। দিন আমারও আসবে।’
– ‘আজ্ঞে, চৈনিক দূতের বার্তা পেয়েই আমরা সতর্ক ছিলাম, আমার সতর্ক ছিলাম বলেই এখনও স্বর্গ ও পাতালের মধ্যে ভারসাম্য রাখা গিয়েছে’। মহাদেবের প্রশ্নের উত্তর দিলেন যমরাজ।
– ‘রাখ তোমার ভারসাম্যের জ্ঞান। সেই ছিড়ি তো আমি দেখতেই পাচ্ছি। আজ যমালয়ে দেওয়ালে তোমার নামে পোস্টার পড়েছে। তাতে লেখা মিসিং যমরাজ। কাল,পরশু আমাদের নামে পড়বে। কী ভেবেছ তুমি, এই বয়সে আমাদের পথে বসাবে।’ প্রায় তোপ দাগলেন দেবরাজ। ‘এই তো সেদিন ইন্দ্রকাননের বেঞ্চিতে বসে একটু হাওয়া খাচ্ছিলাম। প্রাক্তন এক রাজনেতার সঙ্গে দেখা হল। তিনি বললেন, এ কী মশাই আপনাদের মধ্যেও সমন্বয়ের অভাব। এই সমন্বয়ের অভাবে জন্য আমার রাজ্যে তো সরকারই উলটে গিয়েছিল। যদিও আমি ছিলাম না। আমি যাঁকে উত্তরসূরি করে দিয়েছিলাম, সে তখন দায়িত্বে ছিল। এক ডাকসাইটে মহিলা নেত্রী বললেন, আমি হলে এখুনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দিতাম।’
যমরাজ বুঝলেন, হাওয়া তাঁর উলটো দিকে বইছে। তা-ও এখনও বুড়ো ব্রহ্মা মুখ খোলেননি। ‘আমি কী করব’, সবার কাছেই জানতে চাইলেন যমরাজ।
– ‘কী আবার করবে, মাথা হেঁট করে সবার কাছে ক্ষমা চাইবে। আর যা সত্যি, তাই বলবে’। বেশ বিরক্তি নিয়ে কথাগুলি বললেন বিষ্ণু।
-‘আচ্ছা একবার উমার সঙ্গে পরামর্শ করলে হয় না’। এইবার একটা আলতো গুগলি ব্রহ্মার। ‘বলছিলাম উমা তো বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা, যদি ও কিছু একটা করে’।
– ‘শুনুন, আমি কিন্তু বলতে পারব না’। আগেই হাত তুলে দিলেন মহেশ্বর। কারণ, এবার নাকি বাজার খারাপ। তাই গিন্নির মেজাজ বেশ খিঁচড়ে আছে।
– ‘তা-হলে কে বলবে’ ? প্রশ্ন করলেন দেবরাজ।
– ‘দায় যখন তোমার, তখন তুমিই কথা বলবে।’ ব্রহ্মার কথায় পা কেঁপে গেল যমরাজের। মনে হল, এর থেকে তাঁর মহামরিতে মৃত্যু হলে ভাল হত।
– ‘আজ্ঞে আমি’। জিজ্ঞেস করলেন যমরাজ।
– ‘হ্যাঁ তুমি’। সমস্বরে উত্তর।
৩
– ‘দিদি আসব’।
– সবে ভাতটা চাপিয়ে, ধামা থেকে কয়েকটা সবজি বার করেছিলেন। একটা ক্ষীণ গলা শুনে, বঁটিতে কুটনো কাটতে কাটতে দরজার দিকে থাকালেন দুর্গা। দেখলেন বেশ গো-বেচারের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে যমরাজ।
– ‘কী ভাই, বিপদে পড়ে অবশেষে দিদির কথা মনে পড়েছে’ ?
