পুরাণ মতে ব্রহ্মার নির্দেশ অনুযায়ী পিতৃপুরুষরা এই ১৫ দিন মনুষ্যলোকের কাছে চলে আসেন। তাই এই সময় তাঁদের উদ্দেশ্যে কিছু র্অপণ করা হলে তা সহজেই তাদের কাছে পৌঁছয়। এই পক্ষকাল ধরে পিতৃ পুরুষদেব স্মরণে র্তপণ করা হয়। যার চূড়ান্ত প্রকাশ বা মহালগ্ন হল এই মহালয়া।সেই দিন থেকে কোজাগরী পূর্ণিমা পর্যন্ত ১৫ দিনই হল দেবীপক্ষ।মহালয়া শব্দরে র্অথ মহান+আলয় =মহালয়।সঙ্গে স্ত্রীকারাত্মক আ যুক্ত হয়ছে।আবার মহ শব্দের র্অথে পাই পুজা এবং উৎসব।মহালয়া একটি র্অথে দাঁড়ায় পুজা বা উৎসবের আলয়। অন্যদিকে, মহালয়া বলতে পিতৃলোককে বোঝায়।
হিন্দুমতে প্রকৃতির সন্তুষ্টি ব্যতীত কোনো শুভ কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হওয়া কঠিন বলে মনে করা হয়। মহালয়াতে যারা গঙ্গার জলে অঞ্জলি প্রদান করে থাকেন, তারা মূলত পৃথিবীর সকল সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেন ও তর্পণ প্রদান করেন।
তর্পণের উপকরণ হলো কূশ ও কালো তিল।ছয়টি কূশ প্রথমে জলে ভিজিয়ে রেখে সেটা নরম হলে একত্রে তিনটি কূশ নিয়ে অনামিকা আঙুলে আংটির মতো ধারণ করে তর্পণ করতে হয়। বাঁ আঙুলেও একইভাবে কূশাঙ্গরীয় ধারণ করা প্রয়োজন।
মার্কণ্ডেয় পুরাণ গ্রন্থে বলা হয়েছে, পিতৃগণ শ্রাদ্ধে তুষ্ট হলে স্বাস্থ্য,ধন,জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু এবং পরিশেষে উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন। পুরাতাত্ত্বিক উষা মেননের মতেও, পিতৃপক্ষ বংশের বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে।এই পক্ষে বংশের বর্তমান প্রজন্ম পূর্বপুরুষের নাম স্মরণ করে তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পিতৃপুরুষের ঋণ হিন্দুধর্মে পিতৃমাতৃঋণ অথবা গুরুঋণের সমান গুরুত্বপূর্ণ।
মহাভারতে বর্ণিত, কর্ণ মারা যাওয়ার পর স্বর্গে গেলে তাঁকে খাবার জন্য সোনা আর ধনরত্ন দেওয়া হলে সবিস্ময়ে কর্ণ প্রশ্ন করায় তাঁকে বলা হয়েছিল যেহেতু তিনি সারাজীবন সবাইকে ধনরত্ন দান করেছেন ,পিতৃপুরুষকে জল ও খাবার দেন নি তাই এই ব্যবস্থা, তাতে কর্ণ বলেন জীবিতাবস্থায় উনি তার পিতৃপুরুষ কে তাই জানতেন না। তখন দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশে ওনাকে ১৫ দিনের জন্য পৃথিবীতে পাঠানো হয় ,উনি ওনার পিতৃপুরুষকে জল ,খাবার দেন ,তাই এই পক্ষকে পিতৃপক্ষ বলা হয় ।
রেডিওতে মহালয়া:
অল ইন্ডিয়া রেডিওতে মহালয়া অনুষ্ঠানের শুরু সেই ১৯৩১ সালে /তৎকালীন প্রোগ্রাম ডিরেক্টর শ্রী নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার বাণী কুমার,রাইচাঁদ বড়াল,পঙ্কজ কুমার মল্লিক ও যোগেশ বসুকে দিয়ে শুরু করলেন ‘দূর্গা সপ্তষ্ঠী’ পরে যার নাম হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
মহালয়ার ভোর আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বঙ্গজীবনের অঙ্গ।কিন্তু এত বছর ধরে চলে আসা এই প্রায় কিংবদন্তি হয়ে ওঠা এই অনুষ্ঠানের পেছনে আরও দুজন অবিস্মরণীয় ব্যক্তি হলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বাণীকুমার।বাণীকুমারের আসল নাম শ্রী বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য্য। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিমার একটু আড়ালে চলে যাওয়া এই বাণীকুমারেরই রচনা ও পরিকল্পনা এই মহালয়া অনুষ্ঠানের।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাণীকুমারের আরাধ্য। কবিগুরুর বহু কবিতার নাট্যরূপ দান করেছেন তিনি । বাণীকুমারের সঙ্গে কবি নজরুলেরও হৃদ্যতা জন্মেছিল।,আকাশবানীর প্রায় গোড়া থেকে যুক্ত ছিলেন বাণীকুমার। তাঁর সৃজনশীলতা কেবলমাত্র বেতারের জন্য নাটক রচনা ও প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। তাঁর বহু প্রবন্ধ ও গল্প বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে।