দুর্গার প্রশ্নে যমরাজ বুঝতে পারলেন, মহামারি পরিস্থিতিতে তাঁর ব্যর্থতার কথা আর কোথাও গোপন নেই। বরং তিনি আজ সবার কাছেই খিল্লির পাত্র। ‘না মানে,আপনি তো সবই জানেন, যদি এই বারটি আমাকে বাঁচিয়ে দেন, আমি কথা দিচ্ছি, আমি চির কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব।’
দুর্গাও বুঝতে পারলেন যম তাঁকে তেল মারছেন। ‘পরিস্থিতি কঠিন, তা বুঝতে পারছি। কিন্তু এটাও ঠিক অমন দুধের শিশু বিচিত্রগুপ্তর হাতে যমালয়ের দায়িত্ব দিয়ে ছুটিতে চলে যাওয়া সিদ্ধান্ত হিমালয়ের মতো ভুল’। ফোড়ন কাটলেন লক্ষ্মী।
– বিচিত্রগুপ্ত ‘দুধের শিশু’। অবাক হলেন যমরাজ। সাড়ে তেরশো কোটি বছর চাকরির পর এখনও বিচিত্রগুপ্ত যদি দুধের শিশু হোন, তা-হলে তিনি কী ? যাই হোক,নিজের দোষ স্বীকার করে সোজার দুর্গার পায়েই ড্রাইভ মারলেন যমরাজ। বললেন, ‘এর কিছু একটা বিহিত করুন। না-হলে আর গদি থাকবে না।’
– ‘একটু চা করি।’ খুব ঠান্ডা গলায় যমরাজকে জিজ্ঞেস করলেন দুর্গা। ‘আগে তো পাঁচদিনেই সব আনন্দ হত। এখন তো দশদিনেও মর্তবাসী আমাদের ছাড়তে চায়না। তারপর শুনছি, সেখানে নাকি সবাই এখন মুখোশ পড়ে বাইরে বেরচ্ছে। আমার তো চিন্তা হচ্ছে গণশাকে নিয়ে। বেচারা শুড়ের মধ্যে মুখোশ পড়বে কী ভাবে ?
বিশ্বকর্মাকে বলেছি, ওর জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করতে। আবার শুনছি, একটা শাড়ির দোকান নাকি বলেছে, এবার তারা শাড়ির সঙ্গে রং মিলিয়ে মুখোশও তৈরি করবে। সর তো বলছে, মা এবার গিয়ে ওই দোকানে একবার যাব।’
দুর্গার কথা শুনে যমরাজও বুঝতে পারলেন মর্তের সব খবর তাঁর দিদির কাছে আছে। ‘তবুও আপনিই সহায়’।
– ‘এবার তো নাকি আমাদের দেখতে একসঙ্গে কুড়ি জনের বেশি আসতে পারবে না। তা ভাল, কম লোক পরিবেশটাও হালকা থাকবে। না-হলে বড় অস্বস্তি হয়।
তোমার তো মনে আছে কয়েক বছর আগে আমার এমন বিশাল আকৃতি করেছিল, সবাই তো আমাকে জেঠিমা বলে ডাকতে শুরু করেছিল,’ চায়ের কাপ বাড়িয়ে যমরাজকে বললেন দুর্গা।
– ‘হ্যাঁ, এবার শুনছি থিম নেই। সবাই বলছে বাজেট কমিয়ে আমাদের জন্য মশারি খাটিয়ে দেবে। দেখ বছরে পাঁচটা দিনের জন্য মামার বাড়ি যাই। ওই মশারির মধ্যে ল্যাদ খাওয়া যায়।’ বাগানে তির প্র্যাকটিস করতে করতে বলল কার্তিক। এরমধ্যেই অসুরকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকল নন্দী আর ভৃঙ্গি।
– ‘মা আপনি আমায় ডেকেছেন’ ? প্রশ্ন করল অসুর।
– ‘হ্যাঁ তোমার এবার একটা কাজ আছে। সেই কবে এবার আমার সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরেছ, তারপর ফ্রি’তে মর্তে বেড়াতে যাও। এবার বাপু তোমায় আবার লড়াই করতে হবে। এই ক’দিন একটু বেশি করে কসরত কর। আর হ্যাঁ, যদি অতিরিক্ত অনুশীলনের প্রয়োজন হয় কেতোর সঙ্গে এসে যোগাযোগ করো। ও কী সব নতুন অস্ত্রের কথা বলছিল, আমার গুলো তো সব ভোঁতা হয়ে গিয়েছে।’ অসুরকে নির্দেশ দিলেন দুর্গা।
– ‘কিন্তু মা আমি লড়াইটা করব কার সঙ্গে। এত তো শুনছি ভয়ানক রোগ। দেখাই যায় না। শুধু ছুঁয়ে দিলেই সব শেষ। এতো অশরীরি।’ বেশ বিব্রত মনে হল অসুরকে। ‘না এর থেকে আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করা অনেক সহজ।’
– ‘ব্যাটা গবেট। লড়াই করবি কেন, ঝাপটে ধরবি।’ গণেশের কথায় সবাই হকচকিয়ে গেল। এতক্ষণ নিউটন, আইনস্টাইন আর কেসি নাগকে নিয়ে ক্লাস করাচ্ছিলেন।
আর চুপ করে শুনছিলেন বাকিদের কথা। ‘সব ক্রিয়ার একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। এই যে দেখছ আমার ছাত্র নিউটন, এটা ওঁরই আবিষ্কার। আর তোমার তো দানবীয় শক্তি হে’। অসুরের দিকে তাকিয়ে বললেন সিদ্ধিদাতা। ‘সব জায়গায় নিজের শক্তির প্রচার করছ, আর একটা রোগের নাম শুনেই দে ছুট। এই কারণে ব্যাটা তুই সব সময় পিছিয়ে।’
– মাথা চুলকে একবার যমরাজের দিকে তাকালে অসুর। ‘এই যে মশাই, আপনি যত নষ্টের গোড়া। আপনি ছুটিতে গিয়ে এত কাণ্ড ঘটালেন। আপনি আর বজ্জাত বুড়ো চিত্রগুপ্ত মিলে এই ষড়যন্ত্র করেছেন। একবার ফিরে আসি, দেখুন এবার যমালয় আক্রমণ করব। তখন ঠেলা সামলাবেন। কিন্তু এখন আমি কী করব মা’ ?
– ‘তুমি এবার নীলকণ্ঠ হবে’ ? উত্তর দিলেন দুর্গা।
– ‘কিন্তু এর পেটেন্ট তো মহাদেবের কাছে, তা উনি কী আমায় তাঁর ভাগ দেবেন’। বেশ সংশয় নিয়ে জানতে চাইল অসুর।
– ‘তুমি চাপ নিও না। বাপিকে ঠিক আমরা ম্যানেজ করে নেব’। কথা দিলেন সরস্বতী।
এরমধ্যেই দরজা ঠেলে উঠোনে ঢুকলেন স্বর্গের ডাক্তার অশ্বিনী কুমার। সঙ্গে অনেক শিসিতে ভরা জল। ‘এই নিন মা, ধন্বন্তরী। যাঁরা আপনাদের দেখতে আসবেন,তাঁদের দিকে একবার ছিটিয়ে দেবেন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। যে যাই বলুক, আপনার হাতেই মোক্ষলাভ হবে। আপনি নিশ্চিন্তে বাপের বাড়ি যান। কিস্যু হবে না।’ অশ্বিনীর আশ্বাসে বুকে বল পেলেন স্বয়ং যমরাজও। সবার জন্য বিশেষ মুখোশ নিয়ে এবার হাজির বিশ্বকর্মাও। ‘গ্যারান্টি দিচ্ছি এই মুখোশ পড়লে কোনও জীবাণুই ছুঁতে পারবে না’।
– ‘হ্যাঁ টেস্ট রান তো তোমায় দিয়েই হবে’। ফুট কাটলেন কার্তিক। মেনকা, রম্ভা, উর্বশীরাও হাজির। পাঁচ দিনের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শুরু। গুমোট কাটল।একটা তুড়িও মেজাজ নিয়ে দুর্গার বাড়ি থেকে বেরলেন যমরাজ।
৪(বেশ কয়েকদিন পর)
এখনও পাত্তা নেই চিত্রগুপ্তের। ছুটি বাড়িয়েই চলেছেন। দিনরাত এক করে কলম পিষছেন বিচিত্রগুপ্ত। আর সিংহাসন ছেড়ে কাউন্টারে বসছেন যমরাজ। উলটো পালটা
প্রশ্নে মাঝে মধ্যেই তাঁর মেজাজ খিঁচরে যাচ্ছে। তবুও নিজেকে সামলে নিচ্ছেন। এতদিন তিনি পাবলিক হ্যান্ডেল করেননি। এবার তিনি বুঝছেন কত ধানে, কত চাল।
– ‘বিচিত্রগুপ্ত একটা বিষয় খেয়াল করছ কী’ ?
– ‘কি মহারাজ’ ?
– ‘এই ক’দিনে যমালয়ে ভিড়ের সংখ্যা কত কম। লাখ লাখ লোকের নাম আর লিখতে হচ্ছে না। বরং অনেক সময় পর দু’একজন আসছেন কাউন্টারের নাম লেখাতে।’
– ‘মহারাজ চোখ খুলন, কান পাতুন মর্তের দিকে। শুনতে পারছেন কিছু’।
– ‘হ্যাঁ সত্যিই তো, সেই ধুনোর গন্ধ। সেই শিউলির সুবাস। সেই সংগীতের সুর। বিচিত্রগুপ্ত আমরা সফল বিচিত্রগুপ্ত। আমার চাকরি এবারের মতো বেঁচে গেল। তোমার
এবার একটা জম্পেশ প্রমোশন হবে।’
– মা এবার কোভিডনাশিনী…. ‘বলো দুগ্গা মাইকী…. জয়….।’
,
শেয়ার করুন :