এখনকার অনেকেরই হয়ত জানা নেই এবং জানলে আশ্চর্য হতে হয় যে সেই সময় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠের মহালয়ার কণ্ঠদান নিয়ে গোঁড়া ব্রাহ্মণদের কাছে থেকে সেকালে প্রবল ও তীব্র আপত্তি ছিল প্রথমত দেবীপক্ষের আগে এই অনুষ্ঠান সম্প্রচারের আর একজন অব্রাহ্মণের চন্ডীপাঠের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এই বাণীকুমার। কঠোর ভাবে বলেছিলেন ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণই করবেন গ্রন্থনা ও চণ্ডীপাঠ।‘ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তিনি। আর, তার পরেই তৈরি হল একটা ইতিহাস।
সঙ্গীত শিল্পীরা :
জয়ন্তী মঙ্গলা কালী: পঙ্কজ কুমার মল্লিক
বাজলো তোমার আলোর বেণু : সুপ্রীতি ঘোষ
অমল কিরণে :প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়
জাগো দুর্গা: দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়ার কথা ছিল)
শুভ্র শঙ্খ রবে: শ্যামল মিত্র,আরতি মুখোপাধ্যায়,অসীমা ভট্টাচার্য্য
বিমানে বিমানে আলোকের গানে:সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়
তব অচিন্ত: মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
শান্তি দিলে ভরি: উৎপলা সেন
হে চিন্ময়ী:তরুণ বন্দোপাধ্যায়
অখিল বিমানে তব জয়গানে:কৃষ্ণা দাসগুপ্ত
মাগো তব বিনে:সুমিত্রা সেন
ওগো আমার আগমনী: শিপ্রা বোস
নমো চন্ডী নমো চন্ডী: বিমল ভূষণ
রূপং দেহি জয়ং দেহি :ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য
১৯৭৬ সালে জরুরি অবস্থা কালে দিল্লীর এবং আকাশবাণীর কিছু কতৃপক্ষের ষড়যন্ত্রে প্রবাদপ্রতিম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও পঙ্কজ কুমার মল্লিককে সরিয়ে দেওয়ার কলকাঠি প্রক্রিয়ায় ঠিক হয় নতুন মহালয়া অনুষ্ঠানের।
‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র পরিবর্তে‘দুর্গতিহারিণী’৷ বিষয় ভাবনা স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন ধ্যানেশ নারায়ণ চক্রবর্তী। সুর করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।চমক বা ষ্টার ভ্যালুর জন্য মহানায়ক উত্তমকুমার, কিন্নরকন্ঠী লতা মঙ্গেশকর,বসন্ত চৌধুরী।স্তোত্র পাঠে তৎকালীন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের বিভাগীয় প্রধান ডঃ গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায় এবং সেই সময়কার নামী স্তোত্র গায়িকা মাধুরী মুখোপাধ্যায়।
এই অনুষ্ঠান শুধু সুপার ফ্লপই নয়,অনুষ্ঠান চলাকালীন দেবীদুর্গতিহারিণীম্’ সম্প্রচারের মধ্যপথেই টেলিফোনে শ্রোতাদের অবর্ণনীয় গালিগালাজ আসতে শুরু করে অকথ্য ভাষায়।আকাশবাণীর সামনে তীব্র বিক্ষোভ এবং ঢিল পাটকেল পড়ায় আপামর বাঙালির ক্ষোভ প্রশমনে সেই বছর মহাষষ্ঠীর সকালে আবার বাণীকুমার,পঙ্কজ কুমার মল্লিক,বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সম্প্রচারিত হলে সকলের ক্ষোভ প্রশমন হয় এবং স্বয়ং উত্তমকুমার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বাড়ি গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসেন।
আশ্চর্যের বিষয় হল এই ঘটনা নিয়ে তৈরী সৌমিক সেনের ছবি ‘মহালয়া’ও বিতর্কের ঊর্ধে নয়।ছবির গুণমান নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও বিতর্ক ছিল উত্তমকুমার আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রায়ন নিয়ে।অনেকের বক্তব্য আসল সেই ‘দুর্গাতিহারিণী’ অনুষ্ঠানে উত্তমকুমারের পাঠের অংশ ছিল ১০ মিনিট আর ছবিতে উত্তমকুমার আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে যুদ্ধের মাঠে লড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।তবে এটাও ঠিক যে ছবির ট্রেলার দেখেই যারা রে রে করে উঠেছিলেন তাদের অনেকেই ছবি দেখে তাদের মত পাল্টেছেন কিন্তু একটি বিষয়ে সকলে একমত যে শুভাশিস মুখোপাধ্যায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণের চরিত্রে অসাধারণ,অপূর্ব অভিনয় করেছিলেন।
শেয়ার করুন :